স্বামী আমার বড্ড ভালো, জানেন? এমন ভালো স্বামী আর কেউ পাবেনা কোনদিন। মদের নেশা নেই, সিগারেটের নেশা নেই, বাজে মেয়ের ধার ধারে না, প্রেম করেনি কোনদিন, চাকরি ভালো, বেতনও বেশ চড়া, দেখতে যেনো অপূর্ব সুন্দর! যেমন হাইট তেমনি ফিটনেস, বংশ পরিচয়েও বেশ এগিয়ে, চৌধুরী বংশ। এতো ভালো বর ক’টা মেয়ের কপালে জুটে বলুন? বিয়ের আগে তার বায়োডাটা দেখে সবার মতো আমিও পটে গেলাম, তারপর থেকেই সে আমার স্বামী।
বিয়ের মাত্র ষষ্ঠ দিন, আলমারি খুলে দেখি আমার বিয়ের গহনা একটিও নেই। বাসার কেউ কিছু বলতে পারে না। কথা হলো তার সাথে, আমাকে জানালো গহনাগুলো লকারে রেখেছে, ঘরে থাকলে শাশুড়ি মা যে কোন সময় নিয়ে নিবেন, মায়ের নাকি লোভ আছে। ছেলের মুখে মাকে নিয়ে বলা এমন কথায় একটু অবাকই হয়েছিলাম।
বিয়ের পর প্রথম অফিস যাচ্ছি শ্বশুরবাড়ি থেকে। ও নিজেই পৌঁছে দিলো অফিসে। কি রোমান্টিক স্বামী আমার! অফিস যেতে যেতে অনেক কথা হচ্ছিলো, এই ধরুন আমার বেতন কবে হয়? বেতনের টাকা নিয়ে আমার প্লান কি? এতোদিন কিভাবে চলেছি? এখন কিভাবে চলবো? তার আয় কতো, ব্যয় কতো সব হিসাব হচ্ছিলো। কি সুন্দর করে যাত্রাপথে কথা বলতে বলতে সমাধান হলো, “এটা আমাদের সংসার, আয় ব্যয় দুটোই আমাদের।” তবে সতর্ক করেছিলো মা’কে নিয়ে। মায়ের থেকে সাবধানে থাকতে, নিজের সংসারের ভালো না বুঝে তিনি নাকি বরাবরই তার ভাইয়ের সংসার নিয়ে চিন্তিত। এ নিয়ে মা ছেলের মাঝে মন কষাকষি। প্রতিবেশীর বিয়ের দাওয়াতে যাবো। মা বললেন,
– নতুন বৌ তুমি, গহনা কিছু পরো, কেমন খালি খালি লাগছে। স্বামী আমার গাল টিপে বললো,
– ওকে এমনিতেই ভালো লাগে। ওসব সোনার গহনা শো অফের কি দরকার! কথা বেশি আগালো না। দাওয়াত খেয়ে ঘরে ফিরতেই মা চুপি চুপি জানতে চাইলেন,
– গহনাগুলো কি তোমার কাছে নেই?
– না, আপনার ছেলে লকারে রেখেছে।
– কেন দিয়েছো ওকে?
– ও বললো লকারে না রাখলে আপনি নিয়ে যাবেন, তাই আমাকে না জানিয়েই…
– শয়তানটা এখনও মানুষ হলো না। বৌ মা, ওর কাছে তুমি গহনা ফেরত চাও।
– কিন্তু মা..
– আহ! কথা বাড়িও না। যা বলেছি তাই করো।
কথাটা বেশ গুরুগম্ভীর মনে হলো। কিছু একটা গড় বড় হচ্ছে, হয় শাশুড়ি করছে নতুবা আমার স্বামী। কিন্তু কি সেটা? বিবাহের প্রায় আট মাস পর….
রোজকার মতো সেদিনও অফিস করে ফিরেছি। মা ছেলের মাঝে তুমুল ঝগড়া চলছে। আমার স্বামীর টাকা লাগবে কিন্তু মা দেবেন না। বাবার পেনশনের টাকার এক সিকিও তিনি আর দেবেন না। মায়ের গায়ে রীতিমতো হাত তুলে ফেললো আমার ভালো স্বামী। দৃশ্যটা দেখে থমকে গেলাম। ঘরে ঢুকতেই আমার ব্যাগটা কেড়ে নিলো সে, কার্ড নিয়ে চলে গেলো। মা বাধা দিচ্ছেলেন কিন্তু সে বাধা শুনে নি। আমি এসব কিছুই দেখছি না, দেখছি মায়ের কপাল ফেটে রক্ত ঝড়ছে! তারপর একদিন মরেই যাচ্ছিলাম জানেন! দম বন্ধ হয়ে মরে যাচ্ছিলাম! শাশুড়ি মা যদি পেছন থেকে আমার স্বামীর মাথায় আঘাত না করতেন তাহলে আমি মরেই যেতাম। বদমাইশটা কি শক্তভাবে আমাকে বালিশ চাপা দিয়ে ধরেছিলো। নিঃশ্বাস নিতে পারছিলাম না, পাগলের মতো হাত পা ছুড়ছিলাম, কি শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি!
আমার স্বামীর টাকা লাগবে। ওই যে সেদিন কার্ড নিয়ে চলে গেলো, আমার জমানো সব টাকা খরচ করে এলো…সব! লকারে যেই গহনাগুলো রাখা আছে বলে জানতাম সেই গহনাগুলো সেদিনই অন্যের হাতে চলে গিয়েছিলো, লকার কেবল স্বান্তনা। মাকে নিয়ে বলা প্রতিটি খারাপ কথাই ছিলো মিথ্যে, বানোয়াট। আমার ভালো স্বামীর মদ, গাঁজা, সিগারেট কিংবা মেয়ের নেশা না থাকলেও জুয়ার নেশা আছে। শাশুড়ি ভেবেছিলো বিয়ে করলে ছেলে ভালো হয়ে যাবে আর ছেলে ভেবেছে বিয়ের উছিলায় সে অতিরিক্ত কিছু টাকা পাবে, তাছাড়া আমি চাকরিজীবী, একার আয়ের সাথে বউয়ের আয় মিলিয়ে জুয়ার আসরটা বেশ ভালোই জমবে।
আমার মতো খারাপ মেয়ের সাথে আসলে অতো ভালো স্বামী মানায় না। খুব গোপনে সিদ্ধান্ত নিলাম, একা চলবো। সংসার থেকে একটু একটু করে গুছিয়ে নিচ্ছি নিজের সব। হঠাৎ রক্তমাখা ওড়নাটা হাতে পড়লো, ওই যে সেদিন ছেলের করা আঘাতে মায়ের কপাল ফেটে গেলো, আমি এই ওড়না দিয়ে তার মাথা চেপে ধরেছিলাম। লাল টকটকে রক্তটা শুকিয়ে আজ কালচে হয়ে গেছে। শাশুড়ি মায়ের মনের সব রঙও হয়তো আজ ধূসর হয়ে গেছে সময়ের স্রোতে। এতোদিন তার উপর খুব রাগ হয়েছিলো, ছেলের জুয়ার কথা কেন গোপন করেছে? ওড়নাটা দেখে মনটা শান্ত হলো। গুটিগুটি পায়ে তার কাছে গেলাম। কানে কানে বললাম,
– এই সংসার ছেড়ে আমি চলে যাচ্ছি। আপনি যাবেন? তিনি কিছু সময় চুপ করে রইলেন, চারপাশটায় কি যেনো দেখলেন। আমি আবার জিজ্ঞাসা করলাম,
– যাবেন?
– পেনশন থেকে মাসে যা পাই তা দিয়ে বাসা ভাড়া, থাকা, খাওয়া সব হবে?
– আমার চাকরি আছেতো। যাবেন?
বউ শাশুড়ির সংসার ছেড়ে শুরু হলো আমাদের মা মেয়ের সংসার। আজকাল মা’কে মন খুলে হাসতে দেখি আর ঘৃণা দেখি তার জুয়ারি ছেলের উপর। আমি নির্বাক…ওসব নিয়ে ভাবতে চাই না। কিন্তু মাকে যখন দেখি দূরে বসেও ছেলের ভালো হওয়ার জন্য প্রার্থনা করেন তখন নিজের মা’কে খুব মিস করি। দূর আকাশে বসে আমার মাও কি আমার জন্য দোয়া করেন?