মুদ্রাদোষ

মুদ্রাদোষ

“মেয়েটা পার করলেই বাঁচি।” বাবার কন্ঠস্বর বাতাসে ভাসতেই দরজার আড়ালে কান দিলাম। যদিও কারো কথা লুকিয়ে শোনা ঠিক নয় তবু প্রসঙ্গটা যেহেতু আমার তাই আড়ি পাতায় যায়। শুনে যা বুঝলাম তা হল, এ বাড়ি থেকে আমাকে তাড়ানোর ঘোর ষড়যন্ত্র চলছে। বিয়ের খরচপাতি নিয়ে বাবা-মা আলোচনা করছেন। বিষয়টা যে এত দুর গড়িয়েছে, অথচ আমি এর কিছুই জানি না। সেদিন রাতে ঠিকমত ঘুম হলো না, বিছানায় এপাশ ঐপাশ করতে করতে ভাবছিলাম, পাত্র কি ঠিক হয়ে গেছে? পাত্র কে? কি করে? দেখতে কেমন? আগ বাড়িয়ে মা’কে জিজ্ঞেস করবো, কিন্তু লজ্জায় আর পারলাম না। মাঝরাতে চারপাশে শুনশান নিরবতা। মাঝে মাঝে একটা কোকিল কুহ কুহ ডেকে চলেছে। কেন এই মাঝরাতে কোকিল ডাকছে? এক অজানা শিহরণে মনের কোণে উৎকন্ঠা বিরাজ করতে লাগলো।

আমি বাবা-মাকে ছেড়ে কোথাও যাবো না। এই বাড়ি ছাড়া কোথাও গিয়ে আমি এক মুহূর্তও থাকতে পারবো না। কিন্তু বাবার মুখের উপর কথা বলতে না পেরে বিয়েতে হ্যাঁ বলে দিলাম। কেন জানি, বাবার কোন কথা ফেলতে পারি না। আজও এর ব্যতিক্রম হল না। না শব্দটি বলার সাহস হল না। মেয়ের জন্মের পর থেকে প্রতিটা বাবা-মাই ভীষণ চিন্তিত থাকেন। একটা সুপাত্রে না গছানো পর্যন্ত তাদের কপালে থাকে চিন্তার ভাঁজ। আমি আর না বলি কি করে, রাজী হয়ে গেলাম।

সৃষ্টিকর্তা মেয়েদের অপার সহ্য করার ক্ষমতা দিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। প্রতিটা ধাপে অসংখ্য কাঙ্ক্ষিত অনাকাঙ্ক্ষিত সব বাঁধার সম্মুখীন হতে হয়। এটাই সৃষ্টি প্রদত্ত নিয়ম। রাতে খাবারের সময় মা বললেন, “মেয়ে হয়ে জন্মালে পিতৃগৃহ নয়, শ্বশুরালয় হয় একমাত্র ঠিকানা। এটাই চিরন্তন নিয়ম। শ্বশুরশ্বাশুড়ীকে বাবা-মায়ের মত সম্মান করবে। সবার যত্নাত্তি করবে। স্বামীর মুখের উপর কথা বলা যাবে না। ছোটদের স্নেহ করবে।’ বিয়ের আগেই মা শ্বশুরবাড়ি পড়ে থাকার দীক্ষা দিতে শুরু করলেন। এটাও হয়ত মায়েদের নিয়ম। ভাত গলা দিয়ে নামলো না। প্লেটে হাত দিয়ে নকশা করতে করতে মায়ের ডাকে সম্বিৎ ফিরে পেলাম। ‘কি রে খাচ্ছিস না কেন??’

-না! মানে এমনি। খেতে ইচ্ছে করছে না। উহ! এভাবে বসে থেকে কথা গলাধঃকরণ করার চেয়ে প্লেটে হাত ধুয়ে উঠে চলে গেলাম। ঘর থেকে টের পেলাম, বাবা মা’কে বকাবকি করছেন,-‘এসব কথা বলার সময় পেলে না। মেয়েটাকে ঠিকমত খেতেও দিলে না।’

ঘরের কোণে জানালার গা ঘেসে দাঁড়িয়ে ভাবছি, আমার কত্তগুলা স্বপ্ন! নিজের পায়ে দাঁড়াবো, একটা চাকরি করবো, একটা বাড়ি বানাবো, বাড়ির চারপাশে থাকবে রংবেরংয়ের নজরকাড়া ফুল। ফুলের গন্ধে মৌ মৌ করবে পুরো বাড়ি। শান বাঁধানো পুকুরপাড়ে ফুলেদের আসর বসবে। পাড়ার পিচ্ছিপাচ্ছারা এসে হৈ চৈ করবে রোজ। মা বাবা আর বোন মিলে জমিয়ে আড্ডা দিবো। এভাবেই কাটবে আমার দিনগুলো। বিয়ের চিন্তা তো মাথাতেই ছিল না। হঠাৎ সবকিছু এলোমেলো, আমার বাগিচা করার স্বপ্নে ছেদ পড়লো পাত্রপক্ষের সামনে নাস্তা পরিবেশন করতে গিয়ে পাত্রের কোন হদিস পেলাম না। পাত্রের বাবা-মা আর তাদের একমাত্র মেয়ে আমায় দেখতে এসেছে। সবার সামনে যথারীতি পাত্রের বাবা প্রশ্ন করলেন,

-মা, তোমার নাম কি? কিসে পড়ো? রান্নাবান্না করতে পারো কিনা?

সমুদয় প্রশ্নপর্ব শেষে পাত্রের মা আমার সাথে আলাদা রুমে কথা বলতে চাইলেন। শুনেছিলাম, আলাদাভাবে পাত্র পাত্রীর মতবিনিময়ের সুযোগ দেয়া হয়। কিন্তু উনি রুমে এসে আমার সারা শরীরের নাড়ী-নক্ষত্র পোস্টমর্টেম করতে লাগলো। চুল কত বড়, দাঁত ঠিক আছে কিনা, পা লম্বা না বাঁকা, ঠিকমত হাটতে পারি কিনা….আর কত কি। তখন নিজেকে হাটে তোলা পশুর মত অসহায় লাগছিল। কোরবানি পশু কিনতে এসে, লেজ উচিয়ে, পা দেখে, শিং দেখে যেন সতীত্ব খুঁজতেছিলেন। জীবন্ত অবস্থায় আমার শবচ্ছেদ করে তারা জানালো মেয়ে তাদের পছন্দ হয়েছে। তাদের ছেলে নাকি ভদ্রতার অবতার, তার মতামত লাগবে না, পরিবার যা বলবে তাই হবে। কথাবার্তা মোটামুটি ফাইনাল। ছেলে সামনের মাসে ছুটিতে আসবে, প্রথম সপ্তাহের বিয়ের কাজ সম্পন্ন করে বউ ঘরে তুলে নেয়া হবে, এমন সিদ্ধান্ত গৃহীত হল।

গত তের তিনে উনার সাথে কথা হয়েছে মাত্র একবার। তাও কয়েক মিনিটে শুধুমাত্র পরিচয় পর্ব। উনি বিজিবিতে জব করেন, রাঙামাটি পোস্টিং। উনার একটা ছবি পেয়েছিলাম, ছবির সাথে স্বপ্ন বুনতে ছিলাম। প্রতিটা মেয়ের মত আমিও চাইতাম, ”আমার প্রিয় মানুষটা আমার মনের মত হবে। আমার স্বামী হবে আমার বন্ধু, স্বপ্নের সারথী, সুখ দুঃখের সারথী। তার ভালবাসায় সিক্ত হবে আমার অধরা স্বপ্নগুলো। তার প্রশ্রয়ে পূর্ণ হবে অপূর্ণ ইচ্ছাগুলো।”
কেন জানি, মনের মাঝে আড়ষ্টতা কাজ করছিল। প্রশ্ন জেগেছিল, ”চাওয়া’ আর ‘পাওয়া” একই মোহনায় মিলবে তো? বাবার আঙিনায় লালিত একগুচ্ছ স্বপ্ন নিয়ে পদার্পণ করলাম শ্বশুরালয়ে। নতুন বউকে পাড়াপড়শিদের দেখানোর জন্য উঠানের এক কোণে বসানো হল। পাড়া প্রতিবেশী সবাই যে যার মত শাড়ীর আচঁল সরিয়ে, মাথা তুলে নানান ভঙ্গিতে দেখছিল আমায়। কেউ একজন বললো,

-দেখি, দেখি বউ দেখি! তার কথা শুনে তার দিকে তাকাতেই আশেপাশের প্রায় সব মহিলারাই হো হো করে হেসে উঠলো। সেই মহিলা বলে বসলো,

-“ওমা বউ দেখি আবার তাকায়ও।”

সেদিন নিজেকে চিড়িয়াখানার পশুর মত মনে হচ্ছিল। বিনা টিকেটে মজা লুটতে এসেছে সবাই। ইচ্ছে করছিল, সপাটে এক চড় বসিয়ে দেই। কিন্তু চুপ করে বসে থাকতে হবে, এটাও এই সমাজের রেওয়াজ। বাসর ঘরে নিয়ে এসে আমার শ্রদ্ধেয় শ্বাশুড়ী আম্মা ঘোমটা সরিয়ে গায়ের গহনা চোখ দিয়ে মাপতে শুরু করলেন। তখনও আমার খারাপ লাগেনি, কিন্তু লেগেছে তখন যখন তিনি মুখে অরুচি এনে বলছিলেন, “চেইন, কানের দুল, হাতের বালা শুধু এইগুলোই দিছে? আবার এমিটেশন নয়তো? বিয়ের পূর্বে পাত্রপক্ষের কোন দাবী দাওয়া ছিল না। তবে বোধহয় থাকলেই ভাল হত, এসব শুনতে হত না। বাবার উপর ভীষণ অভিমান হচ্ছিল, “কেন তুমি নিজের মেয়ে এভাবে বিক্রি করে দিলে?”

জীবনের প্রথম রাত টা নিজেদের জানতে জানতে আর চিনতেই কেটে গেলো! মনে হল, পৃথিবীর সেরা মানুষটাকেই বর হিসাবে পেয়েছি। দুজনে গল্প করতে করতেই কেটে গেলো প্রহর। নতুন পরিবেশে তিনি আর জোর করলেন না। পরদিন একটু বেলা গড়াতেই গোসল না করায় শ্বাশুড়ী কথা শুনালেন। কিভাবে আর উনাকে বলি, আমাদের মাঝে কিছুই হয় নি। অথচ এই সাতসকালে গোসল করতে হবে, এটাও ফরজে আইন?

স্বামীর ছুটি শেষ। ফিরে গেলেন কর্মস্থলে। স্বামী বাসায় থাকতেই গত এক মাসে বাড়ির যাবতীয় কাজের দায়িত্ব নিজের কাঁধে এসে পড়লো। শ্বাশুড়ী রান্নাঘর থেকে ছুটি নিয়েছেন। ননদ সেও রান্নাঘরে ভুলেও প্রবেশ করে না, দেবর সেতো এখনও ছোট। যদিও এ বাড়িতে কর্তৃত্ব শ্বাশুড়ী আম্মার হাতে, আর আমি শুধু কাজের মেয়ে বনে গেলাম। শ্বশুরমশাই ছিলেন নিষ্ক্রয় দর্শক, উনি কিছুই বলেন না। এভাবেই চলতে লাগলো আমার সংসার জীবন….!

সেবার আমার ইন্টারের পরিক্ষার সময় ঘনিয়ে আসলো। পড়াশোনার জন্য বাবার বাড়ি থেকে বই নিয়ে আসলাম। কাজের ফাঁকে ফাঁকে বই পড়তাম। কিন্তু একদিন শ্বাশুড়ী বললেন, ‘সারাজীবন তো রান্নাঘর সামলাতে হবে, এত পড়াশোনা করে কি হবে? ওসব ছেড়ে রান্নাঘরে মন দাও।’ আমার পড়ার ইচ্ছে দমে গেল। স্বামীকে বলে লাভ নেই, তিনি মাতৃভক্ত ছেলে। মা যা বলবে তাই সঠিক। স্বপ্নগুলো জলাঞ্জলি দিয়ে পুরোদস্তুর গৃহিণী হয়ে উঠলাম। দুদণ্ড বিশ্রাম নিবো, সেই ফুসুরৎ নেই। এই বাড়িতে কোন কাজের লোক নেই। শ্বশুরমশাই বাজার করে দিয়েই খালাস, শ্বাশুড়ী আম্মা সিরিয়াল নিয়ে ব্যস্ত, ননদ সারা দিনরাত ব্যস্ত ফোন নিয়ে। আর আমার সময় কাটে পুরো সংসার সামলানোর দায়িত্বে।

রমজান মাস, রাত্রি আড়াইটা। এলার্ম বাজছে। ক্লান্ত বিধ্বস্ত শরীর নিয়ে উঠতে ইচ্ছে করছিলো না। কিন্তু আমি না উঠলে এই বাড়ির উনুনে আগুন জ্বলবে না। আর স্বামীর কাছে রিপোর্ট চলে যাবে, তোর বউ কথা শুনে না।
চোখেমুখে পানি দিয়ে রান্নাঘরে ঢুকলাম। একেক জনের পছন্দ একেক রকম খাবার। এজন্য কয়েকপদের খাবার রান্না করতে হবে। রান্না শেষ করে শ্বশুর-শাশুড়ি, ননদ-দেবরকে ডেকে তুললাম। ননদ আর দেবরের ব্রাশে পেস্ট দিয়ে, তোয়ালে রেডি করে টেবিলে খাবার সাজিয়ে রাখলাম। সবাই একসাথে খেতে বসলো। কিন্তু আমার বসার পারমিশন নেই। স্বামী না থাকলে এমনটা হয়। কারণ আমি খেতে বসলে খাবার বেড়ে দেবে কে? বিয়ের পরপর একদিন শ্বাশুড়ীর ধমকে এই শিক্ষাটা পেয়েছিলাম। সবার খাওয়া শেষ হলে আমি খেতে বসি। সেহরির সময় প্রায় শেষের দিকে, আমি খেতে বসতেই আজান দিয়ে দিল। পেট ভরে আর খাওয়া হল না। এরপর নোংরা টেবিল পরিষ্কার করা, বাসনপত্র মাজা এগুলো আমার নৈতিক দায়িত্ব। শ্বাশুড়ী আম্মার বাতের ব্যাথা, অথচ আমার বিয়ের পূর্বে তিনি সব কাজ সামলাতেন। আমি সবকিছু একা করতে গিয়ে গুছিয়ে উঠতে ভীষণ কষ্ট হয়।

ভোরবেলায় নামাজ শেষ কোরআন পড়া আমার নিত্য অভ্যাস। কোরআন পড়তে পড়তে সকাল হয়ে যায়। সকাল হতেই শাশুড়ি নাস্তা বানাতে বললো, তার বাবু রোজা রাখবে না। ডিম পরোটা বানিয়ে দিলাম। এরপর সবার বিছানা ঠিক করা, উঠান ঝাড়ু দেওয়া, ঘর পরিস্কার করা, ঘর মোছা, কাপড়চোপড় ধোয়া, এসব করতে করতে দুপুর হয়ে যায়। তারপর গোসল, নামাজ সেরে আবার রান্না ঘরে। ইফতারির উপকরণগুলো রেডি করতে করতে বেলা চলে যায়। বিকেলে শাশুড়ির বাবুকে খেতে দেয়া আমার কাজ। নিজের সন্তানের মত দেবরের সব খেয়াল রাখতে হয়। আসরের নামাজ শেষে শুরু হয় বাহারি আইটেমের ইফতারি তৈরি করা। ছোলা, ডালের বড়া, বেগুনি, পিয়াজু, আলুর চপ, ডিমের চপ তৈরি করতে গিয়ে একা হিমশিম খেয়ে যায়। এরপর আপেল, মাল্টা, শশা কেটে, লেবুচিনির শরবত বানিয়ে টেবিলে পরিবেশন করার পর আমার যেন স্বস্তির নিশ্বাস পড়ে।

ইফতারি আর একসাথে করা হয় না, রাতের খাবারের আয়োজন করতে গিয়ে রান্না ঘরেই ইফতার করতে হয়। চাল ধুয়ে চুলোয় দিয়ে ক্ষণিকের ছুটি নিয়ে নামাজ শেষ করি। নামাজ শেষে আবার টেবিলে পরিস্কার করা, থালাবাটি ধোয়া, সাথে রান্না শেষ করা সব দায়িত্ব যেন আমার। আবার রাতে খাবার পরিবেশন করা আবার আবার। এতকিছুর পরও ছেলের কাছে শাশুড়িকে ফোনে বলতে শুনলাম, ‘সারাদিন কত্ত কাজ করলাম।’ কিছুক্ষণ পর স্বামী আমাকে কল দিয়ে বলে, তুমি কি মরে গেছো? আমার আম্মুই সব করে তুমি আছো কেন? নিরবে চোখের পানি মুছলাম। কারণ এই প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত