– বাবা, শোনো। আগামী মাসের নয় তারিখ জামিল চাচার ছেলের সাথে আমার বিয়ে। মেয়ের কথা শুনে আনিস সাহেব যেন আকাশ থেকে পড়লেন।
-মানে? কি বলতে চাইছিস তুই?
– মানে জামিল চাচার বাসায় গিয়েছিলাম।
উনার ছেলের সাথে আমার বিয়েটা নয় তারিখ ঠিক করে আসলাম। তোমার কি এই বিষয়ে কোনো আপত্তি আছে বাবা? আনিস সাহেব রাগে কটমট হয়ে বললেন, বিয়ে ঠিক করে আসলি মানে! থাব্রে সবগুলো দাঁত ফেলে দিব, বেয়াদব মেয়ে! নিজের বিয়ে নিজে ঠিক করতে যাস! লজ্জা করে না তোর? আর জামিল গাধাটাও তোর সাথে কথা বলে বিয়ের তারিখ দিয়ে দিল! গাধা কোথাকার!
– জামিল চাচাকে একদম গাধা বলবে না বাবা। উনি যথেষ্ট বুদ্ধিমান। আর লজ্জার কথা কি বলছো! তোমার মনে নেই? এইচএসসিতে পরপর দু’বার ফেইল করে এসেও সে কথা তোমাকে হাসি মুখেই বলেছিলাম। তখন লজ্জা না পেলে এখন কিসের লজ্জা! আর ফেইল করা অপেক্ষা বিয়ে করাটা অবশ্যই উত্তম হওয়ার কথা।
– তুই দিনদিন অনেক বেশি নির্লজ্জ হয়ে যাচ্ছিস তনয়া। অবশ্যই অনেক বেশি নির্লজ্জ! এক্ষুনি আমারচোখের সামনে থেকে যা।
– ঠিক আছে যাচ্ছি, এতো চেঁচিয়ো না। শিলা বোধহয় তোমার জন্য খাবার গরম করে টেবিলে রাখছে। খেয়ে নাও। আমি জামিল চাচার বাসা থেকে খেয়ে এসেছি। আর খাবো না।
আনিস সাহেব চেষ্টা করেও রাতে ঘুমাতে পারলেন না। সারারাত তনয়ার কথাগুলো মাথার মধ্যে ঘুরপাক করতে লাগলো। উনি নিজেই জামিল সাহেবের ছেলের সাথে তনয়ার বিয়ে ঠিক করেছেন। আজ সকাল পর্যন্ত তনয়া বিয়েতে রাজি ছিলো না। বিকালে কি এমন ঘটলো যে ও নিজে গিয়ে বিয়ের দিন ঠিক করেআসলো! নাহ, মাথাটা একদমই কাজ করছে না!তনয়ার আজ খুব খুশি খুশি লাগছে। কাউকে ভড়কে দিতে পারলে সে খুব আনন্দ পায়। বাবাকে আজ খুব দারুনভাবে ভড়কে দেওয়া হয়েছে। এখন সারারাত বাবা এটা নিয়ে ভাববে। ছোটবেলা থেকেই সে এরকম মিথ্যা গল্প বানিয়ে, কখনও বা সত্যি সত্যিই অদ্ভুত ঘটনা ঘটিয়ে কত মানুষকে যে ভড়কে দিয়েছে হিসেব নেই। কাল সে জামিল সাহেবের ছেলের সাথে দেখা করবে। এতে বাবা আরও বেশি ভড়কে যাবে। ইশ! কি যে আনন্দ হচ্ছে তনয়ার! সকাল ন’টা। তনয়া বেশ পরিপাটি হয়ে হালকা সেজেগুজে বাবার ঘরে ঢুকলো।
– বাবা, ভাত খাবে চলো।
– তুই যা। আমি জামিলকে ফোন করবো। কিছুক্ষণ চেঁচাবো। তারপর যাবো।
– জামিল চাচা আবার কি করলো?
– কি করলো মানে! গর্দভটা তোর সাথে কথা বলে বিয়ের তারিখ দিয়ে দেয়! ওর কি আক্কেলগুড়ুম হয়েছে!
– কিসব বলছো বাবা! আমার সাথে কথা বলে বিয়ের দিন ঠিক করেছে মানে? তোমার মাথা ঠিক আছে? আমি তো বিয়েতে রাজিই না। আর আমি যাবো বিয়ে ঠিক করতে? কি যে হয়েছে তোমার! খেতে আসো তো।
– মানে? তুই-ই তো বললি কালকে, বিকালে জামিলের বাসায় গিয়েছিলি। রাতে খেয়েও এসেছিস।
– একদমই না বাবা। আমি কালকে মিলির বাসায় গিয়েছিলাম। আর ওর বাসা থেকেই খেয়ে এসেছি
– তাহলে কি আমি স্বপ্ন দেখলাম?
– তাই হবে হয়তো। এখন আসো তো।
আনিস সাহেবের মাথার ভেতর সবই কেমন গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। কি হচ্ছে কিছুই যেন বুঝছেন না। কাল তনয়ার কথাতে তিনি রাগ করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু মনে মনে খুশিও হয়েছিলেন। মেয়ে বিয়ের জন্য অন্তত রাজি তো হয়েছে! কালকের ঘটনাটা যদি মিথ্যা হয়ে থাকে তার মানে তো তনয়া বিয়ের জন্য এখনো রাজি না। মেয়েকে রাজি করানোর চিন্তায় আবার তিনি চিন্তিত হয়ে গেলেন।
– হ্যালো, জামিল চাচা বলছেন?
– হ্যাঁ বলছি। তুমি কে?
– আমি তনয়া বলছি চাচা।
– ওহ তুমি! কেমন আছো মা?
– ভালো আছি চাচা। আপনার ছেলে কি এখন বাসায়?
– হ্যাঁ আহাদ তো বাসাতেই আছে। কেন কথা বলবে? ডাকবো?
– না না ডাকতে হবে না। উনাকে বলুন সাড়ে এগারোটার মধ্যে নিউমার্কেট চলে আসতে। আমি উনার জন্য অপেক্ষা করছি। অবশ্যই সাড়ে এগারোটার মধ্যেই। জামিল সাহেবকে আর কথা বলার সুযোগ না দিয়ে তনয়া ফোন কেটে দিলো। তার ধারণা সাড়ে এগারোটা বাজার আগেই আহাদ চলে আসবে। তনয়ার ধারণা সঠিক হলো। সাড়ে এগারোটার পনেরো মিনিট আগেই আহাদ এসে উপস্থিত হলো।
-আপনি আমাকে কেন বিয়ে করতে চান? তনয়ার কথায় আহাদ একটু নড়েচড়ে বসলো।
– যদি জিজ্ঞেস করতেন বিয়ে কেন করছি তাহলে হয়ত বলতাম বিয়ে করার সময়টা হয়ত হয়েছে তাই বিয়ে করছি। কিন্তু আপনাকে কেন বিয়ে করছি তা ঠিক জানি না। হয়ত বাবার পছন্দ তাই।
– আমি ইন্টারে দুইবার ফেল মেরেছি জানেন?
– হ্যাঁ জানি।
– আমি প্রচুর মিথ্যা কথা বলি। বানিয়ে বানিয়ে অনেক মিথ্যা গল্প বলি। এটা জানেন?
– হ্যাঁ এটাও জানি।
– তবে এখন যেটা বলবো সেটা আপনি জানেন না। কেউ-
ই জানে না মূলত। আপনাকে বলছি শুধু।শুনুন। আমার ১৫ তম জন্মদিনে আমার বাবা আমাকে দুইটা লাভবার্ড কিনে দিয়েছিলেন। খুবই সুন্দর। কিন্তু তার এক সপ্তাহ পরেই পাখি দুটোকে আর পাওয়া গেল না। দুইটা পাখিই নিখোঁজ। সবাই ভাবলো হয়ত কেউ চুরি করেছে। কিন্তু আসল ঘটনা কেউ-ই জানে না।
– আসল ঘটনা কী?
– আসল ঘটনা হলো, পাখি দুটো আমি খেয়ে ফেলেছিলাম। জীবন্ত পাখিই মুখের ভেতর দিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে খেয়েছিলাম। শুধু তাই নয় এরপর বিভিন্নভাবে বিভিন্ন ছোট ছোট প্রাণী এরকমভাবে খেয়েছি। আমার মনে হয় আমি কিছুটা খোক্কস টাইপের।
– বাহ ইন্টারেস্টিং তো!
– এটা আপনার কাছে ইন্টারেস্টিং মনে হলো?
– অবশ্যই ইন্টারেস্টিং। আমি আপনাকে এই বিষয়ে একটা সাজেশন দিতে পারি। আপনি অবশ্যই একবার টিকটিকি টেস্ট করে দেখবেন। আমি ছোটবেলায় অনেক টিকটিকি খেতাম।
– ছিঃ! কি বলছেন আপনি! টিকটিকি আবার খাওয়া যায় নাকি?
– কেন খাওয়া যাবে না? আস্ত লাভবার্ড খাওয়া গেলে টিকটিকি কেন খাওয়া যাবে না? তনয়া জড়োসড়ো হয়ে আড়চোখে আহাদের দিকে তাকিয়ে আছে। এই ছেলে যে খুব সহজেই ওর সব ভাওতাবাজি ধরে ফেলবে তা খুব ভালোভাবেই বোঝা যাচ্ছে। বেশ কিছুক্ষণ তনয়া কোনো কথা বললো না। কি যেন ভাবছে। হঠাৎ বলে উঠলো,
– যাওয়ার আগে আপনাদের বাসার ঠিকানাটা দিয়ে যাবেন।
– কেন বলুন তো?
– কাল আমি আপনাদের বাসায় যাবো একা একা।
– বাহ! কিন্তু কেন?
– গতকাল বাবাকে একটা মিথ্যে গল্প বলেছিলাম, আগামীকাল হয়ত গল্পটি সত্যি হবে।
– কি বলেছিলেন?
– বলেছিলাম, জামিল চাচার সাথে দেখা করে বিয়ের দিন ঠিক করে এসেছি। আহাদ জোরে জোরে হাসতে শুরু করলো। তনয়ার আহাদের হাসি দেখতে ভালো লাগছে। আজ সে বাবাকে গিয়ে আরেকটা মিথ্যা বলবে। বলবে, জামিল চাচার ছেলে আর আমি কাজি অফিসে গিয়ে বিয়ে করে এসেছি। ওহ হ্যাঁ, এটাই তনয়ার শেষ মিথ্যা ছিল!