একমুঠো মুক্তোদানার দল

একমুঠো মুক্তোদানার দল

আনিকা আমাকে বলল,, “তোমার সাথে আমার বিয়ে হওয়ার পর তোমার পাড়ার যত মেয়ে আমাকে দেখতে আসবে! তাদের সবাইকে আমি একটা করে মেহেদি গিফট করব।

“কি অদ্ভুতুড়ে চিন্তা তোমার! মেহেদি কেনো দেবে??

“তারা যখন আমার হাতটা দেখবে! তখন হয়তো সবাই আমার মেহেদি রাঙা হাতের প্রশংসা করবে। তাই ভাবছি মেহেদিই দেবো!

“যদি তাদের হাতেও মেহেদি পরিয়ে দিতে বলে??

“তাহলে পরিয়ে দেব!

“তখন এত সুযোগ কোথায় পাবে???

“শুনো! আমার বিয়ের পর দিনের বেলা একটানা সাতদিন তুমি আমার কাছে আসবেনা।

“আচ্ছা আসবনা। তুমি সুযোগ পেলে সবাইকে মেহেদি দিয়ে দিও।

“শুনো! তাদের হাতে মেহেদি পড়িয়ে দেয়ার মাঝে একটা প্রশংসা কুড়ানোর দিক লুকিয়ে আছে, সবাই যখন নিজেদের বাড়িতে যাবে! তখন সবার পরিবার যখন জানতে চাইবে ‘আমি কেমন বউ! তখন সবাই বলবে,
“নাঈম ভাইয়ের বউ অনেক অনেক ভালো হয়েছে। খুবই মিশুক। আমাদের হাতে মেহেদিও পরিয়ে দিয়েছে।

দ্বিতীয় আরও একটি দিক আছে, সেটি হচ্ছে বদনাম থেকে মুক্তি। আমি যতই সুন্দর হই না কেন! কিছুকিছু মানুষ আমার ভুল খুঁজতে আসবে। কিন্তু তাদের দলও আমার এই ব্যবহারে মুগ্ধতা নিয়ে বাড়ি ফিরবে। ইনশাআল্লাহ।

“হা..হা..হা… অনেক ভালো বুদ্ধি তোমার। আচ্ছা শুনো! তাদের মেহেদির সাথে করে চকলেটও দিয়ে দিও। আমি দেশে আসার সময় তোমার প্লানিং সাকসেসফুল করর জন্য অনেক প্রকারের চকলেট নিয়ে আসব। “আচ্ছা আনিও। আর শুনো আমার জন্য মনে করে সৌদিআরবের খেজুর নিয়ে আসবে কিন্তু!

এভাবেই দুষ্টুমি প্লানিং আর স্বপ্নের আদানপ্রদান করতে করতে আমাদের কেটে গেলো দিব্যি ছ’মাস। বাংলাদেশ বিমান বন্দরে ঘুমে নেতিয়ে পরা চোখে আমি প্রথম সকাল দেখলাম। সকালটা তখনো পুরোপুরি হয়নি, হয়তো তখন আলো আধারের মিলনোৎসব চলছিলো বিদায়ী রাতের শেষ প্রহরে। বিমান থেকে নামার পর একগুচ্ছ অনুভূতি এসে ঘিরে ধরলো আমায়। দেশের মাটির মিষ্টি গন্ধ, শীতল বাতাস, শহুরে কাকের ডাক, কি যে এক আনন্দ! বলে বুঝানো যায়না। এরই মাঝে অচেনা মানুষজনেরর চেনা চেনা কণ্ঠ কানে এসে বাজছে।

বাড়ি ফিরলাম অনেকবছর পর। চেনাজানা জন্মভূমিটাকে নতুন নতুন মনে হতে লাগলো। মায়ের লাগানো সেই ছোট্ট আমগাছটায় আম এসে ডাল ঝুলিয়ে দিয়েছে। আমার লাগানো জামগাছটায় এত ঘনকরে জাম ধরেছে! মনে হচ্ছিল সবুজের ছায়ায় কালোরঙের মেলা বসেছে জামতলায়।

হঠাৎ আনিকার ফোন। ফোনটা দেখেই চিন্তায় পরে গেলাম। এই নাম্বারটা সে কি করে জানলো?? দেশে আসার ছ’মাস আগে আনিকার সাথে আম্মা আমার বিয়ে ঠিক করেছে। আনিকাকে আমার দেশের এই নাম্বারটা তো আমি দেইনি! তাহলে সে পেলো কোথায়! “হ্যাঁ আনিকা! বলো! তুমি আমার নাম্বার পেলে কোথায়??

“আরে তোমার ছোট বোনের থেকে চেয়ে নিয়েছি। শুনো! দেশে আসার পর কি ভুলে গেলে নাকি?? এত ভিষণ লজ্জা পেলাম নাম্বার চাইতে গিয়ে। একটাবার ফোন দিলে কি হতো?? “আচ্ছা তোমাকে পরে ফোন দিচ্ছি। বাড়িতে এলাম কেবল! বাড়ির সবাই ভিড় করছে দেখাসাক্ষাৎ করতে। অত:পর আমাদের বিয়ে হলো। আনিকা তার প্লানিং মত পাড়ার অনেক মেয়েকেই মেহেদি উপহার দিলো। কারোর হাতে হাতে অনেক যত্নের সাথে মেহেদি পরিয়েও দিয়েছে। বিয়ের তৃতীয় দিনের মাথায় আমি বাজার থেকে ফিরছিলাম বেলা এগারোটার দিকে, হুট করে প্রাক্তনের সাথে দেখা হলো আমার। সে তার ছেলেকে নিয়ে কিন্ডারগার্ডেন স্কুল থেকে ফিরছে। সে আমাকে ডেকে বলল,,

“শুনলাম বউকে দিয়ে নাকি মেহেদি বিক্রির ব্যবসা শুরু করলে??

“হ্যাঁ! তুমি বিকেলে চলে এসো। বিদেশী পদের হরেক রকমের মেহেদি এনেছি। বউ সেগুলো বিক্রি করে অনেক টাকা আয় করছে। প্রাক্তন ভেবেছিল তার কথায় খুব রেগে যাবো আমি। কিন্তু পাত্তা না পেয়ে সে আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। বাড়ি গিয়ে আনিকাকে সব খুলে বলার পর আনিকা বলল,,

“আমাকে তাদের বাড়ি নিয়ে যাবে?? আমি আপুকে একটু দেখবো।

“নাহ। তোমার কোথাও যেতে হবেনা। বাড়িতে বসে সংসারের কাজ করো। আর শুনো! এত প্রশংসা পাওয়ার প্রয়োজন নেই। কেউ এলে আর মেহেদি উপহার দিবেনা। বিষয়টা সবাই হাস্যকরভাবে নিতে পারে এখন।

“আনিকা মাথা নিচু করে বলল,,

“আচ্ছা। আমার মিজাজটা খারাপ দেখে, দুপুরের খাবারের পর আনিকা আমাকে এসে খুব নরম গলায় বলল,,

“খুব রাগ করেছো?? আর করবনা এমন, প্লিজ রাগটা কমিয়ে নাও! আমি হেসে হেসে বললাম,,

“শুনো আনিকা! চোখে হালকা কাজল দাও। কাজল আমার খুব ভালো লাগে। আর শুনো! শাড়ি পরে আসো। নতুন বউদের একমাস ধরে শাড়ি পরতে হয় জানোনা?? বাচ্চা মেয়েদের মত উৎফুল্লতা নিয়ে আনিকা ব্রিফকেস থেকে শাড়ি বেড় করছে, আর আমাকে বলছে,,

“প্লিজ! আমি নতুন বউ। এভাবে রাগ করোনা। তোমাকে খুব ভয় লাগে তো! আনিকাকে নিয়ে ঘুরতে বেড়িয়েছি। সন্ধ্যা নেমেছে। আকাশে অনেক বড় চাঁদ উঠেছে। আনিকাকে বাড়ি ফিরতে ফিরতে বললাম,,

“চলো আনিকা! আজ পৃথিবীটা দু’জনে মিলে বণ্টন করে নিই?

“কিভাবে!

“তোমার আকাশ – আমার মাটি, তোমার সন্ধ্যা – আমার তারাবাতি। তোমার জোছনা – আমার,,,,

“এই থামো থামো! একা একাই সব বণ্টন করে নিচ্ছো! তাহলে দু’জনে বণ্টন করার কথা কেন বললে??

“ওহ- তাইতো! আচ্ছা যাও, পুরো পৃথিবীটাই তোমাকে দিলাম। তুমি শুধু আমার থেকো??

কথাটা শুনার পর আনিকা বিমূঢ় অবস্থায় আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। তার চোখ থেকে জল গড়িয়ে পরার সময় মনে হলো, সেই জলে আকাশের জোছনা এসে মিশে গেছে। যেন জল নয়, গড়িয়ে পরছে একমুঠো মুক্তোদানার দল।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত