জয় এবার অনার্সে ভর্তি হলো। নতুন শহর, নতুন জায়গা, নতুন বন্ধু-বান্ধব, সবকিছুই নতুন। বাবার আদেশ, শহরে গিয়ে যেন সে বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে পড়ালেখা না ছেড়ে দেয়। পড়ালেখাতে সে ছোট থেকেই খুব ভালো। চুপচাপ গম্ভীর স্বভাবের ছেলে সে। অতি প্রয়োজন ছাড়া কারো সাথে কথাও বলে না তেমন। তবুও কিভাবে যেন কিছু বন্ধু জুটলো তার। অবশ্য তারা তাকে খুব ভালোও বাসে। কেননা সে একজন সত্যবাদী এবং স্পষ্টভাষী।
নতুন জায়গার সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে বেশ কয়েকটা মাস লেগে গেল তার। এখন সে কিছুটা চঞ্চল এবং চালাক-চতুর হয়েছে। সেদিন সে লাইব্রেরীতে বসে বন্ধুদের সাথে ফিন্যান্সের কিছু প্রবলেম সলভ করছিল। ঠিক তখনই তার ফোনটা বেজে উঠলো। সে স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখলো তার বাবা কল করেছে। সে কলটা রিসিভ করে সালাম দিলো। অপর প্রান্ত থেকে তার বাবা তাকে জানালো “রবিনের বাবা আবারো ঝামেলা করছে। তারা অসৎ উপায়ে তাদের বাড়ির জমিসহ রাস্তার ধারের জমিও আত্মসাৎ করতে চাইছে।”
জয় তার বাবার থেকে সবকিছু শুনে বললো, আব্বা তুমি কোনো চিন্তা করো না। রবিনের সাথে আমি কথা বলবো। সে তো আমার বন্ধু হয়। সে তার বাবাকে বললে উনি আর এমন করবেন না। জয়ের বাবা উত্তর করলেন, আচ্ছা বাবা বলিস। জয় রবিনকে কল করে পুরো বিষয়টা জানালো। কিন্তু রবিনের থেকে সে যেমন উত্তর আশা করেছিল, পেল ঠিক তার উল্টোটা। রবিনও তার বাবার পক্ষে কথা বলছে। গ্রামে রবিনদের বেশ ক্ষমতা, আধিপত্য আছে। কেননা তার বাবা এলাকার একজন চেয়ারম্যান। কিন্তু কখনো গ্রামের কোনো উন্নতি করতে দেখা যায়নি তাকে। বরং অন্যের সম্পদ জোর করে কেড়ে নিতে দেখা গিয়েছে।
যে কালে তিনি চেয়ারম্যান ছিলেন না। সে কালেও ঠিক একই কাজ করতেন। কারণ তিনি চেয়ারম্যান না হলেও বেশ ক্ষমতাবান ছিলেন। টাকা দিয়ে আইন কিনে নিজ স্বার্থ হাসিল করতেন। তারই ধারাবাহিকতায় এখন তিনি জয়ের পরিবারের উপর তার অমানবিক অপারেশন চালাচ্ছেন। মাঝখানের একটা বছর সবকিছু ঠিকঠাকই ছিল। জয়ের বাবা ভাবতেন, তারা বুঝি আর তাদের উপর জোর জুলুম করবে না। কিন্তু না, সম্প্রতি তারা আবারো জয়দের বাড়ির জমি আর পথের ধারে থাকা সবজি চাষের জমিটার দখল নিতে উঠে পড়ে লেগেছে।
এদিকে জয় বিজনেস মার্কেটে খুব ভালো একটা জায়গা করে নিয়েছে। পরিশ্রমেই কাঙ্খিত বস্তু মেলে। এখন সে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের শেষের দিকে। জব মার্কেটের পাশাপাশি নিজের স্কিল ডেভোলোপমেন্ট সহ একাডেমিক পড়ালেখাও খুব যত্নসহকারে চালিয়ে যাচ্ছে সে। বেশ কয়েকটা কোম্পানি তাকে অধিক সুবিধা প্রদানের কথা বলে তাদের নিজেদের কোম্পানিতে টেনে নিতে চাইছে। কিন্তু সে বর্তমানে যেই কোম্পানিতে আছে, সেখানকার মালিক নিজে তাকে তার কোম্পানির “মালিকানা শেয়ার” দিয়ে আঁটকে ফেলেছেন। তিনি বলছেন, এই কোম্পানির মালিক তো আপনিও। নিজের কোম্পানি ছেড়ে কেউ অন্য কোম্পানিতে চলে যায়?
সামনে জয়ের অনার্স চতুর্থ বর্ষের অর্থ্যাৎ ফাইনাল ইয়ারের ফাইনাল পরীক্ষা। পরীক্ষার দেড়টা মাস সে অবসরে থাকবে বলে চিন্তা করলো। সে তার কোম্পানির মালিকের সাথে কথা বলে ছুটি নিতে চাইলে মালিক বললেন, একটা বাড়ি করতে কত খরচ হতে পারে? জয় বললো, স্যার কোন এলাকাতে? তিনি বললেন, এই ধরো আমাদের এই গুলশান ব্রাঞ্চের আশেপাশে। যেখান থেকে অফিসে আসতে সুবিধা হয়। জয় হিসাব করে টাকার আনুমানিক পরিমাণটা বলে মালিককে জিজ্ঞেস করলো, স্যার আপনার তো গুলশানে একটা বাড়ি আছেই। তবে আবার তিনি তার কথাটা পুরোপুরি শেষ করতে না দিয়ে একটু হেসে বললেন, আমার জন্য না। জয় অবাক হয়ে বললো, তবে? তবে কার জন্য স্যার? তিনি উত্তর করলেন, তোমার জন্য। জয় এটার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না।
জয়ের ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হলো। এখন সে মুক্ত স্বাধীন। সে ভেবেছে মাস্টার্সে ভর্তি হওয়ার আগে বাজারে নতুন কোনো পণ্য আনবে। যেই পণ্যের বিকল্প কোনো পণ্য থাকবে না এবং যেটা মানুষের নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য হিসেবে গণ্য হবে। একদিন রাতে জয়ের বাবা জয়কে ফোন করে বললেন, বাবা তুই আজই বাড়ি আয়। কালকে রবিনের বাবা উঁকিল নিয়ে এসে ভুয়া দলিল দেখিয়ে কিংবা লাঠিয়াল এনে আমাদেরকে এখান থেকে উঠিয়ে দেবে। জয় কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললো, ওরা আমাদের উপরে এমন করছে কেন? আমরা কী ক্ষতি করেছি ওদের?
– কোনো ক্ষতি করিনি। রবিনের বাবা এখানে মাছের চাষ করবে। প্রথমে আমাকে বলেছিল আমি যেন জমিটা তাদের কাছে বিক্রি করে দেই। কিন্তু বাপ দাদার ভিটেমাটি আমি বিক্রি করতে পারবো না। পরে সে বলেছিল, বিক্রি না করলে কিভাবে জমি আদায় করে নিতে হয় সেটা তাদের জানা আছে।
– আচ্ছা আব্বা তুমি কোনো চিন্তা করো না। আমি কাল সকালে পৌঁছে যাবো।
– আচ্ছা বাবা দেখে শুনে আসিস।
জয় সেই রাতেই তার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলো। ভোরের আলো ফুটতেই সে তার বাড়িতে পোঁছে ঘরের দরজায় কড়া নাড়লো। তার বাবা দরজা খুলে দিলেন। জয় ফ্রেশ হয়ে এলে তার বাবা তাকে সবকিছু খুলে বললেন।
.
সকাল দশটার সময় রবিনের বাবা তাদের দলবল এবং উকিল নিয়ে হাজির। জয়দের বাড়ির উঠানে বেশ বড় মাপের একটা বৈঠক বসে গেল। রবিন তার বাবার পাশে লাঠি হাতে করে দাঁড়িয়ে আছে। জয় রবিনের চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলো, এই রবিন আর “সেই ছোটকালে ধূলোমাটিতে খেলা” রবিন নেই। সে এখন অনেক বড় হয়ে গিয়েছে। শরীরে শক্তি হয়েছে।
বৈঠকে আলোচনার এক পর্যায়ে রবিন জয়কে লাঠি দিয়ে আঘাত করলো। কেননা জয় রবিনের বাবার উদ্দেশ্যে বলেছিলো, দেখুন আপনি জোর জবরদস্তি করে এভাবে আমাদের ভিটেমাটি কেড়ে নিতে পারেন না। আজ আপনাদের ক্ষমতা আছে বলে আপনি যা ইচ্ছে, তাই করতে পারেন না। এমন এক দিন আসবে যেদিন আপনার এই ক্ষমতা, প্রতিপত্তি কিছুই থাকবে না।
সেদিন রাতেই জয় তার পরিবারকে নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিলো। যাওয়ার সময় সে রবিনকে কল করে বললো, তুই অনেক পাল্টে গিয়েছিস বন্ধু। আমাকে আঘাত করার আগে তোর একটিবারও ছোটবেলার কথাগুলো মনে পরলো না? সেই প্রাথমিকে পড়া দিনগুলো, পথের ধারে থাকা আমগাছের আম চুরির দিনগুলো। কিচ্ছু মনে পরলো না তোর? আর হ্যাঁ, তোর মনে আছে ঐদিনের কথা? যেদিন তোর পায়ে কাঁচের বোতলের এক ভাঙা অংশ ঢুকে গিয়েছিল? মনে নেই বন্ধু, তোর কিচ্ছু মনে নেই। তবে তুই চিরকাল আমার মর্মে রইবি। আমি তোর বন্ধু হতে না পারি। কিন্তু তুইতো আমার বন্ধু ছিলি, আছিস, থাকবি। ভালো থাকিস বন্ধু। শুভ বিদায়। হয়তো আর কখনো গ্রামে আসা হবে না। মাঝখানে দশটা বছর চলে গিয়েছে। জয় এখন কোটি কোটি টাকার মালিক। সেইবার সে তার পরিকল্পিত নতুন পণ্য তৈরি করে। যার বাজার অবস্থান ছিল খুবই ভালো। আর সেইবারই তাদের কোম্পানি ঢাকা শহরের শীর্ষ দশটি কোম্পানির আওতায় পরে।
ঢাকা শহরে জয়ের নিজস্ব বাড়ি, নিজস্ব গাড়ি, নিজস্ব কোম্পানি সকল কিছুই আছে। বিভিন্ন জায়গা থেকে জয়ের বাবা মায়ের কাছে সম্বন্ধ আসছে জয়ের বিয়ের ব্যাপারে। জয় খুব ইনজয় করছে এসব। একদিন সকালে সে তাদের কোম্পানি পরিদর্শন এবং একটা মিটিংয়ের জন্য তাদের মিরপুর ব্রাঞ্চে গিয়েছিল। মিটিং শেষ করে নিচে নামতেই একটা ছেলেকে দেখে তার চোখ আটকে গেল। ছেলেটাকে বড্ড পরিচিত মনে হচ্ছে। সে ছেলেটির কাছে গেল এবং জিজ্ঞেস করলো, তোমার নাম রুহান না? ছেলেটি জয়কে চিনতে না পেরে বললো, হ্যাঁ আমি রুহান। কিন্তু আপনি? জয় বললো, আমি জয়। রবিনের বন্ধু।
ঠিক তখনই রবিন একটা ফাইল হাতে করে উপর থেকে নিচে নামছিল। নিচে নেমে সে জয়কে দেখে চমকে গেল। দশ বছর বাদে তাদের দেখা। জয়ের বেশভূষা দেখে রবিন অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো তার দিকে। জয়কে চেনায় যাচ্ছে না। কত পরিবর্তন হয়েছে তার! জয় হালকা কাঁশি দিতেই রবিন চোখ নামিয়ে নিলো। সে আর জয়ের চোখের দিকে তাকাতে পারছে না। বড্ড অপরাধ করে ফেলেছে সে। যার ক্ষমা কখনোই সে পাবে না। রবিন পাশ কাটিয়ে চলে যেতে চাইলে জয় বললো, কেমন আছিস বন্ধু? ভুলেও গিয়েছিস দেখছি। রবিন দাঁড়িয়ে গেল। তার মুখে কোনো কথা নেই। কিই বা বলবে সে? চুপচাপ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। জয় বললো, এখানে কোথায় এসেছিলি?
পাশে থেকে রুহান বললো, ভাইয়ার চাকরির জন্যে এসেছিলাম স্যার। যেই সময় জয় এবং জয়ের পরিবার গ্রাম ছেড়ে ঢাকায় চলে আসে। সেই সময় এই রুহানের বয়স ছিল ১০ বছর। কিন্তু এখনো তার চেহারাটা ঠিক আগের মতোই আছে। তবে কথার বলার ধরণটা পরিবর্তন হয়েছে। জয় রবিনের দিকে তাকিয়ে বললো, তা চাকরি পেয়েছিস? রবিন এবার “না” সূচক মাথা নাড়লো। জয় বললো, ঢাকায় এসেছিস যখন, তখন আয় আমার বাসা থেকে ঘুরে যা। রবিন না না করেও জয়ের জোড়াজুড়িতে গাড়িতে চেপে বসলো। জয় নিজেই ড্রাইভিং করছে। ড্রাইভারকে অন্য গাড়িতে করে বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছে।
রবিন মনে মনে নিজেকে ধিক্কার দিচ্ছে। আজ সে জয়ের পাশে বসে থাকা সত্ত্বেও নিজেকে খুব অপরিচিত একজন মনে করছে। অথচ এই জয়ের সাথেই সে প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত লেখাপড়া করে এসেছে। রবিনকে চুপ থাকতে দেখে জয় বললো, তারপর কেমন আছিস? আংকেল আন্টি কেমন আছেন? রবিন মৃদুস্বরে ‘ভালো’ বলে “হ্যাঁ” সূচক মাথা নাড়ালো। জয় জানে রবিন আনইজি ফিল করছে। তাই সে বললো, তারপর? চাকরি হয়েছে? ইন্টারভিউ কেমন দিলি?
সারা রাস্তা জয় নিজেই বকবক করলো। মাঝে মাঝে রুহানের সাথেও কিছু কথা বললো। রুহানের সাথে কথা বলার সময় রুহান জানালো, তার বাবা খুব অসুস্থ। বাড়িতে টাকা ইনকামের মতো কেউ নেই। তাই তার বড় ভাই একটা চাকরির জন্য ঢাকাতে এসেছে। তাদের গ্রামে যেসব ব্যবসায় ছিল। সেসবও এখন নেই। তারা এখন সাধারণ জীবন যাপন করছে। জয় বাসায় পৌঁছে কলিংবেল চাপতেই তার মা দরজা খুলে দিলেন। জয় তার মাকে বললো, দেখো আম্মু কাকে নিয়ে এসেছি। জয়ের মা রবিনের দিকে তাকাতেই তাকে চিনতে পারলেন। তিনি বললেন, কেমন আছো বাবা? জয় বললো, আহা আম্মু! ও খুব ক্লান্ত। যাও নাস্তা রেডি করে রান্না করতে যাও। জয়ের মা নাস্তা তৈরি করতে চলে গেলেন। খানিক পর জয়ের বাবা আসতেই রবিন দাঁড়িয়ে গেল। তিনি বললেন, বসো বাবা বসো।
রাতে ছাঁদে দাঁড়িয়ে আছে দু’জন। জয় জানে, ঢাকাতে রবিনের থাকার কোনো জায়গা নেই। তাই সে রবিনকে বললো, বন্ধু কিছুদিন থেকে যা আমাদের বাসায়। রবিন কোনো কথা বলছে না। জয় তাকে বললো, আরে অতীতে যা হয়েছে, সেসব ভুলে গিয়েছি। ঐযে যেদিন ঢাকাতে চলে এলাম আমরা। সেদিন তোকে কল করে বলেছিলাম না যে, তুই চিরকাল আমার মর্মে রইবি? হ্যাঁ, এখনো তুই আমার হৃদয়ে রয়েছিস সেই ছোট্টবেলার রবিন হয়ে। আমি শুধু দশ বছর আগে ঘটে যাওয়া সেই অতীতটা ভুলে গিয়েছি। জানি তোর মধ্যে এখন অনুশোচনা বোধ হচ্ছে। এটা স্বাভাবিক। তবে বন্ধু, সবাই সবসময় এক জায়গায় থাকে না। কখনো নদীর মাঝে চর দেখেছিস? চরটাও কিন্তু একসময় নদীর পানিতে বিলীন হয়ে যায়।
কথা বলার মাঝখানে রবিন হঠাৎ করেই জয়ের পা জড়িয়ে ধরলো। বললো, আমাকে মাফ করে দে বন্ধু। আমাকে মাফ করে দে। জয় বললো, ছাড় ছাড়। এসব কী করছিস? রবিন কাঁদছে। খুব করে কাঁদছে। সে আপন মানুষ চিনতে ভুল করেছে, সে বন্ধু চিনতে ভুল করেছে। সে জানে না, কী করলে সে জয়ের কাছে ক্ষমা পাওয়ার যোগ্য হবে। তবে সে এটা জানে, তার অপরাধটা ক্ষমার যোগ্য না।