খুলনা টু কক্সবাজার গামী বাসে বসে আছি।বাসের কেউ কেউ আমার দিখে তাকিয়ে তাকিয়ে হাসছে। কারণ দুইটা সিটে আমরা তিনজন।বাবা-মা আর আমি প্রভাতি।আমি উনাদের মাঝখানে শিশুর মতো বসে বসে চিপস খাচ্ছি।বাসে সিট থাকতেও কেন দুই সিটে তিনজন বসলাম ঘটনাটা পরিস্কারভাবে বলি। চোখেরজল টলমল করছে।বাবা দুই হাজার টাকা দিয়ে বললেন,সন্ধ্যা হয়ে আসছে।কালকেই তো কক্সবাজার যাওয়ার কথা।যা গিয়ে টাকাটা জমা করে আয়।
আমি দিলাম এক দৌড়।বন্ধুদের ফোন করে কনফার্ম হয়ে টিকেট কেটে নিলাম। অরু,চার্মিলো আর আমি তিনজন মিলে কক্সবাজার বেড়াতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।বাড়িতে বলছি কলেজ থেকে পিকনিকে নেওয়া হচ্ছে। কারণ সমস্যাটা মাকে নিয়ে।উনি কোনোমতে কক্সবাজার যেতে দিবেনা।ঐখানে নাকি পিকনিকের নামে বয়ফ্রেন্ড-গার্লফ্রেন্ড ঘুরতে যায়।আর হোটেলে রাত কাটায়।আম্মুর বান্ধবীর এক মেয়েকে কক্সবাজার বেড়াতে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে পালিয়েছিলো তার বয়ফ্রেন্ড। পুলিশ কেইস হলেও আসামিকে কিছু করতে পারেনি তারা।কারণ ছেলেটার এড্রেস ভুল ছিল।
অন্যদিকে আব্বু খুব স্বাধীনচেতা মানুষ।মৃত্যু-হত্যার ঘটনা ঘটবে বলে আব্বু ছেলে-মেয়েদের নিজেদের স্বাধীনতা কখনো হরণ করতে পারেনা।আব্বুর ধারণা আম্মু লেখাপড়াটা কম করেছে বলে আম্মু ছেলেমেয়েদের সাথে রাজাকারের মতো আচরণ করে।সবসময় সন্দেহ করে। রাতে খাবার টেবিলে আব্বু বললেন, তোদের সাথে নাকি গার্ডিয়ানরাও যাচ্ছে। আব্বুর টেকনিক বুঝে নিলাম ।যেভাবেই হোক উনি আমায় অনুমতি নিয়ে দিবেন।তাই বললাম, হ্যা বাবা চাইলে তুমিও যেতে পারো। আম্মু আব্বুর দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে বললেন, দেখো তোমার আস্কারা পেয়ে যেনো ও তোমার মুখে চুনকালি না মাখে।
আব্বু সহাস্যে উত্তর দিলেন, এসব কি বলছ রুমা,তুমি মা বলে ওর স্বাধীনতা তুমি কেড়ে নিতে পারোনা।ওর বয়স হয়েছে বুদ্ধি হয়েছে।ভুল করার আগে দশবার ভাবার বয়স ওর হয়েছে নাকি। আব্বুর কথায় মা রেগেমেগে টেবিল থেকে ওঠে সোজা রুমে চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পর দুই হাজার টাকা নিয়ে ফিরে এসে বললেন, এই নে তোর খরচের টাকা।তোর বাবার ও যাওয়ার দরকার নাই।এনজয় করবি ভালো কথা উল্টাপাল্টা কিছু খাবিনা।কয়েকদিন আগে দেখেছিসতো একটা মেয়ে বন্ধুদের সাথে কক্সবাজার বেড়াতে গিয়ে ইয়াবা সেবন করে মৃত্যু বরণ করেছে। আম্মুর দিকে না তাকিয়ে টাকাটা নিলাম।আমি জানি আম্মুর চোখের দিকে তাকালে আমার টাকা পাওয়ার আনন্দটা মাটি হয়ে যাবে।আম্মুর চোখ সবসময় শাসন করে।
সকাল ছয়টায় বাস ছাড়ার কথা রয়েছে।এক্সাইটমেন্টের কারণে রাতে ভালো ঘুম হয়নি।অরুর সাথে চ্যাটিং করতে করতে কাটিয়ে দিলাম। রাত তিনটা থেকে ওঠে তৈরি হচ্ছি।বাবা স্টেশন অব্ধি আমাকে এগিয়ে দিলেন।আমার হাতে একটা ডিএসএলআর ক্যামেরা এবং পাচ হাজার টাকা দিয়ে বললেন,শীতের মৌসুম।কক্সবাজার ঘুরতে যাচ্ছিস। সেন্টমার্টিন না গেলে মনে হবে সেখানে ঘুরতে যাওয়াটা বৃথা।আর ওখানে যাওয়ার পর তোর ইচ্ছে হবে সেরা মূহুর্তগুলো বন্দি করার।বিয়ের পর তোর মাকে নিয়ে গিয়েছিলাম।সেই সময় নিজের ক্যামেরা ছিলোনা বলে অনেক কিছু মিস করে ফেলছি। তাই কাল রাতে তোর জন্য এটা কিনেছি। ক্যামেরাটা নিয়ে ভালো করে দেখে নিলাম।অরুকে বলেছিলাম এরকম একটা ক্যামেরা নিতে।কিন্তু ওতো যাচ্ছেনা আর।অরু যখন যাচ্ছেনা আব্বুকে নিতে এখন কোনো সমস্যা নাই।তাই বললাম, তুমি যাবে আমার সাথে।এবার কোনো কিছু মিস হবেনা।অরুর হঠাৎ এতো জ্বর চলে এসেছে যে সে নাকি সে যেতে পারছেনা।আর চার্মিলোকে কোনোদিন দেখেনি। ওর সাথে ফেসবুকে পরিচয়।
আব্বু দাঁড়ি চুলকাতে চুলকাতে বললেন,তোইতো বলছিস পিকনিকে যাচ্ছিস।এখন শুধু তুই আর চার্মিলো?তাও ফেসবুকে পরিচয়।চাইনিজ টা কেরে?আমি গেলে তোরা মন খুলে এনজয় করতে পারবিনা।তবে আমি তোর চাইনিজ ফ্রেন্ড আশা অব্ধি অপেক্ষা করছি। মনে মনে বললাম,আমাদের জেনারেশনে ফেসবুকে বন্ধু কেন আব্বু,ভালোবাসাও ফেসবুক থেকে চ্যাটিং করতে করতে হয়।যেমন আমি আর অরু।না দেখেই দুজন দুজনকে কতো ভালোবেসেছি।অরুর কথা আব্বুকে আর বললাম না।ওখানে আমি আর অরু কতো প্লেনিং করে রেখেছিলাম।এখন সব ভেস্তে গেলো।
মিথ্যে বলেছি বলে দুঃখিত আব্বু।আমি নিজেও দেখেনি।আজ প্রথম দেখবো।মেয়েটা আমাকে তার পরিবারের গল্প বলেছে,কলেজের বন্ধুদের গল্প বলেছে।তিন মাস যাবত সে আমাকে বেস্টফ্রেন্ড ভেবে আসছে।মাঝেমধ্যে আমিও ওকে আমার শখের কথা বলছি।এইরকম বোকাসোকা মেয়েদের সাথে একা যাওয়া বিপদ।আব্বু কিছু একটা বলতে চাইছিলেন কিন্তু বলতে পারলেন না চার্মিলোটার কারণে। চার্মিলো চলে এসেছে।সম্পূর্ণ পর্দানশীন মহিলা।বাবাকে দেখে সালাম দিলেন। কিন্তু বাবা বোকার মতো দাড়িয়ে রইলেন। তারপর কিছুটা বিচলিত হয়ে বললেন, হাব ভাব ভালো না মা,চল কেটে পড়ি। আমি ব্যাগ নিয়ে বসা থেকে উঠতে যাবো তখন চার্মিলো কানে কানে ফিসফিস করে বললেন,অরু কোথায়?অরুর জায়গায় তোর আব্বু কেন? কন্ঠটা খুব পরিচিত মনে হলো।আমি ঘামতে ঘামতে বললাম,অরু আসেনি।
তখন চার্মিলো বললেন, কোথায় যাচ্ছিস গাঁধি।এতোদিন শাসন দেখেছিস,শাসনের পিছনে লোকানো ভালোবাসা দেখবি এবার।তোরতো অনেক দিনের ইচ্ছে বাবাকে নিয়ে কক্সবাজার ঘুরতে যাওয়ার।সুযোগটা দ্বিতীয়বার আর পাবিনা। এবার বুঝতে পারলাম গলার স্বরটা আসলে চার্মিলোর না স্বরটা মায়ের।আমি আবার বসে পড়লাম। চার্মিলো বাবাকে বললেন,একটু সাইডে চাপুন।আজকাল বাসেও অঘটন ঘটে।মেয়ের নিরাপত্তা দরকার। স্বাধীনতা দিয়ে দিয়ে মেয়েটার মাথা খেয়েছ।আজ ও সত্যি সত্যি তোমার মুখে চুনকালি মাখতে অরুর সাথে দেখা করতে যাচ্ছিল।ভাগ্যিস ফেইক আইডি থেকে ওর বেস্টফ্রেন্ড হয়ে ওর মনের কথাগুলো জেনেছি। আব্বু আম্মুর দিকে তাকিয়ে অদ্ভুতভাবে হাসলেন,তারপর বললেন, কি ভেবেছ?গাধির গাধামির কথা আমি জানিনা?
অরুর কথা আমিও জানি। কাল রাতে তোমার কারণে অরুর আর তোমার মেয়ের ব্রেকআপ হয়েগেছে।অরু চাইছিলনা তুমি ওদের সাথে যাও। আমি আব্বুর দিকে তাকালাম কিন্তু আমি কিছু বলার আগে আব্বু বলল, জীবনসঙ্গীর ক্ষেত্রে হলেও ফেসবুককে একটু ছাড় দে মা।জীবন সঙ্গীটা বাস্তব জগত থেকে বেঁচে নে। অরু নামক যে ছেলেটাকে বিয়ের প্রপোজ করতে তুই কক্সবাজার নিয়ে যাচ্ছিস সেই আইডিটাও তোর এই পঞ্চাশোর্ধ আব্বুর ফেইক আইডি। বাস চলছে।আমি মাঝখানে শিশুর মতোই অবলা হয়ে ভাবছি।কেন যে অপরিচিত আইডি গুলোর সাথে এতো কাছের সখ্যতা গড়ে তুলেছিলাম।