অহমিকা

অহমিকা

আদিল সাহেব বিয়ে করেছেন বড় লোকের মেয়ে এটা তার জন্য অনেক গর্বের ব্যাপার। বারবার এই কথাটা মনে করিয়ে দেয় আদিল সাহেবের স্ত্রী ডালিয়া, ডালিয়া আদিলকে সবসময় বলে আমার মত মেয়েকে স্ত্রী হিসেবে পেয়েছ এটাই তোমার ভাগ্য৷ আমাকে বিয়ে করার জন্য এই শহরের নামকরা লোকরা ভীড় জমাইছে শেষে কি না তোমাকে আমি বিয়ে করলাম। তোমাকে ভালোবেসে ছিলাম বলে আমার মত কোটিপতির মেয়ে তোমার বউ। ডালিয়ার এমন অপমানজনক কথা শুনে আদিল মাথা নিচু করে ফেলে, সে মনে মনে ভাবে আসলেই আমার ভুল হয়েছে ধনীর দুলালীকে বিয়ে করা।

ছুটির দিন হওয়াতে আজ ডালিয়াকে শপিংয়ে নিয়ে যেতে হবে, মধ্যবিত্ত পরিবার আদিলের, প্রতি সাপ্তাহে ডালিয়া শপিং করে। সব টাকা আদিলের দিতে হয় না, ডালিয়া তার বাবার কাছ থেকে টাকা নিয়ে আসে। শপিং করে বাসায় আসার সময় গাড়ি জ্যামে আটকা পড়ে, পিচ্চি একটা মেয়ে বয়স নয় দশ হবে, গাড়ির কাচে টোকা দিচ্ছে।
ডালিয়া কাচ নামিয়ে বলে,

এই কি চাস রে ফালতু যত্তসব, যেখানেই বড় লোক মানুষ দেখবে হাত পাতবে, তোদের কি লজ্জা করে না হাত পাততে, আর কখনো যদি আমার সামনে এসে হাত বাড়িয়েছিস হাতে থুথু দেবো। আপা আমি ভিক্ষুক না, আমি ফুল বিক্রি করি, আপনি আমাকে এভাবে কথা শুনাইলেন। আরে যা তো ওই একি হলো, তোদের আর কি আত্মসম্মান আছে সেটা আমি ভালো করেই বুঝি, এখন পঞ্চাশটা টাকা দিলে খুশি হয়ে যাবি।

মেয়েটার চোখের কোনে জল চিকচিক করছে ডালিয়ার আচরণে, সেই দিকে ডালিয়ার আক্ষেপ নেই, তার নজরে গরীবদের কোনো আত্মসম্মান নেই, মন নেই তাদের কষ্ট নেই। ডালিয়ার দৃষ্টিকোন থেকে গরীব মানুষ মানুষ না। শপিং করে বাসায় আসলে ডালিয়ার শাশুড়ী এসে বলে, বউমা প্রতি সাপ্তাহে এতো টাকার শপিং না করলে হয়না, তুমি মধ্যবিত্ত পরিবারের বউ হয়েছ এখন আমাদের মত মানিয়ে চলতে চেষ্টা কর।

শুনেন, আপনাদের ফকিন্নি মার্কা নজর নিয়ে আপনারা থাকেন, আমাকে উপদেশ দিতে আসবেন না আমি আপনাদের মত নিচুতলার মানুষদের মনমানসিকতায় বড় হইনি, আমার বাবার অনেক টাকা দুই হাতে খরচা করছি যখন যা চেয়েছি আমার বাবা আমাকে দিয়েছে, এখনো আমি বাবার থেকে টাকা নিয়ে আসি, আপনার ছেলে কয় টাকা বেতন পায় চাকরি করে, মাত্র ষাট হাজার টাকা, আমার তো প্রতি মাসে পঞ্চাশ ষাট হাজার টাকা শপিং পার্লার আর বন্ধুদের সঙ্গে রেস্টুরেন্টে খেয়ে চলে যেতো।

ডালিয়ার শাশুড়ী নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থেকে ধীর পায়ে চলে গেলো, আদিল নির্বিকার হয়ে ডালিয়ার কথা শুনছে, সে ভুল করেছে, বড়সড় ভুল এই ভুলের মাশুল তাকে সারাজীবন দিতে হবে। আদিলের বড় দুই ভাই তাদের বউদের নিতে সুখী, আদিলের ভাবীরা অনেক ভালো শাশুড়ীকে শ্রদ্ধা সম্মান করে, আর ডালিয়া আদিলের মাকে শাশুড়ী মা বলে কোনদিন তোয়াক্কা করে না। দুপুরে যে যার মত ঘুমাচ্ছিলো, ডালিয়া টিভিতে মেকাপ শো দেখছিল এমন সময় দরজায় ঠকঠক করে নক হলো, ডালিয়া উঠে যায় না, বারবার নক করছে রাগে ফুসে দরজা খুলে দেখে এক ভিখারিনী দাঁড়িয়ে আছে।

আম্মা কিছু সাহায্য করবেন? নাই নাই যাও এখান থেকে, সময় পেলো না, আম্মা কিছু সাহায্য করবেন। দেন না কিছু, আপনারা না দিলে কি খামু আমরা। ভিখারিনীর কথায় ডালিয়ার মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো, সে শুরু করলো চিৎকার চেচামেচি সবার ঘুম ভেঙে এসে দেখে ডালিয়া ভিখারিনী মহিলাকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করছে। মহিলা অসহায় ভাবে সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে যাচ্ছে। ডালিয়ার ঝা শাশুড়ী ডালিয়াকে কিছু বলার সাহস পেলো না, কিছু বললেই অপমানিত হতে হবে।

আজ ডালিয়ার ভাই আমেরিকা থেকে আসবে, সঙ্গে বউ নিয়ে আসবে, ডালিয়া এয়ারপোর্টে যাবে ভাই ভাবীকে রিসিভ করতে। অহংকারে ডালিয়া আদিলকে বলছে দেখবে আমার ভাইয়া ভাবী আমার জন্য কত কি নিয়ে আসবে, তোমাকেও কিন্তু বাদ রাখবে না, ওদের সাথে ভদ্রভাবে কথা বইলো।

ডালিয়ার ভাই রিশান আমেরিকায় বড় বিজনেস করবে তার জন্য এখনকার সব টাকা পয়সা নিয়ে যেতে আসছে। রিশান তার মা বাবাকে সঙ্গে নিয়ে যাবে আমেরিকায়। ডালিয়া তার বাবাকে বলল, তোমরা ভাইয়ার সঙ্গে চলে যাবে তাকে ধনসম্পদ সব দিয়ে দিবে, তাহলে আমার ভাগ দিয়ে যাও। ডালিয়ার বাবা বলল, তোর নামে একাউন্ট আছে সেখানে বিশ লক্ষাধিক টাকা রাখা আছে তুই সেই টাকা তুলে নিস। মানে কি তোমার ছেলেকে কোটি টাকার সম্পদ দিচ্ছো আর আমাকে মাত্র বিশ লক্ষ টাকা। রিশান, বলল, তোর জন্য এটাই বেশি, আমার বাবার টাকা আমার অধিকার সেখান থেকে তোকে যা দিয়েছি সেটাই অনেক।

রিশানের কথা ডালিয়া বুঝতে পারলো না, সে তার বাবার কাছে জানতে চাইলো তার ভাইয়ার কথার মানে কি।
ডালিয়ার মা ছিল রিশানদের বাসার কাজের মেয়ে, গ্রামের বাড়ি থেকে রিশানের বাবা ডালিয়ার মাকে কাজ করার জন্য নিয়ে আসছিলো, কিছুদিন পর জানতে পারে কাজের মেয়ে অন্তসত্তা, মেয়েটা অবিবাহিত ছিল, এইদিকে রিশান জন্মের পর ডাক্তার বলে দিছে রিশানের মায়ের আর সন্তান ধারনের ক্ষমতা নেই, তাই ডালিয়া জন্মানোর পর তাকে নিজের মেয়ের মত মানুষ করেছে রিশানের মা বাবা।

আজ ডালিয়াকে নিজের কাছে নিজেকে তুচ্ছ মনে হচ্ছে, সে এতদিন গরীব মানুষকে মানুষ মনে করেনি সে আজ জানতে পারছে সেও একজন গরীব মায়ের পেটের সন্তান, জারজ সন্তান সে। তার এতদিনের অহংকার চূর্ণ হয়ে গেছে, তার আত্ম অহামিকা ভেঙে তচনচ হয়ে গেলো।

ডালিয়া তার বাবার বাসা থেকে তখনি আদিলকে নিয়ে চলে আসলো, এসে রুমের দরজা বন্ধ করে আদিলের পা জড়িয়ে ধরে কান্না করছে, আদিল আমাকে তুমি ক্ষমা করে দাও, আল্লাহ আমার অহংকারের শাস্তি আমাকে দিয়েছে, আমি তো জারজ তুমি কি আমার সাথে সংসার করবে এখন। আমি তোমাকে ভালোবাসি তোমার বংশ পরিচয়ে আমার কি আসে যায়। প্লিজ আদিল তাহলে তোমার মা ভাই ভাবীকে বইলো না আমার বাবার পরিচয় নেই, আমি কাজের মহিলার সন্তান।

আদিল কখনো তার পরিবারকে বলেনি ডালিয়ার পরিচয়। এখন ডালিয়া সবার সাথে ভালো ব্যবহার করে সংসারের সব কাজ করে রাস্তাঘাটে গরীব মানুষেদের সঙ্গে ভালো আচরণ করে, তার অহংকার চূর্ণ হয়ে সে ভালো মানুষে পরিণত হতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত