বিশ্বাস

বিশ্বাস

আমার লিখালিখি, পাঠক পাঠিকা, এগুলো মিহি কখনোই সহ্য করতে পারতোনা। বারবার আমাকে বলতো “মেহরাব তোমার লিখালিখি, কোনো মেয়ের কমেন্ট, এগুলো কিচ্ছু আমি নিতে পারিনা। আমি চাই তোমার লাইফে স্রেফ আমি থাকবো। আমার সাথেই তুমি সারাদিন কাটাবা”।

আমি মুচকি হাসতাম। বলতাম- “আরে বোকা মেয়ে, তুমিই তো আমার ভালোবাসা। তুমিই তো আমার সব। কিন্তু ওগুলো ও আমি ছাড়তে পারবোনা”। ফেসবুকে টুকটাক লিখালিখি করার কারণে সাধারণত অনেক প্রপোজ পেতাম৷ এটা হয়তো প্রায় সব রাইটার’রাই পেয়ে থাকে। আর এটাই মিহি একদম সহ্য করতে পারতোনা। আমি খুব একটা পাত্তা দিতাম না ওগুলো। কারণ আমি ভালো করেই বুঝতাম ” লিখার প্রেমে পড়া, আর মানুষের প্রেমে পড়া দুইটা একদম ভিন্ন”। একদিন আমার কাছে “মায়া ইসলাম” নামের একটা আইডি থেকে মেসেজ আসে। মেসেজটা এমন ছিলো- “আপনার লিখা খুবইই খারাপ। কেনো যে এতো ফলোয়ার আপনার আমি বুঝিনা”।

মেয়েটার মেসেজ দেখে আমি হাসলাম। এই প্রথম কোনো মেয়ে আমাকে এভাবে বললো। মেয়েটার আইডিতে ঢুকলাম। কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিলাম ওর প্রোফাইল পিকের দিকে। কারো চেহারায় এত্তটা মায়া থাকে কিভাবে?? মনে হয় সৃষ্টিকর্তা বড্ড যত্ন করে বানিয়েছিলেন এই মেয়েটাকে। সত্যি বলতে আমার দেখা সবচাইতে মায়াবতী মেয়ে ছিলো “মায়া”। মায়ার প্রোফাইল থেকে বেরিয়ে আসলাম। কোনো রিপ্লাই দিলাম না ওর মেসেজের। রাতে আবারো আরেকটা মেসেজ আসলো- “শুনুন, এতোটা ভাব নেওয়ার মতো কোনো লিখা আপনি লিখেন না। আমার সাথে এসব ভাব টাব নিবেন না ওকে”? আমি মেসেজ দেখে আবারো হাসলাম। এবার রিপ্লাই দিলাম-

–আসলে ভাব না। লিখা নিয়ে একটু বিজি থাকিতো। তাই খুব একটা রিপ্লাই দেওয়া হয়না”।
– আমার সাথে এগুলো করা যাবেনা বুঝছেন?
– হু বুঝলাম।

তখন থেকেই মেয়েটা প্রায় প্রতিদিন আমাকে মেসেজ দিতো। আমি সব মেসেজের রিপ্লাই না দিলেও টুকটাক রিপ্লাই দিতাম। কেনো দিতাম জানিনা। হয়তো আমাকে ভাবওয়ালা না ভাবুক এজন্য। অথবা “পৃথিবীর সব ছেলেদের কাছে মায়াবতী মেয়েদের ইগনোর করাটা কষ্টকর” হয়তো এটার জন্য। আমি মিহিকে এমন কিছু নাই যেটা শেয়ার করতাম না। সবকিছু বলতাম। সবার আগেই বলতাম। মায়ার কথাটাও আমি মিহিকে বলেছিলাম। মায়ার পিক ও দিছিলাম মিহিকে। একদম ফ্রেশ মনে মিহিকে জিজ্ঞাস করলাম- “মায়া অনেক কিউট তাইনা”? মিহি আমার প্রশ্নের কোনো উত্তর দিলোনা। মেসেজ সিন করে অফলাইনে গেলো। আমি তখন ও বুঝতে পারিনি “ভালোবাসার মানুষটার কাছে অন্য কারো প্রশংসা শুনা কতোটা কষ্টের”।

ব্যাস এভাবেই চলতে থাকলো। কেটে গেছে প্রায় ৪মাস। এই চারমাসে আমার লিখা বা পাঠকদের নিয়ে মিহি তেমন কিছুই বলেনি। আমাকে আগের মতো ততোটা জোর দেয়নি ফেসবুক ছাড়ার জন্য। শুধু একটা কথাই বলতো-
“মেহরাব ফেসবুকটা মানুষের লাইফ না… এখানে এতোটা সময় টাইম দিওনা। নিজের ক্যারিয়ারের দিকে মন দাও”।
আমি মিহির কথাগুলো পাত্তা দিতাম না। কারণ আমি তখন ফেসবুক আর লিখালিখি নিয়ে এতোটাই ডুবে ছিলাম যে, আমার মাথায় অন্যকিছু ঢুকতোনা। মিহি আমাকে অনেকবার বলেছিলো- “মেহরাব তোমার ফেসবুক পাসওয়ার্ড আমাকে দাও”।

আমি দিতাম না। এটা নিয়ে ওর সাথে অনেক ঝগড়াও হইছে। কিন্তু আমার কথা হচ্ছে ” আমাকে বিশ্বাস করবেনা কিজন্য? যেখানে বিশ্বাস নেই সেখানে ভালোবাসা থাকে কিভাবে?” আর এসব পাসওয়ার্ড দেওয়া নেওয়া, এটা সেটা পিক চাওয়া, এগুলো আমার একদম পছন্দ না… ব্যাস শুরু হতো ওর সাথে ঝগড়া। আবার কিছুসময় পর মিহি নিজে থেকে এসেই সরি বলতো। মিহির এই গুণটা আমার অনেক অনেক ভাললাগে। হয়তো এই গুণটার জন্যই আমি মিহিকে এত্তটা ভালোবাসি”। একদিন রাত ২টায় মায়া আমাকে মেসেজ করে- “মেহরাব একটা কথা বলি”? আমি বুঝতে পারছিলাম সিরিয়াস কিছুই হতে যাচ্ছে। রিপ্লাই দিলাম-

-হু বলো। কি কথা??
-আমি জানি মেহরাব তোমাকে অনেক মেয়েই প্রপোজ করে। কিন্তু আমি ওইসব মেয়েদের কাতারে পড়তে চাইনা।

আমি একদম মনের গভীর থেকে বলছি “আমি তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি। আমি তোমাকে ছাড়া এখন অন্যকিছু ভাবতে পারছিনা”। আমি মায়ার প্রপোজটা পাত্তা দিলাম না… কেনো জানিনা আমার কাছে ৮-১০টা প্রপোজের মতোই এটাও একিইরকম লাগলো। কেনো একিইরকম লাগলো সেটার ও কারন আছে। মায়ার সাথে আমি এমনভাবে কোনো চ্যাট করিনি, বা এতোটা সময় ও কথা বলিনি যার জন্য মায়া আমাকে ভালোবাসা শুরু করবে। আমি কোনো রিপ্লাই দিলাম না… ব্যাস সিন করে রেখে দিলাম। যেখানে মিহিকে ভালোবাসি, সেখানে মায়া হোক বা পৃথিবীর সবচাইতে সুন্দর মেয়ে হোক। মিহির জায়গাটা অন্য কাউকে দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না।

পরেরদিন আর মায়ার কোনো মেসেজ পেলাম না। একদিন গ্যাপ দিয়ে রাত ১টায় মায়ার আবারো একটা মেসেজ-
“মেহরাব, তুমি হয়তো অন্য সব মেয়েদের মতোই আমাকে মনে করলে… আমার কি ছেলের অভাব?? এত্ত ছেলে আমাকে প্রপোজ করে, কিন্তু আমার মন তো কাউকে চায়না। তুমিই একমাত্র… যাকে মন থেকে ভালোবেসে ফেলেছি। আমি জানি তুমি আমার এই কথাটাও পাত্তা দিবানা। আমি এটাও জানি, তুমি আমাকে কখনোই ভালোবাসবেনা। তাই ডিসিশন নিলাম “যেখানে তোমাকেই পাবোনা, সেখানে আমার নিজেকে রেখেও লাভ নাই… ভালো থেকো”।

মায়ার প্রথম কথাটা আমি বিশ্বাস করলাম। ওর ছেলেদের অভাব হওয়ার কথা না৷ যে টাইপের মাত্রাতিরিক্ত সুন্দর মেয়ে, ছেলেদের লাইন লেগে থাকবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু মায়ার ২য় কথাটা আমি বিশ্বাস করলাম না।
এসব ফিল্মি ডায়লগ এর আগেও আমাকে বহুজন দিছে। “তোমাকে ছাড়া বাঁচবোনা। আমি সুসাইড করবো। এই করবো, সেই করবো, হ্যান থ্যান এগুলো আমি কখনোই বিশ্বাস করিনা… বরং এগুলো শুনলে আমার হাসি পায়। আমি মায়ার এই মেসেজটাও সিন করে রেখে দেই। ফেসবুক থেকে বের হয়ে মিহিকে কল দিলাম। মায়া আমাকে প্রপোজ করছে এটা জানালাম। মিহি কথাটা শুনে চুপ করে রইলো। বললাম- “কিছু বলবেনা মিহি”? একটা দ্বীর্ঘশ্বাস নিয়ে মিহি বললো-

– মেহরাব আমি আর এগুলো নিতে পারছিনা? তুমি কেনো সবার থেকে আমাকে আড়াল করে রাখো? কেনো নিজেকেই বা আড়াল করে রাখো? কেনো মায়াকে বলে দিচ্ছোনা আমি তোমার গার্লফ্রেন্ড। কেনো???
মিহির প্রশ্নের কোনো উত্তর দিতে পারলাম না। সত্যি বলতে ফেসবুকে আমার নিজের ব্যাক্তিগত এবং প্রিয় জিনিষগুলো আমি কখনোই কারো সাথে শেয়ার করিনা। নিজের পিক, ফ্যামিলি, লাইফস্টাইল, মিহি, সবকিছুই আড়াল করে রাখি। কেনো জানিনা কারো সাথে শেয়ার করতে ইচ্ছা হয়না। তারপরেও ডিসিশন নিলাম মায়াকে মিহির কথা সব বলে দিবো। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম রাত ২টা ৩০মিনিট। ঠিক এই মুহুর্তে মায়াকে কল বা মেসেজ করাটা ঠিক মনে করলাম না। ভাবলাম ঘুম থেকে উঠে সকালে সব বলা যাবে। সকাল ৯টা… ফোনের শব্দে ঘুম ভাংলো। চোখে ঘুম নিয়েই ফোনটা ধরলাম। ওপাশ থেকে একটা মেয়ে কন্ঠ কানে আসলো- ” হ্যালো মেহরাব ভাইয়া”? ঘুম জড়িত কন্ঠেই উত্তর দিলাম-

-হ্যা মেহরাব ভাইয়া। কে বলছেন আপনি”?
-ভাইয়া আমি রিয়া। মায়া আপির ছোট বোন”।

রিয়া আমাকে কেনো কল দিলো ঠিক মাথায় আসছিলো না। রিয়া আবারো বললো- “ভাইয়া আপি গতকাল রাতে অনেকগুলো স্লিপিং পিল খাইছে। আপির অবস্থা বেশি ভালোনা। আমরা তাকে এখন হসপিটালে নিয়ে আসছি। আপির সব ফ্রেন্ডদেরকে আমি কল দিয়ে জানাচ্ছি। আপনার কথা লাস্ট কয়েকদিন আপির মুখে অনেক শুনছি… তাই ভাবলাম আপনকেও জানাই”। কথাটা শুনে একটু আগেই চোখে লেগে থাকা রাজ্যের ঘুমটা আর রইলোনা। বিছানা থেকে উঠে বসলাম। কিছু বলার আগে ভাবলাম এটা মায়ার হয়তো কোনো চালাকি হতে পারে। একদম তাড়াহুড়ো করা যাবেনা। ঠান্ডা মাথায় কথা বলতে হবে… আমি রিয়াকে ২টা প্রশ্ন করলাম- “ওর অবস্থা এখন কেমন? একটু ভিডিও কলে মায়াকে দেখা যাবে”??

-হ্যা ভাইয়া যাবে। দাঁড়ান আমি আপনাকে এখন ই কল দিচ্ছি !!

ঠিক ২মিনিট পর রিয়া আমাকে ভিডিও কল দিলো। আমি রিসিভ করলাম। ভিতরটা ধুক করে উঠলো। চোখগুলো মুহুর্তেই ঝাপসা হতে শুরু করলো। আমি দেখলাম একটা বেডে মায়া সেন্সলেস হয়ে শুয়ে আছে। ওর হাতে মুখে অনেক কিছু লাগানো ছিলো। বেডের পাশে দেখলাম কয়েকজন নার্স দাঁড়িয়ে আছে। একদম স্তব্ধ হয়ে গেলাম এটা দেখে। আমি না চাইতেই আমার চোখ থেকে একফোঁটা পানি টুপ করে বিছানায় পড়লো। কেমন যেনো নিজেকে এই পৃথিবীর সবচাইতে অপরাধী মানুষটা মনে হচ্ছে। মায়ার এই অবস্থার জন্য শুধুমাত্র আমি দায়ি। শুধুমাত্র আমি। এই প্রথম আমি অনুভব করলাম ” আমার মনের ভিতর মায়ার জন্য “মায়া” নামক জিনিষটা কাজ করছে” !! ফোনটা কেটে বিছানায় অনেক্ষণ বসে রইলাম। চোখ থেকে তখনো পানি পড়ছে। ভাবলাম “একটা মানুষকে কিভাবে এতোটা ভালোবাসা সম্ভব”? কতোটা ভালোবাসলে মানুষ নিজের জানটা দিয়ে দিতে পারে। কতোটা ভালোবাসলে??

আমি রিয়াকে একটু পর পর কল দিয়ে মায়ার খুজ নিতে থাকি। এর ভিতরে মিহি আমাকে অনেকবার মেসেজ করলেও রিপ্লাই দেইনি। কিভাবে দিবো? কিভাবে দেওয়া সম্ভব?? আমার জন্য ওইদিকে একটা মানুষ মরে যাচ্ছে, আর আমি এদিকে প্রেম করবো…?? দুপুর ২টার দিকে রিয়া কল দিলো। ধরলাম। রিয়া বললো- “ভাইয়া আপির মাত্রই জ্ঞান ফিরেছে। সবার আগে ও তোমার সাথেই কথা বলতে চাচ্ছে”। কথাটা শুনে ভিতরটা কেমন করে উঠলো। জ্ঞান ফিরার পর প্রথম আমার সাথেই কথা বলতে চাইছে? বললাম-
“ওর কাছে ফোনটা দাও”।

মায়ার কন্ঠটা শুনার জন্য আমি পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম। একটা মানুষ আমার জন্য মরতে গেছিলো এটা ভাবলেই আমার শরীরটা শিউরে উঠছে বারবার। রিয়া ফোনটা মায়ার কাছে দিলো। মায়া খুবই আস্তে করে বললো- “মেহরাব” আমি বড় একটা দীর্ঘশ্বাস নিলাম। মায়ার কন্ঠটা শুনে খুব কান্না পাচ্ছিলো আমার। চুপ করে রইলাম… কোনো কথা বললাম না। আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম ওপাশ থেকে মায়া অবিরাম কান্না করছে। কান্না জড়িত কন্ঠে খুব আস্তে করে আমাকে দুইবার বললো- “ভালোবাসি”। “ভালোবাসি”। ঠিক এই মুহুর্তে আমার জায়গায় অন্য কোনো ছেলে থাকলে কি করতো আমি জানিনা। কিন্তু আমি বরাবরের মতো এবারো চুপ করে রইলাম। এবার চুপ করার সঙ্গে আমার চোখের পানিও ছিলো…!!

তারপর কেটে গেছে প্রায় ২০ দিন। মায়া হসপিটাল থেকে বাসায় আসলো। কিন্তু ডাক্তার বলে দিছিলো মায়াকে যাতে কোনোভাবেই কোনো কষ্ট দেওয়া না হয়। সবসময় যাতে হাসিখুশি রাখা হয়। আমি আমার আগের অভ্যাসটা বদলাতে পারলাম না। “কাউকে সব বলে দেওয়ার অভ্যাসটা ভীষণ রকমের বাজে”। আমি মিহিকে কল দিয়ে মায়ার বিষয়ে সব বললাম। রিয়ার কল থেকে শুরু করে সব। আমার কথাগুলো শুনে মিহি রাগলোনা… আবার কোনো কথাও বললোনা। হয়তো অভিমান করেছে। “অভিমানী মানুষরা সবসময় কথা বলেনা”। মিহি সব কথা শুনেই ফোনটা কেটে দিলো। আমি বুঝতে পারলাম মিহি এখন কান্না করবে। ও কান্না করার আগে এভাবেই কিছু না বলে তাড়াতাড়ি ফোনটা রেখে দেয়…!!

এই কয়েকটা দিন আমি মায়াকে অনেক সময় দিতে লাগলাম। এর ভিতর মিহি আমাকে কল দিয়ে অনেকবার ওয়েটিং পাইছে। যেটা ও আগে কখনোই পায়নি। স্বাভাবিক ভাবেই বুঝতে পারছিলাম ” মিহির কাছ থেকে আমি দূরে সরে যাচ্ছি। ওর বিশ্বাসটা হারিয়ে ফেলছি”। কিন্তু আমার এগুলোর চাইতেও এখন মায়ার সুস্থ হয়ে উঠাটা জরুরী ছিলো। মায়া। যে মেয়েটা আমার জন্য নিজের জীবন দিতে গেছিলো…!! প্রায় আরো এক সপ্তাহ পর সকাল ৭টায় মায়ার নাম্বার থেকে আমার কাছে কল আসে। এতো সকালে মায়া আমাকে কখনোই কল দেয়না। বুঝলাম সিরিয়াস কিছু। ধরলাম। কোনো হ্যালো না বলেই মায়া সরাসরি প্রশ্ন করলো- “মিহি কে”? কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না। বারবার মনে হচ্ছিলো বলে দেই ” মিহি আমার ভালোবাসা”। কিন্তু পরক্ষনেই মনে হলো “যদি আবার সুসাইড করতে যায়”? আমি আমতা আমতা করে বললাম-

-মায়া কি হইছে? এতো সকালে এসব প্রশ্ন কেনো?

-মেহরাব, একটু আগে মিহির সাথে কথা হইছে আমার। মিহি আমাকে মেসেজ দিয়ে বললো ও নাকি তোমার গার্লফ্রেন্ড। আমি বিশ্বাস করিনি। ও আমাকে তোমার আর তার কলের অনেকগুলো স্ক্রিনশট দিছে। আমিও তাকে অনেকগুলো স্ক্রিনশট দিয়ে বলছি এসব আমার কাছেও আছে। কিন্তু এসব স্ক্রিনশটের চাইতেও আমি তোমাকে বেশি বিশ্বাস করি মেহরাব। আমি তোমার মুখেই সত্যিটা শুনতে চাই”। আমি আবারো চুপ করে রইলাম। আমার চুপ থাকা দেখে মায়া বললো-

-মেহরাব প্লিজ। অন্তত আজকে চুপ করে থেকোনা। আমি সত্যিটা জানতে চাচ্ছি। তুমি কি সত্যিটা বলতে ভয় পাচ্ছো? ভাবছো আমি আবার সুসাইড করবো কি’না? আমি ওইদিন হসপিটালে আমার আব্বু আম্মুর চেহারা দেখেছি মেহরাব। আমি দেখেছি ওরা আমায় কতোটা ভালোবাসে। তাই এসব সুসাইড আমি আর কখনো মাথায় আনবোনা। তুমি সত্যিটা আমাকে বলো”।

মায়ার এই কথাটা শুনে আমি একটু শক্তি পেলাম। সরাসরি বললাম- “মিহি আমার ভালোবাসা। আমি মিহিকে ভালোবাসি”। কথাটা শুনে মায়া ১মিনিট চুপ করে থাকলো। আমাকে ২টা প্রশ্ন করলো- “আমাকে আগে বলোনি কেনো? আমাকে ভালোবাসোনি কখনো”?? “হসপিটালে যাওয়ার আগ অবধি বলিনি কারন আমার মনে হয়েছিলো অন্য সবার মতো তুমিও রেসপন্স না পেয়ে চলে যাবে। আর পরে বলিনি ভয়ে। যদি আবার সুসাইড করতে যাও?? আর ভালোবাসা? হুম ভালোবাসি তোমায়। অনেক ভালোবাসি। কিন্তু সেটা বন্ধু হিসাবে। মিহির জায়গাটা আমার পক্ষে কাউকে দেওয়া সম্ভব না”। ব্যাস কথাটা শুনেই মায়া কলটা কেটে দেয়।

মায়া ফোনটা রাখার পর মিহিকে কল দিলাম। ধরলো। প্রথম শব্দটা ছিলো- “কুত্তার বাচ্চা আমাকে ফোন দিলি কেনো?? আমি কি উত্তর দিবো বুঝতে পারছিলাম না। প্রথমবার মিহি আমাকে গালি দিচ্ছে। তাও আবার চিৎকার করে। মিহি আবারো চিৎকার করে বললো- “কত্ত বড় সাহস ওই মেয়ের। আমাকে বলে আমি না’কি থার্ড ক্লাস মেয়ে। তুই থাক তোর ওই সুন্দর মায়াকে নিয়া। মায়া তো আমার চাইতে সুন্দর তাইনা? তুই ওরে নিয়াই থাক। আমাকে আর কক্ষনো কল দিবিনা”।

আমি বুঝতে পারলাম খারাপ কিছু হতে চলেছে। মিহির এতোটা রাগ আমি আগে কখনো দেখিনি। আস্তে করে বললাম- “মিহি আমার কথা শুনো। ভুল বুঝিওনা”। এবার আরো জোরে কান্না করতে করতে চিল্লায়া উঠলো- ” চুপ কর তুই। শালা হারামি। কতো ভালোবাসছিলাম তোকে। আর তুই? ওই মেয়েকে আমি স্ক্রিনশট দেওয়ার পরেও আমার কথা বিশ্বাস করেনি। বরং উল্টো আমাকে তোদের কলের স্ক্রিনশট দেখাইছে। তুই কিভাবে পারতি অন্য একটা মেয়েকে এতোটা টাইম দিতে? কিভাবে পারতি?? তুই তোর মায়াকে নিয়েই ভালো থাক। আমার ধারে কাছেও আর আসবিনা”।

আমি কিছু বলার আগেই মিহি ফোনটা কেটে দেয়। আমি ঠিক তখন ও বুঝতে পারিনি ওইটাই মিহির সাথে আমার শেষ কথা বলা হবে। আমি মিহির কন্ঠটা ওইদিন ই শেষবারের মতো শুনেছিলাম। মায়ার সাথে কলে কথা বলার স্ক্রিনশট দেখেই হয়তো অনেক কষ্ট পেয়েছিলো মিহি। কিন্তু মিহি কিভাবে জানবে “এগুলো শুধুই একটা অসুস্থ মানুষকে সুস্থ করার জন্য ছিলো। একটা মৃত্যু ফেরত মানুষকে হাসিখুশি লাইফে ফেরানোর জন্য ছিলো। তাও আবার সেই মানুষটা, যে আমার জন্যই মরতে যাচ্ছিলো !! ওই সকালটার পর কেটে গেছে প্রায় ৭৩০টা সকাল। মানে ২টা বছর। ওই সকালটার পর আমার জীবনে আর কখনো সকালটা সুন্দর হয়নি।

এই দুই বছরে বহুভাবে ট্রাই করেছিলাম মিহির সাথে একটু যোগাযোগ করার। পারিনি। কোনোভাবেই পারিনি। ফেসবুক ডিয়েক্টিব। নাম্বার, ইমো, হোয়াটসঅ্যাপ, সব ব্লক করা। অবশ্য ওর কাছের একটা ফ্রেন্ড থেকে জানতে পারি আমার সাথে ব্রেক নেওয়ার ১সপ্তাহ পরেই না’কি মিহি নতুন একটা রিলেশনে যায়। তাও আবার শুধুমাত্র আমাকে ভুলার জন্য। সেই রিলেশনটাও না’কি ৭মাসের উপর টিকেনি। সেটার কারণ ও আমি। মিহি না’কি সারাদিন আমার কথাই এটা সেটা বলতে থাকতো। কোন প্রেমিক তার প্রেমিকার মুখে এক্সের নাম বারবার সহ্য করবে বলুন??
আর মায়া? মায়া অবশ্য আমাকে ব্লক দেয়নি। কিন্তু আর কোনো মেসেজ ও দিতোনা আমায়। মায়ার আইডিতে দেখলাম ” সিজান” নামের একটা ছেলের সাথে রিলেশনে গেছে। ভালোই আছে ওরা।

কিন্তু আমি?? আমি জানিনা কখনো আর ভালো থাকতে পারবো কি’না। আমি জানিনা আগের মতো হাসতে পারবো কি’না। লিখতে পারবো কি’না। আমি এটাও জানিনা “মিহি আসবে নাকি না”। কিন্তু আমি এটা জানি বিশ্বাস জিনিষটা ভীষণ রকমের মারাত্মক হয়। ভীষণ রকমের। বিশ্বাস গড়তে অনেকটা সময় লাগে। আর যদি সেটা ভুল করেও একবার ভেঙে যায়, তাহলে সেটা আর কখনোই আগের মতো জোড়া লাগেনা। জোড়া লাগানো যায়না। কখনোই না…!!

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত