অনেক মেডিকেল চেকআপ করেছি ঔষধ ও খেয়েছি কিন্তু কোন ভাবেই কাজ হচ্ছে না । বিয়ের পাঁচ বছর পেরিয়ে গেল অথচ মা হতে পারলাম না। আর দশজন মেয়ের মত আমিও স্বপ্ন দেখি ছোট একটা পুতুলের। একজন মেয়ে কখনোই পরিপূর্ণ হতে পারেনা যতক্ষণ পর্যন্ত সে মা না হয়। তারমানে আমি এখনো অপূর্ণাঙ্গ রয়ে গেছি! এর থেকে বড় দুঃখের বিষয় আমার কাছে আর কিছুই না।
যদিও আমার হাজব্যান্ড কখনোই এই বিষয় নিয়ে আমাকে কিছু বলেননি তবু মাতৃ হৃদয় আমার বারেবারে কেঁদে ওঠে! তবে আমি হাল ছাড়িনি। আশা-আকাঙ্ক্ষা দুটোই আমাকে আঁকড়ে ধরে রেখেছিল। আমি আরো বহু বছর অপেক্ষা করতে পারি শুধুমাত্র একটি রাজপুত্রের আশায়! কিছুদিন পর যখন জানতে পারলাম, আমি মা হতে চলেছি। তখন যে আমার কি পরিমান আনন্দ হয়েছিল সেটা আমি কাউকে বোঝাতে পারবো না। এমনকি নিজেকেও না ।মনে হচ্ছিল যেন, দুনিয়ার সব থেকে বেশি সুখী মানুষ একমাত্র আমি। তবে ডাক্তার আমাকে বলে দিয়েছিল,
– আমার আর আমার বেবি দুজনের কন্ডিশন ভীষণ খারাপ!
এবং এই বাচ্চাটা দুনিয়াতে আনা খুবই কঠিন ব্যাপার। তবুও যদি আমি চেষ্টা করি তাকে দুনিয়ার মুখ দেখানোর, তবে আমার ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি ! শুধু তাই না এরপর সারা জীবনের মত আমাকে মা হওয়ার আশা ছেড়ে দিতে হবে। মানে এটাই আমার ফার্স্ট ও লাস্ট সন্তান হিসেবে মেনে নিতে হবে! শর্ত যদি ও কষ্টকর তবে আমি মেনে নিয়েছিলাম সানন্দে! যাই হোক, দীর্ঘ চেষ্টা প্রচেষ্টার পর এক পুত্রের মুখ দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম আমি! এ যেন সত্যিই রাজপুত্র! আমার রাজপুত্র! কিন্তু কথায় আছে না, সুখ কপালে নেই যার দুঃখ ফিরে বারবার! আমার বেলায় ঠিক এরকমটাই ঘটেছিল।
ছেলের দু বছর পূর্ণ হওয়ার পরের ঘটনা:- একদিন আমরা কোন এক অনুষ্ঠান থেকে অনেক রাত করে ফিরছিলাম। হঠাৎ আমাদের গাড়িটি এক দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। আমি ছাড়া প্রত্যেকেই মারাত্মকভাবে আহত ছিলো! আমাদের সাথে আমার ছোট টিও ছিল। আমরা মোট চারজন ছিলাম। আমার ছেলে, আমি আমার হাসবেন্ড আর আমার ছোট ভাই । ওরা তিনজনই মারাত্মকভাবে আহত ছিল। নিকটস্থ একটি হসপিটালে নিয়ে তিনজনকেই অ্যাডমিট করা হয়। আমি বাসায় যোগাযোগের অনেক চেষ্টা করেছি কিন্তু পারিনি। রাত এত গভীর ছিল যে কারো সাহায্যের আশা করাও ভুল। আমার ছেলে আর ভাই দুজনের অবস্থা ছিল গুরুতর ।যেহেতু দুজনেই ছোট । ডাক্তার বললেন,
– দুই ব্যাগ O+ রক্তের দরকার ইমারজেন্সি। কিন্তু এত রাতে আমি রক্ত কোথায় পাব ? হঠাৎ আমার মনে পড়ে গেল আমার রক্তের গ্রুপ O+। আমি ডাক্তারকে গিয়ে নিজের রক্তের গ্রুপের কথা বলে সবকিছু পরীক্ষা করিয়ে নিলাম। কিন্তু ডাক্তার বললেন,
– দুজনের অবস্থা খারাপ।
আর দুজনেরই একসাথে রক্ত লাগবে । আমার একার রক্ত দিয়ে তো হবে না । আমি নিজেও অসুস্থ হয়ে পড়বো । এই মুহূর্তে রক্ত না দিলে দুজনের কাউকে বাঁচানো যাবে না। আর যদি দুজনের একজনকে রক্ত দেওয়া হয় তাহলে আরেকজন কে বাঁচানো যাবে না। আর এত রাতে রক্তের ডোনার খুঁজে পাওয়াও সম্ভব না! আমি দোটানার মাঝে পড়ে গেলাম। কাকে রক্ত দিয়ে বাঁচাবো ?একমাত্র ভাইকে নাকি বহু অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে পাওয়া সন্তানকে! বলা হয়নি, আমার ছোট ভাই কিন্তু আমাদের চার বোনের একমাত্র ভাই । আমার বাবার ছেলের স্বপ্ন ছিল খুব! আর সেটা আমার জন্মের পর থেকেই । কিন্তু ছেলের আশা করতে করতে আরো তিন মেয়ে হয়ে গেল। অবশেষে ছোট বোনের সাত বছর পেরোনোর পর ভাইয়ের জন্ম হয়। বোঝাই যাচ্ছে এই ছেলের প্রতি বাবা-মায়ের কতটা ভালোবাসা থাকতে পারে! চার মেয়ের পড়ে একটা মাত্র ছেলে । অনেক আদরের ছোট ভাই আমার।
ছোট ভাইয়ের যদি কিছু হয় নির্ঘাত আব্বু হার্ড স্ট্রোক করবেন! আর আম্মু হয়তো মরেই যাবেন । কিন্তু আমার ছেলে??? ওর যদি কিছু হয় আমার হাজবেন্ড কে আমি কি জবাব দিব ? আর আমি কি নিয়ে বাঁচব? এখন কি আমি নিজের কথা ভাববো ? নাকি বাবা-মায়ের কথা ভাববো ? নিজের সন্তানকে বাঁচাবো ? নাকি নিজের একমাত্র ছোট ভাইকে বাঁচাবো? অনেক চেষ্টার পর আমার ছোট ভাইয়ের জন্ম হয়েছে। আর আমার অনেক কষ্ট ,যন্ত্রণা ,অপমান ,অপেক্ষা, ব্যাথা, বেদনার পরে আমার ছেলের জন্ম হয়েছে । কাকে বাঁচানো উচিত আমার?
অনেক ভাবার পর একবার মনে হল , আমি আমার ভাইকেই রক্ত দিব। আমি নিজের কথা আর ভাববো না। এত টেনশনের মাঝে আমি আমার হাজবেন্ডের কথা ভুলেই গেছিলাম! আমার হাজবেন্ডের অবস্থাও ছিল গুরুতর। চোখের জল ঝরাতে ঝরাতে ভাইকে দিয়ে দিলাম রক্ত। যখন আমার শরীর থেকে এক ফোঁটা এক ফোঁটা করে রক্ত আমার ভায়ের শরীরে প্রবেশ করছিল হয়তো তখন আমার ছেলের শরীর থেকে একটু একটু করে প্রাণটা বেরিয়ে যাচ্ছিল!
সে রাতে আমি একত্রে আমার প্রিয় দুজন মানুষকে আমার জীবন থেকে হারিয়ে ফেলেছিলাম! আমি কিন্তু আমার ভাইকে রক্ত দিয়েছিলাম। আমি স্বার্থপর ছিলাম না । আমি স্বামী সন্তান সব ভুলে গিয়েছিলাম আমার ভাইয়ের জন্য ,আমার বাবা মার জন্য। শুধু তাদের কথা ভেবে। আমি অনুভব করতে পারি সেই কষ্ট । “তখন তো আমি গর্ভস্থ গোপন আজন্মার কথা জানতামই না।”