ওই অন্ধ ট্রেন তো নয়টায়। দশটায় না। আর নয়টা তো বেজেই গেলো। কী হবে এখন?” আমি আপুর কথা শুনে চমকে উঠলাম, ” হায় হায় বলিস কি আপু?” আপু বললো, ‘যা সত্যি তাই বললাম।” আমি টিকিটটা হাতে নিয়ে দেখলাম আসলেই তো। ট্রেন ছাড়ার সময় তো নয়টায়ই লিখা। তাহলে কালকে দশ টায় দেখেছিলাম কিভাবে। অহ আল্লাহ দশটা ছিল ক্রয়ের সময়।
আমি তাড়াহুড়ো করে আমার দুই ফ্রেন্ড নিরব আর তামিমকে নিয়ে বের হলাম। আমরা এসেছিলাম ঢাকাতে বেড়াতে আমার আপুর বাসায়। আজ নেত্রকোনা যাবো ট্রেনে করে। আমরা দৌড়িয়ে দৌড়িয়ে রেললাইনের দিকে যাচ্ছি। রেল স্টেশনের কাছাকাছি আসতেই দেখলাম ট্রেন যথারীতি প্রথম লাইনে এসে প্রবেশ করেছে। ছাড়বার আগে বারবার ভুভু শব্দ করছে। টিকিট ক্রয় করা মানুষেরা ছুটাছুটি করছে। বেশ কয়েকটা যাত্রীবাহী বাস ওখানে সাড়ি করে দাঁড়িয়ে আছে।
ঠিক তখন একটা ঘটনা ঘটলো। দেখলাম সামনে একটা রিকশার পেছনে কোন গাড়ি সজোরে ধাক্কা দিয়েছে এবং রিকশাতে একজন বৃদ্ধা ছিল যে মাটিতে পড়ে গেলেন। পড়ে গিয়ে মাথা থেকে রক্ত বেরোচ্ছে বৃদ্ধার। আমরা বেশ কয়েকজন ওখানে দৌড়াদৌড়ি করে গেলাম। অনেকে মিলে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছি। কেউ কেউ বলছে, ” বড্ড কষ্টের ব্যাপার দেখছি দেখি, হাসপাতালে না নিতে পারলি পরে বৃদ্ধার প্রাণটা না আবার চলে যায়। ”
আমরা সবাই বেশ কষ্ট পেলাম ব্যাপারটা দেখে। কেউ কেউ বৃদ্ধার শরীরে একটুখানি ধরেছে। কিন্তু বৃদ্ধাকে হাসপাতালে নিতে কারো আগ্রহ দেখা গেল না। যে যার মত আফসোস করতে করতে চলে যাচ্ছে। আমাদেরও যাওয়ার সময় হয়েছে। ট্রেন ছেড়ে দিল দিল। ট্রেন ধীরগতিতে এগোচ্ছে আমরা দৌড়ে গিয়ে ট্রেনে উঠলাম। সে কি নীরব উঠেনি। সে কোথায় গেল তাহলে? আশেপাশে কোথাও দেখতে পেলাম না বলে বাধ্য হয়ে ট্রেন থেকে নামতে হলো। ট্রেন থেকে নেমে আমি আর তামিম মিলে প্রথম প্ল্যাটফর্মের দিকে এগিয়ে গেলাম। তখন দেখলাম নিরব ওই বৃদ্ধাকে কোলে করে নিয়ে একটা ভ্যানে উঠছে। আমরাও সেদিকে ছুটে গেলাম। কিছুটা দূরের একটা হাসপাতালে ভর্তি করানো হলো বৃদ্ধাকে। ডাক্তারের সাথে সাক্ষাৎ হলে তিনি বললেন আর কিছুক্ষণ পর আসলে হয়তো বাঁচানো সম্ভব হতো না।
কিছুক্ষণ পর নিরব আমাকে বললো, “বুঝলি আকাশ সবসময় উদ্যোগের দিকে তাকিয়ে থাকতে নেই মাঝেমধ্যে আচমকা নিজেকেও উদ্যোগী হতে হয়। জানিস আমার খুব ভালো লাগছে রে।” আমি অবাক হয়ে নিরবের মুখের দিকে তাকালাম। সত্যিই তো নিরব যদি তখন এই ভাবে না এগিয়ে আসত হয়তো এই বৃদ্ধার প্রাণটাই চলে যেতো। কথা কম বলা এই নীরব ছেলেটার মনের ভেতর যে মনুষত্বের এরকম পরিপূর্ণ বিবেক জাগ্রত হয়ে আছে এতদিন বুঝিনি বলে নিজের প্রতি আফসোস হলো। ট্রেনের টিকিট গুলোর টাকাগুলো না হয় গেলে গেছে কিন্তু এই যে মহৎ কাজের সাথে সম্পৃক্ত হতে পারলাম তা তো ত্রিভুবনের সেরা কাজগুলোর একটা কাজ ভালো ভাগ্য না হলে এসব কাজে শরিক হওয়া যায় না।
রাত ৯ টা বাজে। বৃদ্ধার আত্মীয়দের খবর দেয়া হয়েছে সকাল নাগাদ আসবেন ওরা। আমরা তিনজন বসে আছি বৃদ্ধার বেডের পাশে। দক্ষিণমুখী জানালাটা দিয়ে বাইরের আকাশ দেখা যায়। আমি জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। বাইরে তাকাতেই দেখলাম আকাশের নীল সমুদ্রের সৌন্দর্য ফুটে উঠেছে জ্যোৎস্নায়। তারা গুলো যেন মুগ্ধ চোখে এ দিকে তাকাচ্ছে। দূরের গ্রামগুলোর উপরে অন্ধকার খেলা করছে। জানা-অজানা কতো বিলীন অস্তিত্ব এখানের হাওয়ায় ভেসে বেড়ায় তার হিসেব কেউ রাখেনি। এইসব নীরব নিস্তব্ধ চারিপাশ যেন আরো বেশি তাগিদ দেয় ভালো কাজ করার জন্য। মনে মনে বললাম, “একটা ভালো কাজের মাধ্যমে সৌন্দর্য দেখার যে চোখের সৃষ্টি হয় তা আর কোনভাবে হয়তো পাওয়া যায় না। মানবপ্রেম তাইতো এত মূল্যবান জিনিস। বিরল জিনিস।”