একটি কালো মেয়ে

একটি কালো মেয়ে

মিতু নামের মেয়েটা আজো সেঁজে-গুজে বসে আছে। চোখে কড়া করে কাজল দিয়ে, ঠোঁটে লিপস্টিক দিয়ে, হাতে চুড়ি পরে এভাবে বসে থাকাটা বিরক্তিকর। তাও যদি কেউ এসে ওকে পছন্দ করে ভাড়া নেয় সেজন্য এভাবে বসে থাকা। সে মনে মনে দোয়া করে, “আল্লাহ, কেউ যেন আসে আর আমারে নিয়া যায়।” বরাবরের মতোই তার দোয়া বিফলে গেল। কেউ এসে ওকে পছন্দ করলো না। সারারাত এভাবে বসে থেকে সে বাইরে চলে এলো। হাসু আপা তখন অন্যদের টাকাগুলো হিসাব করছেন। উনার কাছে যেতেই উনি মিতুর দিকে তেড়ে এলেন, “কী রে? আইজকাও কেউ তোরে নিল না?” নতমুখে মাথা নাড়ে মিতু।

“কাইল্লা, এই সুরত নিয়া আইছস মাগীগিরি করতে।” মিতু চুপচাপ হাসু আপার কথাগুলো শুনে। হাসু আপা চেঁচিয়ে বলতে থাকেন, “তুমি এইখানে রাজরাণী হইয়া বইসা থাকবা আর অন্য মাইয়াগোর ভাগের থন তোমারে টাকা দিমু ভাবছো। বাইরো এইখান থাইক। আর এমুখো হইস না।” মিতু আর চুপ থাকতে পারে না। বাচ্চাদের মতো কেঁদে দেয়। সে কান্নায় হাসু আপার মন গলে না। তিনি টাকা গুনায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন। মিতু কিছু বলার চেষ্টা করে। সুযোগ পায় না। টাকা গোনা শেষ হলে হাসু আপা আবারো মিতুকে ধমকান, “কী হইল? এখনো যাস নাই?”

“মায়ের ওষুধের টাকাটা।”
“কী কইলি? মাগীগিরি কইরা কয় টাকা আইনা দিছস? আইছে রে! মায়ের ওষুধের টাকা নিতে। যা ভাগ।”

মিতু আর কিছু বলতে পারে। ছেঁড়া জুতা ছাড়াই বাইরে বেরিয়ে আসে। হাতের তলা দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে সে হাঁটে। জুতা ছাড়া হাঁটতে গিয়ে পায়ের তলা কেটে যায়। মিতু খুঁড়িয়ে হাটে আর বলে, “আল্লা, ক্যান? ক্যান করলা আমার লগে এমন? আমি কালা এইটা আমার দোষ? কালা কইরা পাঠাইয়া এই ধান্ধায় ক্যান নামাইলা? আমি তো মায়ের ওষুধের টাকাটাও জোটাইতে পারি না। তুমি আমারে মরণ দ্যাও, মরণ দ্যাও।”

রাস্তার ধারের সোডিয়াম বাতিগুলোর আলোয় মিতুর ভেজা চোখ কারো নজরে পড়ে না। এরকম কোনো এক বাতির নিচে একটা ভ্রাম্যমান চায়ের দোকানে ঝুলানো বনরুটি দেখে ও জিভ চাটে। আঁচলের গিট খুলে দেখে তাতে পড়ে আছে একটা পাঁচ টাকার নোট। টাকাটা আবার আঁচলেই রেখে দেয়। হাজারো ঝড়-ঝাঁপটায় এই টাকা সে খরচ করে না। এতে ওর ছোট ভাইয়ের রক্ত লেগে আছে। টাকা ছাড়াই সে দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। দোকানদারকে বলে, “ভাই, আমারে একটা রুটি দিবেন। খুব ক্ষিধা লাগছে। সারাদিন কিছু খাই নাই।” “ক্ষিধা লাগছে। সারাদিন কিছু খাও নাই। আমার এইটা কী লঙ্গরখানা যে চাইলেই খাওন দিমু। নিজের রাস্তা মাপ।” মিতু তবুও দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। একটা পিচ্ছি এসে তাকে ধাক্কা দিয়ে দোকানের সামনে থেকে সরিয়ে  দেয়। তাল সামলাতে না পেরে রাস্তায় লুটিয়ে পড়ে মিতু।

“ও মাগো!” বলে ককিয়ে ওঠে সে। তার কপালটা ফেটে গেছে। ঠোট কেটে গেছে, হাঁটু-কনুই ছিলে গেছে। আর শহুরে বাতাসে দাড়াতে পারে না মিতু। সে ব্রিজ পাড়ি দিয়ে ওর ঝুপড়ির পথে পা বাড়ায়। হাজার হাজার মানুষের হাজারো আবাসিক এলাকার হাজারো বস্তির একটা জলতরঙ্গি বস্তি। এই বস্তিতে মানবেতর দিনাতিপাত করে মিতু। মা ছাড়া এই পৃথিবীতে আর কেউ নেই ওর। সেই ছোটবেলা বাবা এই শহরে কাজ খুঁজতে এসেছিলেন। আর ফিরে যাননি। বাবাকে খুঁজতে এসে মিতুও আর ফিরে যেতে পারেনি। শহরের একটা মিছিলে ওর ছোট ভাই নয়ন প্রাণ দিল। কতইবা বয়স ছিল ওর ভাইয়ের। আট কিংবা নয়। শহরের মানুষগুলো ওর সেই ভাইকেও ছাড় দিলো না। পিটিয়ে মেরে ফেললো। বিচার চাইতে গিয়ে মিতুকে হতে হলো বেশ্যা। দেহ দিলো কিন্তু বিচার পেলো না। সেদিনও মিতু চিৎকার করে কেঁদেছিল। কেউ সে কান্না শুনেনি।

বস্তিতে যখন মিতু পা রাখে বস্তিটা তখন প্রায় জেগে উঠেছে। অনেকেই মিতুকে দেখে। অনেকেই দেখে না। যারা দেখেছে তারা দেখেই চোখ নামিয়ে নেয়। যারা দেখেনি তারা আগ্রহ দেখায় না। একেতো মিতু কুচকুচে কালো, তার সাথে যোগ হয়েছে ওর অভুক্ত কাঠের মতো দেহ। কাজেই পুরুষদের তার প্রতি আগ্রহ দেখানোর প্রয়োজন নেই। এদের মাঝে কেউ কেউ আবার বড় বড় চোখে মিতুর দিকে তাকিয়ে থাকে। লোভে তাদের চোখ চকচক করে ওঠে, জিভ লকলক করে ওঠে। তাদের কাছে মেয়েদের রঙ, সাইজ, বয়স এগুলোর কোনো মূল্য নেই। মেয়ে মানেই এক টুকরা মাংসপিণ্ড। যেভাবেই হোক এই মাংসে তাদের তৃপ্তি মেটানো চাই। মিতু এদের এড়িয়ে চলে।
ঝুপড়ির বাইরে থেকে মায়ের খুকখুক কাশি শুনেই মিতু বুঝতে পারে মায়ের হাঁপানির টানটা আবার বেড়েছে। একদৌড়ে মায়ের কাছে ছুটে যায় সে। ছেঁড়া কাঁথা জড়ানো রুগ্ন একজন মহিলা বিছানায় শুয়ে কাতরাচ্ছে। মিতুকে দেখে তিনি কান্না জুড়ে দেন। কাঁদতে কাঁদতে বলেন, “মা রে, আমার লাইগা তুই আর কত করবি? আমি বাঁচুম না।”

“তোমার কিচ্ছু হইবো না। আমি তোমারে মরতে দিমু না।”
“হুনো মেয়ের কথা। ডাক্তার কইলো না আমার মরণব্যাধি। চাইলে কি আর মরণ ঠেকান যায়?”
“চুপ করো তো। তোমারে কয়দিন কইছি এমন কথা কইবা না। আমি তোমারে যেমনে পারি বাঁচামু।” মিতুর ধমকে মিতুর মা চুপ হয়ে যান। বিয়াল্লিশ বছর বয়সে এসে ভর করেছেন যুবতী মেয়ের উপর। মেয়ের অনুগ্রহে এতদিন বেঁচে আছেন। নাহলে খাদ্যনালীর ক্যান্সারে কবেই পৃথিবী ছাড়তেন।

মিতুর মা শক্ত কিছু খেতে পারেন না। আবার গরম কিছুও খেতে পারেন না। মিতু তাই বেরোবার আগে মায়ের জন্য খিচুড়ি রান্না করে। মাকে খিঁচুড়ি খাইয়ে নিজে ভাত খেয়ে তবে বেরোয়। চালের কন্টেইনারে উঁকি দিতেই মিতু দেখে সেখানে এক মুঠ চাল পড়ে আছে। মনে মনে বলে, “আইজকাও সারাদিন না খাইয়া থাকা লাগবো।” কন্টেইনারের চাল দিয়ে মায়ের জন্য খিচুড়ি বানিয়ে একটা প্লেটে রেখে দেয়। গোসল সেরে মাকে খিচুড়ি খাইয়ে নিজেও বেরিয়ে পড়ে। পেছন থেকে মায়ের গোঙানির শব্দ শুনে সে থামে না। মা নির্ঘাত খাওয়ার কথা বলছেন। সারাদিন মিতু এ গলি ও গলি করে। অনেকের কাছেই প্রস্তাব দেয়। গায়ের রঙের জন্য হোক কিংবা রুগ্ন দেহের জন্য হোকস ওকে কারো পছন্দ হয় না। ক্ষুধার যন্ত্রণায় ও চলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। উপায় না দেখে তাকে আবারো হাসু আপার কাছে যেতে হয়। ওখানে গেলে অন্তত কিছু খাবার মিলতে পারে। হাসু আপার কাছে যেতেই হাসু আপা বিরক্ত হন। ঝাঁঝের সাথে বলেন, “তোরে না আইতে নিষেধ করলাম। ক্যান আইছস?”

“আপা, আপনে আমারে বাঁচান। আমি তো না খাইয়া মইরা যামু।”
“তো মইরা যা। কে আটকাইলো?”
“আমার মা চিকিৎসা পাইবো না।”
“তাতে আমার কী?”
“দয়া করেন আপা। আমার উপরে দয়া করেন।”
“না। তুই আমার ব্যবসা ডুবাবি। তোরে আমি কোনো টাকা দিমু না। টাকা রোজগার কইরা আমার হাতে আইনা দেয়। তখন দেখমুনে।”

মিতু হাসু আপার পা জড়িয়ে ধরে। হাসু আপা ব্যাপারটা সহ্য করতে পারেন না। মিতুকে লাথি দিয়ে পা থেকে সরিয়ে দেন আর গালাগালি করতে থাকেন, “করছস কী? মাগী, নিজের নোংরা শরীর দিয়া আমারে ছুইছস। এই কে কোথায় আছস? এই মাইয়ারে তুইলা ফালাই দে।” দুজন সুঠামদেহী পুরুষ মিতুকে তুলে নেয়। মিতু হাসু আপাকে অনেক কাকুতি মিনতি করে কিন্তু সে কান্না উনার হৃদয়ে পৌছায় না। আকাশে মেঘ ডাকছে। মিতুর মনের প্রতিক্রিয়া যেন আকাশে গুমোট হয়ে ধরা দিচ্ছে। কালো আকাশের আঁধারীতে মিতু হাঁটতে থাকে। গায়ে এতটুকু জোর বাকি নেই। মিতুর পা টলে, মাথা ঘুরে। সে কিছুক্ষণ হেঁটে বসে পড়ে। আবার হাঁটে। এভাবে ত্রিশ মিনিটের পথ সে তিন ঘণ্টায় অতিক্রম করে।

ঝুপড়ির সামনে অনেক মানুষের ভীড় দেখে মিতুর বুকটা ছ্যাত্‌ করে ওঠে। কোনোমতে পা চালিয়ে ঝুপড়িতে এসেই মায়ের লাশ দেখতে হয় তাকে। নিজেকে আর সামলে রাখতে পারে না মিতু। মাথা ঘুরে পড়ে যায়। ভীড় করা মানুষগুলো মিতুকে ধরাধরি করে বিছানায় শুইয়ে দেয়। দর্শনার্থীরা মিতুর মায়ের লাশ যত দ্রুত সম্ভব দাফনের জন্য নিয়ে যায়। কেউ একজন ফতোয়াও দেয়, “মরা মাইনশেরে এতক্ষণ জমিনে রাখতে নাই। আজাব হয়।” দুইজন বৃদ্ধমহিলা লাশটাকে গোসল দিয়ে কাফন পরিয়ে দেয়। চারজন লাশটাকে কাঁধে করে বস্তির মসজিদে নিয়ে যায়। জানাজা পড়িয়ে তাড়াতাড়ি দাফনের কাজ সেরে ফেলা হয়। মেঘ ডাকার শব্দে কেঁপে ওঠে মিতু। চারপাশের জমাট অন্ধকারে মিতুর বুঝতে কষ্ট হয় না এখন গভীর রাত্রি। মায়ের জন্য ওর মনটা কেঁদে ওঠে, “কত অক্ষম আমি। মায়ের লাইগা ঔষধও কিনতে পারলাম না।” কাঁদতে কাঁদতে হাঁটুমুড়ে মাটিতে বসে পরে মিতু।

বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। একটু পরপর মেঘও ডাকছে। সেই বৃষ্টিতেই মিতু বাইরে বেরিয়ে আসে। বৃষ্টির জল আর ওর চোখের জল একাকার হয়ে যায়। হেঁটে হেঁটে মিতু ব্রিজের ওপরে চলে আসে। ব্রিজের পাশে অনেকক্ষণ হেলান দিয়ে বসে থাকে। মাঝে মাঝেই শব্দ করে কাঁদে। শেষরাত হওয়ায় ওর কান্না কেউ শুনে না। কাঁদতে কাঁদতে হঠাৎই ওর চোখ মুখ শক্ত হয়ে ওঠে। সে ওঠে দাঁড়ায়। এক দৌড়ে ব্রিজ থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ব্রিজের চৌকিদার কিছু একটা পড়ার শব্দে দৌড়ে ব্রীজের উপর আসে। সে দেখে একটা কুচকুচে কালো শরীর নদীর পানিতে ভাসছে। “নদীর পানিতে ওইটা কার লাশ? খবরটা পুলিশে দিতে হইবো।” চৌকিদার থানার দিকে ছুটে। আর একটি কালো মেয়ের লাশ ভাসতে ভাসতে চলে যেতে থাকে নদীর স্রোতে। এভাবেই মিতুর মতো অকালে হারিয়ে যায় হাজারো কালো মেয়ে।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত