মার্কেটিং ডিপার্টমেন্টের সবচেয়ে ভদ্র ছেলেটাকে সেদিন দেখলাম নিতুর পিছন পিছন অনুসরণ করছে। আমার অবাক হওয়ার সীমা নাই। ঐ ব্যাটারে এত ভালো ভাবি আর ও কিনা শেষপর্যন্ত। বাহ বাহ বাহ। ক্যাম্পাসের পাশেই নিতুর বাসা। নিতু এতটাই সুন্দর যে সিনিয়র-জুনিয়রদের অধিকাংশই তাকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছে একবার না একবার। অসংখ্য ছেলে তাকে ফলো করে। তাই বলে আদনান? আচ্ছা বোঝাচ্ছি দাঁড়া। বিকেলে খেলার মাঠের পাশ দিয়ে হাঁটার সময় দেখলাম ছোট একটা পলিথিনে কি যেন নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে আদনান। আমি ডাক দিলাম, “ওই আদনান শুনে যা। ” ও আমার কাছে এসে বললো, “বলো ভাই। ”
– ভাই মানে তুই আমার সেম ব্যাচের। সবসময় ভাই ডাকলে ব্যাপারটা খ্যাত খ্যাত লাগে।
– না ভাই এমনি অভ্যেস আমার এটা। আমি বললাম, “আচ্ছা যাস কই”
– বাসায় যাই।
– আচ্ছা আজ তোর বাসায় যাব নিয়ে যা।
– আসলেই যাবা?
– হ্যাঁ আসলেই যাব এবং এখনি যাবো।
– আচ্ছা তাহলে চলো।
আমরা দুজনে ওর বাসার দিকে হেঁটে যাচ্ছি। কিছুদুর যাওয়ার পর বললাম একটা ভ্যান নিতে। কিন্তু ও বললো ভ্যান দিয়ে গিয়ে টাকা না ফুরিয়ে হাটলেই ভাল হবে। আর নাকি বেশিদূর নাই। আমি মনে মনে ওর প্রতি বিরক্ত হলাম। এতটা পথ আবার নাকি হাঁটবো। বাধ্য হয়ে হাঁটছি। আমি বললাম, “তা ব্যাপার কী? সেদিন দেখলাম নিতুর পিছন পিছন অনুসরণ করছিস? শেষপর্যন্ত তোকেও ওর পিছনে ঘুরতে দেখব কল্পনাও করিনি। ” ও কিছুটা হেসে বলল, ” কোথায় দেখেছিলে আর কার পিছনে? আমি বললাম,” কেন এখন কি ঢং করো মিয়া। নিতুর পিছে ঘুরো না? ও বলল,” নারে ভাই আমার এসবের সময় আছে নাকি? এসবের সময় নাই। ” কিছুক্ষণ পর পথ যখন আর শেষ হচ্ছিল না আমি বললাম তুই কি এই পথে প্রতিদিন এভাবে হেঁটে হেঁটে যাস নাকি? ও বললো হ্যাঁ। আমি মনে মনে বললাম এতটা পথ এতবার ও কিভাবে হাঁটে? ও কি মানুষ নাকি?
প্রায় ২৫ মিনিট হেঁটে ক্লান্ত হয়ে ওর বাসায় আসলাম। গ্রাম থেকে বেশ খানিকটা দূরে একটা আম বাগানের মধ্যে ছোট্ট একটা কুটির। এলাকার মহাজনদের কারো হয়তো পরিত্যক্ত কুটির এটা। এখানে আরো একটি পরিবার থাকে। ছোট্ট একটা পুবের কোণার রুমে আদনান থাকে। আমি এসেছি বলে খুব করে তাড়াহুড়ো করতে লাগল কিনা কি খাওয়াবে। আমি খেয়ে এসেছি বললেও ও দেখলাম জোর করে কি সব আয়োজন করতে শুরু করলো। চাল নেয়ার বস্তাটা তলানীতে হয়তোবা আর একদিন খাওয়া চলবে। একটা ডিমই নিচে রাখা ছিল এটা আমার জন্য ভাজি করতে লাগলো। আর ক্যান্টিনের অল্প টাকায় কেনা ডালটাও আমার সামনে রাখলো। কোমল করে আমায় বলল, “ভাই তোমায় কি খাওয়াবো জানিনে এই প্রথম এলে এর থেকে বেশী কিছু আয়োজন করা উচিত কিন্তু এখন করতে পারছিনে বলে আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত। ” আমি বললাম,” ধুর ব্যাটা এসব কি বলছিস? ”
আমি এতো বললাম কিন্তু ও আমার সাথে খেতে রাজি হলো না। আমি খেতে বসার পর ডিমটা মুখে নিতেই কেমন যেন একটা অসহ্যকর স্বাদ অনুভূত হলো। হয়তো পেঁয়াজ দেয়া হয়নি বা অন্য কোন কিছু দেয়া হয়নি চালও অনেক মোটা মোটা। ওর দিকে তাকিয়ে কোনোমতে খেলাম। খাাওয়ার পর কিছুক্ষণ ওর বিছানায় বসলাম। ওর বাসার জিনিস গুলো দেখছি। কয়েকটা মলিন শার্ট ঝুলে আছে পুরোনো দেয়ালটায়। সেগুলোই নিয়ম করে আদনান পড়ে। একটা ভাঙ্গা আলমারি সামনে রাখা।
বেশ কিছুক্ষণ ওর বাসায় থাকার পর রওনা দিলাম। ওর দুটো টিউশন আছে ক্যাম্পাসের দিকে। যথারীতি আবার পায়ে হেঁটে ওর বাসা থেকে ক্যাম্পাসে ফিরছি। আমি বুঝতে পেরেছি ভালভাবে যে তখন হয়তো ঠিক এভাবেই হেঁটে হেঁটে নিতুর পিছন পিছন যাচ্ছিল ও আর আমি ভাবলাম কী। পথে হেঁটে আসার সময় আদনানের বোন মনে হয় কল দিলো। আদনানকে বলতে শুনলাম,” কাল নাগাদ পাঠাবো টাকা টেনশন করিস না। আর আব্বাকে ওষুধটা কিনে দিস আজকেই। ”
আদনান অনেক কিছুই আমায় বলে নি অথবা আমি অনেক কিছুই জানি না তার ব্যাপারে। অথচ এভাবে নিরীহ হয়ে থেকে চুপি চুপি গুরু দায়িত্ব পালন করে বেড়ানো এই আদনানদের দেখে অনেক কিছুই শেখার আছে, অনেক কিছু। ক্যাম্পাসের কাছাকাছি চলে এসেছি। নানান রকম মানুষের চলাচল দেখা যাচ্ছে। সবাই ব্যস্ত। কেউ মনের সুখে ব্যস্ত অথবা কেউ সুখে থাকার ভান করে ব্যস্ত। সত্যিই কতো বিচিত্রিতায় ভরপুর এই দুনিয়া।