কতক্ষন ধরে খেয়াল করছি আমার পাশের সিটের ছেলেটা বেশ উসখুস করছে আর বার বার একটু সামনের দিকে তাকাচ্ছে। বাস ছেড়েছে মাত্র মিনিট পাঁচেক হলো আর এতো জলদি গন্তব্যর জন্য ব্যাকুল হতে দেখে আমি জিজ্ঞেস করলাম,
“কি ব্যাপার ভাই! বার বার সামনে দেখছেন যে? এতো জলদি তো বাস পৌঁছাবে না”
“আরে না ভাই সামনের সিটে আমার গফ বসে আছে তাই তাকাচ্ছি বার বার”
“ওহ আচ্ছা এই ব্যাপার! তো আপনি এখানে কেনো তাহলে? যান ওনার পাশে গিয়ে বসুন”
“সেটা পারলে কি আর এখানে বসতাম নাকি!”
“কেনো কি সমস্যা! তাইলে কি আমি গিয়ে ওইখানে বসবো? আপনি তারে এখানে ডেকে নিন?”
“আরে ভাই তা পারলে কি আর আপনাকে এতোক্ষণ বসতে দিতাম?”
কথাটা শুনে কেমন যেনো লাগলো! আমাদের কোনো কদরই নেই আজকাল কার পোলানের কাছে! আমার সিটেই নাকি আমায় বসতে দিতো নাহ! ভাবা যায়? তাও আমার থেকে কম হলেও তিন বা চার’বছর ছোট হবে ছেলেটা।
উৎসুক থাকায় আবার ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করলাম যে কোনো সাহায্য করতে পারি কিনা, “ভাই তাইলে সমস্যাটা কি? আমি কিছু করতে পারি?” “হ্যাঁ পারেন, আমার গফের পাশে যে মেয়েটা বসে আছে ওইটা ওর হবু ননদ! আপনি পারলে ওই মেয়েটারে সরিয়ে দিন” কথাটা শুনে মনে হচ্ছে আমি আর বাসে নেই! হ্যাঁ আমি নেই কারণ যে মেয়েটা ওর গফ সে আমার হবু বঁধু! আর পাশের সিটের মেয়েটা আমার বোন! মনে হচ্ছে ওর কথা শোনার পরে আমি মিনিট ক্ষানেক পাগল ছিলাম! না মানে ভাবা যায় বিষয়টা? মনে করেন আপনার পাশেই আপনার হবু বঁধুর বফ বসে আপনাকেই বলতেছে তাদের কথা বলার ব্যবস্থা করে দিতে তাও আপনার বোনের সাথে আপনাকে লাইন মেরে???
আর একটাও কথা বললাম না আমি, পা থেকে মাথা অবদি মাপছি ছেলেটাকে। মাথার চুলে তার কালার করা, চেহারা দেখলে মনে হয় একটু আগে ফেসিয়াল করে আসছে, গায়ে আমাদের জাতীয় শার্ট তার উপর আবার একটা লকেট ঝুলছে তাতে সবার এইচ অক্ষর যুক্ত! আরেহ, এইচ দিয়ে তো হিমার নাম। মানে ও আমার হবু বউয়ের নামের প্রথম অক্ষরের লকেট গলায় ঝুলিয়েছে! একটা ছেড়া প্যান্ট পরা তাও আবার পায়ের দিক থেকে ভাঝ করে প্রায় হাটু অবদি উঠানো! আহহ, পায়ে তাহার ফুল চন্দন! মনে হচ্ছে একটু আগে হালচাষ করে এসেছে। ভাবতেই অবাক লাগে হিমার মতো একটা মিষ্টি সুন্দরী মেয়ে এই ছেলের সাথে প্রেম করে! আর এখনো তাদের প্রেম চলতেছে! তাইলে কি বিয়ের দিন পালিয়ে যাওয়ার ফন্দি এটেছে নাকি ওরা! নাহ আর চুপ থাকা যাবে না, ছেলেটার কাছ থেকে খুটিনাটি জানতে হবে।
“তো ভাইয়া আপনার গফ তার ননদের পাশে বসা আর আপনি কিভাবে এখনো তারে গফ বলেন?”
“আর বইলেন ভাই, কোন শালায় যেনো আইসা আমার প্রেমের বারোটা বাজায় দিছে”
“ধুর মিঞা, গালাগালি কেন করেন! ভাল ভাবে বলুন”
“আরে ভাই আপনি রেগে যাচ্ছেন কেনো ভাই? আপনাকে তো আর বলিনাই”
“সে যাই হোক, এখন বলুন আপনার প্রেম কতদিনের?”
“আর প্রেম, প্রেম দিয়া কি করুম! কতদিন ধইরা পিছে ঘুরতাছি এখনো কিছুই করতে পারলান নাহ”
“মানে! কিছু করতে পারলেন না ঠিক বুঝলাম নাহ”
“আরে মিঞা আজকাল কি ভালবাসা আছে নাকি! খাওয়া হলেই চইলা যাইতাম”
চুপ হয়ে গেলাম আমি, কিছু বলতে পারছি না কারণ এখন কিছু বলতে নিলে আমি নিজেকে সামাল দিতে পারবো না। তাই চুপ থাকাই শ্রেয় বলে মনে হচ্ছে আমার আর কি বা বলবো ও যখন বলবে যে আমার হবু বঁধু ওর প্রাক্তন তখন মুখ রাখবো কই! তাই চুপ থাকাই ভাল। চুপচাপ বসে ভাবছি সপ্তাহ ক্ষানেকের ভিতর কি ঘটলো আমার সাথে! সেদিন দুপুরে হঠাৎ মা ফোন দিয়ে বলেছিলেন ছুটি নিয়ে বাড়ি ফিরতে কি যেনো সমস্যা হয়েছে তাই জন্য। আমিও কথা না বাড়িয়ে চলে গেলাম বাসায় কিন্তু যাওয়ার পরে দেখি সবাই ব্যাস্ত। আমি ঢুকতেই বললো গোসল সেরে জলদি খেয়ে নিতে। আমি সমস্যা কি হয়েছে জানতে চাইতেই ছোট বোন বললো
“আজ তুই শেষ!”
“মানে! আমি শেষ মানে কি?”
“তোর জন্য আজ পাত্রী দেখতে যাবে সবাই”
“মানে কি! আমার বিয়ের কথা চলছে আর আমি জানিনা?” ও ঘর মা এসে বললেন
“এতে জানা জানির কি আছে! তুই তো বলছিলি তোর কোন পছন্দ নেই তাই আমরাই যাচ্ছি পছন্দ করতে” আমি হা করে তাকিয়ে ভাবছিলাম তখন যে আমি আসলেই শেষ!
তারপর গেলাম হিমাদের বাড়িতে, একটা গাঢ় গোলাপি রঙের শাড়ি পরে ছিল মেয়েটা। টানাটানা চোখে কাজল দেয়া মেয়েটাকে দেখেই মায়ায় পরে গিয়েছিলাম আমি আর পরিবারের সবারই পছন্দ হয়েছিল ওরে। তারপর খুব জলদি করেই ঠিক হয়ে গেলো বিয়ে আর আজ যাচ্ছি শপিংয়ে। হ্যাঁ বিয়ের শপিংয়ে যাচ্ছি হিমাকে নিয়ে আর সাথে আমার ছোট বোন। আমাদের মফস্বল শহরে বাড়ি তাই শহরের দিকে যাচ্ছি বাস যোগে। আর এই বাসেই হলো বিপত্তি! কিন্তু আমি ভেবে পাচ্ছি না যে কি করবো! নিজের হবু বঁধুর সম্বন্ধে কারো কাছ থেকে এমন শোনা আমার জন্য মোটেই সুখকর ছিল না। তবে এটা ঠিক বুঝেছিলাম যে হিমাকে আমার পরিবার পছন্দ করে ভুল কিছু করেনি। এই বয়সের মেয়েরা আজকাল ভুলবশত ভালবাসায় জরাবে এটা অস্বাভাবিক কিছু নয় কিন্তু তার মধ্যে নিজেকে সংযত রাখা টাই আত্নমর্যাদার অধিকারী।
ভাবতে ভাবতে গন্তব্য পৌঁছে গেছি আমরা। বাস থেকে ছেলেটাসহ নেমেছি আমি, আমার সাথে ওই ছেলেটাকে দেখে হিমার বিন্দুমাত্র কোন অনুভূতি প্রকাশ পেতে দেখলাম না ওর চোখেমুখে। এক মুহুর্তের জন্য আমার ছেলেটার কথা মিথ্যে মনে হয়েছিল যে কি করে হিমা এতো স্বাভাবিক আছে এই ভেবে। কিন্তু পরক্ষনেই আমার বোন হিমাকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করলো, “ভাবি এই ছেলেটা?”
সিমিনের কথায় মাথা নাড়ালো হিমা। আর ওমনি, সিমিন গিয়েই এক থাপ্পড় লাগিয়ে দিলো ছেলেটার গালে! অবস্থা দেখে আমি কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে তাকিয়ে আছি…. আর ছেলেটা কিছু বলতে গিয়েও বলেনি কেন বুঝলাম নাহ, মানে বিষয়টা কি হচ্ছে তা কিছুই বোধগম্য হচ্ছিলো না আমার। সিমিন ছেলেটার উদ্দেশ্যে বলতেছে, “পরবর্তীতে তোরে আমার ভাবির আশেপাশে দেখলে তোর খবর আছে, যা যা সামনে থেকে যাহ” আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখছি আমার ছোট বোনটা এত আগ্রাসী আর এতো সাহসী! এভাবে রাস্তার মধ্যেই একটা ছেলের গায়ে চড় বসিয়ে দিলো!
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ওদের নিয়ে বসলাম পাশের কফিশপে আর তখনই সিমিনের কাছ থেকে শুনলাম ইতিহাস, ওই ছেলেটা নাকি অনেকদিন ধরেই হিমার পিছে লেগেছিল। ওদের মধ্যে খুব ভাল সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল কিন্তু ছেলেটা প্রায়ই হিমাকে জোর করতো বাজে সম্পর্কে যাওয়ার। হিমা এজন্য যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে বেশ কয়েকবার আর এখনো সেজন্যই পিছে লেগে আছে হিমার। পরিশেষে আমি সিমিনকে জিজ্ঞেস করলাম, “আচ্ছা তুই ওরে থাপ্পড় মারার সাহস কই পাইলি রে?” “এহেম এহেম, তোরা পাশে ছিলি তো তাই আর কি!”