আম্মা বাসায় ইফতারি বানাচ্ছে,ছোট বোনটা একটু পর পর রান্নাঘর থেকে কিছু একটা নিয়ে আমাদের সামনে দিয়ে হেঁটে হেঁটে খাচ্ছে,বড় দুইটা বোন আমাকে জোর করে দোকানে পাঠিয়ে দিলো তাদের পছন্দের নতুন কিছু ইফতারি নিয়ে আসতে,ওদের আবদার আমি কখনোই অবহেলা করতে পারতাম না,তাই দোকানে গিয়ে ওদের জন্য অনেক কিছুই নিয়ে আসতাম,আর আম্মা দেখলে আমাদেরকে অনেক বকা দিতো,বাসায় এতো ইফতারি থাকতে দোকান থেকে আবার আনতে হলো কেনো । আমি চুপ করে থাকতাম,কারন বোনদের রাত হলে টুকটাক ইফতারি খাওয়ার ইচ্ছে জাগতো,তখন ওরা এগুলো খেতো।
মা রোজ-রোজ বকা দিতো,আমার সাথে তোরা একটু কাজ করতে পারিস না,বড় হইলি,একটু কাজ তো শিখে নে। ওরা করতো না যে তা না,কিছুটা করতো,তবে সঠিকের চেয়ে ভুলটাই বেশি করতো,তখন মা আরেক বকা দিয়ে ওদেরকে রান্না ঘর থেকে বের করে দিতো। আর আমরা তিন ভাই-বোন মিলে আড্ডা দিতাম,আর একটু পর পর মাকে গিয়ে জ্বালাতান করতাম,মা এটা বানানো হয়নি? এটাও বানাও। মা একটা দীর্ঘশ্বাস পেলে বলতো,আচ্ছা বানাচ্ছি,তখন মাকে জড়িয়ে ধরতাম আমার লক্ষী মা বলে। মা একটা হাসি দিয়ে বলতো এবার ছেড়ে দে, অনেক কাজ।
এইতো ইফতারি খাওয়ার আগে আমার বোনরা তাদের পছন্দের খাবার থেকে কিছুটা আলাদা করে লুকিয়ে রাখতো,পরে তারাবির নামাজ পড়ে আমরা একসাথে খাবো বলে,সাথে অনেক গল্প,ঐদিকে মা রাতের খাবারের নতুন আয়োজন করতো।
উপরের গল্পগুলো আজ থেকে ৬ বছর আগের,তবে হ্যাঁ, আজকেও মা ইফতারি তৈরি করছে,ছোট বোনটা মায়ের সাথে একটু আধটু কাজ করছে,আমি বসে বসে বিরক্ত হচ্ছি,সময় একদম যাচ্ছে না। বড় বোনটাকে ফোন দিলাম,ফোন রিসিভ করে বললো, “ভাইয়া,কাজ করতেছি,সবার জন্য ইফতারি বানাচ্ছি,পরে কথা বলি?” বোনটা আজ ভীষণ ব্যস্ত, তাকে পরিবারের সব কাজ করতে হচ্ছে,দুইটা মিনিট কথা বলার মতো তার সময় হচ্ছে না,আমি বোনটাকে বললাম,আমার মামনীর কাছে ফোনটা দে কথা বলি,তারপর কিছুক্ষন ভাগনীর সাথে কথা বলে ফোনটা রেখে দিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাকে বলি, ”তোমার মেয়ে তোমার মতো হয়ে গেছে,খুব ব্যস্ত। ”
তারপর মেজো বোনটাকে ফোন দিলে সে প্রথমে রিসিভ করতে পারেনি,পরে রিসিভ করলে বলে, ”ইফতারি বানাচ্ছিলাম,তাই ফোনটা ধরতে পারিনি।” আমি বললাম আচ্ছা,”ভালো আছিস।” ওহ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, ”হুম ভালো আছি,আজকে প্রথম জিলাপি বানালাম,তেমন একটা ভালো হয়নি ”,কথাটা বলে ও কেমন যেনো কান্না করে দিলো। পরে বললো, ”এখন ব্যস্ত রাতে কথা বলবো। ” আমি ফোনটা রেখে দিই, আমার বোনের জিলাপি অনেক পছন্দের ছিলো,রমজানের দিনগুলোতে আছরের নামাজ পড়ে আমি ওর জন্য জিলাপি আনতে যেতাম,এমন একটা দিন নেই যে ওর জন্য জিলাপি আনতে যাইনি,এমনকি শুক্রবারেও নামাজ পড়ে আসার সময় বাজার হয়ে আসতাম ওর জন্য জিলাপি নিয়ে,আর ও আজকে নিজেই জিলাপি বানাচ্ছে,ওর কান্নাটা আমাকে হাজারটা গল্প বলে দিচ্ছে,সহ্য হয়নি। মায়ের পাশে গিয়ে কি বানানো হচ্ছে দেখছি।
ভোর রাত,আব্বা একটু পর পর এসে আমাদের তিনজনকে ডাকছে,একবার এসে পাখা বন্ধ করে দিচ্ছে,একবার এসে লাইট জ্বালিয়ে দিচ্ছে,একবার এসে মাথায় হাত বুলিয়ে ডাকছে,শেষ পর্যন্ত টেনেই তুলছে,অনেক কষ্ট করে উঠে কোনোরকম মুখ ধুয়ে টেবিলে গিয়ে বসতাম,মা বকা দিয়ে খাইয়ে দিতো।
আজ যখন বাবা ডাকলে ঘুম থেকে উঠি,তখন ফ্রেশ হয়ে বোনদেরকে কল দিই,ওরা উঠতে পারলো কিনা জানার জন্য,তখন বড় বোনটা বলে ও তরকারি গরম করছে,অনেক আগেই উঠলো। মেজো বোনটাকে ফোন দিলে ও বলে ভাইয়া সবাইকে খাবার দিচ্ছি,ছোটটা উঠলো?ওকে ডেকে নে। আমি আচ্ছা বলে ফোন রেখে ছোট বোনটাকে ডেকে তুললাম।
এইটা শুধু আমার পরিবারের গল্প না,এটা আমাদের সবার পরিবারের গল্প,সবার বোন একটা সময় বাবার ঘরে রাজকন্যা হয়ে থাকে,মায়ের আদর,বাবার? ভালোবাসা,ভাইয়ের আগলে রাখার ভেতরে তাদের জীবনটা ফুলের মতোই চলে যায়,কিন্তু একটা সময় আমার বোন অন্য কারো ঘরে যায়,অন্য কারো বোন আমার ঘরে আসে,এভাবেই একটা মেয়ে নিজের বাবার রাজপ্রাসাদ ছেড়ে অন্য একটা ঘরের সবটুকু দায়িত্ব নিজের মাথায় নিয়ে নেয়। যে কাজটা সে কখনো করেনি,তাও কত সুন্দর করে সে করে নেয়,যে সময়টায় তাকে তিন জনে টেনে ঘুম থেকে তুলতে পারতোনা,সে সময়টায় সে সবার আগে ঘুম থেকে উঠে যায়,যে সামান্য একটু কাজ করতে গিয়ে হাঁফিয়ে যেতো,সে আজ চুপচাপ সব কয়টা কাজ নিজেই একা করে।
এরা আল্লাহর এক অপরূপ সৃষ্টি,এদের সাথে কখনো খারাপ ব্যবহার করতে নেই,কখনোই না। এদেরকে সবসময় ভালোবেসে আগলে রাখতে হবে,এদের একটু আধটু কাজের ভুলকে হাসি মুখেই মেনে নিতে হবে । যতটা সম্ভব এদের সাথে বাসার কাজগুলো করতে হবে,অনেক কষ্ট হলেও এরা বলেনা যে আমার কষ্ট হচ্ছে আর পারছিনা,এই জিনিসটা আমার আপনাকে বুঝে নিতে হবে। এখন মোটামুটি আমরা সবাই বাসায়,সবাই সবার স্ত্রীকে কাজে সাহায্য করি,এতে আল্লাহ খুশি হবেন,সংসারে সুখ আসবে।
আমরা কখনোই এই অপরূপ সৃষ্টির সাথে খারাপ ব্যবহার না করি,ওদেরকে কষ্ট না দিই,ওদের সাথে জোর গলায় কথা না বলি,ওদেরকে সবসময় সম্মান দিই। মনে রাখতে হবে,আপনার ঘরে যে মেয়েটি এলো সে কারো সন্তান,কোনো ভাইয়ের বোন,কোনো বাবার রাজকন্যা। তেমনি আপনার বোনও অন্য কারো ঘরে। ভালো থাকুক প্রতিটা ভাইয়ের বোন,প্রতিটা সন্তানের মা।