ইফতার

ইফতার

কাল ইফতারে আমারে বিরিয়ানি খাওয়াবি বাবা কথাটা মনে পড়তেই দুটা চোখ ঝাপসা হয়ে আসে, এখনো কানে বাজে কথাগুলো নিজেকে কেমন যেন অপরাধী মনে হয়। সালটা ২০১৫ রমজান মাস। মাস্টার্স পাশ করেছি তিন বছর হয়ে গেল, এখনও কোন চাকরি-বাকরি হয় নি। শত চেষ্টার পরও একটা চাকরি পেলাম না। এখন এ দুনিয়াতে সবচেয়ে মূল্যহীন বস্তুটা হলাম আমি। এ লজ্জা শুধুই আমার…..

ছাত্র হিসেবে খারাপ ছিলাম না। স্কুল কলেজ প্রথম সারিতেই থাকতাম। একটা পাবলিক ভার্সিটি থেকে ১ম শ্রেণীতে অনার্স, মাস্টার্স শেষ করেছি। চাকরির জন্যও কম কষ্ট করি নি। সবই ভুয়া, এখন আর কেউ সার্টিফিকেট দেখে চাকরি দেয় না। কোন মামা-চাচা ছিল না, বাবা এত টাকাও ছিল না। আমার একটাই দোষ ছিল আমি সাধারণ কৃষক পরিবারের একটা ছেলে। আমি ছিলাম পরিবারের বড়। পাঁচ ভাইবোনকে পড়ালেখা করাতে গিয়ে বাবার বাড়িটা ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। একটাই আশা ছিল লেখাপড়া শেষ করে আমি পরিবারের হালটা ধরব। এখন ছোট দুইটা বোনের লেখাপড়াও বন্ধ হয়ে গেছে। বাবাও অসুস্থ হয়ে পড়েছেন আগের মত কাজ করতে পারেন না। আর এদিকে আমার চাকরি নেই।

মাঝে মাঝে টিউশনির টাকা থেকে দুএক হাজার টাকা বাড়িতে পাঠাই আবার কখনো পাঠাতেও পারি না। মা মাঝে মাঝে ফোন দিয়ে কেমন আছি জিজ্ঞেস করে। বাড়ির কথা জিজ্ঞেস করলেই বলে সবাই ভাল আছে, আমি যেন কোন চিন্তা না করি, আমিতো সবই জানি তারা কত কষ্টে আছে। লজ্জায় তখন কথা বলতে পারি না। শুধু চোখটা ভিজে যায়। ইচ্ছে করে চিৎকার করে কান্না করি। কিন্তু পারি না, ছেলেদের কান্না করতে নেই। স্কুল, কলেজ, ভার্সিটিতে আমার অনেক বন্ধু ছিল, কিন্তু এখন কোন বন্ধু নেই। কারণ বেকারদের কোন বন্ধু থাকে না।
কোন বন্ধুর সাথে দেখা হলেও এখন এড়িয়ে যায় পাছে আমি তার কাছে টাকা চেয়ে বসি।

ভিতরের আর্তনাদটা চেপে রেখে হাসি মুখেই দিনগুলো কেটে যায়। কাউকে মুখফুটে বলতে পারি না, কেউ শুনতেও চায় না। শুনার মত যে একজন ছিল তাকেও ধরে রাখতে পারি নি। অনেক স্বপ্নও ছিল। আমার সব স্বপ্নগুলোই আজ দুঃস্বপ্ন। নিম্নবিত্ত পরিবারে ছেলেদের এসব সাজে না। ইচ্ছে করে কোন এক সন্ধ্যয় অজানা কোন এক দেশে পাড়ি জমাই। কিন্তু পারি না মা-বাবা ভাই বোন দিকে চেয়ে। অনেকদিন হল বাড়িতে যাই না। কোন মুখে যাব আমার জন্য যারা শেষ সম্বলটুকু উজার করে দিয়েছে তাদের দুঃসময়ে আমি আজ নির্বাক দর্শক। মাকে বলেছিলাম চাকরি হলে তোমার জন্য মিষ্ট নিয়ে বাড়ি ফিরব।

আজ হঠাৎ বাবা ফোন করে জানাল মার শরীরটা অনেক খারাপ। মার কাছে ফোনটা দিতেই বলল বাবা বাড়িতে আসবি না? তোরে দেখতে খুব ইচ্ছে করছে আমি বলল আসব। আর তোমার জন্য কাল টাকা পাঠাব ডাক্তারের কাছে যেও আর শরীর ভাল না থাকলে রোজা থেকো না। মা বলল টাকা পাবি কই? (একমাত্র মা ই আমার না বলা কথা গুলোও বুজে নিত) আর কিছুই বললাম না। পরদিন একটা টিউশনিতে অগ্রিম কিছু টাকা চেয়ে মার জন্য পাঠালাম। দিন দিন মার শরীরটা আরো খারপের দিকে যাচ্ছে। কি করব বুঝতে পারছি না।

একদিন সকালে একটা প্রাইভেট কোম্পানি থেকে ফোন আসল আমার আমি ভাইভাতে সিলেক্টেড,(কয়েক মাস আগে একটা কোম্পানিতে ভাইভা দিয়েছিলাম ) আমার চাকরি হয়েছে। কথাগুলো যেন বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। চোখের কোনায় কয়েক ফোটা জল জমে গেল। প্রচন্ড খুশিতেও নাকি চোখে জল চলে আসে তাই হয়ত। সাথে সাথেই বাড়িতে ফোন দিলাম। এই প্রথমবার বাবাকে এত খুশি হতে দেখলাম। ভাই-বোন গুলো এটা ওটা নিতে বলল। সবশেষে মার সাথে কথা হল। মাকে বললাম মা তোমার জন্য কি আনব? মা কাঁপা কাঁপা গলায় বলল আমার কিছু লাগবেনা রে তুই চলে আয়। তোরে দেখতে খুব ইচ্ছে করছে। তর চাকরি হয়েছে এইটাই আমার সবচেয়ে বড় পাওয়া। মাকে বললাম কালকেই আসব।

ফোনটা রেখে দেব এমন সময় মা বলল, বাবা কালকে ইফতারিরে আমারে বিরিয়ানি খাওয়াবি?(মা বিরিয়ানি খুবই পছন্দ করতেন। আমি বাড়িতে গেলে মাঝে মার জন্য নিয়ে যেতাম) আমি হেসে বললাম আচ্চা নিয়ে আসব। হাতে যা কিছু টাকা ছিল তা দিয়ে ভাই-বোনদের জন্য টুকটাক কিছু কিনলাম। সকালে উঠে ট্রেনে করে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। আমার স্টেশনে নামতে প্রায় দুপুর গড়িয়ে গেল। স্টেশনে নেমে প্রথমেই মার জন্য দু-প্যাকেট বিরিয়ানি কিনলাম।

মনটা আজ খুশিতে ভরে উঠল। এখন থেকে বাবা মাকে আর কারো কাছে টাকার জন্য হাত পাততে হবে না, ডাল দিয়ে আর ভাত খেতে হবে না, ভাই বোন গুলো আবার স্কুলে যাবে। আমর পরিবারে আর কোন দুঃখ থাকবে না। স্টেশন থেকে সিএনজি করে বাড়ির রাস্তায় নামলাম। প্রায় বিকেল হয়ে গেছে। এখান থেকে ১৫ মিনিট পায়ে হেটে বাড়িতে যেতে হবে। আজ সবকিছুই অন্যরকম ভাল লাগছে, চারদিকের রুক্ষ মাঠগুলোও আজ খুব সুন্দর মনে হচ্ছে।

বাড়ির কাছে পৌছাতেই বাড়িতে বেশ কিছু মানুষ দেখতে পেলাম। মনে মনে ভাবলাম মা হয়ত সবাইকে বলেছে আমার চাকরি হয়েছে তাই সবাই এসেছে। বাড়ির ভিতরে ঢুকতেই যেন মাথার উপর আকাশটা ভেঙ্গে পড়ল।
হাতে থাকা বিরিয়ানির প্যাকেটগুলো মাঠিতে ছড়িয়ে পড়ল। বাড়ির পাশের পুকুরটা, বাড়ির ঘরগুলো, গাছপালা সবকিছু ঠিক আগের মতই আছে, শুধু মা নেই। কেউ যেন ছুড়ি দিয়ে বুকটা ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে। কেউ একজন আমাকে ধরে মার পাশে বসাল, মার দিকে তাকিয়ে আজ শুধু চোখদুটো থেকে অশ্রুধারগুলো গড়িয়ে পড়ছে। ছোট বোনটা মাকে ডেকে বলছে মা মা উঠনা ভাই তোমার লাইগা বিরিয়ানি আনছে শেষ ইফতারিটা আর মা’র মুখে তুলে দিতে পারলাম না…..

যে হাত দিয়ে মা’র মুখে আজ ইফতারি তুলে দেওয়ার কথা ছিল সেই হাতেই আজ মাকে কবরে রেখে আসলাম।
আজ কোন এক নিষঙ্গ বিষাদময় পাহাড়ের পাদদেশে দাঁড়িয়ে আছি। এরপর কেটে গেছে অনেক বছর। এখন আমার সব কিছুই আছে। বাবা, ভাই-বোন সবাই অনেক ভাল আছে। কিন্তু না পারার বিষণ্ণতার করাল গ্রাস এখনও আমাকে কুড়ে কুড়ে খায় এখনও মা’র কথাগুলো কানের মধ্যে বাজে,”ইফতারে আমারে বিরিয়ানি খাওয়াবি বাবা…..

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত