‘ভাইয়া যে নেশা করে তুমি কি সেটা জানো মা?’ রুমের ভেতর থেকে কথাগুলো ভেসে আসলো আমার কানে। অমনি থমকে দাঁড়ালাম আমি। ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকলাম জানালার পাশে। শোনা যাচ্ছে মা বলছেন,
– চুপ কর! রিয়াদ নেশা করে তোকে কে বলেছে?
– আমি সেদিন ভাইয়ার পকেটে সিগারেট পেয়েছিলাম, আর শুধু যে সেদিনই পেয়েছিলাম তা নয় প্রায়সই আমি ভাইয়ার পকেটে সিগারেট পাই। তোমাকে এতদিন বলতে সাহস পাইনি।
– কি বলছিস এসব! আজো পেয়েছিস নাকি?
– না, আজ পাইনি।
– আচ্ছা শোন, এটা আমাকে বলেছিস বেশ করেছিস। তবে, ভুলেও যেন আর কাউকে বলতে যাসনে। তোর বাবাকে তো একদমই না। বুঝেছিস?
– আচ্ছা ঠিক আছে, বলবো না কাউকে।
এবার আমি জানালার পাশ থেকে সরে ডাইনিং রুমের দিকে চলে আসলাম। সম্ভবত ওরা এখন রুম থেকে বেরোবে। আর বেরিয়ে যদি আমাকে দেখে দাঁড়িয়ে আছি তাহলে বুঝে ফেলবে আমি যে তাদের সব কথা শুনে ফেলেছি। কিছুক্ষণ পর এসে আমাকে ডাইনিং রুমে দেখে মা জিজ্ঞেস করলেন,
– কিরে রিয়াদ, এখানে কি করছিস?
– কিছুনা মা, লাইটার খুঁজছিলাম।
– কেন, লাইটার দিয়ে তুই কি করবি?
– তেমন কিছু না। কাজ করবো একটু।
– আগে বল তারপর লাইটার দিচ্ছি। কি করবি লাইটার দিয়ে?
– মোমবাতি জ্বালাবো।
– মোমবাতি! আমাদের ঘরে তো সবসময়ই বিদ্যুৎ থাকে। তা মোমবাতি কেন?
– এত প্রশ্ন করছো কেন? তা তোমার কি মনে হয় আমি সিগারেট খাব? আমাকে এই চিনেছো তুমি? ওহ আচ্ছা, আজকাল তাহলে এসবও ভাবা হচ্ছে আমার সম্বন্ধে! লাগবেনা লাইটার।
কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে ডাইনিং রুম থেকে সোজা নিজের রুমে চলে আসলাম। এমন সময় ছোটবোন রোদেলাকে রুম থেকে বেরোতে দেখে বললাম,
– এই দাঁড়া, কি করছিলি আমার রুমে?
– সবকিছু গোছগাছ করে দিলাম। কেন?
– গোছগাছ করেছিস তা ভালো। আমার পারমিশন ছাড়া আর কখনোই আমার রুমে ঢুকবি না। মনে থাকে যেন।
আমাকে এভাবে কথা বলতে দেখে বিস্মিত হয়ে গেলো রোদেলা। চুপচাপ দাড়িয়ে রইলো ও। আমি রুমে ঢুকে ভেতর থেকে ওর মুখের উপর দরজা লাগিয়ে দিলাম।
রোদেলা আমার বোন তবে সৎ। বাবা দুটো বিয়ে করেছেন। মা মারা যাবার দেড় বছর পর বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেন। রোদেলা আমাকে বাঘের মতো ভয় পায়। কোনদিন আমার সাথে কোনকিছু নিয়ে মুখে মুখে তর্ক করবে তো দূরে থাক চোখ রাঙিয়ে তাকায়ওনি পর্যন্ত। এমনিতে ওকে নিয়ে আমার কোন অভিযোগ না থাকলেও আমার নেশা করার বিষয়টি মাকে বলে দেয়াতে ওর প্রতি আমার ভেতর কেমন যেন এক ধরনের ক্রোধের সৃষ্টি হয়। এরপর সপ্তাহ দুয়েক ওর সাথে ভালোভাবে কখনো কোন কথাও বলিনি আমি। বাবা সরকারি চাকুরীজীবি। ছুটিতে বাড়ি এসে উঠেপড়ে লেগেছেন রোদেলার বিয়ে দিয়ে দিতে। আজ এনিয়ে কথা বলতেই মা আর আমাকে নিয়ে বাবা বসেছেন। রোদেলা বাসায় নেই। বাবা বললেন,
– রিয়াদ, সবকিছু তো জানিসই। তা, তোর জানাশোনার মধ্যে কোন ভালো ছেলে আছে কি? আমি কিছুটা বিরক্তির স্বরে বললাম,
– আমি কি এসব নিয়েই পড়ে থাকি নাকি? আপনার মেয়ে বিয়ে দিবেন আপনিই ভালো ছেলের খোজ করে দেখুন না! আমার এমন আচরণে বাবা-মা দু’জনই বিস্মিত হলেন। চেহারা দেখে তা বুঝতে পারা গেলেও কেউই কিছু বললেন না আমায়। এবার মাকে উদ্দেশ্য করে বাবা বললেন,
– আমার এক কলিগের সাথে রোদেলাকে নিয়ে কথা হয়েছিলো একবার। তারও বিয়ের উপযুক্ত এক ছেলে আছে। তুমি কি বলো, উনার সাথে কি কথা বলবো একবার? মা,
– এটা তো ভালো কথা। কথা বলে দেখো।
বাবা ফোন বের করে কল দিলেন ঐ ভদ্রলোককে। কথা বলতে বলতে চলে গেলেন বাইরে। আমি ফোন বের করে ফেসবুকে ঢুঁ মারলাম। মিনিট দশেক পর বাবা আসলেন। তাঁর চোখেমুখে আনন্দের ছাপ স্পষ্ট। মনে হচ্ছিলো বিয়ের আলাপ যেন পাকাপাকিই করে ফেলেছেন। আমার আর মায়ের চেহারায় প্রশ্নবোধক চিহ্ন। চোখের ভাষায় বাবাকে দুজনের জিজ্ঞাসা,
– কি কথা হলো? বাবা হয়ত আমাদের চোখের ভাষা বুঝতে পেরে যান। এবার তিনি বলতে শুরু করেন,
– সারোয়ারের সাথে কথা হয়েছে। সেও তার ছেলের জন্য মেয়ে খুঁজ ছিলো। ছেলের নাম রায়হান। কাল ওরা দেখতে আসছে। পছন্দ হলে দু-তিন দিনের মধ্যেই বিয়ের তারিখ ফেলে দিব। আমি এবার সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললাম,
– তাহলে তো হলোই। কাল আসলে কালই দেখা যাবে কি হয়।
এই বলে চলে আসলাম নিজের রুমে। বাবার হোটেলে খাই, নামেমাত্র পড়াশোনা করি, বন্ধুদের সাথে রাস্তাঘাটে মেয়েদের বিরক্ত করি, সিগারেট খাই, আড্ডা দিই আর এভাবেই দিন কেটে যায় আমার। নিজের কাপড় কখনো নিজেকে ধুয়ে দিতে হয় নি। বিছানাও কখনো গোছাতে হয়নি আমার। সবকিছুই রোদেলাই করে দেয়। এতকিছুর পরও কেন জানিনা রোদেলার প্রতি আমার মনে কোন ধরণের সহানুভূতি, স্নেহ বা ভালোসার জন্ম হয় না। এভাবেই দিন কেটে যাচ্ছিলো। রাত তখন সাড়ে নয়টা। বিছানায় শুয়ে শুয়ে ফেসবুকিং করছি। এমন সময় দরজায় কেউ নক করলো। সাথে বললো,
– আসবো ভেতরে? রোদেলার গলা এটা। বললাম,
– হ্যা, আয়। এক গ্লাস দুধ হাতে ভেতরে প্রবেশ করলো ও। পাশের টেবিলের উপর গ্লাসটি রেখে ও দাড়িয়ে রইলো। বললাম,
– কি হয়েছে? রোদেলা,
– না মানে, আসলে, একটা কথা বলার ছিলো ভাইয়া। কিন্তু কিভাবে বলবো বুঝতে পারছিনা। বললাম,
– এত অভিনয় করতে হবে না। যা বলার বলে ফেল! রোদেলা আর কিছু বললো না আমায়। বেরিয়ে গেলো রুম থেকে। আমিও বিষয়টিকে কোন গুরুত্ব দেয়ার প্রয়োজন বোধ করলাম না। করতে লাগলাম ফেসবুকিং।
দুপুরের পর উনারা নাকি এসেছিলেন। আমি ইচ্ছে করেই বাসায় ছিলাম না। বাবা, মা, এমনকি রোদেলাও বেশ কয়েকবার ফোন দিলেও ইচ্ছে করেই কারোর ফোন রিসিভ করিনি আমি। সন্ধায় বাসায় ফিরে জানতে পারি দু’পক্ষেরই সবকিছু পছন্দ হয়েছে। আমার মত না নিতে পারায় বাবা নাকি বিয়ের দিনতারিখ ঠিক করতে পারেন নি। ওরাও বলেছে আমার সাথে কথা বলে যেন ওদেরকে পাকা কথা জানানো হয়। বিষয়গুলো মা আমাকে অবগত করলেন।
আমাকে যখন এসব নিয়ে মা বলছিলেন তখন দূর থেকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আমাদের কথা শুনছিলো রোদেলা। ওকে দেখে মনে হচ্ছিলো আমাকে ও কিছু বলতে চায়। কিন্ত সাহস করতে পারছে না। এতটা বুঝতে পারার পরও রোদেলার সাথে একান্তে কথা বলার প্রয়োজন মনে করিনি আমি। আমার মনে বোন হিসেবে ওর জন্য যেন কোন জায়গাই নেই। রাতে একসাথে খেতে বসেছি আমরা। বাবা জানেন আমার বিষয়ে। আর তাই কল ধরিনি কেন, বাসায় থাকিনি কেন এসব নিয়ে বললেন না কিছু। সোজাসুজি বললেন,
– ওদের সবকিছু পছন্দ হয়েছে। আর আমাদেরও। আমি চাইছিলাম আগামী তিন চারদিনের মধ্যে যেন বিয়েটা হয়ে যায়। এজন্য আগামী শুক্রবারই ভালো হয়। তোর মত কি? আমি বরাবরের মতোই কোন গুরুত্ব দিলাম না বিষয়টাকে। বললাম,
– সবার যেভাবে ভালো হয় তাই করুন। আমার কোনকিছুতে আপত্তি নেই।
রাতেই বিয়ের তারিখ চূড়ান্ত হয়ে গেলো। শুক্রবার বিয়ে। এসব আয়োজন নিয়েও আমার কোন মাথাব্যথা নেই। বাবা তো আছেনই। তিনিই তার মেয়ের বিয়ের সব ব্যবস্থা করবেন। প্রতিদিনের মতো আজো ফেসবুকিং করতে করতে আর গান শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়লাম আমি। তবে প্রতিদিনের মতো পরদিনের সকালটা হলো না। মায়ের চিৎকারে ঘুম ভাঙলো আমার। হন্তদন্ত হয়ে বিছানা ছেড়ে দৌড়ে বেরোলাম রুম থেকে। বাবাও ছুটে গেলেন রোদেলার রুমের দিকে।
আমিও গেলাম। দরজার সামনে আসতেই থমকে দাঁড়ালাম আমি। মা মেঝেতে পরে অজ্ঞান হয়ে গেছেন। সিলিং ফ্যানের সাথে ওড়নায় ঝুলছে রোদেলার নিথর দেহটা। আলতো করে ঘুরছে ফ্যানটা। বাবা দেয়ালের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে দাড়িয়ে রইলেন। আমিও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলাম। মনের অজান্তেই চিৎকার করে উঠলাম আমি। হাউমাউ করে কান্না শুরু করে দিলাম। না, আমি নয়। আমি তো ভাই নামের একটা পশু। আমি কেন কাঁদবো? কাঁদছিলো আমার ভেতরের ভালো মানুষটা। আমাদের চিৎকার চেচামেচি শুনে পাশের বাসার লোকজন এসে জড়ো হয়ে গেলো। তারাও বিস্মিত, হতভম্ব আর নির্বাক। ওদের মধ্যেই কেউ একজনকে শুনলাম পুলিশে ফোন করতে।
প্রাথমিকভাবে রোদেলার আত্মহত্যার কোন কারণ কেউই শনাক্ত করতে পারেনি। পুলিশ এসে ওর লাশ ময়নাতদন্তের জন্য নিয়ে যায়। যার বিয়ের আমেজে বাড়িতে উৎসব হবার কথা ছিলো আজ তারই চলে যাওয়ায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে। দলে দলে বাড়িতে ওর কলেজের সহপাঠীরা এসে জমায়েত হচ্ছিলো। শিক্ষকরাও আসছিলেন। আত্মীয়স্বজনরা তো ছিলোই। সবাই শোকে স্তব্ধ। কেন আর ঠিক কি কারণে রোদেলা এটা করলো তার কোন উত্তর কারোর জানা নেই। সবাই ওর চলে যাওয়ায় হতাশা আর দুঃখ প্রকাশ করছে। এদিকে সন্ধা নাগাদ লাশের দাফন কাজ সম্পন্ন করা হয়। সারাদিন বাড়িতে এসে শত শত মানুষ জড়ো হলেও এখন আর কেউই নেই। সবাই চলে গেছে।
শুয়ে আছি এমন সময় তানহা তাবাসসুম নামের একটি আইডি থেকে মেসেজ রিকোয়েস্ট আসে। বাসায় ওয়াই-ফাই থাকায় তাই প্রায় সবসময়ই ডাটা অন করা থাকে আমার। মেসেজটা সিন করলাম আমি। কিন্তু একি! একের পর এক ছবি পাঠাতে থাকে মেয়েটি। না, কোন মানুষের ছবি নয়। এসব ছবি কোন ডায়েরির পাতার মনে হচ্ছে। আমি মেসেজটা পড়তে লাগলাম। লিখেছে,
‘পৃথিবীতে হয়তো আপনার মতো অমানুষ আর পাষাণ হৃদয়ের কোন ভাই নেই। আমার বান্ধবীর কি দোষ ছিলো বলতে পারেন? আমি ওর আত্মহত্যার খবর শুনে বান্ধবীদের নিয়ে ছুটে যাই আপনাদের বাসায়। ওর রুমে যখন আমরা বসে ছিলাম তখন এই ডায়েরিটা পাই। আর কেউ দেখেনি এটা। আমি লুকিয়ে নিয়ে এসেছি। কিন্তু এতে যা লিখা রয়েছে তা পড়ার পর মনে হলো রোদেলা আত্মহত্যা করেনি। ওকে হত্যা করা হয়েছে। এবং ওর সেই হত্যাকারী আপনিই মিস্টার রিয়াদ! ছিঃ! আপনি আসলে পৃথিবীতে ভাই নামের কলঙ্ক। আমি কয়েকটি ছবি পাঠাচ্ছি ওর ডায়েরির। দেখুন কি লিখেছিলো ও। অমনি আমি একটি ছবিতে ক্লিক করলাম। ভেসে উঠলো ডায়েরির পাতাটি। তাতে লিখা;
‘পৃথিবীতে হয়তো আমিই একমাত্র হতভাগী বোন যে কিনা তার ভাইয়ের সাথে মন খুলে দুটো কথা বলারও সাহস করতে পারে না। আমি যদি আমার ভাইয়ের সাথে খোলামেলা আর বন্ধুসুলভ কথা বলতে পারতাম তবে হয়তো এমুহূর্তে তাঁকে আমার ভালোবাসার মানুষটির কথাও বলতে পারতাম। কিন্তু সে ভাগ্য নিয়ে আমি জন্মাই নি। আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেলো আজ। আমি কার সাথে আলোচনা করবো কাকে কি জানাবো সেটা নিয়ে অনেক চিন্তা করেছি। বাবা-মায়ের সাথে এসব বিষয় নিয়ে কথা বলাটা অসম্ভব। ভাইয়ের সাথে বলা যেতো।
কিন্ত পারিনি। আমার ভাই তেমন নয়। কে জানে, বিয়ের পর হয়তো জীবনে কখনো আমাকে সে দেখতেও যাবেনা! এমুহূর্তে আমার কি করা উচিৎ আমি জানিনা। তবে আমি আমার ভালোবাসার মানুষটিকে ঠকাতে পারবো না। আমি এভাবে বাঁচতে পারবো না। ভাই কে বলি, তুমি যদি কখনো আমার এই লিখাটি পড়ো তাহলে জেনে রেখো, আমি তোমার ভালোর জন্যই তোমার নেশা করার বিষয়টি মাকে বলেছিলাম। আমি তোমার কোন শত্রু নয় বোন ছিলাম। জানিনা তুমি কখনো আমায় বোন ভাবতে পেরেছিলে কিনা। তবে, আমি জানি, আমার একটাই ভাই ছিলো। সে যেমনই হোক, ভাই তো ছিলো।’
লিখাটি পড়ার পর আমি আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারলাম না। চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করলাম। পৃথিবীর সবচাইতে নিকৃষ্ট মানুষ বলে নিজেকে মনে হচ্ছিলো আমার। ফোনটা দূরে ফেলে রেখে বিছানায় গড়াগড়ি খেতে লাগলাম আমি। কাঁদতে শুরু করলাম। তবে, এখন বোনের জন্য আমার এই কান্নার কোন অর্থ হয়না। যা হবার তা হয়ে গেছে। হারিয়ে গেছে আমার বোন। আমার কারণেই ও হারিয়ে গেছে। আমি একটা পাষাণ। আমার মনটাও পাষাণ। আমার কোন ক্ষমা নেই। সত্যিই ক্ষমা নেই।