মাঝে মাঝে মীরার খুব মন খারাপ লাগে। মা অকারণেই অরু আপাকে বকাঝকা করে। অরু আপার মুখটা তখন এতটুকু হয়ে যায়। ডাগর আঁখি দুটো কেমন ছলছল করে।অথচ সেই একই কাজ তরু আপা করলে মা কিচ্ছু বলবে না। মীরা মাঝে মধ্যে ভাবে ওদের চার ভাই বোনের মধ্যে মা আসলে একমাত্র তরু আপাকেই পছন্দ করে। ও আর টগর ভাই নিউট্রাল। আর সবচেয়ে বেশি অপছন্দ করে অরু আপাকে৷ মীরা জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো। শুক্লা দ্বাদশীর চাঁদ ঝুলে আছে আকাশে। গুনগুনিয়ে গান ধরলো মীরা। ‘নয়নও সরসী কেন ভরেছে জলে, কত কি রয়েছে লেখা কাজলে কাজলে। ‘
-গান গায় কেডা? গান গায় কেডা? মীরার দাদী চেঁচিয়ে উঠলো।
-আমি দাদী
-ক্যান?মনে রঙ লাগিছে? পিরীতের রঙ?হাঙ্গা করবি?
মীরার কান ঝাঁ ঝাঁ করতে লাগলো। যত বয়স হচ্ছে জোবেদা বানুর মুখ তত আলগা হচ্ছে। মীরা শুনেছে বয়সকালে মাকে কথা দিয়ে খুব জ্বালাতো দাদী। মীরার মাও ছিলো ডাকের সুন্দরী৷ স্বাভাবিক ভাবেই সুন্দরী বউ জ্বালানো ছিলো সেকেলে শ্বাশুড়িদের শখ। নীচে নামতেই একেবারে বাবার সামনে পড়লো।
-কে অরু?
-আমি মীরা বাবা।
-ওহ! এককাপ চা হবে?
-এখন হবে না বাবা। মা অরু আপাকে খুব ধুচ্ছে। পেপারটা ভাঁজ করে সোবহান সাহেব চশমার উপর দিয়ে মীরার দিকে তাকালেন।
-আজ আবার কি করেছে?
-এখনো বলতে পারছি না।
-যা তো। ডেকে আন মেয়েটাকে।
-আমি পারবো না বাবা। তোমার যদি মায়ের বকা শোনার ইচ্ছা থাকে তুমি যাও।
-টগর কই?
-ভাইয়া তো সেই সাত সকালে বের হয়৷
-তরু কি টিউশনিতে?
-হু
-আচ্ছা যা
মীরা বাগানে চলে গেলো৷ওদের এই বাসার আর কিছু ভালো হোক বা না হোক বাগানটা খুব ভালো। মীরার দাদার নিজ হাতে লাগানো এক একটা গাছ এখন বিশাল হয়েছে। একটা প্রাচীন ছাতিম ফুলের গোড়া শান বাঁধিয়ে দেয়া হয়েছে। মীরার খুব অস্বস্তি লাগলে এখানে এসে বসে৷ বাগানে বেশ কিছু ফুলের গাছও আছে৷ অরু আপা লাগিয়েছে। অরু আপাটা বেশ সংসারী। কিন্তু কেন যে সংসারটা আপার করা হলো না!
মীরাদের বাসার নাম জোবেদা মহল৷ মীরার দাদা নামটি রেখেছিলো দাদীর নামে। দাদার তিন ছেলে মেয়ের মধ্যে বাড়িটি তিনি তার মেজছেলে সোবহান সাহেবকেই দিয়ে গেছেন। এবং মৃত্যুর আগে তিনি প্রত্যেককেই পাঁই পাঁই করে বলে গেছেন’ যেন তার বড় মেয়েকে এই বাসায় ঢুকতে দেয়া না হয়। দেখা মাত্র যেন তাকে পাঁচশো জুতা মারা হয়। ‘ যদিও মীরার বড় ফুপুর কোনো খোঁজ আজ অব্দি পাওয়া যায় নি। মীরার বড় ফুপুর দোষ বলতে তিনি তার বাবার অমতে, তারই অপছন্দের ছাত্রের হাত ধরে পালিয়ে গিয়েছলেন। আর মীরার একমাত্র ছোটচাচা আনিস মীরাদের সাথেই থাকে। মীরার বাবা ভূমি অফিসের কর্মকর্তা । তার হাত দিয়ে ঘুষ উপর মহলে চলে যায় ঠিকই কিন্তু একটাকাও তার পকেটে আসে না। সততা বোধহয় খানিকটা অসুখের মতো। মীরার ছোটচাচা ঠিক কি করে কেউ জানে না। কখনো কখনো সারাদিন বাসায় থাকে।
নিজের রুমে দরজা বন্ধ করে রাখে। তখন একমাত্র টগর সেখানে যেতে পারে। আবার মাঝে মাঝে দিন কয়েকের জন্য হাওয়া হয়ে যান।বিশাল বিশাল চুল দাঁড়ি নিয়ে ফিরে আসেন। মীরার বড় ভাই টগর।মাস্টার্স শেষ করেছে তাও বছর চারেক। এখনো চাকরি বাকরি কিছুই করছে না। অরু আর তরু আপা টুইন। অরু আপা বড়। গায়ের রঙটা একটু যা চাপা। তরু আপার কাছে বোম্বের নায়িকা ফেইল। দুজনই গ্রাজুয়েশন করছে। অরু আপা জুলজিতে। তরু আপা আর্কিটেকচারে।দু জনেই টিউশনি করে। মূলত টিউশনি গুলো তরু আপাই পায়, কিন্তু সেগুলো কিছুদিন পরেই অরু আপার কাছে চলে আসে। কোনো টিউশনিই তরু আপা বেশিদিন করতে পারে না। অপরদিকে অরু আপাকে গার্জিয়ান তো বটেই স্টুডেন্টরাও ছাড়তে চায় না। আর মীরা সবে ইউনিভার্সিটিতে পা রেখেছে। মীরাদের বাসায় আরো দুজন মানুষ আছে। একজন কাদের, অন্যজন রহিমা খালা। এরা মূলত একজন সরকার পক্ষ, অন্যজন বিরোধী পক্ষ। দুজনের কেউ কাউকে দেখতে পারে না আবার একজনকে ছাড়া অন্যজনের চলেও না।
এই বাড়ির আরেকজন সদস্যের কথা বলা হয় নি। তিনি জামিল চাচা। বিপত্নীক এই মানুষটি প্রায় সাত বছর ধরে দোতালার দক্ষিন অংশ ভাড়া নিয়ে আছেন ।ছেলে মেয়েও নেই । চলেন নিজের পেনশনের টাকায় । বাগানের সব গাছ অবশ্য অরু আপা একা লাগায় নি , জামিল চাচারও কিছু হাত আছে । দুনিয়ার কোনো কিছুই কি একা হয় ? বাবা অফিস থেকে এসেই বিশাল হৈচৈ লাগিয়ে নিয়েছে । ফেরার পথে তিনি বিশাল একটি বোয়াল মাছ নিয়ে ফিরেছেন । মাছ দেখে মা হয়েছেন বিরক্ত । টগর ভাই একবার শুধু জিজ্ঞেস করেছে কত দাম ? তাও উত্তর না শুনেই বেরিয়ে গেছে । বাবা শুকনা মুখ করে বসে আছে । যেন মাছটা নিয়ে এসে তিনি বিরাট অন্যায় করেছেন । বাবার শুকনা মুখ দেখে অরু এগিয়ে গেলো ।খুকুদের মত উৎসাহী গলায় বললো ,
-ওমা ! বাবা কত্তবড় মাছ ! সাথে সাথে বাবা হেসে উঠলো ।
-অনেক বড় না রে মাছটা ?
-হ্যা বাবা ।কত নিলো?
-আন্দাজ করতো ?
-এক হাজার ?
-হয়নি
-তুমি বলে দাও তো বাবা
-আড়াইশো ! অরু আপা আবারো চেঁচিয়ে উঠলো ,
-ও মা গো ! কি বলছো বাবা ! এতবড় মাছটা কিনা আড়াইশো টাকা মাত্র?
সোবহান সাহেব মিটমিট করে হাসছেন । অরু আপা জামিল চাচাকেও ডেকে এনেছে । বাবার উৎসাহ আবার আগের মতোই দেখা যাচ্ছে ।তিনজন হৈ চৈ করে মাছটা কুটতে বসেছে । মা বিরক্ত স্বরে বললো ,
-উহ!বুড়ো বয়সে ঢং ! মীরা জিজ্ঞেস করলো ,
-তুমি আসলে অরু আপাকে দেখতে পারো না কেন মা?
মীরার দিকে কিছুক্ষন ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থেকে ভেতরে চলে গেলেন রাশিদা বানু । তরু আপার হাবভাব খানিকটা পালটে গেছে মনে হয় । আজকাল কিছুই খেতে পারছে না । গতকাল গভীর রাতে উঠে বমি করেছে ।অরু আপা লেবুর শরবত বানিয়ে নিচু গলায় কিছু বললো । তারপর দুবোন খিলখিলিয়ে হাসি ।মীরাকে দেখে চুপ করে গেলো ।যেন অন্যায় কাজ করে লুকিয়েছে মাকে দেখে । সকালে মীরার ঘুম ভাংলো মায়ের চিৎকারে । তরু আপাকে মেরেছে মা । এত বড় মেয়ের গায়ে হাত তোলার মত কারন নিশ্চয়ই ঘটেছে ! টগর ভাই নিচু গলায় বললো ,
-মা , চুপ করো তো । যা ঘটার তা তো ঘটিয়েইছে । এখন হাউকাউ করে আরো পাড়া প্রতিবেশী জানানো ।তারচেয়ে বলি কি করা যায়?
-কি করা যায় মানে?আমার মুখে চুনকালি তো যা দেয়ার দিয়েছেই ।এখন ওকে বিয়ে কে করবে?
-আমি বলি কি মা , আমার বন্ধু হাবীব আছে না? ওর সাথে বিয়েটা দিয়ে দিই । মা একটু শান্ত হলো ।এক সপ্তাহের মধ্যে হাবীব ভাইয়ের সাথে তরু আপার বিয়ে হয়ে গেলো ।বিয়ের দিন টগর ভাই আর অরু আপা ধরলো তরু আপাকে ।
-দে , আমাদের টাকা দে । অরু আপা বললো,
-তোর আবার টাকা কিসের ? বুদ্ধি তো আমার ।
-মাকে বললাম যে আমি !
তিনভাইবোন হাসছে । কি যে সুন্দর লাগছে । মীরা মনে মনে বললো ‘ এই ভাবেই ভালো থাকিস ভালোবাসা’ । ভার্সিটি থেকে ফিরে মীরা দেখে ওদের বাসায় পুলিশ ।বাবা কেমন বাচ্চাদের মতো কাঁদছে ।অরু আপা আর টগর ভাই বাবার দুহাত শক্ত করে ধরে রেখেছে । দাদী চিল্লাচ্ছে ‘ও টগরের মা ।কই গেলা? বাসাত কি হইছে কও না ক্যান’ ?মাকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না । ঘটনা হলো ছোটচাচাকে নিয়ে । উনি নানা সমস্যায় নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছিলেন । তারমধ্যে একটা হলো মানি এক্সটরশন । তার ডেডবডি আইডেন্টিফাই করার জন্য বাবাকে যেতে হবে ।বাবার অবস্থা দেখে টগর ভাই বললো ‘আমি যাচ্ছি’ । ফিরে এসে বললো ‘কাউকে দেখতে হবে না । আমি পুলিশকে বলে এসেছি লাশ সৎকার করিয়ে ফেলতে’ । বাবা এবার হাউ মাউ করে কান্না শুরু করলো । টগর ভাই বাবাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো ‘ভয় নাই বাবা । ভয় নাই’ । তরু আপার বাচ্চা হবে । আপা বেশ খানিকটা ফুলেছেও । আপাকে দেখে কেমন সুখী সুখী লাগে । মীরার সামনে ইয়ার ফাইনাল । বই নিয়ে ছাদে উঠতেই দেখে টগর ভাই এক কোনে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছে । কেমন উস্কখুস্ক লাগছে ভাইয়াকে । মীরাকে দেখে সিগারেট ফেলে দিল ।
-কি রে পুচকি? পরীক্ষা নাকি ? মীরা মাথা ঝাঁকাল । তারপর দুজনেই চুপ । সন্ধ্যা নেমে আসছে পৃথিবীর আনাচে কানাচে । মীরা যেন এক মহাকাল ওপার থেকে প্রশ্ন করলো ,
-ছোটচাচাকে না মারলেও পারতে ভাইয়া । টগর অনেকক্ষন চুপ থেকে একটা মার্লবোরো ধরালো । শান্ত গলায় বললো ,
-না মারলে হোতো না রে । চাচা বাবাকে মেরে দেয়ারই প্ল্যান করেছিলো । নইলে এ বাড়ির দখল পেতো না কিছুতেই ।
মীরা কিছু না বলে চুপ করে রইলো । নাকে মুখে একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে বললো ,
-বাবাটা এত বোকা ! মাঝে মাঝে কি মনে হয় জানিস?
-জানি টগর সামান্য চমকালো । মীরা বললো ,
-বাবার আমরা কেউ নই । না রে ভাইয়া ?
-এইটাই খুব আফসোস !
কি প্রচন্ড শুদ্ধ একজন মানুষ । আমাদের বুঝতেই দেয় নি আমরা তার সন্তান না । আবার তার কুলটা স্ত্রীর সেই প্রেমিককেও নিজ বাড়িতে আশ্রয় দিয়ে রেখেছে । মাকেও কোনদিন একটা বাজে কথা বললো না পর্যন্ত ।অরু আপার চেহারায় জামিল চাচাকে স্পষ্ট বোঝা যায় । অথচ বাবা অরু আপাকে কি ভালোটাই না বাসে! জানিস , আমার সবসময় বাবাকে ছুঁয়ে থাকতে ইচ্ছে করে । কি বিশাল হৃদয়ের শুদ্ধ একজন মানুষ । নীচ থেকে সোবহান সাহেবের গলা পাওয়া যাচ্ছে ।টগর ,মীরাকে খুঁজছে । অরু আর তরু আপা আম ভর্তা খাচ্ছে । টগর ভাই হাউমাউ করে কাঁদছে । মীরা চোখমুখ শক্ত করে বসে আছে । এই পৃথিবীতে বাবাদের হৃদয় সবসময় বিশালই হয় । বাবারা সবসময় শুদ্ধই হয় ।।