‘মা আজও কি শুধুই ছোলা মুড়ি আর চিঁড়ে দিয়ে ইফতারি করবো?’ কথাগুলো মন খরাপ করে বলতেই মা হেসে বললো, ‘ডালের বড়া বানাইছি। ওটাও ইফতারিতে খাইস’ ‘ডালের বড়া! তুমি বাবাকে আজও বলোনি বেসন নিয়ে আসতে? কতদিন ধরে বলছি চপ খাবো।’
মা চুলায় আরেকটা লাকড়ি দিয়ে হেসে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘তোর বাবার মনে ছিল না নিয়ে আসতে। আজ একটু কষ্ট করে খা। আগামীকাল তোকে আমি সব ধরনের চপ বানিয়ে খাওয়াবো।’ ‘তুমি এই কথা রোজ’ই বলো মা।’ উত্তরে মা আর কোনো কথা বলেনি৷ আসলে বাবার বেসন নিয়ে আসতে ঠিকই মনে থাকতো কিন্তু পকেটে পয়সা থাকতো না। অভাবটা শুধু বেসনে আঁটকে ছিল না, অভাবটা ছিলো সবকিছুতেই। ছোট বেলা থেকেই এমন টানাপোড়েন অবস্থা দেখেছি সংসারে। অনেক কিছু কিনতে মনে চাইতো, খেতে ইচ্ছে করতো কখনও মুখ ফুটে বলতে পারতাম না আবার কখনও বললেও পেতাম না৷
‘আপা পিয়াজ কি আর বাটন লাগবো? নাকি এতেই চলবো?’ রেবেকার ডাকে ভ্রম কাটে।
‘না না আর লাগবে না। তুই এবার কাঁচা মরিচগুলো ঝটপট কেটে ফেলতো’
‘আপা মেহমান কয়জন?’
‘তোর ভাইজান তো বললো চার জন।’
‘চার জনের জন্য এত আয়োজন!’
অনেক অবাক হয়ে কথাটা বললো রেবেকা। আমি হেসে বললাম, ‘হ্যাঁ।’
‘ভাইজানের অফিসের লোক? সাহেব মেমসাহেব মনে হয়। তয় আপা চার জনে ইফতার পার্টি হবে ক্যামনে? ইফতার পার্টিতে তো ম্যালা মানুষ লাগে।’
হাসির মাত্রা বেড়ে গেল, ‘ইফতার পার্টি না তো। এমনিই তাদেরকে দাওয়াত দেওয়া হয়েছে। আর কে বলেছে তোকে চারজনে ইফতার পার্টি হয় না? আর চারজন কই? আটজন তো আমরা।’ রেবেকা কিছু একটা বলতে যাবে এমন সময় রেবেকার চার বছরের ছেলেটা রান্না ঘরে দৌঁড়ে এলো। রেবেকা চোখ রাঙানি দিয়ে বললো, ‘হাসান? বাজান তোমারে না কইছি ওই ঘরে বসে টিভি দেখ। এখানে আসতে মানা করছি না?’ হাসান শুকনো মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে৷ আমি ওর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘খিদে পেয়েছে হাসান? ‘ হাসান মাথা নেড়ে আমার কথায় সম্মতি প্রকাশ করলো। আমি রেবেকার দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘হাসানকে ফ্রীজ থেকে মিষ্টি বের করে দে তো।’
রেবেকা হাসি মুখে উঠে বললো, ‘জ্বী আপা।’ তারপর আবার প্রশ্ন করলো, ‘আপা আটজন কই পাইলেন?’ ‘তুই, আমি, তোর ভাইজান, হাসান আর মেহমানরা। আটজনে তো ইফতার পার্টি হয় নাকি?’ আমার কথায় রেবেকা খানিকটা লজ্জা পেয়ে উত্তর দিল, ‘জ্বী আপা’ আমি মনোযোগ দিয়ে চপগুলো তেলে উল্টিয়ে পাল্টিয়ে দিচ্ছি। কিছুক্ষণ পর রেবেকা রান্নাঘরে প্রবেশ করলো। ‘আপা মেহমান কখন আসবে?’
‘ইফতারের আগেই চলে আসবে।’
‘ভাইজানে কই গেছে?’
‘বললো তো বাজারে যাচ্ছি। কি যেন নাকি জরুরী কেনাকাটা বাকি আছে।’
এই নাহিদটার বাজে খরচের স্বভাব আছে। বিয়ের পর থেকেই দেখছি। এতকিছুর আয়োজন করলাম, তারপরেও সে গেছে আরও কেনাকাটা করতে। এত বললাম যে, ইফতারিতে এত খাবার কেউ খেতে পারবে না৷ নষ্ট হবে। কে শোনে কার কথা! বললো নষ্ট হবে না৷ খাবার থেকে গেলে, সেগুলো খাওয়ার মানুষেরও অভাব থাকবে না। এই মানুষটা কখন কি যে বলে বুঝতে পারিনা৷ তবে মানুষটাকে আমার খুব ভালো মনে হয়। আমি কখনও কল্পনাও করিনি আমার মত নিম্নমধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ের কপালে এরকম কেউ একজন আছেন। কি নেই নাহিদের মধ্যে। দেখতে সুন্দর, শিক্ষিত, ভালো চাকুরি, অনেক টাকা পয়সার মালিক আর সর্বোপরি হাসি খুশি প্রাণোচ্ছল একটা মানুষ। বাশর রাতে যখন জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনি আমাকে কেন বিয়ে করলেন? কি যোগ্যতা আছে আপনার বউ হওয়ার?’
উত্তরে বলেছিল, ‘কি নেই তোমার মাঝে?’
আমি মাথা নিচু করে বলেছিলাম, ‘আমি গরিব পরিবারের মেয়ে। বাবা গ্রামের একটা স্কুলের শিক্ষকতা করেছিলেন। এখন অবসরেও চলে গেছেন। কত কষ্ট করে আমার বড় বোন দু’টোকে বড় করে বিয়ে দিলেন। আমাকেও দিলেন। ছোট ভাইটার ভবিষ্যৎ এখনও অনেক বাকি। বলার মত কি আছে আমার? ‘ ‘বলার মত একটা পরিবার আছে তোমার। তোমার বাবা একজন খুবই ভালো মানুষ। তাঁর মত লোকের সন্নিধ্যে পাওয়াও ভাগ্যের বিষয়। আর তোমাকে আমার প্রথম দেখায়’ই খুব ভালো লোগেছিলো। একটা মায়া কাজ করেছিল। আমি তোমাকে ছেড়ে আসতে পারিনি। তাই ওইদিনই বিয়ের কথা পাকাপোক্ত করেই তবে বাড়ি ফিরলাম।’ কলিংবেলের শব্দ শুনে দরজা খুলে দেখি দুই হাত ভর্তি বাজার নিয়ে নাহিদ দাঁড়িয়ে।
‘এত বাজার কেন? মেহমান কি এক মাস থাকবে নাকি? কি যে করোনা তুমি!’
‘এগুলো রাখো। প্রয়োজনেরটুকু রেখে বাকিটা ফ্রীজে তুলে রাখো। বাজারে যা ভীড়। প্রতিদিন বাজারে যাওয়া খুবই বিরক্তিকর একটা অবস্থা।’
‘তাই বলে এত বাজার! মেহমান কত দূর? কখন আসবে?’
‘চলে আসবে। আমি বের হচ্ছি। তাদের নিয়ে আসবো সাথে করে। রান্না বান্না তো শেষের দিকে তাইনা?’
‘হ্যাঁ।’
‘আচ্ছা আমি বের হলাম।’
‘আপা অনেক নামি দামী মেহমান আসবে। ভাইজানের অফিসের বসেরা হয়তো। এত আয়োজন তো বড়লোক মেহমানদারের জন্যই করে।’ রেবেকার এমন কথায় সম্মতি দিয়ে বললাম, ‘হতে পারে। তুই কাজ কর তাড়াতাড়ি। ‘ আমি বিয়ে হয়ে আসার পর থেকেই রেবেকাকে এ বাড়িতে কাজ করতে দেখি। রেবেকা বয়সে আমার ছোট, তাই ভালোবেসে তুই করে সম্বোধন করি। খুবই ভালো একটা মেয়ে। ওর স্বামী ফল বিক্রি করে। অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে এখন সে চার বছরের বাচ্চার মা। বাবা মায়ের কথা খুব মনে পড়ছে। মা’কে একবার কল দিলাম। কিন্তু কল তো রিসিভ করছেনা। হয়তো ব্যস্ত আছে। যাক পরে আবার দিব।
বিয়ে হয়েছে ছয় মাস হলো। এই ছয় মাসে প্রত্যেক বেলায় ভাত খাওয়ার সময়, কেনকাটার সময়, ঘুরতে বের হলে বাবা মা আর ছোটুর কথা খুব মনে পড়ে। আমাদের ভালো খাবার খাওয়াতে পারেন নি বাবা, ভালো একটা জামা পড়াতে পারেন নি কিন্তু লেখাপড়া শিখিয়ে ভালো মানুষ হিসেবে বড় করেছেন। ভালো ঘরে বিয়েও দিয়েছেন। এখন হয়তো সব ভালোটাই আমার আছে তবে হজম করার শক্তিটা নেই। খেতে গেলে তাদের কথা মনে পরে। ওপাশে তাঁরা আলু ডাল দিয়ে খেয়ে উঠছেন আর এপাশে আমার পেটে এত ভালো খাবার হজম হবে কি করে! বাবার পাঞ্জাবীটা রংচটা হয়ে পুরোনো হতে হতে কয়েকটা ছিদ্র হয়ে যেত তবুও বাবা নতুন একটা পাঞ্জাবী কিনতেন না। আর মায়ের শাড়িটা পুরোনো হয়ে ছিদ্র হয়ে যেত, মা সেলাই করতে থাকতো তবুও মুখ ফুটে একটা নতুন শাড়ীর আবদার করতো না বাবার কাছে। কিন্তু আমাদের প্রয়োজনের জিনিসটা ঠিকই আমরা পেতাম। হয়তো কম দামী আর একটু দেরীতে পেতাম।
আমার এখনও মনে আছে, একবার বাবার জুতা জোড়া ছিঁড়তে ছিঁড়তে সেলাই করার আর বাকি ছিল না কোনো জায়গা। মুচি বিরক্ত হয়ে বলেছিল এ জুতাটা আর কখনও তাঁর কাছে যেন নিয়ে না যায়। বাবা মন খারাপ করে বাড়ি ফিরেছিলেন। তারপর নিজেই নিজের জুতার মুচি হয়ে গেলেন। মা বলেছিলো বাবাকে একটা নতুন জুতা কিনে নেওয়ার জন্য। বাবা উত্তরে বলেছিল, ‘না থাক! ওই টাকা দিয়ে একটা জামা কিনে দিব রূপাকে। ওর জামাটা ছিঁড়ে গেছে সেদিন পেয়ারা গাছে উঠতে গিয়ে। ওর একটা জামা দরকার। আমার এ জুতাতেই চলবে।’
হাসি মুখে বলা বাবার সেদিনের কথা মায়ের চোখে ছলছল করে জল এনে দিয়েছিল। পরদিন আমার জন্য নতুন একটা জামা নিয়ে এলেন বাবা। বাবার এই ত্যাগের মুল্য সেদিন বুঝিনি কিন্তু বড় হওয়ার পর তাঁর প্রতিটি অবদান আমাকে ভাবিয়ে তোলে। মা সবসময় বলতেন, তোরা স্বামীর বাড়িতে খুব সুখে থাকবি। বাবার বাড়ির অপূর্ণতাগুলো সব পূরণ হবে। এই বাড়িতে অনেক সুখ আছে কিন্তু আমি এই সুখের সাথে একদম মানিয়ে নিতে পারছি না। আমার এত সুখে এখন খুব কষ্ট হয়। আমার অপূর্ণতা পূরণ হওয়ার নয়।
আমাদের তিন বোনের বিয়েই বাবা বেশ আয়োজন করে গ্রামের দশজন নিয়েই দিয়েছেন। সংসারটা সারাজীবন টানাপোড়েনে টেনেটুনে চালিয়ে জমিয়ে রাখা টাকাগুলো বাবা আমাদের বিয়েতে খরচ করেছিলেন। জামাই বাড়ির লোকজনের কাছে নিজের মেয়েকে যেন ছোট না হতে হয়, সে ব্যবস্থায়ও তিনি করেছেন। আমাদের ভালোর কথা ভেবে তিনি তাঁর সবটুকু ভালো বিসর্জন দিয়েছিলেন।
ভর দুপুরে শুকনো মুখ নিয়ে খরতাপে বাবা ঘামতে ঘামতে যখন বাড়ি ফিরতেন, মা কখনও মুড়ির সাথে গুড় দিয়ে খেতে দিতেন আর এক গ্লাস পানি। বাবা পানি গ্লাস খেয়ে মুড়ি আর গুড়টা মাকে রেখে দিতে বলতেন। আমার আর ছোটুর ঘন ঘন খিদে লাগে, এগুলো তাই আমাদের জন্য তুলে রাখতেন৷ বড় দুই আপা খুব শান্ত শিষ্ট ছিলেন। পড়াশোনায় আমরা সবাই খুব ভালো ছিলাম। ভাই বোনদের মধ্যে আমি আর ছোটু খুব দুষ্টুমি করতাম। বড় আপাদের বিয়ে হয়ে গেলে আমরা দু’জনই বাড়ি মাথায় করে রাখতাম। মা খুব বকতো। ববা কখনও বকতেন না। বাবা মাকে বলতেন এই বয়সে এমন করে সবাই, বড় হলে শান্ত হয়ে যাবে। আসলেই বড় হয়ে শান্ত হয়ে গেছি।
বছরে শুধু কোরবানির সময়ে আমাদের বাড়িতে গরুর গোশত রান্না হত। বাবা আর আমার গরুর গোশত ছিল খুব পছন্দের। মা নিজের প্লেটের গোশতগুলো তুলে রাখতেন, আমাদের থালায় একটু বেশি দিবে বলে। ঈদের দিন মা তাঁর পোষা হাঁস মুরগী থেকে বড় মোরগটা বা হাসটা রান্না করতেন। সাথে পোলাও। ছোটু কব্জি ডুবিয়ে খেত। মাও পছন্দ করতেন। বড় আপা আর মেঝ আপা মিষ্টি খুব পছন্দ করতেন। বাবা তাই দূরে কোথায়ও গেলে বাড়ি ফেরার পথে মিষ্টি নিয়ে ফিরতেন।
বাড়িতে পিঠা বানানো হলে সেদিন আর আমরা কেউ বাড়ির আঙিনা রেখে দূরে যেতাম না। বারবার শুধু উঁকি মেরে দেখতাম মায়ের পিঠা বানানো কখন শেষ হয়। পিঠা বানানো শেষ হলে মা সবাইকে ডাক দিতেন। আমরা সবাই বেশ মজা করে খেতে বসতাম। খাওয়ার সময় ঝগড়াও লেগে যেত আমাদের মাঝে। বাবা শালিশ করতেন। পিঠার প্রতি সবার আগ্রহ থাকলেও মায়ের থাকতো না। খেতে বললেও বলতো, ‘আমার খিদে নেই তোরা খা। আমার পিঠা পছন্দ নয় তেমন।’ তখন না বুঝলেও পরে বুঝেছিলাম আমাদের সবার মত মায়েরও পিঠা খুব পছন্দ। আর মায়েরও খিদে থাকতো। শুধু খিদেটা চাপা দিত।
বিয়ের পর বাবা বাড়িতে খুব কম যাওয়াই হয়েছে আমার। একে তো অনেক বেশি দূর তারপর আবার গেলে বাবার অনেক খরচ করতে হয়। এইসব চিন্তা করে যাওয়া হয়না, খুব ইচ্ছে করলেও। বিয়ের পরে আমরা বোনেরা বাবা বা মাকে যতবারই সাহায্য করতে চাইতাম ততবারই বারণ করে ফেরত দিতেন। একই কথা বলতেন, ‘এভাবে টাকা দিবি না কখনও। জামাই পরে জানলে কি মনে করবে! তাঁরা এলে, আমরা যেভাবে পারছি আপ্যায়ন করার চেষ্টা করি। উপরওয়ালা ঠিকই চালিয়ে নিবেন। শুধু শুধু এসব করে সংসারে কখনও অশান্তি ডেকে আনিস না।’
যতই বোঝাতাম টাকাটা তো আমারও। আমাকে খরচ করার জন্যই দেওয়া হয়েছে, তো আমার বাবা মায়ের পেছনে খরচ করলে সমস্যা কি।ততবারই বাবা মা কোনো না কোনো যুক্তি দাঁড় করাতেন। আসলে তাঁরা কখনও ছোট হতে চাননি। না নিজেদের কাছে, না অন্যদের। আমাদের এতগুলো বোনকে বড় করে লেখাপড়া শিখিয়ে বিয়ে দিয়েছেন কারো কাছে কখনও হাত পাততে দেখি নি। কম খেয়েছি, কিন্তু খেয়েছি। ভাইটাকেও এখন টেনেটুনে বড় করছেন। ছোটুই এখন বাবা মায়ের অবলম্বন, শেষ ঠাই।
বাবা সবসময় একটা কথা বলতেন, ‘জীবনে না খেয়ে থেকেছি তবুও মান সম্মান বিসর্জন দেই নি। তোমাদেরকে কোথায়ও ছোট করিনি আর করবোও না। আশা করি তোমরাও আমাকে কখনও ছোট করবে না।’ বাবার কথাটা খুব মনোযোগ দিয়ে মাথায় রেখেছিলাম। অনেকে দারিদ্র্যের সুযোগ নিতে চেয়েছিল, অনেকে সত্যিই ভালোবেসেছিল কিন্তু বাবার কথা চিন্তা করে সব কিছু এড়িয়ে যেতে পেরেছি খুব সহজেই। বাবার থেকেই শেখা কিভাবে সম্মানের সহিত বাঁচতে হয়।
আজ বাসায় গরুর গোশত রান্না হচ্ছে, মোরোগ পোলাও, নানান ধরনের পিঠা, পায়েশসহ আরও অনেক দামী খাবারের আয়োজন রয়েছে। বাবা মা আর ছোটুর কথা খুব মনে পড়ছে। বরাবরের মত এই খাবারগুলো আজও আমার পেটে যাবে না। পেট টা ভরা ভরা লাগছে, খিদে নেই, খেতে ইচ্ছে করছেনা, এগুলো আমার পছন্দ নয়, একদমই ভালো লাগছেনা সহ আর নানান বাহানার ভেতর থেকে একটা বাহানা খাঁড়া করে আমাকে খাবার রেখে উঠতে হবে। বিয়ের আগে দেখেছি মায়ের খিদে থাকতো না, আর বিয়ের পর এখন আমার খিদে থাকে না। বাবাকে একবার কল দিলাম কিন্তু তিনিও রিসিভ করলেন না। কি হলো? ছোটু নিশ্চয়ই ফোন সাইলেন্ট করে গেম খেলছে। বদের হাড্ডি একটা। যাই হোক নাহিদ বাসায় এলে একবার কল দিতে বলবো।
নাহিদ কল করেছে ওরা চলে এসেছে কাছাকাছি। আমি আর রেবেকা তাড়াতাড়ি সবকিছু ঠিকঠাক করে নিজেরাও ঠিকঠাক হয়ে নিলাম। হাসান কান্না করছে একটা জিলাপি খাবে বলে। রেবেকা একটা ধমক দিয়ে বসিয়ে রেখেছে। আমি এসে একটা জিলাপি ওর হাতে দিতেই বেজায় খুশি। রেবেকার দিকে তাকিয়ে দেখি ওর চোখমুখ জুড়েও বেশ খুশি ছড়িয়ে গেল। হঠাৎ কলিংবেলের শব্দ। রেবেকাকে বললাম দরজা খুলতে। রেবেকা দরজা খুলতে গেছে আমিও পিছন পিছন গেলাম। দরজা খুলতেই দেখি ছোটু গড়গড় করে রুমে প্রবেশ করে এক মুখ হাসি নিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘আপা কেমন আছো?’
আমি কিছু বলার আগেই তাকিয়ে দেখি মা আর বাবা। তাঁর পেছনে ব্যাগগুলো নিয়ে রেবেকার স্বামী জয়নুল ঢুকছে। সবার পেছনে নাহিদ দাঁড়িয়ে। মা আমাকে জাড়িয়ে ধরে কান্না করে দিল। বাবার চোখে জলেরা ছলছল করছে। আমি কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। শুধু চোখ থেকে অনবরত জল গড়াচ্ছে। খুশির জল, কষ্টের নয়। মা চোখের পানি মুছতে মুছতে বললেন, ‘তুই আমাদের জন্য এত মন খারাপ করিস কেন বোকা মেয়ে? এভাবে মন খারাপ করে কেউ থাকে। আমরা ভালো আছি তো। তোরা ভালো থাকলেই তো আমরা ভালো থাকি।’ নাহিদ পেছন থেকে এসে বললো, ‘কান্নাকাটি করার সময় অনেক থাকবে কিন্তু এভাবে এখন কান্নাকাটি করতে থাকলে আজানের সময় কিন্তু বেশি বাকি থাকবে না।’
আমি বাবা মা আর ছোটুকে নিয়ে রুমে গেলাম। তাঁদেরকে ফ্রেশ হওয়ার জন্য বলে আমি নাহিদকে খুঁজতে যাবো এমন সময় দেখি নাহিদ বেলকনিতে দাঁড়িয়ে। আমি পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। ‘এই তাহলে তোমার অনারেবল গেস্ট।’ ‘আমার নয় আমাদের।’ এ মুখ হাসি নিয়ে ওর দিকে তাকাতেই ও বললো, ‘তোমার কি মনে হয় আমি তোমাকে বুঝতে পারিনা? নাকি ভেবেছো ছয়টা মাস তো মামুলী বিষয়। এতে একজন অন্যজনকে কতটুকুই বা বুঝতে পারে!’ আমি চুপচাপ ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। আর ও বলেই চললো, ‘তোমার এই যে খিদে না থাকা, খেতে ইচ্ছে না করা কিংবা ভালো লাগে না এসবের কারন আমি ঠিকই বুঝেছিলাম। হয়তো দেরি হয়েছে বুঝতে কিন্তু ঠিক বুঝেছি। রূপা আমি তোমাকে প্রথম দেখায় এত মায়ায় পড়েছিলাম কেন জানো?’ ‘কেন?’
‘কারন তোমার মুখে একটা হাসি লেগে ছিল। ওই হাসিটা আমাকে খুব টেনেছিল। আর যেটা আমি বিগত ছয় মাসে তোমার ভেতরে খুঁজে পাইনি। আমি খুব চেষ্টা করে গেছি ওই হাসিটা ফিরিয়ে আনার জন্য, কারন খুঁজেছি কিন্তু আসল কারনটা বুঝতে পারিনি এতদিন। আমি তোমাকে ভালোবাসি রূপা।’ চোখ ছলছল করে উঠছিল নাহিদের কথায়। কান্না জড়ানো কন্ঠে বললাম, ‘আমিও তোমাকে অনেক ভালোবাসি।’ ‘নাহ্ তুমি আমাকে ভালোবাসো না। যদি ভালোবাসতে আমার সাথে একটাবার বিষয়গুলো শেয়ার করতে পারতে। আমাকে তোমার এতটা খারাপ মানুষ মনে হয় রূপা, যে আমার কাছে বলাই গেল না?’
আমি কিছু বলতে পারলাম না। নাহিদকে শরীরের সব শক্তি দিয়ে আঁকড়ে ধরে কান্না করে দিলাম। নাহিদ আমায় ওর বুকের মধ্যে আগলে রেখে বললো, ‘তোমাকে একটা খবর দিতে চাই।’ আমি চোখের জল মুছে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কি খবর?’ ‘বাবা মা আর ছোটু এখন থেকে এখানেই থাকবেন।’ ‘মানে?’ ‘মানে তাঁরা এ বাসায়ই থাকবে।’ ‘বাবা মা রাজি হবেন না। আর তাছাড়া লোকেও বা কি বলবে। কেমন না বিষয় টা?’ নাহিদ আমার হাত দু’টো চেপে ধরে বললো, ‘রূপা লোকের কথা বাদ দাও। লোকে কি চাইলো তা দিয়ে আমরা ভালো থাকবো না। আমরা কিসে ভালো থাকবো সেটা আমাদেরই করতে হবে। তুমি মন থেকে সত্যি করে বলো বাবা মা আর ছোটু এখানে থাকলে তোমার ভালো লাগবে কিনা? ‘ আমি শান্ত স্বরে বললাম, ‘হ্যাঁ অনেক বেশিই ভালো লাগবে।’
‘তাহলে সেটাই হবে। আর বাবা মাকে আমিই রাজি করাবো। তুমি একটু সাহায্য করো শুধু। আর শোনো আমার তো বাবা মা নেই। তো তোমার বাবা মা আমার বাবা মা হলে দোষ কি? তাছাড়া আমার বাবা মা বেঁচে থাকলেও আমি তাদের সাথে তোমার বাবা মাকেও এখানে এনে রাখতাম বিশ্বাস করো। আমার যেমন ইচ্ছে করে আমার বাবা মায়ের সাথে থাকতে। তাহলে তোমার কেন ইচ্ছে করবে না! সে ইচ্ছেতে দোষের কিছু তো দেখছি না। আর ছোটু আমারও ভাই। তুমি এখন থেকে দয়া করে আর সব নিজের একার বলে দাবি করবে না। আমাকেও একটু অধিকার বসানোর আর কর্তব্য পালনের সুযোগ দিও।’ আমি শুধু হেসে দিলাম। নাহিদ আমাকে টেনে ওর বুকের মধ্যে নিল। ‘জয়নুলকে সাথে করে নিয়ে এসেছো তাই না?’ ‘তুমি যেমন তোমার বরকে ভালোবাসো। তোমার বর তোমার কাছে থাকলে খুশি হও, রেবেকাও তো তেমন। জয়নুল এসেছে, এখন দেখবে ও কেমন খুশি থাকবে। না হলে ওর পেটে খাবার হজম হত না।’ হাসতে হাসতে বললাম, ‘মানুষজনকে খুব খুশি রাখা শিখেছো তুমি।’ ‘চলো এবার আজানের সত্যিই বেশিক্ষণ নেই’
রেবেকাকে বললাম সব খাবার টেবিলে এনে রাখতে। বাবাকে সহ সবাইকে ডাকতে গিয়ে মা’কে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আমার কল তোমরা কেউ রিসিভ করলে না কেন?’ মা হাসতে হাসতে জবাব দিল, ‘জামাই নিষেধ করে দিয়েছিল।’ রাগের সুরে বললাম, ‘জামাই বলছে ওমনি মেয়ে পর হয়ে গেছে।’ বাবা হোহো করে হেসে ফেললেন। বললেন, ‘পাগলী মেয়ে বলে কি দেখ!’ ‘হইছে বুঝছি। চলো এবার ইফতার করতে হবে।’ ডায়নিং রুমে ঢুকতেই দেখি রেবেকা আর জয়নুল সব সুন্দরভাবে সাজিয়ে রেখেছে। নাহিদও সাহায্য করছে। আমরা সবাই একসঙ্গে ইফতারির জন্য বসলাম। রাতে খাবার শেষে নাহিদ রেবেকাকে বললো, ‘তোর বাসায় তোর বাবা মা আছেন না?’
‘জ্বী ভাইজান।’ ‘ইফতারি আর রাতের যে খাবারগুলো তখন আলাদা করে রাখতে বলছিলাম। ওগুলো নিয়ে যা। আর তোদের সবার সেহরির খাবারগুলোও নিয়ে যাস।’ রেবেকার চোখে জল ছলছল করছে। ও কিছু একটা বলতে চাইছে কিন্তু বলতে পারছে না। আমার দিকে তাকিয়ে নাহিদ বললো, ‘বলেছিলাম না খাবার থাকলে, খাওয়ারও লোক আছে।’ আমি কিছু না বলে অপলক এই ভালো মানুষটির দিকে তাকিয়ে রইলাম।