– বাপ আমার, ঐ ফ্যানের সাথে দড়ি বেঁধে একটা ফাঁসির বন্দোবস্ত করে দে। আমি গলায় দিয়ে মরে তোদেরকে উদ্ধার করি।
বাবার রুমে খাবারের প্লেট টা রেখে চলে আসছিলাম তখন বাবার মুখে এমন কথা শুনে আমার কান খাড়া হয়ে গেল। পেছন ফিরে তাকিয়ে বাবার চোখে চোখ রাখলাম। খেয়াল করলাম ভীষণ আক্ষেপ, অভিযোগ জমে আছে। আমি দু কদম এগিয়ে সামনে এসে বললাম,
– এসব ভাব কেন নিচ্ছেন? ফাঁসি লাগিয়ে মরতে যাবেন কেন, আমাদেরকে জেলে পাঠানোর জন্য? মৃদু হেসে বাবা বললেন,
– নারে বাপ, তোদের কেন জেলে দিতে যাব। ঈশ্বর তো আমাকে বন্দী কারাগারে রেখেছেন।
বাবা প্যারালাইজড হয়ে কয়েকবছর থেকে বিছানায় আছেন। কোমরের নিচের অংশ পুরোই অবশ তাই চলাফেরা একদম করতে পারেননা। বিছানায় ঘুমিয়ে থাকেন আর শুধু খান। ভাবছি বৃদ্ধাশ্রমে দিয়ে রেহাই পাই। এই জঞ্জাল সাফ না করলে আমিই হয়তো একদিন ফাঁসি লাগিয়ে মরে যাব। কিন্তু বুড়ো বলে যাবেনা বৃদ্ধাশ্রমে। এখানে যদিও না খেয়ে মরে তাতেও সমস্যা নেই। বাবাকে বললাম, সুখেই তো আছেন। তিনবেলা গিলে গিলে খেতে পারছেন। আর কি চাই আপনার? বাবা বললেন,
– এভাবে গিলে গিলে খাওয়ার চেয়ে তো মরে যাওয়া অনেক ভালো রে বাপ। অন্তত কারো নজরের কাটা হয়ে তো বাঁচতে হবেনা।
এবারের কথাটা আমার বউয়ের উদ্দেশ্যে ছিল সেটা আমি বুঝতে পেরেছি। অনন্যা বাবাকে সহ্য করতে পারেনা। বাবার জন্য আলাদা খাবার বানানো, উনার কাপড় চোপড় ধোয়ে দেওয়া, সময়ে সময়ে ঔষধপত্র খাইয়ে দেওয়া এইসব তার একদম গ্রাহ্য হয়না। তাই সেও বাহানা করে দুদিন পরপর তার বাবার বাড়ি চলে যায়। বাবার দেখাশোনার জন্য এখন আলাদা করে কাজের মেয়ে রাখতে হয়েছে।
এমনিতেই বেতন মাত্র ২০ হাজার টাকা। এর মধ্যে ছেলের স্কুল খরচ, ছোট ভাইটার কলেজ খরচ, সংসার চালানোর খরচ তারপর আলাদা করে বাবার চিকিৎসার খরচ। ২০ হাজার টাকায় কি এতকিছু সম্ভব? তবুও বাবার অকপটে কথাগুলো শুনতেই হয়। ধমকের স্বরে কিছু কথা বাবাকে বলে সেখানে আর দাঁড়ালাম না। বাবার চোখে জল দেখলাম। এড়িয় সেটা চলে আসলাম।
দুদিন আগের কথা। ৪ হাজার টাকা দিয়ে অনন্যাকে একটা শাড়ি গিফট করেছিলাম। তার জন্মদিন ছিল। বাবা যখন জানতে পারলেন তখন আমাকে বললেন উনার নাকি ইলিশ মাছ খেতে ইচ্ছে হচ্ছে। কয়েকবছর হয়ে গেলো খাননা। এমনিতেই কি টানাপোড়েনে সংসারটা চলে আর উনি ইলিশ মাছ খাবেন। সংসার তো উনি চালান না, চালাই আমি। তাই বুঝি সংসার চালাতে কতই না ইট-পাথর ভাঙতে হয়।
পরদিন অফিস থেকে ফিরছিলাম তখন অনন্যার বউদি ফোন দিয়ে বলল অনন্যার বাবার নাকি হার্ট-অ্যাটাক হয়েছে। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে উনাকে। তাড়াতাড়ি অনন্যা কে নিয়ে যেতে হাসপাতালে। আমি তাড়াহুড়ো করে বাসায় এসে অনন্যা কে জানালাম তার বাবার কথা। অনন্যা পাগল হাতির মতো এদিক-ওদিক ছুটতে লাগল। যেভাবে ছিল সেভাবেই বলল তাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে। কাজের মেয়েকে আর ছেলেটাকে ঘরে রেখেই দুজন ছুটলাম হাসপাতালের উদ্দেশ্যে। গিয়ে দেখি হাসপাতালের সাদা চাদরে আবৃত বিছানার উপরে বাবা শুয়ে আছেন। পাশে আমার শাশুড়ী আর শাশুড়ীর পেছনে দাঁড়িয়ে আছে অনন্যার বউদি। কিন্তু দেখলাম বাবাকে জড়িয়ে কাঁদছে তার ছেলে সুমন। বাবা তাকে বলছেন যে চিন্তা করার তো কিছুই হয়নি। ডাক্তার বলেছেন উনি সুস্থ। কিন্তু সুমন কেদেই চলেছে। আমি অভাব অন্য কথা ভেবে। সুমন ঢাকায় জব করে। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি এখানে চলে আসলো কিভাবে সেটা আমি ভাবছি! এত দ্রুত তো চলে আসা খুব কঠিন। সুমন কেঁদেই যাচ্ছে। আমাকে দেখে শ্বশুর বললেন সুমন কে বুঝিয়ে বলতে যে উনি এখন সুস্থ।
-সুমন, ডাক্তার তো বলেছেন উনি সুস্থ। তুমি শান্ত হও। আমার কথায় সুমন পেছনে তাকিয়ে বলল,
– বাবাকে কতবার বলেছি টেনশন নিও না। উনি বুঝেন না। সবসময় ঘরের চিন্তা, আমার চিন্তা। না করেও বুঝাতে পারিনা।
– চিন্তা করাটা তো স্বাভাবিক। কিন্তু সুমন তুমি এতো তাড়াতাড়ি এখানে কিভাবে? ঢাকা থেকে তো এত তাড়াতাড়ি এখানে সম্ভব না। সুমন চোখের জল মুছতে মুছতে বললো,
– বসের গাড়ি নিয়ে চলে এসেছি। দ্রুত আসতে চাচ্ছিলাম তাই স্পিডে ড্রাইভ করে এসেছি।
– কিন্তু রাতের আধারে এত গতিতে গাড়ি চালিয়ে আসছো! এতে যদি তোমার এক্সিডেন্ট হত তাহলে? সুমন ভ্রু কুঁচকে বলল,
– আমার উপর এই ব্যক্তিটার অনেক উপকার আছে জামাইবাবু। এমন সময়ে যদি দেরি করে আসতাম তাহলে পাপের বোঝা টা মাথায় থেকে যেত।
ছেলের উপর বাবার উপকার! কথাটা ঠিক বুঝতে পারলাম না। তাই সুমনকে জিজ্ঞেস করলাম। সুমন জবাব দিল,
-সবচেয়ে বড় উপকার তো আমাকে জন্ম দিয়ে এই পৃথিবীর মুখ দেখানো। নইলে মানবজীবন তো নসিবই হতনা। তারওপর বুকে-পিঠে করে বড় করা। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর যোগ্য করে তোলা। আরোও অগণিত উপকার আছে যেগুলো বলতে গেলে একজীবনটাও কম হয়ে যাবে জামাইবাবু।
সুমন তার বাবার সামনে গিয়ে বসল। কিন্তু তার কথাগুলো আমার কানে বেজে উঠতে লাগল। কখনো কি আমি এভাবে ভেবে দেখেছি? না, ভাবিনি। অভাবের সংসারেও বাবা অভাব কি সেটা বুঝতে দেননি। একবেলা উপোষ থেকে ঘুমিয়েছেন কিন্তু আমাকে কাজ করতে বলেননি। নিজের জন্য কয়েকবছর নতুন কাপড় নেননি কিন্তু আমার কলেজের বেতন একপয়সাও বাকি রাখেননি। মাসে ৭ হাজার টাকা বেতনের চাকরি করে পুরে সংসার চালিয়ে নেয়া কষ্ট হত কিন্তু আমার আবদার গুলোকে অপূর্ণ রাখেন নি। কিন্তু আমি কি সেগুলো ভেবে দেখেছি? না, দেখিনি। অনন্যা তার বাবার হার্ট-অ্যাটার্কের কথায় পাগল হয়ে গিয়েছিল, সুমন নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঢাকা চলে এসেছে। আর আমি? আমি কি এসব করতাম? এসব কথা ভেবে আমার অন্তরটা পুড়ে যাচ্ছিল। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে ধাক্কা খেলাম একটা হুইলচেয়ারে বসা বয়স্ক লোকের সাথে। চেহারাটা দেখে চিনে ফেললাম। রতন বাবু। আগে আমাদের অফিসেই চাকরি করতেন। কিন্তু অসুস্থ হয়ে চাকরি ছেড়ে দিলেন।
– কাকা, এখানে? আমার বিস্মিত হওয়া দেখে বললেন,
– হুম বাবা, ঈশ্বরের মর্জি আমি এখানে। বাঁ পা টা প্যারালাইজড হয়ে গেছে যার কারণে আমি এখানে। এই হুইলচেয়ারটায় বসে বসে বিশ্বাস কর, মনে হচ্ছে আমি যেন নরকে চলে এসেছি। একটা অসহায় প্রাণীর মতো হাসপাতালে পড়ে আছি। এভাবে বাঁচার থেকে তো সন্তানের পাশে থেকে মরে যাওয়া ভালো। কাকার কথায় বুকটা ফেটে গেল। এতদিন যে বাবা কি কষ্টে একজায়গায়, একরুমে পড়ে আছেন সেটা আমি অনুভবই করিনি। এমনসময় বাবা তার ছেলেকে, পরিবারকে পাশে খুঁজে কিন্তু আমি তো উনাকে ক্ষণে ক্ষণে তিরস্কার করে এসেছি। ছি!
তাড়াতাড়ি বাসায় আসলাম। ঘরে ঢুকতেই কাজের মেয়েটা বলল, বাবা আমার কথা চিন্তা করে খাচ্ছেন না। বলছেন আমি আসলে খাবেন। আমার চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগলো। যে বাবাকে আমি প্রতিদিন সে গালাগালি করি সে এখনো আমাকে ভালোবাসে। আমি বাবার রুমে গেলাম। খাবার প্লেট টা টেবিলে রাখা। বাবা আমাকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন,
– তোর শ্বশুর এখন কেমন?
– ভালো বাবা। বাবা একটা কথা ছিল?
আমি নরম কণ্ঠে বললাম। বাবা জানতে চাইলেন। আমি উনার পায়ে পড়ে কাঁদতে কাঁদতে আমার এতবছরের পাপের জন্য ক্ষমা চাইলাম। আমার কান্নায় বাবাও কেঁদে ফেললেন। আমাকে জড়িয়ে ধরে একমুহূর্তেই ক্ষমা করে দিলেন….