একজন ভদ্রলোককে চিনি যিনি রোজ মেয়ের শ্বশুরবাড়ির সামনে বেঞ্চিতে বসে থাকে। হাতে জরাজীর্ণ ছাতা। গালে কাঁচাপাকা দাঁড়ি। খদ্দরের পাঞ্জাবি ঘামে ভিজে থাকে। বিষন্ন মনে একদৃষ্টিতে মেয়ের বাড়ির দিকে চেয়ে থাকে৷ নতুন গড়ে উঠা শহরের এই দিকটায় লোক চলাচল কম। বিত্তবানের কিছুটা দূরত্ব রেখে নিজেদের প্রসাদসম অট্টালিকায় বাস করেন।।রাস্তার বিপরীত পাশে লেকের পাড়ে সারি সারি বেঞ্চ পাতা।
তার একটিতে জামরুল গাছের নীচে লোকটা সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি ঠায় বসে থাকেন। গত দুই বছরে তার রুটিনের হেরফের হয় নি কখনও।ঝড়-বৃষ্টির দিনগুলোতে দৌঁড়ে রাস্তা পাড় হয়ে পান-সিগারেটের দোকানে আশ্রয় নেন। দোকানদার মুরব্বি লোক দেখে খাতির করে বসান। কুশলাদি জিজ্ঞেস করেন। ভদ্রলোক নিরুত্তাপ।দুপুরে পাউরুটি আর কলা দিয়ে ক্ষুধা নিবারণ করে আবার বেঞ্চিতে এসে বসেন।মেয়ের বাড়িতে তখন লাঞ্চের আয়োজন চলছে।
এদের বনেদি পরিবার। কাজের লোক আর বাড়ির লোকদের জন্যে রন্ধন প্রনালী ভিন্ন। পঞ্চব্যঞ্জন টেবিলে সাজিয়ে আলতাফ তালুকদার খেতে বসেন। তিনি আহার করেন খুব সামান্য কিন্তু টেবিল ভর্তি খাবার সাজিয়ে আনন্দ পান। বাড়ির একমাত্র পুত্রবধূর এই সময় উপস্থিত থাকা চাই। টাঙ্গাইলের শাড়িতে ঘোমটায় ঢাকা আড়ষ্ট একখানা মুখ। হাতে-গলায় গহনার বাহার দেখলে অবশ্য মনে হয় মেয়েটা সুখেই আছে। দুপুরের এই সময়টা শ্বশুরের খাবার তদারকি করা ছাড়া তার সারাদিন ছুটি। শুয়ে বসে দিন কাটে। তিন বেলায় কখন কি রান্না হবে তার দেখভাল তার শ্বাশুড়ি মা করেন। বাড়ির যাবতীয় কাজ একা হাতে সামলিয়ে সুরমা বেগম বউয়ের ঘরে উঁকি দেন,
-বৌমা, আজ কি মাছ খাবে? সর্ষে ইলিশ নাকি কৈ মাছের ঝোল।
-আপনার যা ভালো হয় রান্না করুন। আমি আসব আপনাকে সাহায্য করতে?
– এত অল্পবয়সে রান্নার ঝামেলা পোহানোর দরকার নেই। ওসব করার জন্যে সারাজীবন আছে। তুমি বরং গোসল সেরে সবুজ জামদানি পরো। খোকা সবুজ রং পছন্দ করে। আইরিনকে বলে দিচ্ছি ও এসে তোমার চুল বেঁধে দিবে। মেয়েটা গোসল সেরে চুপিচুপি বেলকনিতে এসে দাঁড়ায়। হাত নেড়ে ডাকে।
-বাবা!
বেঞ্চিতে বসা বৃদ্ধ ভদ্রলোক তড়িৎ গতিতে উঠে দাঁড়ায়। ইশারায় বাবা-মেয়ের কথা হয়। মেয়ে রাগ করে মুখ ভার করে। বাবাকে বাড়ি ফিরতে অনুরোধ করে। বাবা মাথা নেড়ে বিগলিত ভঙ্গিতে হাসে। মেয়েকে সুস্থ দেখে বাবা সন্তুষ্ট চিত্তে বাড়ি ফিরে। পরদিন মেয়েকে এক পলক দেখার উদ্দেশ্যে আবার বেঞ্চিতে এসে বসেন। বাবা-মেয়ের এই লুকোচুরি খেলা চলছে শ্বশুরবাড়ির অজান্তে। অথবা শ্বশুরপক্ষ জেনেও না জানার ভান করে থাকে৷ হোক সে বাড়ির পুত্রবধূর জন্মদাতা কিন্তু নিম্নবিত্ত কেরানির মূল্য এদের কাছে মুড়ির ঠোঙা, কলার খোসার চেয়ে বেশি কিছু নয়। সে যাই হোক, ভদ্রলোক বাড়ির পথ ধরেন সূর্য ডোবার পর। মেয়ের বাড়ির দরজা -জানালা একে একে বন্ধ হয়ে গেছে। তার ছোট্ট সোমার জীবন আরেকটা বিভিষীকাময় রাতের শুরু।। সারাদিন ক্লান্ত দেহটাকে বয়ে বয়ে চলতে বৃদ্ধ বাবা প্রার্থনা করেন,
-হে ঈশ্বর, আপনি আমার মেয়েটাকে সুস্থ রাখো। ভালো রেখো।
শেফালি বানু কলঘরে স্বামীর ওযু করার আওয়াজ শুনে দ্রুত এক পট চাল ফুটাতে বসান। বেচারা সারাদিন একপ্রকার অভুক্ত থাকে, রাতেও শুকনো ঠাণ্ডা ভাত দেখলে না খেয়ে উঠে যাবে।।ছোট মেয়ে রেবা তাড়াহুড়োয় বাবার জন্যে ডাল-তরকারি গরম করে আনে। জামাল হোসেন কিন্তু খাবার সময় মা-মেয়ে কারো দিকে তাকায় না। শেফালি বানু আগবাড়িয়ে প্রশ্ন করেন,
-সোমা, ভালো আছে?
-বড়লোক বাড়ি মেয়ে দিছি। খারাপ থাকবে কোন দুঃখে!
-তোমার ওর সাথে দেখা হল?
-বারান্দায় দাঁড়িয়েছিল। এক পলক দেখেছি।
-তুমি একবার ওর শ্বশুরের সাথে কথা বলে সোমাকে দু’দিনের জন্যে এবাড়িতে নিয়ে আসো না! জামাল হোসেন ভাতের থালায় হাত ধুয়ে ফেলেন। গামছায় হাত মুছে তিক্ত হাসি হাসেন।
– শেফালি, তোমার মেয়েকে তারা বউ করে নেয় নাই। লাখ টাকার শাড়ি আর কোটি টাকার জরোয়ার সেট দিয়ে কিনে নিয়ে গেছে,ভুলে যাও কেন? তুমি আমি চাইলেও আর মেয়ের সাথে দেখা করতে পারি না। শেফালি বানু চোখের জল মুছতে মুছতে শোবার প্রস্তুতি নেয়। জামাল হোসেন বিরক্ত হয়।
-আরে কাঁদো কেন?
-মেয়েকে কতদিন দেখি না।
-আমার সাথে একদিন গেলেই পারো।দূর থেকে দেখবে।
-তুমি সারাদিন সোমার বাড়ির সামনে ঘুরঘুর করো। এদিকে আমি কিভাবে সংসার চালাই।সেই খেয়াল আছে!
জামাল হোসেন উত্তর না দিয়ে পাশ ফিরে ঘুমানোর চেষ্টা করেন। বংশধর। দিনের পর দিন তালুকদার বাড়িতে আগামী প্রজন্ম জন্মের লক্ষ্যে সোমাকে একজন মানসিক বিকারগ্রস্ত পুরুষের সংসার করে যেতে হয়।ভয়াবহ রাতের অভিজ্ঞতার শেষে ফজরের আজান পর বদ্ধ ঘর থেকে ওর চিৎকার ভেসে উঠে।
-দরজা খোল! দরজা খোল!
ক্ষত-বিক্ষত শরীরে অসহনীয় যন্ত্রণা নিয়ে বিছানায় শরীর এলিয়ে দেয়। দুজন অল্পবয়স্কা কাজের মেয়ে এসে ওর সেবা-শুশ্রুষা করে। জমাট বাঁধা নীলাভ ক্ষত স্থানে বরফ ধরতে সোমা ব্যথায় ককিয়ে উঠে।বদ্ধ উম্মাদ ছেলেকে শিকল বেঁধে রাখে। বাবা-মা ভয়ে ছেলের ঘর মাড়ায় না অথচ ১৯ বছরের অল্পবয়স্কা তরুনীকে ছেলের মনোরঞ্জনের জন্যে বিবেকবোধ বিসর্জন দিয়ে পাঠান। সুরমা বেগম রুটিন করে সোমাকে ডাক্তার ডেকে চেক-আপ করেন। এক বছর আগে পুত্রবধূর কাছ থেকে সুসংবাদ পেয়েছিলেন কিন্তু পাগল ছেলের লাথি খেয়ে বাচ্চাটা নষ্ট হয়ে গেল।এনিয়ে সোমার শ্বশুর আলতাফ তালুকদারের আফসোসের শেষ নেই। স্ত্রীকে বারংবার বলে দিয়েছেন।
-এবার গর্ভধারন করলেই সোমার মুক্তি৷ আর ছেলের কাছে পাঠাতে হবে না।
সোমা এতকিছু জানে না। সে প্রতি রাতে নরকযন্ত্রণা ভোগ করে স্বপ্ন দেখে একদিন আত্মঘাতিনী হবে। আবার বেঞ্চিতে বসা ভদ্রলোকের মুখপানে চেয়ে স্বপ্নকে দুঃস্বপ্ন ভেবে পরবর্তী রাতের জন্যে প্রস্তুত হয়।সোমা শৈশব থেকে শুনে এসেছে সে সুন্দরী, সুলক্ষণা।স্কুল-কলেজে সবাই প্রশংসিত দৃষ্টিতে তাকাত ঠিক কিন্তু এতবড় ঘর থেকে যখন সম্বন্ধ এল বাবা-মার পাশাপাশি সেও অবাক হয়ে গিয়েছিল। ঘটকের কাছে ওদের বাড়ি-গাড়ি আর পারিবারিক ঐতিহ্য শুনে মা বিমোহিত হলেও বাবাকে খুশি দেখাচ্ছিল না।
-এদেশে ডজন ডজন সুন্দরী মেয়ে থাকতে তোমার মেয়েকে বউ করে নিতে তাদের এত তাড়া কিসের বলো তো। নিশ্চয়ই এর মধ্যে ঘাপলা আছে। মা কিন্তু শুনলেন না। এক সপ্তাহের মধ্যে পানচিনি থেকে শুরু করে বিয়ের আয়োজন করে ফেললেন। কপাল বটে সোমার। বরের সাজে সুবেশী পুরুষটাকে দেখে একবারও কারো মনে হয় নাই এইলোকটার মাথায় গণ্ডগোল।বিয়ের পর সোমাকে আর বাপের বাড়ি পাঠাতে হত না।ল্যান্ডফোনে টুকটাক কথা হত । সুরমা বেগম পাশে সতর্কভাবে দাঁড়িয়ে থাকত যেন স্বামী সম্বন্ধে বেঁফাস কথা ওর মুখ দিয়ে বের না হয়। এক বিকেল ছোট বোন রেবা বোনকে দেখতে এসে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরল,
-আপার চিবুকে কামড়ের দাগ।হাতের আঙুলে সিগারেটের পোঁড়া চিহ্ন।
সোমার ফোনে কথা বলাও বন্ধ হল। এবাড়িতে ওর বাবা-মায়ের প্রবেশাধিকার নেই। তবু প্রতিদিন একজন বৃদ্ধ ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে থাকে তার বড় সন্তানকে এক নজর দেখার অপেক্ষায়। জামাল হোসেনের মাঝরাত থেকে বমি হচ্ছে। সাথে জ্বর।ঘরে ভাঙা থার্মোমিটার। শেফালি বানু কপালে হাত দিয়ে আন্দাজে কিছুক্ষণ পর পর জ্বর দেখছেন আর মাথায় পানি ঢালছেন।ভোরে জামাল হোসেন উঠে বসলেন।হাত নেড়ে স্ত্রীকে নিষেধ করলেন,
-আর পানি ঢালতে হবে না। তিনি সুস্থ আছেন। গা-হাত-পা এখনো গরম। শেফালি বানু কাতর স্বরে অনুরোধ করেন,
-আজকে আর সোমাদের বাড়ি যেও না। রাস্তায় মাথা ঘুরে গেলে দেখার কেউ নাই। জামাল হোসেন জবাবে মুখ ঝাপ্টা দেয়,
-আমার মেয়েটাও কাল রাতে ওই পাগলটার হাতে খুন হলে ওকে দেখার কেউ নাই।আমরা জানতেও পারব না আমাদের সোমা আর বেঁচে নেই। শেফালি বানু তবুও স্বামীর পথ আগলে দাঁড়ান।
-দূর হও। লোভী মেয়েমানুষ। তোমার জন্যে আমার মেয়েটা দুঃখ পাচ্ছে। সোমা বুঝতে পারছে না পর পর দুই রাত তাকে কেন স্বামীর ঘরে পাঠানো হয় নি।আজ সকালে তার শ্বাশুড়ি এসে দোয়া-দরুদ পড়ে ওর মাথায় ফু দিয়ে গেলেন। নিত্যদিনের পর আজ কি খাবে প্রশ্ন করে আবার ঘুরে দাঁড়ালেন।
-বৌমা, আজ তুমি রান্না করো।। তোমার শ্বশুর তোমার হাতের রান্না খেতে চেয়েছেন। সোমা জানে না তার শ্বশুরমহাশয় কি খেতে পছন্দ করে। বিয়ের আগে বেছে বেছে সেই রান্না গুলোই শিখেছিল যা বাবা খেতে পছন্দ করেন। সর্ষে দিয়ে পাবদা মাছ,পুঁইশাক দিয়ে ইলিশ মাছের মাথা, মুড়িঘণ্ট আর দেশী মুরগির ঝোল আর ঝুড়ি আলু ভাজা। তার হাতে বিদঘুটে রান্না বাবা সানন্দে খেয়ে হাততালি দিতেন। সেই দিনগুলো আর কখনই ফিরে পাওয়া যাবে না। রান্না শেষে ঘর্মকাক্ত শরীরে সোমা বেলকনিতে এসে দাঁড়ায়। কাঁধে কারো স্পর্শ পেয়ে চমকে পিছন ফেরে। সুরমা বেগম বলেন,
-বৌমা, যাও বেয়াইসাহেবকে ডেকে নিয়ে আসো।তোমার শ্বশুরের সাথে বসে ভাত খাবেন। সোমা কয়েক সেকেন্ড বুঝতে পারে না ও সত্যি শুনছে নাকি। তারপর এক দৌড়ে ঘর ছেড়ে বের হয়। পিছন থেকে শ্বাশুড়ি মা বলেন
-আর শোনো,বেয়াইকে বলো খুশি মনে মেয়ের গৃহে প্রবেশ করতে।এবাড়িতে উনার নাতি আসতে চলেছে। সোমার পায়ের গতি আরো দ্রুত হয়৷ রেলিঙঘেরা ইটের দেয়াল পাড় হতে রাস্তার ওপাড়ে বাবাকে দেখতে পায়। বেঞ্চিতে চিৎ হয়ে শুয়ে আসে।সোমা চিৎকার করে ডাকে,
-বাবা!
বাস-ট্রাকের শব্দের ভীড়ে এই ডাক জামাল হোসেনের কানে পৌঁছায় না। সোমা এক দৌঁড়ে রাস্তা পাড় হয়। দেখতে পায়, বাবার নাকের কাছে কয়েকটা মাছি ভনভন করে উড়ছে।