জীবনে প্রথমবারের মতো একা একা ইফতার করলাম। একাকী একটা কক্ষে নির্জনে, নিরিবিলি। এইরকম একটা দিন আসবে সেটা কখনোই কল্পনা করিনি। নিজের অজান্তেই কখন যে চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়া শুরু হয়েছে সেটাও বুঝতে পারিনি। বাড়ি ছেড়েছি প্রায় ছয় বছর হলো। এই দীর্ঘ হোস্টেল জীবনে প্রতিবারই বান্ধুবীদের সাথে ইফতার করেছি। আর তার আগে পরিবারের সবাই একসাথে বসে ইফতার করতাম। শেষ পাঁচটা বছর রুমের দশজন মিলে ইফতার করেছি। রুমমেটদের মধ্যে একজন নন-মুসলিমও ছিলো। কিন্তু তাকে কখনোই আলাদা ভাবতাম না। দুইটা বেড একসাথে করে দশজনে গোল হয়ে বসে ইফতার করতাম। আর কলেজের চার ব্যাচ এবং ফ্যাকাল্টির সবাই মিলে একটা জম্পেশ ইফতার মাহফিল তো করতামই। আহা! সেই মধুর দিন তো কখনোই ভুলবার নয়।
অথচ আজকের ইফতারটাও আমার একা করার কথা ছিলো না। পাশের রুমেই আমার বান্ধুবী থাকে। দুইজনে একসাথে ইফতার করতে পারতাম। কিন্তু করোনা ভাইরাসের এই মহামারিতে আজ যে আমরা যে যার রুম আইসোলেশন রুম বানিয়ে ফেলেছি। দুইদিন আগেও তো এমনটা ছিলো না। আমি আর আমার বান্ধুবী আলাদা আলাদা রান্না করেছি ঠিকই, কিন্তু খেতে বসতাম একসাথে। একজন আরেকজনের রান্না করা খাবার না খেলে তৃপ্তিই পেতাম না। আমি দেশের একটা নামকরা প্রাইভেট হাসপাতালের স্টার্ফ নার্স। সেদিন নাইট ডিউটিতে যাওয়ার সময় বান্ধুবীর রুমমেট তানিয়া আপুকে বলেছিলাম- আপু, তরকারী আর ভাত রেখে যাচ্ছি। লিমা (বান্ধুবী) ডিউটি থেকে আসলে আপনারা দুইজন খেয়ে নিয়েন। আমি হাসপাতালে যাচ্ছি।
আপু- তাহলে কাল তুমি এসে কি খাবে?
আমি- কেন, আপনার রান্না করা মজার তরকারি।
এরপরে আমি চলে যাই। কিন্তু জানতাম না, ওই মজার তরকারি আমার রিযিকে নাই। পরেরদিন সকালবেলা হস্পিটাল থেকে আসার সময় আমাদের ফ্ল্যাটের আরেক আপুর কাছে শুনতে পাই, কিছুদিন আগে তানিয়া আপুর অপারেশন থিয়েটারে একটা রোগীর(রোগীর লোক ইনফরমেশন হাইড করে) অপারেশন হয়। গতকাল সেই রোগীর করোনা পজিটিভ আসার কারণে তানিয়া আপুকে আইসোলেশনে থাকতে বলা হয়েছে। সেইসাথে লিমা রুমমেট হওয়ার কারণে সেও আইসোলেশনে থাকবে। আর আপুর করোনা টেস্ট করা হবে। এরপরে রুমে আসি। দেখি আপু যথাযথ নিয়ম মেনে হাসপাতালে যাচ্ছে করোনা টেস্টের স্যাম্পল দিতে। এরপরেই আমাদের রান্নাঘর, ওয়াশরুম সব আলাদা। কেউ কারোর সাথে কথা নেই, আগের মতো প্রাণচঞ্চল হাসি, আড্ডা নেই, নেই একসাথে খেতে বসা। বান্ধুবী গতকালকে আমার পছন্দের কচুরলতি দিয়ে চিংড়ি মাছ রান্না করেছিলো। কিন্তু ও আমাকে একবারো জিজ্ঞাসা করেনি খাবো কিনা। কারণ আমরা যে সেল্ফ আইসোলেশনে।
জীবনে কখনো ইফতার বানাই নাই। প্রথমে যৌথ পরিবারে এবং পরবর্তীতে একক পরিবারে থাকা সত্ত্বেও পরিবারের আদরের একমাত্র মেয়ে হওয়ায় কখনো রান্নাঘরে যেতে হয়নি। আজকে সব একা একা করতে হয়েছে। অবশ্য মাঝেমাঝে আম্মুকে ফোন দিয়ে এটাসেটা জিজ্ঞাসা করে নিয়েছি। আজ খুব চাচ্ছিলাম, আপুর রিপোর্টটা যেন ইফতারের আগে চলে আসে। তাহলে একসাথে ইফতার করতে পারতাম সবাই মিলে। কিন্তু বিধাতা সেই কথা শুনেনি। রিপোর্ট আসতে নাকি আরো দেরি আছে। আবার আমাদের ডিউটি শিডিউল না মেলার কারণে ফ্ল্যাটের আরেক বান্ধুবী আজ প্রথম ইফতার হাসপাতালেই করবে। আমার আজ ছুটি থাকার কারণে রুমে একাকী ইফতার করতে হচ্ছে। মনে হচ্ছিলো আজকে আমার ছুটি না হলেই ভালো হতো। অথচ কয়েকদিন আগেও চেয়েছি, প্রথম ইফতার যেন রুমে বসে করতে পারি। হাসপাতালে যেন না করতে হয়।
জানিনা এই মহামারী কবে শেষ হবে। কবে পৃথিবী ফিরে পাবে তার নিজস্ব রূপ। কবে আমরা দেখতে পাবো বাহিরের আকাশ। অনেকদিন বাড়ি যাওয়া হয় না। আম্মু, আব্বু আর ভাইয়েরা পথ চেয়ে বসে থেকে দিন গুনছে। কবে আমি বাড়ি ফিরবো সেই অপেক্ষায়। প্রতিবার নামাজে তারা একটাই প্রার্থনাই করছে, যাতে তাদের মেয়ে সুস্থ থাকে। নিরাপদে তার কাজ সম্পূর্ণ করতে পারে।
হাসপাতালে যে কিরকম সংগ্রাম চলছে, তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। তারপরও একদল মানুষ বলবে- ডাক্তাররা কসাই, নার্সরা ভালো হয়না। মানুষের প্রতি দয়ামায়া নাই, হাবিজাবি। এই যে, আপনাদের বলছি, প্লিজ আপনারা ঘরে থাকুন। এখন ঘোরাঘুরি করার সময় না। আপনাদের জন্য আমরা হাসপাতালে আছি। দয়াকরে আপনারা আপনাদের ইনফরমেশন লুকাবেন না। যথাযথ ইনফরমেশন দিয়ে আমাদের সহায়তা করুন। আমরাও যে বাহিরের আকাশ, সুস্থ প্রকৃতি দেখতে চাই। একসাথে সবাই মিলে ইফতার করতে চাই। ফিরে যেতে চাই মায়ের কোলে।