সদ্য প্রাইমারি ছেড়েছি। নিজেকে খুব বড় বড় লাগে। আব্বা বাড়ি এলে সদর দরজায় এখন আমি দৌঁড়ে যাই। আমার আগে আরো তিন ভাই আছে। তাই আমার আগে ওদের অধিকার ছিল দরজা খুলে আব্বাকে জড়িয়ে ধরার। আব্বা আদর করে আমার নাম রেখেছেন পাভেল। আব্বা বই পড়তে ভালোবাসেন। পাভেল ইস্পাতের নায়ক। পাভেল গোর্কির বিখ্যাত উপন্যাস “মা’ এর নায়ক। আব্বা আদর করে ডাকেন ‘ কই আমার ইস্পাত ! ‘ ছোটবেলা থেকেই আব্বা নিজে আমায় নামাজ শিখিয়েছেন। আমি ক্লাস টুতে থাকতে গড়গড় করে দশটি সূরা ও নামাজের সব তাকবীর, তাহরীমা বলে ক্লাস টিচারকে চমকে দিয়েছিলাম।
সংসারের নানান ঝামেলা সাথে আমাদের পাঁচ ভাইয়ের অত্যাচারে আম্মা খুব অতিষ্ঠ থাকতেন। আম্মার কাছে
আমি আর ছোট ভাই রুবেল হচ্ছি বাড়তি ঝামেলার মতো। রুবেল আমার চার বছরের ছোট হলেও, ছয় বছরের আমি দুই বছরের রুবেলকে দিব্বি দেখেশুনে রেখেছি। রুবেল ব্যথা পেয়েছে আমার দোষ, খিদেয় কাঁদছে আমার দোষ। আম্মা আমাকে শপাং শপাং করে মারতেন। মার খেয়ে কখনো কেঁদেছি মনে পড়ে না। তবে না খেয়ে থেকেছি । রাতে আব্বা এসে ঘুম থেকে তুলে আদর করে পাশে বসিয়ে খাইয়ে দিতেন। আর মাকে বলতেন, আমার এই ছেলেটা আলাদা ঠিক যেন ইস্পাত।
কীভাবে যেন ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়ে গেলাম। যারা বৃত্তি পায়নি। তাদের মাঝে একজন পৃথ্বি। ফর্সা চৌকামুখো এক মায়াবতী মেয়ে। পৃথ্বীর বৃত্তি না পাওয়ার দুঃখের কান্নায় আমার মনে হচ্ছিল আমার বৃত্তিটা ওকে দিয়ে দেই। আব্বা আমায় নতুন শার্ট কিনে দিলেন। আমি লজ্জায় বাঁচি না। আম্মা রাগে গজগজ করতে করতে বললেন। বাকি ছেলেরা বানের জলে ভেসে এসেছে। আমার বৃত্তি পাওয়া না পাওয়ায় আম্মা খুশি হলেন না রাগ করলেন ঠিক বুঝলাম না।
মাঝে মাঝে বালু নদীতে সাঁতরাতে যাই। কী স্বচ্ছ পানি। একদম নদীর নিচ পর্যন্ত দেখা যায়। বিকেল বেলায় ধানের খড়ের উপরে শুয়ে শুয়ে বন্ধুদের সাথে গল্প করি। ওদের গল্প আর হাসাহাসি প্রায়ই কোন মেয়ে কেন্দ্রিক হয়। আমার ভালো লাগে না। আমি চোখ বুজে ভাবি মৃন্ময়ীকে কখনো হৈমন্তীকে। রবিঠাকুরের গল্পের নায়িকা এরা। সন্ধ্যায় ঘরে ফিরি। গায়ে খড়ে ছড়ে যাওয়া দাগ নিয়ে। আম্মার বেতের বাড়ি আর খড়ের ছড়ে যাওয়া দাগ মিলেমিশে কালশিটে পড়ে যায়। আমি পরদিন আবার গুটিগুটি পায়ে বালু নদীর তীরে যাই। আমার নিজেকে পথের পাঁচালির অপু ভাবতে ইচ্ছে করে। তবে আমার কোন ‘দূর্গার মতো’ দিদি বা বোন নেই।
সপ্তম শ্রেণীতে পড়ছি। আব্বার আজ কয়েকদিন শরীর খারাপ। দোকানে যেতে পারছেন না। আমি আব্বার কাছে বসে বসে ছোট ছোট হাদিস পড়ি। রুবেল মোটে ক্লাস টুতে পড়ে। আব্বা রুবেলকে নামায শেখার তাগাদা দেন। সেদিন রাতে কেন জানি আমার ঘুম এলো না। ফজরের নামাজ পড়তে একাই মসজিদে গিয়েছি। নামাজ শেষে দেখি সবাই আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি অবাক হয়ে ভাবছি। আমার শার্টের কোথাও কী ছেঁড়া?
এক বড়ভাই এসে আমার হাত ধরলেন। পাভেল চলো তোমায় বাসায় দিয়ে আসি। আমি কেঁপে উঠি। এক দৌঁড়ে বাড়ি আসি। আব্বা মারা গেছেন। সবাই কাঁদছে। আম্মা চিৎকার করে বলছেন ‘ হতভাগা কই ছিলি! শেষ সময়েও লোকটা তোকে দেখতে চেয়েছিল।’ ইস্পাত বদলে সেইদিন থেকে আমার নামের পাশে ‘হতভাগা’ উপাধি জুটে গেল। বড় ভাই পড়া ছেড়ে ব্যবসার হাল ধরলেন। দু বছর পর মেজোভাই ও তাই। রাসেল আমার তিন বছরের বড়। আমি ক্লাস টেনে উঠেছি। সামনে এসএসসি। মনোযোগ দিয়ে পড়ছি। পাশের বাড়ির তিথির সাথে প্রায়ই দেখা হয়। আমার কাছ থেকে নোট নিতে প্রায়ই আমাদের বাড়ি আসে। একবার এলে আর যেতে চায় না। আমার বড্ড অস্বস্তি লাগে। আম্মা কী না কী ভাবেন।
এসএসসিতে খুব ভালো রেজাল্ট হলো। আমি পুরো শহরের মাঝে প্রথম হয়েছি। রাসেল ভাই অনেক মিষ্টি নিয়ে এলো। নিজের পাশের মিষ্টি নিজে খাচ্ছি। দেখি আমার পাশ ঘেঁসে একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে শাড়ি পরনে। মাথায় ঘোমটা দেয়া। মুখে মিষ্টি থাকার কারণে আমার চিৎকার গলায় আঁটকে গেলো। জোড়ে বিষম খেলাম, যখন শুনলাম, তিথি আজ দুপুরে রাসেলের কাছে পালিয়ে এসেছে। ইয়া আল্লাহ। আমি এক দৌঁড়ে ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে ভয়ে কাঁপছি। আমি ঠিক শুনছি তো! তিথি যে ভয়ঙ্কর মেয়ে। ও আবার আমার নাম বলে বসবে না তো! আল্লাহ রক্ষা করো। আম্মা তাহলে আমাকে পিটিয়ে মেরেই ফেলবে। রাতে বড় ভাইয়েরা আসলেন। তারা বুঝিয়ে শুনিয়ে তিথিকে বাড়িতে দিয়ে আসলেন। বলা হলো পরে অনুষ্ঠান করে তাকে তুলে আনা হবে। আমি কলেজে ভর্তি হলাম। গোঁফ ওঠেনি। আমি লজ্জা লজ্জা মুখ করে কলেজে যাই। মেয়েদের দিকে ভয়ে তাকাই না। একদিন নয়ন বললো – জানিস পাভেল পৃথ্বী এই কলেজেই পড়ে। আমি অবাক হয়ে যাই। কলেজের তিনতলা দালানটিকে আমার স্বর্গ মনে হতে থাকে। আমি ওর কাছে জিজ্ঞেস করতেও ভুলে যাই ও কী করে পৃথ্বীকে চিনলো। সবচেয়ে অবাক হই সেই সন্ধাতেই ফোন আসে। ‘ আমি পৃথ্বী। ভালো আছেন তো ! ‘
পৃথ্বীর সাথে প্রায়ই আমি ঘুরে বেড়াতাম। ও সাথে থাকলে রিকসার ঘণ্টা, বাসের হর্ণ, কিছুই আমার কানে আসে না। পথের ধুলা, পথচারীদের চিৎকার, গা ঘেঁসে যাওয়া প্রিমিও এ সমস্তই আমি অবলীলায় অগ্রাহ্য করতাম। কারণ আমি জানতাম এই সমস্ত সাধারণ ব্যাপারগুলি শেষে কোন এক ফাঁকে আমি পৃথ্বীর নরম হাত এক মুহুর্তের জন্য ছোঁয়ার অধিকার পাবো। যা আমাকে পরম শীতের লেপ বিহীন রাতেও উষ্ণতা জোগাবে। বড়লোকের ছেলে আমি কখনোই ছিলাম না। তাই অন্য দশজন ছেলের চেয়েও আমাকে নিজের আত্মসম্মান, আত্মসংযমের সাথে ধরে রাখতে হয়েছে। আমি জানতাম আমাকে লক্ষে পৌঁছাতে হবে। এইচএসসির অসাধারণ ফলাফল পৃথ্বীর চোখে আরো একটু স্বপ্ন বুনে দিয়ে গেল। মাঝরাতে আমাকে কল দিয়ে সে একদিন গাইলো। শাহানা বাজপেয়ীর গান। ‘ একটা ছেলে মনের আঙিনাতে ধীর পায়েতে এক্কা দোক্কা খেলে। বন পাহাড়ির ঝর্ণা জলে একলা ভেজে। সেই ছেলেটা আমায় ছুঁয়ে ফেলে। সেই ছেলেটা আমায় ছুঁয়ে ফেলে। ‘
আমি ওর হাত ছোঁয়ার লোভে পুরোরাত ছটফট করি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি ফি জমা দিয়ে আমি আর পৃথ্বী সেদিন খুব ঘুরলাম। ওর ছিলো ১২৫ টাকা আমার ১৫০ এই মিলিয়ে ভয়ে ভয়ে কাচ্চি খাই। ওকে বাসে তুলে দিয়ে বাড়ি ফিরি। পরদিন এবং তার পরদিন পৃথ্বীর ফোন আসে না। নয়ন এক সন্ধ্যায় আসে আমাকে বালু নদীর তীরে নিয়ে যায়। তারপর বিড়বিড় করে বলে বহু কথা। তার কিছু বুঝি কিছু বুঝি না। শুধু একটা বাক্য মাথায় ঘুরছে ‘ পৃথ্বীর কাল বিয়ে হয়ে গেছে। ‘ আমি ছেলেবেলার মতো খড়ের গাদায় আকাশের দিকে চেয়ে শুয়ে থাকি। পৃথ্বী বলেছিল ‘ আমার যখন মনে হয়, তুমি আমাকে ভালোবাসো না। আমার পৃথিবীর সব কিছু ভেঙ্গে ফেলতে ইচ্ছে করে। তুমি কেন আমায় ভালোবাসবে না! ‘
খুব ছেলেবেলায় একটা পাপ করেছিলাম। তখন বয়স সাত / আট হবে। একটা কুকুরের বাচ্চাকে নদীতে ছুঁড়ে মেরেছিলাম। ছানাটি আর উঠতে পারেনি। আমার নিজেকে সেই ডুবন্ত কুকুরছানা মনে হয়। নিশ্বাসের কষ্ট। প্রায় মাঝরাতে রাসেল আমাকে খুঁজে নিয়ে আসে। আমি জ্বরে কাঁপছি। সাতদিন জ্বরে আর নিউমোনিয়ায় ভুগে প্রায় মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে এলাম। প্রিয় মানুষ হারানোর কষ্ট, শারীরিক কষ্ট হয়ে আমার জীবনে এলো। আমি ক্লাস করি যেন ভূতে পাওয়া মানুষ। সেকেন্ড ইয়ার ফাইনাল দিয়েছি। ক্লাস নেই, তবুও যাই। সবার সাথে থাকলে যন্ত্রণা একটু কম মনে হয়। দল বেঁধে সবাই বন্ধুর প্রেমিকাকে রাগায়। চড়ুই পাখি বারোটা ডিম পেড়েছে তেরোটা একটা ডিম নষ্ট চড়ুই পাখির কষ্ট।
আমিই একা বন্ধুহীন। আমার কিছুই ভালো লাগে না। উপন্যাস, কবিতায় মুখ গুঁজে থাকি। না পেলে ডিকশনারি। হঠাৎ একদিন মকবুল স্যার এটা আবিস্কার করলেন। আমাকে ইংরেজীতে আঁটকানো কঠিন। নববর্ষে নতুন খেতাব পেলাম ‘ উইকিপিডিয়া। ‘ একদিন ক্যাম্পাসে আনমনে হাঁটছি। দেখি আমার শার্টের হাতা কারো হাতের মুঠোয়। ফিরে তাকিয়ে অবাক হই। পৃথ্বী দাঁড়িয়ে। তার আমেরিকা প্রবাসী স্বামী তাকে রেখে আবার নিজ কর্মক্ষেত্রে চলে গেছে। পৃথ্বী এতোদিন চেষ্টা করেছে আমাকে ভোলার। তারপর ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসেছে।
আমি এখন আরো শক্ত মানুষ। কারো স্ত্রীর উপরে অধিকার খাটাবো এমন আমি নই। পৃথ্বীকে তার বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসি। ফেরবার সময় বুঝি, আজো ও আমার মনের আঙিনায় ধীর পায়ে হেঁটে যাচ্ছে। আমি চুপচাপ ছাদে শুয়ে থাকি। অনন্ত নক্ষত্ররাজী আকাশের বুকে জোনাক হয়ে জ্বলে। বাঁকা চাঁদ মেঘের আড়ালে লুকায় লজ্জায়। হয়তো আমার ব্যর্থতায়। আসলে আঁকড়ে ধরার মতো আমার কিছুই নেই পৃথিবীতে। অথচ আমার এই বয়সে সব থাকার কথা ছিল। সম্বল আমার দুটো টিউশনি। সেই নিয়ে ভাঙ্গা পায়ের মতো সংসারে সোজা হয়ে হাঁটার স্বপ্ন দেখা যায় না।
পৃথ্বী চলে যাচ্ছে ওর স্বামীর কাছে। তার আগে আমার কাছে কিছু স্মৃতি ধার চায়। অনার্স শেষ বর্ষে পড়া যুবক কীইবা স্মৃতি জীবন ভাণ্ডারে জমা করতে পারে! একদিন পুরো একটা দুপুর ওকে নিয়ে হাঁটি। সস্তার চাইনিজে বিকেলে খাওয়াই। স্যুপেও আজকাল ঝাল দেয়। ঝালের আড়ালে পৃথ্বীর চোখে জল। সেই জলে আমার ভেসে যাওয়া হয়না। আমি ওকে বলি। সংসারের জন্য কিছু করলে সংসার থেকে আশা করা যায়। যখন মানুষ একটু সঙ্গ চায় তখন আমি একা থেকেছি। কারো আদর বা আবদারের সঙ্গী আমি নই। চলো তোমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। সেই শেষ দেখা। বারো বছর পড়ে আজ আমেরিকা এসেছি। একদিন কী মনে করে পৃথ্বীকে কল দেই। ‘ আমি পাভেল । ভালো আছো তো? ‘ বাড়ির সামনে বড় একটা লন। আমি পৌঁছানো মাত্র দুটি দেব শিশু হাত বাড়িয়ে দেয়।
– আমি নোরা। আমি খুব ভালো বাংলা বলতে পারি তাই না! আমি অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে আছি। সেই বৃত্তি না পাওয়া অভিমানী চোখের এক মেয়ে। আহ কী মায়াবী। আমাকে আরো অবাক করে দেয় ক্ষুদে আরেকজন।
– আমি পাভেল। আমিও বাংলা জানি। জানো মা আমাকে ইস্পাত বলে ডাকে। Um sure Steel means
ইস্পাত, তাই না? আমি ওদের বুকে জড়াই। কী আশ্চর্য মায়াময় উষ্ণতা। পৃথ্বী হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করে তোমার স্ত্রী কেমন আছে? আমিও হাসতে হাসতে উত্তর দেই। পাভেল পৃথিবীতে যুগে যুগে জন্মেছে। পৃথ্বী সে তো একবারই জন্মায়। বহুদিন পরে আমার ইস্পাতের খোলস ভেঙ্গে মানুষ হবার সাধ জাগে।