ভালবাসাহীন

ভালবাসাহীন

তড়িঘড়ি করে বের হল নিশি। প্রথম সে শাড়ি পরে কোথাও যাচ্ছে। কোথাও বলতে আবিরের কাছে যাচ্ছে। শাড়ি পরে হাটতে তার খুবই সমস্যা হচ্ছে। মনে হচ্ছে এই বুঝি কোমর থেকে শাড়িটা খুলে পড়ল যদিও সে শক্ত করেই শাড়ি পরেছে। এতটা শক্ত যে পেট ও পিঠের চামড়া কেটে যাবে। বাসা থেকে বের হয়েই রিকশা নিল। রিকশাওয়ালারা ইদানীং খুব চালাকি করে। একটু সেজেগুজে বেরোলে অতিরিক্ত ভাড়া দাবী করে। চল্লিশ টাকার পথের জন্য নিশিকে ষাট টাকা গুনতে হল। তারপরও আজ তার মনটা খুব ভাল। আবিরের বাসার সামনেই আসতে বৃষ্টি শুরু হল। শাড়ি পরে দৌড় দেওয়া যায় না। ভিজতে ভিজতে আবিরের বাসার দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। আবির নিশ্চয় এখনো ঘুমাচ্ছে। দুইমিনিট ধরে নিশি দরজার কড়া নাড়ছে।

ওর কোন সাড়াশব্দ নেই। আর একটা ব্যাচেলর ছেলের বাসার সামনে একটা সুন্দরী মেয়ে এভাবে একা দাঁড়িয়ে থাকা খুবই অস্বস্তিকর। আবির চোখ কচলাতে কচলাতে উঠে দরজা খুলে দিল। খালি গায়ে লুঙ্গী পরা। গ্রামে এই পোশাকে কাউকে দেখলে অস্বস্তিকর লাগে না কিন্তু শহরের কাউকে এই পোশাকে দেখলে খুবই অদ্ভুত লাগে। নিশি ঘরে ঢুকে তার হাতের গিফটবক্সটা খাটের উপর রাখতে গিয়ে দেখল খুবই অগোছালো হয়ে আছে বিছানাটা। সে জানে ব্যাচেলররা একটু অগোছালো হয় কিন্তু এতটা হয় তা সে বুঝতে পারেনি। রাগী চোখে আবিরের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি এখানে কিভাবে ঘুমাও? তাও আবার সকাল দশটা পর্যন্ত? আবির নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, দশটা বাজতে এখনো তের মিনিট বাকি।

আবিরের এই নির্বিকার ভাবটা নিশির খুব ভাল লাগে। সে আর রাগ ধরে রাখতে পারল না। হেসে বলল, বাথরুমে যাও, গোসল কর। এই, ব্রাশ না নিয়ে কই যাচ্ছ? আর হ্যাঁ, তোমার এই দেবদাস মার্কা দাড়িটা আজ বিসর্জন দাও।
আবির বাথরুমে ঢুকে গেছে। এদিকে প্রলাপ বকতে বকতে নিশি রুমটা গোছাতে লাগল। মেয়েরা সাজানো গোছানো কাজ খুব ভাল করতে পারে আর যে মেয়েদের মধ্যে এই গুণটা নেই, তাদের মধ্যে মেয়েভাব থাকে না, কেমন যেন ছেলেভাব চলে আসে। বাথরুমের ভিতর থেকে আবির বলল, নিশি, হ্যাঙ্গার থেকে কালো প্যান্টটা দাও।

-আমি পারব না, কাজ করছি তুমি নিয়ে নাও।
-আরে, আমি অর্ধনগ্ন হয়ে তোমার সামনে আসব নাকি? শুধু তোয়ালে পেঁচিয়ে?
-নাহ বাবা, মাফ চাই। আমি দিচ্ছি।

নিশি হ্যাঙ্গার থেকে প্যান্টটা নিয়ে বাথরুমের দরজা একটু ফাঁক করে আবিরকে দিল। আবির বাথরুম থেকে বের হয়ে এসেছে। নিশি আবিরের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। শেভ করায় আবিরকে অন্যরকম লাগছে।
হঠাৎ একটা কথা মনে করতেই নিশির মন খারাপ হয়ে গেল। আর প্যাকেটটা খোল তো। নিশি বলল, প্যাকেটে কী আছে বল তো?

-তুমি আমার জন্য পাঞ্জাবী নিয়ে এসেছ। ওটা পরব। নাকি খালি গায়ে থাকব। আবির ঘড়ি দেখল দশটা সাতাশ।

প্যাকেট খুলে পাঞ্জাবী পরছে এমন সময় বাইরে থেকে কেউ ডাকল, আবির ভাই, বাসায় আছেন? আবির পাঞ্জাবীর বোতাম লাগাতে লাগাতে দরজার কাছে গেল। একটা ছেলে দুইটা প্যাকেট নিয়ে এসেছে। তাকে ধন্যবাদ নিয়ে বিদায় করে নিশির হাতে একটা প্যাকেট দিয়ে বলল, হ্যাপি বার্থডে টু ইউ। নিশির যে কী ভাল লাগছে তা বুঝাতে পারবে না। আবির মনে রেখেছে যে আজ তার জন্মদিন। কিন্তু তার ভাব দেখে মনে হয় যে সে ভুলেই গেছে। আরেকটা প্যাকেট ছিল জন্মদিনের কেকের। নিশি কেক কাটল। দুজন দুজনকে কেক খাইয়ে দিচ্ছে। এরকম রোমান্টিক দৃশ্য খুবই কম দেখা যায়।

বৃষ্টি থেমে গেছে। আবির আর নিশি বাইরে বের হল। রিকশা পেয়ে গেছে। দুজন রিকশায় বসে আছে চুপচাপ। তাদের এই চুপচাপ থাকার অন্য একটা কারণ আছে। আর তা হল আজ কথা ছিল নিশি রিকশায় উঠে গান গাইবে। যতক্ষণ না গান গাওয়া হবে, ততক্ষণ আবির কথাই বলবে না। নিশি গান গাওয়া শুরু করল, ভালবাসি, ভালবাসি এই সুরে কাছে দূরে জলেস্থলে বাজাই… বাজাই বাঁশি, ভালবাসি ভালবাসি আবির অবাক হয়ে শুনছে। ইন্দ্রাণী সেনও নিশির গান শুনে অবাক হবেন। রিকশার মৃদু কম্পনে নিশির গানের সুরে অন্যরকম একটা ভাঁজ পড়ছে যা শুনে আবির সত্যিই মুগ্ধ।

দুপুরে তারা একটা রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ করছে। নিশি খেতে পারছে না। সে আবিরের খাওয়া দেখছে। যাকে ভাল লাগে, তার সবকিছুই মনে হয় ভাল লাগে। না হলে কারও খাওয়ার দিকে এভাবে তাকিয়ে থাকার মানে হয় না। খাওয়াদাওয়া করে তারা রিকশা করে টিএসসিতে এল। আজ এখানে কেমন ফাঁকাফাঁকা লাগছে। টিএসসি ফাঁকা থাকলে ভাল লাগে না। এই যায়গাটা সবসময় গমগম করবে- এটাই যেন নিয়ম। আবির দোকান থেকে সিগারেট নিয়ে ধরাল। আসলেই আজ ভরপুর খাওয়া হয়েছে।

-এখন কী ভাবছ তুমি, আবির?
-তোমাকে বাসায় পৌঁছে দিব। তারপর একটু মিরপুরের দিকে যাব।
-আমি এই ভাবনার কথা বলছি না। আমাদের বিয়ের ব্যাপারটা নিয়েই কথা বলছি।
-তোমাকে তো আগেই বলেছি, চাকরিটা হলেই করব।
-তোমার না গতকাল একটা ইন্টার্ভিউ ছিল, ওইটার কী খবর?
-বলেছে পরে জানাবে। তাদের এই পরে জানানোর অর্থ জান?

নিশি চুপ করে আছে। আবিরের এই উত্তেজনা নিশির পরিচিত। আসলে বেচারা একটা চাকরীর জন্য কতকিছুই না করছে। তিন বছর ধরে একটা চাকরীর পিছনে দৌড়চ্ছে আবির।

-মাথা ঠাণ্ডা করে বস আর সিগারেট শেষ কর। আমার কথাগুলো তোমার মন দিয়ে শোনা উচিৎ। আবির নিশির পাশে বসল। নিশি সময় নিচ্ছে। এই সময় নেওয়ার অর্থ হল একটা লম্বাচওড়া ভাষণ দিবে।

-আবির, আমি বাবা মায়ের প্রথম সন্তান। আমার ছোট একটা ভাই, একটা বোন আছে। আমার ছোটবোনের জন্যেও মাঝেমাঝে বিয়ের সম্বন্ধ আসছে। ব্যাপারটা কি তুমি বুঝতে পারছ? আমি আমার বাবামাকে আর কতদিন অপেক্ষা করিয়ে রাখব? তোমাকে যা করার একমাসের মধ্যে করতে হবে। আর হ্যাঁ, আজ আমার কততম জন্মদিন গেছে, জান?

-পঁচিশ।
-আমার মত মধ্যবিত্ত পরিবারের একটা মেয়ের এই বয়সে দুই তিনটা ছেলে মেয়ে থাকার কথা। আমি আজ কথাগুলো কেন বললাম জান?
-না।

-আজ আমার পঁচিশতম জন্মদিন তাই। ব্যাপারটা মাথায় রেখ। এখন উঠব। আমাকে কি বাসা পর্যন্ত এগিয়ে দিবে? চাইলে আজ তুমি বাসায় যেতে পার। আমার বাবা তোমাকে খুব একটা পছন্দ না করলেও আমার মা কিন্তু তোমাকে  খুব পছন্দ করে।

-জানি, তিনি তো আমাকে “বাবা” ছাড়া ডাকেনই না। চল, তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আবার মিরপুর যাব। রিকশা নিয়ে তারা চলে গেল।

নিশির মন খুবই খারাপ। সাতদিন আবিরের কোন খবর নেই। সাতদিন আগে আবিরের সাথে শেষবারের মত কথা হয়েছিল। তার গ্রামের বাড়িতে গেছে। এরপর থেকে তার ফোন বন্ধ। আবিরের বন্ধু শুভর কাছ থেকেও কিছু জানা যায়নি। সেও কিছু বলতে পারল না।

পড়ন্ত বিকেলের লাল সূর্যটা দেখতে ভালই লাগে। নিশি বারান্দায় জানালা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। বাতাসে চুল উড়ে ওর মুখের উপর পড়ছে। খুব বিষণ্ণ লাগছে। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি যদি বেঁচে থাকতেন আর এই দৃশ্যটা দেখতেন, তাহলে একটা ছবি এঁকে ফেলতেন যা মোনালিসার মত জনপ্রিয় হত। অপলক চোখে নিশি শূন্যের দিকে তাকিয়ে আছে। তার কাছে মনে হচ্ছে সময় স্থির হয়ে আছে। নিশির মায়ের ডাকে ওর ঘোর কাটল।

-কিরে, তোর কী হয়েছে নিশি?
-কিছু না, মা।
-তোকে এমন চিন্তিত দেখাচ্ছে কেন?
-কই? এমনিতেই। অনেকদিন তোমার সাথে বসে গল্প করা হয় না। আমি চা নিয়ে আসি।

নিশি চলে গেল। নিশির মা বারান্দার কাঠের ইজিচেয়ারটায় বসলেন। তাঁর মেয়েকে নিয়ে খুব চিন্তিত। বেচারির কী হয়েছে বুঝা যাচ্ছে না। কিছুক্ষণের মধ্যেই দুইটা মগভর্তি চা নিয়ে নিশি এল। সে তার মায়ের পাশের চেয়ারটায় বসে নিঃশব্দে চায়ে চুমুক দিচ্ছে।

-আবিরের সাথে কি তোর ঝগড়া হয়েছে?
-নাহ, ঝগড়া হবে কেন?
-ওর চাকরিবাকরি কিছু হল?
-না।
-তোর কী হয়েছে বল তো মা?
-আবিরের কোন খোঁজ নেই মা, সাতদিন হল ওর ফোন বন্ধ। ওর বাসায় গিয়ে দেখলাম দরজায় বড় একটা তালা ঝুলছে। বলে গেছিল যে বাড়িতে যাচ্ছে। জমিজমা নিয়ে কী ঝামেলা হয়েছে।
-টেনশন করিস না, চলে আসবে।

আবার দুজনের মধ্যে নীরবতা চলে এল। সূর্য আজকের জন্য বিদায় জানাচ্ছে পৃথিবীকে। নীরবতা ভেঙে নিশির মা বলল, একটা গান শোনা মা, তোর গলাটা খুব ভাল লাগে। নিশি গান ধরল, আমার মন কেমন করে আমার মন কেমন করে কে জানে, কে জানে কে জানে কাহার তরে আমার মন কেমন করে গান গাইতে গাইতে নিশি তার মায়ের কোলে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে লাগল। তিনি নিশির মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। বারোদিন পর নিশি আবিরকে ফোনে পেল।

-কী ব্যাপার? তোমার খবর নেই কেন?
-অনেক ঝামেলা গেছে আমার উপর দিয়ে।
-তুমি কোথায় এখন?
-বাসায়। গতরাতে এসেছি।
-আমি আসছি এখন।
-না, খুব ক্লান্ত। তুমি কাল এসো। এখন একটু ঘুমাব।
-আচ্ছা, ঠিক আছে।

পরদিন নিশি সকালেই আবিরের বাসার দিকে গেল। দ্রুত পায়ে হাঁটছে। দরজা খোলা। আবির খাটে হেলান দিয়ে শুয়ে আছে। আর তার মুখের উপর একটা বই। বইয়ের মলাটে একটা অর্ধনগ্ন নারীর তৈলচিত্র। চেয়ার টেনে নিশি খাটের পাশে বসল। আবির বই মুখ থেকে না সরিয়ে বলল, কেমন আছ নিশি?

-ভাল ছিলাম না। তোমাকে নিয়ে খুব চিন্তিত ছিলাম। এখন ভাল লাগছে। তোমার মুখের উপর থেকে বই সরাও। আবির বই সরাল না। তুমি আমাকে খুব ভালবাস, তাই না?

-টিনএজারদের মত প্রশ্ন কর কেন? ঐ বয়সটা আমি আরও অনেক আগেই পার করেছি। নিশি নিজেই আবিরের মুখের উপর থেকে বইটা সরিয়ে অবাক হল। সারা মুখে খোঁচাখোঁচা দাড়ি। চোয়াল ভেঙে গেছে, চুলগুলো উসকোখুসকো, আর চোখ গর্তে ঢুকে গেছে।

-তোমার এ কী অবস্থা?
-আর বল না। বাড়িতে গিয়ে জ্বর বাধালাম। জ্বর নিয়েই দৌড়াদৌড়ি করতে হয়েছে। ঠিকমতো নিজের দিকে তাকানোর সুযোগই পাই নাই।
-ঝামেলা মিটেছে?
-নাহ, থানাপুলিশ করতে হয়েছে। দেখা যাক, কী হয়। আবির উঠে বসল। নিশির দিকে তাকিয়ে বলল, তোমাকে আজ খুব বেশি সুন্দর লাগছে। চা খাবে?
-হুম।

আবির চা বানাতে গেল। নিশি অর্ধনগ্ন নারীর ছবির মলাটের বইটা নিয়ে পড়তে লাগল। প্রাচীন মিশরে পিরামিডের ইতিহাস আবির চা নিয়ে এসেছে। নিশি চায়ের কাপের দিকে তাকিয়ে আছে, মুখে দিচ্ছে না।

-কী হল, চা খাচ্ছ না যে?
-এমনি। আর তুমি জংলী সেজে থেকো না, প্লিজ। আজই চুলদাড়ি কাটাবে। আর আমার মনে হচ্ছে, ঠিকমতো গোসলও কর নাই। ভাল করে গোসল করবে।
-হুম, এখন চা খাও। ঠাণ্ডা হয়ে গেলে আর চা থাকবে না, শরবত হয়ে যাবে। নিশি চা মুখে দিল। দুই চুমুক দিয়ে রেখে দিয়েছে। আবির বলল, তোমার কী হয়েছে?

-কিছু না, আমি বাসায় যাচ্ছি। পরে কথা হবে।
-চল, আমি এগিয়ে দেই।
-না থাক, তুমি রেস্ট কর।

নিশি বের হয়ে গেল। আবির চা শেষ করে বইটা হাতে নিয়ে পড়তে লাগল। খুব ইন্টারেস্টিং বই। যতই পড়ছে, ততই আবিরের কপালে ভাঁজ পড়ছে। নিশি সরাসরি বাসায় গেল না। রিকশা করে নিউমার্কেট এল। এরপর হাঁটছে। উদ্দেশহীন হাঁটা। একটা সুন্দরী মেয়ের এভাবে উদ্দেশহীন হাঁটা মানায় না।

-হ্যালো, ফোন ধর না কেন? কতবার ফোন দিয়েছি আমি?
-বই পড়ছিলাম। একটা খুব ইন্টারেস্টিং বই। আর তুমি যখন ফোন দেওয়া শুরু কর, তখন একটা টার্নিং পয়েন্টে ছিলাম।

-আমার ফোন থেকে তোমার বইয়ের টার্নিং পয়েন্ট ইম্পরট্যান্ট?
-না।
-তুমি এখন বাসায় কী করছ? আজ না তোমার ইন্টার্ভিউ ছিল?
-হ্যাঁ।
-তাহলে বাসায় কেন?
-ইন্টার্ভিউ দিব না।
-মানে কী?
-চাকরী করব না।
-তোমার সমস্যা কী?
-কোন সমস্যা নাই।

মেজাজ খারাপ করে নিশি ফোন রাখল। আবিরের কী হয়েছে বুঝতে পারছে না। গত তিনদিন ধরে আবির তার সাথে ঠিকমতো কথা বলছে না। ফোন তো দিচ্ছেই না, বরং তাকে ফোন দিলে বিরক্ত হচ্ছে। নিশি বের হয়ে গেল। দরজা বন্ধ। ধাক্কা দিতেই খুলে গেল। আবির শুয়ে আছে, হাতে বই। একবার নিশির দিকে তাকালো। আবার বইয়ের দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। নিশি আবিরের কাছ থেকে বইটা নিয়ে ছুড়ে ফেলে দিয়ে বলল, আমাকে এত অবহেলা করার কারণ কী?

-অবহেলা করছি?
-তা নয় তো কী? তোমার সমস্যা কী বল তো? তুমি কি সম্পর্ক শেষ করতে চাচ্ছ?
-এখানে সম্পর্ক শেষ করার কথা আসছে কেন?
-কথা আসছে এইজন্য যে তুমি আগের মত নেই, অনেক চেঞ্জ হয়ে গেছ।
-তুমিও কিন্তু চেঞ্জ হয়ে গেছ। বস, ঠাণ্ডা হও।
-আমি ঠাণ্ডা আছি। তুমি ইন্টার্ভিউ দিতে যাওনি কেন? আর চাকরী করবে না কেন?
-ব্যবসা করব।
-কিসের ব্যবসা?
-বাড়িতে গিয়ে একটা ডিসপেনসারি দিব।
-আমাকে বিয়ে করবে না?
-কিছুদিন দেরী হবে।
-কতদিন?

-ছয় মাসের মত।
-ছয় মাস তোমার কাছে কিছুদিন?
-তুমি এরকম ব্যবহার করছ কেন?
-করছি এইজন্য যে তোমার জীবনের সাথে আমার জীবন জড়িত। আবির উঠে গেল।
-কোথায় যাও, আমার সামনে বস। আবির দরজা বন্ধ করে কাছে এসে বলল, জীবন জড়িত ঠিক আছে কিন্তু এটা বল, আমার কী করতে হবে?

-তুমি আমার ফ্যামিলির অবস্থা জান। আমার জন্য ফ্যামিলির অনেক কিছু আটকে আছে। আর আমার ফ্যামিলি আমার উপর নির্ভরশীল। আর তুমি নিশি কথা শেষ করতে পারল না। আবির মুখ চেপে ধরে তাকে শুইয়ে দিল। আবিরের শক্তির কাছে সে পরাজিত। চিৎকার করেও কোন লাভ নেই। কারণ সে নিজেই বাঘের খাঁচায় ঢুকেছে। নিশির চোখ বেয়ে অশ্রু পড়ছে। কিন্তু তার কান্নায় কোন শব্দ নেই। শুধু একটা জানোয়ারের হিংস্র গুঙানো শোনা যাচ্ছে।

নিশির মা লক্ষ্য করছেন ইদানীং নিশি সারাদিন দরজা বন্ধ করে শুয়ে থাকে, কোথাও যায় না। আবিরের সাথে কথা বলে না, দেখাও করতে যায় না। সেদিন আবির বাসায় এসেছিল কিন্তু নিশি দেখা করেনি। মাথাব্যথার অজুহাত দিয়ে শুয়ে ছিল। আবির আজ আবার এসেছে। নিশির মা নিশিকে ডেকে বললেন। নিশি বলল, আমার ভাল লাগছে না। ওকে পরে একসময় আসতে বলে বিদায় কর।

-সমস্যা কী? আমাকে খুলে বল।
-সবকথা বলা যায় না। তুমি থাকো, আমি দেখা করে আসছি।

নিশি ড্রইংরুমে এল। আবির বসে আছে। তার সামনে নিশির বোন দিবা বসা। কোন হাসির গল্প করছিল হয়তো, দিবা হেসে কুটিকুটি হচ্ছে।

-এত হাসির কী কথা হচ্ছে শুনি? তোর পড়া নেই?
-আপু…

-যা, আমরা কথা বলি। আর এই ভদ্রলোক এমন মজার মানুষ না যে, তার প্রতিটা কথায় হো হো করে হাসতে হবে।
দিবা মুখভার করে চলে গেল। আবিরের সামনে তাকে অপমান করেছে। আবিরকেও অপমান করা হয়েছে, এটা মনেহয় দিবা বুঝতে পারেনি।

-কেমন আছ, নিশি?
-আমি খুব ভাল আছি।
-আমি ঐদিনের ঘটনার জন্য সরি। আমাকে ক্ষমা কর, প্লিজ। আমি চাকরী পেয়ে গেছি। আগামী মাসের সাত তারিখে জয়েন করব।

-খুব ভাল কথা, নিশ্চয় মিষ্টি নিয়ে এসেছেন।
-আমি তোমাকে সামনে মাসেই বিয়ে করব। নতুন বআআসা খুঁজছি।
-কী বললে? আবার বল।
-আমাদের বিয়েটা….
-আপনাকে আমি বিয়ে করব? আপনার এটা মনে হয়?
-তুমি আপনি-আপনি করছ কেন?
-ওঠেন। চা খাওয়া শেষ হয়েছে। এবার চলেন, আপনার সাথে বাইরে গিয়ে কথা বলি। আবির উঠে পড়ল।

বাসার বাইরে অদূরে একটা বটগাছ আছে। গাছের নিচে দুইটা বেঞ্চ রাখা। নিশি আবিরকে বেঞ্চ দেখিয়ে বলল, এখানে বসেন। নিশি দাঁড়িয়ে আছে। দম নিচ্ছে। আবির বুঝতে পারছে না। একটা ভুল মানুষ করতেই পারে কিন্তু তার জন্য সে অনুতপ্ত।

-আপনি কী বলছিলেন? বিয়ে করবেন আমাকে? কেন বিয়ে করবেন?
-আমি তোমাকে ভালবাসি।
-এই ভালবাসার মানে কী?

প্রেমিকের হাতে প্রেমিকা ধর্ষিত হওয়া? আমি আপনাকে ভালবাসতাম, হয়তো আমার জীবনের একটা চরম ভুল সিদ্ধান্ত ছিল আপনাকে ভালবাসা। যে মানুষের কাছে তার প্রেমিকা, যে মেয়েটা সেই মানুষটাকে জীবনের চেয়েও বেশি ভালবাসে, সেই মেয়েটা নিরাপদ না, সেই মেয়ের কি উচিৎ সেই মানুষটাকে বিয়ে করা?

-আমি তার জন্য অনুতপ্ত। আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাচ্ছি। প্লিজ, ক্ষমা কর।
-আপনি তো কোন অন্যায় করেন নি। কিসের ক্ষমা? আপনি মনুষ্যত্ব হারিয়েছেন। আপনি আর মানুষ নন, আপনি একটা অমানুষ। আর একটা অমানুষের সাথে জীবন কাটানো সম্ভব না। আপনি ভুলেও আমার সাথে, আমার পরিবারের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করবেন না। তাহলে যে কাজটি করিনি, আমি সেই কাজটিই করব। কী করব জানেন?

-না।
-আত্মহত্যা করব।
-প্লিজ..
-চুপ। একটা কথাও বলবেন না। ভাল থাকবেন।

নিশি চলে যাচ্ছে। আবির বটগাছের নিচে বটগাছের মত স্থির হয়ে বসে আছে। তার দৃষ্টি নিশির চলে যাওয়া পথের দিকে। দশবছর পরের কথা। নিশি এখন একটা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা। তার ভাইয়ের পুলিশে চাকরী হয়েছে, বোন দিবার বিয়ে হয়েছে খুব ভাল ফ্যামিলির ছেলের সাথে। বাবামাকে নিয়ে নিশি সেই বাড়িটাতেই আছে। নিশির চেহারার খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। শুধু চোখে চশমা উঠেছে। তাতে শিক্ষিকা হিসেবে খুব মানিয়েছে তাকে। আর আবির একটা মেয়েকে বিয়ে করেছে। তার এক ছেলে, এক মেয়ে। ছেলেটার বয়স সাত আর মেয়েটার বয়স পাঁচ। একটা ভালভাল চাকরী সে পেয়েছে। সরকারী বাসায় থাকে, সরকারী গাড়িতেই চড়ে।

একদিন বিকেলবেলা নিশি বসুন্ধরা সিটিতে গেল। লিফটে ছয় তলায় যাবে। লিফট যখন তিনতলায় এল, দরজা খুলে গেল তিনতলার লোকদের নামাতে ও ওঠাতে। আর তখনি নিশি দেখল, কোট-টাই পরা একটা সুদর্শন লোককে। চিনতে অসুবিধা হয়নি। চেহারার মধ্যে একটু বয়সী ভাব এসেছে, আর জুলফির উপরের কিছু চুলে পাক ধরেছে। এই লোকটাই আবির। আবির তার মেয়েকে নিয়ে লিফটে উঠল। লিফটে ঢুকেই আবির নিশিকে দেখে চমকে উঠল। কথা বলতে গিয়েও বলতে পারল না। সেই দশ বছর আগের কথাটা মনে পড়ে গেল। কী অদ্ভুত ব্যাপার। আবিরের মেয়েটা নিশির পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। নিশির একটা হাত বাচ্চা মেয়েটার মাথায় চলে গেল। কী নিষ্পাপ মুখ মেয়েটার!

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত