জিলাপি

জিলাপি

-এই ছেলে আমার জিলাপি কই?

কথাটা শুনে বেশ হকচকিয়ে গেলো হিমু। জুম’আ এর নামাজ পড়ে মসজিদে থেকে বাড়ি ফিরছিলো হিমু। মসজিদ থেকে ৫ মিনিটের রাস্তা হিমুদের বাড়ি। অর্ধেক রাস্তা আসার পরেই হঠাৎ একটা মেয়ে এসে উপরের কথাটা বললো। মেয়েটাকে দেখতো তো মাশাল্লাহ বেস ভালো। কিন্তু হিমু সে কথা ভাবছেনা। মেয়েকে নিয়ে পরে ভাবা যাবে। কিন্তু ভাবনার বিষয় হচ্ছে এই মেয়ে আমাকেই কেন বলবে? হিমু এদিকে – ওদিকে তাকিয়ে দেখলো। না কেউ তো আসছে না।

– আপনার মনে হয় কোথাও ভুল হচ্ছে।
– এই ছেলে ভুল হচ্ছে মানে কি হুম? কিসের ভুল হচ্ছে? (রাগী রুপে কথাগুলো বললো)

বাহ্ মেয়েটাকে রাগলে তো বেশ লাগে। না এভাবে তাকিয়ে থাকা যাবেনা। প্রেমে পড়ে যেতে পারি। হিমু মনে মনে ভাবছে কথাগুলো।

– এই ছেলে কি ভাবেন হুম?
– না কিছু না। আসলে আপনাকে আমি চিনতে পারছি না।
– চেনা লাগবে না। আগে আমার জিলাপি দেন।
– এই মেয়ে আমি জিলাপি কই পাবো হুম? আমি কি জিলাপির দোকান দিয়েছি নাকি?
– ওই দেখেন সবাই জিলাপি আনছে মসজিদ থেকে। আপনি আনেন কেন?
– আমি কি মসজিদে জিলাপি আনতে যায়?
– আমি জানিনা আমাকে এখনই জিলাপি দেন।

হিমু আর একটুও দাঁড়ালো না। মেয়েটার মাথায় মনে হয় সমস্যা আছে। না হলে চেনা নেই জানা নেই সেই আমাকে বলছে জিপালি দেন। তাও আবার অধিকার খাটিয়ে। যেন আমার বিয়ে করা বৌউ। এদিকে মেয়েটা ভাবছে ইশশশ খালি ভাব। কি ভালো নিজেকে? অপেক্ষা করো তোমার বৌউ হই তারপর সব ভাব একদম শেষ করে দিবো হু। আর শুক্রবারে যদি জিলাপি না আনো তোমার ঘরে ঢোকাই বন্ধ করে দেবো।

হিমু এবার অনার্স ২য় বর্ষে পড়ছে। বাবা মায়ের দুই সন্তানের মধ্যে বড় হিমু আর ওর ছোট বোন মিরা এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। আর ওই মেয়েটা যে হিমুর সাথে একটু আগে কথা বললো তার নাম রুপা। রুপাও এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। এখনও রেজাল্ট বের হয়নি। ছোটবেলা থেকেই দুজন একই গ্রামে বড় হয়েছে। কিন্তু হিমু কখনই রুপাকে দেখেনি। হিমু বেশি ঘর থেকে বের হয় না। সারাদিন পড়ালেখা নিয়ে থাকে। বিকালে মাঝে মাঝে বের হয়। আর নামাজের সময় মসজিদে যায়। হিমু খুবই ভালো ছাত্র আর বেশ ভদ্র। গ্রামে বেশ সুনাম হিমুর। সবাই হিমুকে বেশ পছন্দ করে। আর করবেই না কেন? নামাজ পড়ে, সবার বিপদে সবার আগে এগিয়ে আসে। কোন বাজে আড্ডা দিবেনা।

রুপা বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে। রুপাও বেশ ভালো একটা মেয়ে। কিন্তু রুপা ছাত্রী হিসেবে মোটামুটি। বেশ রাগী মেয়েটা। তবে মনটা অনেক কোমল। সবাইকে ভালোবাসে। সবসময় সাধারণ ভাবে থাকে। হিমুকে রুপা খুব পছন্দ করে। হিমুর চলাফেরা, সবার সাথে ভালো ব্যবহার, মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়া এগুলোই রুপার মনে ধরেছে। রুপার মনে হয় হিমুকে যদি ও পায় তাহলে এজীবনে আর কিছুরই দরকার হবেনা ওর। রুপা হিমুকে সবসময় ফলো করে। যখন নামাজের সময় হয় তখন রুপা রাস্তার পাশে লুকিয়ে থাকে হিমুকে দেখার জন্য। কে লুকিয়ে দেখে সেটা রুপা এখনও জানেনা। প্রতি শুক্রবারে মনে হয় হিমুকে বলি আমার জিলাপি কই। কিন্তু কখনই বলা হয়ে ওঠে না রুপার। আজ একদম সাহস করে বলে ফেলেছে। রুপা সবসময় চেয়েছে এইচএসসি পরীক্ষার পর হিমুকে ওর মনের কথা বলবে। পরের দিন হিমু আসরের নামাজ পড়ে বাসি আসছে তখনই রুপা হিমুকে ডাক দেয়।

– এই যে হিমু সাহেব একটি দাঁড়ান।
– হুম বলেন।
– কেমন আছেন?
– ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?
– ভালো আছি। আচ্ছা একটা কথা বলবো।
– জ্বি বলেন?
– আপনি কি কালকে আমার উপর রাগ করেছেন?
– না রাগ করবো কেন?
– আসলে হয়েছে কি

রুপার কথা শেষ হবার আগেই হিমুর ফোন বেজে ওঠে। আম্মু ফোন দিয়েছে। হিমু কথা শেষ করে।

– আপনার সাথে পরে কথা হবে। আব্বুকে আনতে যেতে হবে। বাই।
– আচ্ছা বাই।

হিমু চলে আসে। রুপা ভাবে ইশশশ আজও হলো না। এখন থেকে প্রতিদিন ওদের বাড়ি যাবো। যেহেতু ওর সাথে দেখা দিয়েছি ওদের বাড়ি যেতেই পারি। হিমুর বোন আর রুপা বেস্ট ফ্রেন্ড। কিন্তু রুপা ওদের বাড়ি যায়না। হিমুর জন্যই জায়গা। কিন্তু এখন থেকে যাবে। হিমু বসে বই পড়ছিলো বারান্দায় বসে। দেখে মেয়েটা আসছে। আরে এই মেয়ে আমাদের বাড়ি কেন?

– আরে রুপা তুই আমাদের বাড়ি? (মিরা)
– কেন আমি আসতে পারিনা?
– আমি কি তা একবারও বলেছি?
– তা বলিস নি।
– রুপা আমি এখনও বিশ্বাস করতে পারছিনা যে তুই আমাদের বাড়িতে।
– থাক হয়েছে। আর ভাবতে হবেনা।

এরপর রুপা অনেক সময় থাকে ওদের বাড়িতে। হিমু অনেকবার লক্ষ্য করেছে মেয়েটা সারাক্ষণ হিমুর দিকে তাকিয়ে থাকে। কয়েকবার চোখে চোখও পড়েছে। হিমু যখনই তাকিয়েছে তখনই রুপা চোখ সরিয়ে নিছে।

রাতের পড়তে পড়তে হঠাৎ করে হিমুর রুপার কথা মনে পড়ে। আজই রুপার নাম জানতে পারে। যখন মিরা রুপা বলে ডাকছিলো তখনই হিমু শুনেছে। হিমু কোন ভাবেই রুপাকে মাথা থেকে সড়াতে পারছেনা। প্রথম দিনে সেই জিলাপি চাওয়া, ওর রাগী মুখের সৌন্দর্য, কথার বলার ধরন সব যেন হিমুকে ঘিরে ধরেছে। হিমু বেশ বুঝতে পারছে হিমুর Love at first side হয়েগেছে। রুপার প্রেমে বেশ ভালো করেই পড়েছে হিমু। এরপর থেকে যখনই ওদের দেখা হয় দুজনেই লজ্জায় কেউ কারো দিকে তাকাতে পারে না। রুপা যখন হিমুদের বাড়ি আসে তখন হিমু লুকিয়ে লুকিয়ে রুপাকে দেখে। রুপাও বেশ বুঝতে পারছে হিমু ওর প্রেমে পড়ে গেছে। রুপা ঠিক করে ফেলেছি আমি আর বলবো না। হিমুরই বলতে হবে আমাকে। যেদিন রাস্তায় দুজনের দেখা হয়ে গেলো।

– কেমন আছেন হিমু সাহেব?
– ভালো আপনি?
– আপনি আপনি করেন কেন? আমি কি আপনার বড়ো নাকি? তুমি করে বলবেন।
– আচ্ছা ঠিক আছে।
– ভালো আছি।
– তোমার সাথে একটু কথা ছিল।
– হুম বলেন।
– এখন না কালকে একটু নদীর পাড়ে আসতে পারবে আমি অপেক্ষা করবো। বিকাল ৫ টায়।
– আচ্ছা ঠিক আছে। আমি আসবো।

পরের দিন হিমুর আগেই এসে রুপা দাঁড়িয়ে আছে। হিমু এসে দেখে রুপা পানির দিকে মুখ করে আছে। হিমুর আসার পর রুপা যখনই হিমুর দিকে তাকালো হিমু সাথ সাথে চমকে উঠে। এ কি দেখছে হিমু। এ যেন আকাশ থেকে পরি নেমে এসেছে। সাদা লেহেঙ্গা আর সাথে নীল একটা হিজাব। হিমু কোনদিন বোঝাতে পারবেনা রুপাকে কতটা ভালো লাগছে ওকে। এস সুন্দর প্রকৃতি আরো সাজিয়ে দিয়েছে রুপা। রুপার উপর আবারও ক্রাশ খায় হিমু।

– এই যে কই হারিয়ে গেলেন? হিমু কিছু বলেনা। একই ভাবে তাকিয়ে আছে রুপার দিকে।

– এই মিস্টার কোনদিন মেয়ে দেখননি নাকি?
– তোমার মতো দেখি নি তো।
– কি বললেন?
– উ উ কিইই কিইই না মানে
– কি মানে মানে করছেন?
– রুপা তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে।
– হয়েছে আর আলু মারতে হবে না।
– না রুপা আলু মারছিনা। সত্যি বলছি।
– হুম বুঝলাম। এবার কি বলবেন বলেন।
– আসলে হয়েছে কি রুপা।
– হুম কি হয়েছে?
– কিভাবে যে বলি।

হিমু ঘামতে শুরু করেছে। এই শীতের মধ্যেও ঘেমে জামা ভিজিয়ে ফেলেছে।

– এই যে আপনি এত ঘামছেন কেন এই শীতের ভেতর? আপনার শরীর ঠিক আছে তো?
– আসলে রুপা তোমাকে যেটা বলবো সেটা হলো…
– হুম বলেন?
– রুপা আমি তোমাকে ভালোবাসি?

চোখ বন্ধ করে রুপাকে এবার বলেই দিলো হিমু। রুপা মনে মনে তো ভিষণ খুশি। কিন্তু রুপা ভাবছে এত সহজে তো হ্যাঁ বলছিনা।

– রুপা কিছু বলো।
– ভাবছি আপনি মিরার বড় ভাই। তার মানে আমারও বড় ভাই। তারপরও সমস্যা ছিল না। কিন্তু সমস্যা হলো আমাকে যদি জিলাপি দিয়ে প্রপোজ করতেন তাহলে আমি ভেবে দেখতাম।

মনে মনে মুচকি হাসছে রুপা। এদিকে হিমুরও প্রচন্ড হাসি পাচ্ছে। হিমুর হাসি পাওয়ার কারন হলো হিমু সাথে করে জিলাপি নিয়ে আসছে। বেশি আনা যাবে না দেখে ১০ টাকা দিয়ে অল্প কিছু এনেছে। যেন নিতে সমস্যা নাই হয়। ভেবেছে আসার সময় রুপাকে দিবে। মনে মনে হিমু জিলাপিকে বেশ ধন্যবাদ দিলো। এবার হিমু ব্যাগ থেকে জিলাপি বের করে রুপার সামনে দিয়ে বলছে,

– রুপা তুমি কি হবে আমার জিলাপি পাগলী? তুমি কি হবে আমার বাবুদের জিলাপি খাওয়া আম্মু। তুমি কি হবে আমার এবার রুপা কিছু না বলে হিমুকে জড়িয়ে ধরে। হিমু চমকে উঠে। রুপা বলে,

– তোমাকে তো সেই কবেই ভালোবেসে ফেলেছি। শুধু ভয়ে বলতে পারিনি। হিমু আমি হবো তোমার পাগলী, তোমার বাবুদের আম্মু।

– রুপা ছাড়ো সবাই দেখছে। রুপা এবার বেশ লজ্জা পায়। হিমুকে ছেড়ে না দিয়ে হিমুর বুকে মুখ লুকায় রুপা।

– হয়েছে আর লজ্জা পেতে হবেনা। সন্ধ্যা হচ্ছে বাড়ি চলো।
– হিমু!
– বলো।
– ভালোবাসি

শেষ বিকালে ভালোবাসা নিয়ে প্রকৃতিকে সাক্ষী রেখে দুজন দুজনের হাতে হাত রেখে হেটে চলে হিমু রুপা। এটাই যেন চাচ্ছিলো প্রকৃতি। আরেকটি সত্যি ভালোবাসার সাক্ষী হয়ে থাকলো কুয়াশাজড়ানো শেষ বিকাল….

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত