ছেলেটি তখন অষ্টম শ্রেণীতে পড়ে। আর মেয়েটি ষষ্ঠ। একই গ্রামের একই স্কুলে তারা পড়ালেখা করে। কোনো এক প্রভাতে কিংবা সন্ধিক্ষণে দু’জনের মধ্যে আলাপ হয়। মেয়েটি দেখতে যতটা সুশ্রী, ঠিক ততটাই চঞ্চল। ছেলেটিও তেমন।
প্রথম আলাপের পর থেকে দু’জনের মধ্যে কথোপকথন বাড়তে থাকে। যেন সদ্য প্রস্ফুটিত ফুলে সঘন ভোমরার আগমনে মুখরিত কানন। ফর্সা বর্ণের সেই ছেলেটির মধ্যে যেন এক ধরনের অদৃশ্য মায়া আছে। মেয়েটি ক্রমান্বয়ে ছেলেটির সেই অদৃশ্য মোহনীয় মায়াতেই আচ্ছন্ন হতে থাকে। একদিন প্রাতঃকালে মেয়েটি ছেলেটিকে বলে, আকাশ তুমি এত দেরি করে স্কুলে আসো কেন? একটু দ্রুত আসতে পারো না? ছেলেটি হেঁসে জবাবস্বরূপ মেয়েটিকে প্রশ্ন করে, হঠাৎ এমন কথা?
– না মানে, রোজ রোজ দেরি করে আসো। একটু তাড়াতাড়ি এলে ক্লাস শুরু হওয়ার আগে বেশ খানিকটা সময় দু’জন একসঙ্গে বসে গল্প করতে পারি।
আকাশ মনে মনে ভাবে, যাক এতদিনে কারো চোখে পড়লাম, যে আমাকে স্মরণ করে, যে আমার প্রতীক্ষায় থাকে, যে আমার সাথে গল্প করতে চায়।
– কী ভাবছো?
মেয়েটির কথায় আকাশ নড়েচড়ে বলে, হ্যাঁ আসবো। কাল থেকে সকাল সকালই স্কুলে আসবো।
– সত্যি বলছো?
– হ্যাঁ।
– আচ্ছা যাই তাহলে এখন, আমার ক্লাস শুরু হয়ে গেছে বোধ হয়।
– আচ্ছা যাও।
মেয়েটি উঠে চলে যেতেই আকাশ পেছন থেকে তাকে ডাক দিয়ে বলে, বৃষ্টি শোনো। মেয়েটি পেছনে ঘুরে হাসি মুখে বলে, বলো। আকাশ মুচিক হেসে বলে, না কিছু না। ক্লাসে যাও। বৃষ্টি একটা হাসি দিয়ে ক্লাসের দিকে পা বাড়ায়। আকাশ অনিমেষ নেত্রে বৃষ্টির পানে চেয়ে। আহ! কী অপরূপ সে হাসি। আকাশ জানে না, “ভালোবাসা কী।” তবে সে এটা জানে যে, বৃষ্টিকে তার ভালো লাগে। এই ভালোলাগা শুধু ভালোলাগাই নয়। বরং ভালোলাগার থেকেও অধিক কিছু। আমরা যার নাম দিয়েছি “ভালোবাসা।” বৃষ্টি অন্য ক্লাসে পড়লেও আকাশ আর তার মধ্যে আড্ডা, ঘুরাঘুরি, গল্প, কোনো কিছুরই কমতি নেই। মুক্ত স্বাধীন পায়রার মতো উড়ে উড়ে চারিদিক ঘুরে ফিরে তারা। দেখে মনে হয় যেন, একজন ছাড়া অপরজন মূল্যহীন।
দিনে দিনে আকাশের মতো বৃষ্টির মনেও ভালোবাসার সৃষ্টি হয়। ছোট্ট মনটা বারবার ডেকে বলে, আকাশ ছাড়া সে এক মুহূর্তও থাকতে পারবে না। কিন্তু সে তার ভালোবাসার কথাটি আকাশকে বলতে পারে না। অন্যদিকে আকাশ চিন্তা-ভাবনা করে ঠিক করে, বৃষ্টিকে সে পরোক্ষভাবে প্রপোজ করবে। মানে সে তার বন্ধুর মাধ্যমে বৃষ্টিকে প্রপোজ করবে। যেই ভাবা সেই কাজ। পরদিন স্কুলে গিয়ে সে রিফাতকে ডাক দেয়। রিফাত বৃষ্টির ক্লাসমেট। একই গ্রামের একই পাড়ায় বাড়ি হওয়ায় রিফাত ছোট থাকা সত্ত্বেও সে আকাশের বন্ধু। আকাশ রিফাতকে বলে, বন্ধু তোদের ক্লাসে বৃষ্টি আছে না?
– হ্যাঁ, আছে।
– ও কি স্কুলে এসেছে?
– না, এখনো আসেনি। তবে চলে আসবে।
– শোন, সে এলে তুই তাকে বলবি আমি তাকে ভালোবাসি।
– তোরা না ভালো বন্ধু?
– হুম। কিন্তু আমি তাকে বন্ধুর থেকে বেশি কিছু ভাবি। মানে তাকে ভালোবাসি আমি। তুই শুধু তাকে এটুকু বলবি যে, আকাশ তোমাকে ভালোবাসে।
– সে যদি না করে দেয়?
– সেটা আমি দেখবো। তুই শুধু বলবি।
– আচ্ছা! আমি বলতে যাবো কেন? তুই নিজে বললেই তো পারিস।
– আমার দ্বারা হবে না। তুই একটু বল না ভাই। আমার সাহসে কুলায় না।
– আচ্ছা আসুক সে। আমি বলে দেবো।
আকাশ নিশ্চিন্ত মনে তার ক্লাসে চলে যায়। দুপুরে স্কুল ছুটি হলে আকাশ রিফাতকে জিজ্ঞেস করে, বন্ধু বলেছিলি?
– হ্যাঁ, কিন্তু…
– কিন্তু কী? সে কী বলেছে?
– সে কিছু বলেনি।
– বলেনি মানে?
– বলেনি মানে বলেনি।
– তাহলে?
– আমি যখন তোর কথা তাকে বললাম। তখন সে হাসতে লাগলো। কিন্তু কোনো উত্তর দিল না।
– তুই সত্যই বলেছিলি তো?
– বিশ্বাস না হলে তুই বৃষ্টিকে গিয়েই জিজ্ঞেস করে দেখ না!
সেদিন স্কুল ছুটির পরে বৃষ্টির সাথে আকাশের আর দেখা হয়নি। বৃষ্টি ইচ্ছে করেই আকাশের সাথে দেখা করেনি। উপরোক্ত ঘটনাটা বহু বছর আগের নয়। বরং সম্প্রতি ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা। আকাশ বর্তমানে অনার্স প্রথম বর্ষে পড়ে। আর বৃষ্টি ইন্টারমিডিয়েটে। ফোনের প্রচলন থাকাতে সেদিন আকাশ বৃষ্টিকে কল করে বলে, আজ দেখা করলে না কেন? বৃষ্টি তেমন কোনো উত্তর দেয় না। বরং পূর্বের মতোই কিছুক্ষণ আলাপ চলতে থাকে তাদের মধ্যে। আকাশ মনে মনে ভাবে, হয়তো তাদের এতদিনে গড়ে ওঠা বন্ধুত্বটা নষ্ট হয়ে যাবে। প্রপোজ করাটা তার একদমই উচিত হয়নি। কিন্তু না, কিছুদিন যেতেই তার ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়। বৃষ্টি তার সাথে সম্পর্ক নষ্ট করা তো দূরের কথা। বরং তার সাথে সে পূর্বের তুলনায় অধিক কথা বলে, কেয়ার করে।
সামনে আকাশের জেএসএসি পরীক্ষা। আকাশের চিন্তার চেয়ে যেন বৃষ্টির চিন্তায় বেশি। বৃষ্টির এমন আচরণে আকাশ ভাবে, হয়তো বৃষ্টিও তাকে ভালোবাসে। তা না হলে সে তার এত খোঁজ খবর নেবে কেন? এতো কেয়ার করবে কেন? আকাশ নবম শ্রেণীতে ভর্তি হলো। আর বৃষ্টি সপ্তম শ্রেণীতে। তাদের মধ্যকার আলাপচারিতা পূর্বের থেকে শতগুণে বেড়ে গেল। বৃষ্টির আচরণে আকাশ ধরেই নিয়েছে, বৃষ্টিও তাকে ভালোবাসে। তাইতো সে সাহস করে একদিন সরাসরিই বৃষ্টিকে প্রপোজ করে বসলো। প্রথমবারের মতো এবারও বৃষ্টি কোনো উত্তর দিলো না। প্রত্যুত্তর স্বরূপ সে একটা মুচকি হাসি দিয়ে বললো, তুমি আগে বড় হও। নিজের পায়ে দাঁড়াও। তখন ভেবে দেখবো। আকাশ তার এমন কথা শুনে আনন্দের সাথে বলে, তার মানে তুমিও আমাকে ভালোবাসো?
– আমরা দু’জন আগে বড় হই।
আকাশের আর বুঝতে বাকি থাকে না, বৃষ্টিও তাকে ভালোবাসে! দেখতে দেখতে দুইটা বছর কেটে যায়। সামনে আকাশের এসএসসি পরীক্ষা। বছর খানেক হলো সে স্মার্টফোন কিনেছে। সাথে ফেসবুকে একটা অ্যাকাউন্টও খুলেছে। অন্যদিকে বৃষ্টিও তার বাবার কাছে জেদ ধরে মোবাইল কিনে নিয়েছে। আকাশের সাথে সর্বক্ষণ কথা বলার জন্য সেও ফেসবুকে তার একটা অ্যাকাউন্ট ক্রিয়েট করে। রাতদিন সবসময় ফেসবুকে তাদের কথোপকথন চলতে থাকে। কিছুদিন পরেই এসএসসি পরীক্ষা শুরু হবে। বৃষ্টি আকাশকে তাগিদ দিচ্ছে ভালো করে পড়ার জন্য। যেন সে পরীক্ষাতে ভালো একটা রেজাল্ট করতে পারে এবং দামি একটা কলেজে চান্স পায়।
বৃষ্টির এত কেয়ার, এত ভালোবাসা আকাশের মনকে প্রফুল্ল রাখে। আকাশ বৃষ্টির ব্যাপারে তার বাড়িতেও জানিয়েছে। অন্যদিকে বৃষ্টির পরিবারও তার আর বৃষ্টির ব্যাপারে অবগত। এসএসসি পরীক্ষা শেষ হলো। এখন শুধু রেজাল্টের অপেক্ষা। আকাশ ভেবে রেখেছে সে রাঙামাটির’ই কোনো একটা কলেজে ভর্তি হবে। যেন ইচ্ছে হলেই সে তার বৃষ্টিকে দেখতে পায়।
রেজাল্ট বের হলো। আকাশ রাঙামাটিতেই তাদের গ্রাম থেকে একটু দূরের একটা কলেজে ভর্তি হলো। বৃষ্টির সাথে যোগাযোগটা ঠিক আগের মতোই আছে। একদিন হঠাৎ করেই বৃষ্টি তাকে জানালো, তার ফেসবুক আইডিটা হ্যাক হয়েছে। এর মাঝখানে সে একটা ছেলের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পরে। আর সেই ছেলেই নাকি তার আইডিটা হ্যাক করেছে। সাথে বৃষ্টি এও বলে যে, বাড়ি থেকে তার স্মার্টফোনটা কেড়ে নেওয়া হয়েছে। এখন থেকে আর নিয়মিত কথা বলা হবে না।
আকাশ বৃষ্টির আইডিতে ভিজিট করতে গিয়ে দেখে তাকে আনফ্রেণ্ড করা হয়েছে। দিন যায়, মাস যায়, কথা বলা কমতে থাকে। সে বৃষ্টিকে কল করলে মাঝে মাঝে রিসিভ করে। তবে অধিকাংশ সময়ই কল কেটে দেয়। যদি কখনো রিসিভ করেও, তবে অল্প কথায় কথার ইতি টানে।
আকাশ ভাবে, হয়তো তার প্রবলেম হচ্ছে এজন্য সে কথা বলতে পারছে না। গ্রামে যাওয়ারও পরিস্থিতি নেই। কলেজ, পড়ালেখা, পরীক্ষা, এসবের জন্য সে গ্রামেও যেতে পারছে না। ফেসবুকে কতবার যে বৃষ্টির আইডিতে ফ্রেণ্ড রিকুয়েস্ট পাঠিয়েছে। তার ঠিক নেই। কিছুক্ষণ পর গিয়ে দেখে রিকুয়েস্ট ডিলিট করা হয়েছে। মেসেজ করলে সিন করে রেখে দেয়। রিপ্লে আসে না। মাঝে মাঝে বৃষ্টির সাথে ফোনে কথা বলার সময় উক্ত বিষয়টা বৃষ্টিকে বললে সে জানায়, তার আইডিটা এখনো ঐ ছেলের কাছেই আছে। আর ঐ ছেলেই নাকি তার আইডিটা ব্যবহার করে।
আকাশ বৃষ্টির এমন কথা বিশ্বাস করে না। একদিন সে একটা ফেক অ্যাকাউন্ট খোলে। তারপর বৃষ্টির আইডিতে রিকুয়েস্ট পাঠায়। ঘণ্টা খানেক পর রিকুয়েস্ট একসেপ্ট হয়। আকাশ নক করে আইডিতে। রিপ্লেও আসে। সে কথা বলে জানতে পারে, আইডিটা বৃষ্টির প্রাক্তন তথা মাঝখানে সম্পর্ক হওয়া ছেলেটি চালায় না। বরং আইডিটা বৃষ্টি নিজেই চালায়। কেননা সে যখন ফেক আইডি থেকে বৃষ্টিকে তার পরিচয় দিতে বলে। তখন বৃষ্টি তাকে সঠিক সঠিক উত্তর দেয়। মানে, তার নাম বৃষ্টি। সে রাঙামাটিতে থাকে। অমুক স্কুলে পড়ালেখা করে। আকাশের আর বুঝতে বাকি থাকে না, বৃষ্টি তার সাথে মিথ্যা কথা বলছে। কিন্তু সে কেন এমন করছে, সে সম্বন্ধে আকাশের অবগত নয়। সে যখন তার রিয়েল আইডি থেকে বৃষ্টির আইডিতে রিকুয়েস্ট পাঠায়, ঠিক তখনই বৃষ্টি তার রিকুয়েস্ট ডিলিট করে দেয়। মেসেজ দিলে সিন করে রেখে দেয়। কিন্তু রিপ্লে দেয় না।
এভাবে বেশ কয়েক মাস চললো। একদিন আকাশ তার ফেক আইডি থেকে বৃষ্টির সাথে কথা বলার সময় বৃষ্টিকে নিজের আসল পরিচয়টা দিয়ে দিলো। ঠিক তখনই বৃষ্টি অফলাইনে চলে গেল। পরে আর রিপ্লে পাওয়া যায়নি। বৃষ্টির বাড়ি থেকে তার স্মার্টফোন কেড়ে নেওয়া হয়নি, তার ফেসবুক আইডিও হ্যাক হয়নি। কিন্তু এটা ঠিক যে, মাঝখানে একটি ছেলের সাথে তার সম্পর্ক হয়েছিল। আকাশ ভেবে পায় না, বৃষ্টি তার সাথে এমন করছে কেন? সে অনেকবার এর কারণ জিজ্ঞেস করেছে। মেসেজ সিন হয়েছে। কিন্তু রিপ্লে আসেনি।
আকাশ উচ্চ-মাধ্যমিক শেষ করে অনার্সে ভর্তি হলো। বৃষ্টির সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও কোনো কাজ হয়নি। বাড়ি গেলেও কথা হয়নি তার সাথে। বৃষ্টির এমন পরিবর্তনের কারণটা এখনো সে জানতে পারেনি। হয়তো আগামীতে জানতে পারবে, কী ছিল সেই কারণ? মাঝে মাঝে সে একাকী নিভৃতে বসে ভাবে, তাদের সেই মাধ্যমিকে থাকা সম্পর্কটা হয়তো প্রাতে উদীয়মান সূর্যের মতো অস্ত যাচ্ছে।