আমি শিল্পী

আমি শিল্পী

মাই নেম ইজ শিলা শিলাকি জ।’ মনের আনন্দে বিছানায় শুয়ে গলা ছেড়ে মাত্র গানটা ধরেছি।

: এই তুমি থামবা। খবরদার আমার বাসায় চিল্লাবা না।

রান্নাঘর থেকে বউয়ের চিৎকার। ভাবলাম এই গান বউয়ের হয়তো পছন্দ না, তাই নতুন গান ধরলাম। ‘মুন্নি বদনাম হুয়ি ডার্লিং তেরে…।’ এবার বউ একা না, বউয়ের সঙ্গে সঙ্গে মেয়ে দুটিও চিৎকার করে উঠল। বউ ছিল রান্নাঘরে। দৌড়ে বেডরুমে ঢুকল।

: তোমার সমস্যা কি?

: কোনো সমস্যা নাই। কেন কি হইছে? নরম গলায় উত্তর দিলাম।

: তুমি চিৎকার করছ কেন?

: আমি চিৎকার করলাম কই? আমিতো গান করছিলাম।

:এগুলো গান? রুচি বলেও তো একটা ব্যাপার আছে। আশপাশের মানুষ এই গানের কথাগুলো শুনলে কি ভাববে।

আমি ছয়তলাতে থাকি। আর এই তলাতে শুধু আমরা ছাড়া আর কোনো বাঙালি নেই। এমনকি ভারতীয় বা পাকিস্তানিও নেই। যারা আছে তারা অন্য ভাষার মানুষ।এই অন্য ভাষার মানুষগুলো আমার গানের কথা শুনে কী বুঝবে, আর খারাপ কী ভাববে, সেটা আমার মাথায় ঢুকল না।

: প্রতিবেশীরা আর কি ভাববে। এত বড় এক শিল্পী তাদের বিল্ডিংয়ে থাকে, এটা ভেবেই তারা বরং আরও গর্বিত হবে।

: মাই গড, তুমি কি এর মধ্যেই নিজেরে শিল্পীও ভাবা শুরু করেছ ?

: আমিতো শিল্পীই, এখানে ভাবাভাবির কি আছে!

: সিরিয়াসলি !

: অবশ্যই সিরিয়াসলি।শোনো তুমি বুঝতে পারছ না,কত বড় সুপ্ত প্রতিভাধর একজন শিল্পী তোমার স্বামী। আরে তুমি তো ভাগ্যবতী। তোমার তো খুশি হওয়া উচিত।

: আমি তো খুশি। এত খুশি যে,খুশি রাখার কোনো জায়গা পাচ্ছি না।

: তাহলে যাই, তোমার জন্য কয়েকটি বস্তা কিনে আনি ।

: মানে কি?

: তুমি না বললে খুশি রাখার জায়গা পাচ্ছো না। তাই ভাবলাম কয়েকটি বস্তা হলে তোমার রাখতে সুবিধা হতো।

: তুমি কি আমার সাথে ইয়ার্কি করছ।শোনো আমার সাথে মজা করবা না।তোমার সাথে মজা করার মতো সময় আমার নাই।আমি খুবই ব্যস্ত। আর শোনো স্কুল বন্ধ, বাচ্চারা বাসায়।অতএব তোমার এসব কুরুচিসম্পন্ন গান বন্ধ কর।

: তা হলে রবীন্দ্র আংকেল বা নজরুল আংকেলের গান গাই।

: না, তুমি কোনো গানই গাইবে না। ঝাঁজালো গলায় বউ বলল।
: আচ্ছা গাইব না। কিন্তু কেন গাইব না তাইতো বুঝলাম না?

: কেন আবার। আমি বলছি গাইবে না, ব্যাস গাইবে না।

: এটা আমেরিকা, আমার স্বাধীনতায় তুমি হস্তক্ষেপ করতে পারো না। আগুনটা আরেকটু উসকে দিলাম। আমি শিওর এবার নির্ঘাত ফেটে পড়বে।

:তোমার স্বাধীনতার গুলি মারি। তোমার গান গাইতে ইচ্ছে হয় তুমি রাস্তায় যাও।রাস্তায় গান গাও,নাচ, যা খুশি কর আই ডোন্ট কেয়ার । কিন্তু আমার ঘরে না। বলে গজগজ করতে করতে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল। মন খারাপ করে বসে আছি। এতক্ষণ ঝগড়া শুনে মেয়েরা বুঝল আমার মন খারাপ। দুজনে এক সাথেই এল আমার কাছে।

: আচ্ছা আম্মু বলো তো, আমার গানের গলা কি খুব খারাপ? কণ্ঠে একটু আবেগ মিশিয়ে প্রশ্ন করলাম। উদ্দেশ্য যদি একটু সিমপ্যাথি ও সমর্থন পাওয়া যায়।

: অবশ্যই খারাপ। আর তোমার ওই সব হিন্দি গানতো আরও খারাপ। বড় মেয়ে সরাসরি উত্তর দিল।সে একটু স্পষ্টবাদী। যেটা সত্য সেটাই বলবে। ওরে আবেগ দিয়ে দলে আনা যাবে না। এবার ছোট মেয়ের দিকে অনেক আশা নিয়ে তাকালাম। আমার ধারণা সে আমাকে একটু বেশিই ভালোবাসে। গলায় আরও বেশি আবেগ মিশিয়ে করুণভাবে বললাম,

: আম্মু তুমিও কি তাই মনে কর? আমার গান কি তোমার ভালো লাগে ?
: আচ্ছা বাবা তোমার গান না গাইলে কি হয় না ? তোমার গান গাওয়ার কি দরকার।গান গাওয়ার চেয়ে গান শোনা অনেক ভালো। মাইগড এটা দেখি আরও বড় মাতব্বর। আরে তোর কাছে কি আমি উপদেশ চাইছি। মেজাজটাই গরম হয়ে গেল।ভেবেছিলাম রাগ করবো না। কিন্তু কোনো ভাবেই নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারলাম না।চিৎকার করে বললাম,

: তোরা দুই মাতব্বর বের হ আমার রুম থেকে। বড়টা চলে গেল। ছোটটা বসে আছে।আমার চিৎকার শুনে বউ রান্নাঘর থেকে দৌড়ের এসে চিৎকার করে বলল,

: তুমি আমার মেয়েদের বকা দিচ্ছো কেন ?

: কই আমি তো বকা দিচ্ছি না। আমরা শাসন শাসন খেলছি।ওদের কে কিভাবে বকা দিতে হয় তার প্রশিক্ষণ দিচ্ছি।যাতে বিয়ের পর স্বামীকে ভালো করে টাইট দিতে পারে।

:খবরদার তোমারে না বলছি আমার সাথে ফাজলামী করবে না।আর একটা কথা আমার মেয়েদের বকা দিবা না। বলে সে আবার রান্নাঘরে চলে গেল।আমি মুখ কালো করে বসে আছি।মেয়ে আদুরে গলায় বলল,

: আব্বু মন কি বেশি খারাপ?

: না গো মা জননী, আমার মনে অনেক অনেক আনন্দ। আমার এখন এই অতি আনন্দে নাচতে ইচ্ছে করছে। তোমরা মা-মেয়ে অনুমতি দিলে একটু নাচতাম।

: আব্বু প্লিজ, তোমার নাচার কোনো দরকার নাই। কারণ তোমার নাচ আরও বেশি খারাপ। এক কাজ কর,তুমি বরং ঘুমাও।ঘুমালে শরীর মন ভালো থাকবে।

মাইগড এই মেয়েতো আবার আমারে উপদেশ দিচ্ছে।এতো দেখি উপদেশের গোডাউন।ইচ্ছে হচ্ছে কষে একটা চড় দেই।কিন্তু দুটো কারণে দিতে পারছি না।প্রথম কারণ হচ্ছে আমি কখনো ওদের গায়ে হাত তুলুনি।আর দ্বিতীয় কারণ বউ এর ভয়। রাগ কে অনেক কষ্টে কন্ট্রোল করে চাপা গলায় ধমক দিয়ে মেয়েকে বললাম,

: তুই দুর হ আমার সামনে থেকে। তোর কাছে কি আমি উপদেশ চেয়েছি ? খবরদার আমার সাথে বুড়িদের মতো কথা বলবি না। তুই বাচ্চা বাচ্চাদের মত কথা বলবি। মেয়ে সরি বলে রুম থেকে চলে গেল। কিছুক্ষণ ঝিম মেরে শুয়ে থাকলাম। মিনিট পাঁচেক পরে, ড্রেস পাল্টিয়ে বাসা থেকে বের হতে যাব, বউ আবার চিৎকার করে উঠল,

: এখন আবার কই যাও ? নরম সুরে বউকে বললাম,

: আচ্ছা আমি একটু উঁচু গলায় কথা বললেই দোষ। এখন যে তুমি চিৎকার করছ, আশপাশের মানুষেরা শুনছে না? নাকি তোমার ধারণা সব ইয়াবা খাইয়া ঘুমাইছে?

: আমার ঘরে আমি যা খুশি করব। মানুষের কি? আর তুমি ইয়াবার কথা কি বললে ? মাইগড তোমার তো দেখি ইয়াবার ব্যাপারে অনেক জ্ঞান! নাকি খাওয়া শুরু করে দিয়েছ ? তাইতো বলি এত অশ্লিল গান এই ব্যাটার মাথা থেকে বের হয় কেমনে?

: মারে মাফ চাই,ক্ষমা চাই।আমার ভুল হইয়া গেছে। আল্লাহর দোহাই লাগে, ঝগড়ার লাইন বদলাইয়া গান থেকে ড্রাগে যেও না।

: ঠিক আছে বাদ দিলাম। কিন্তু এখন বল কোথায় যাচ্ছ ?

: তুমি না বললে ঘরের বাইরে গিয়ে গান করতে। তাই বাইরে যাচ্ছি। কাউকে না কাউকে তো শোনাতে হবে।কেউ যদি নিজে থেকে শুনতে না চায়,তবে টাকা দিয়ে শোনাব।প্রতিভা তো আর অযত্নে নষ্ট করা যাবে না।

: তুমি কি আমার সাথে ফাজলামি করছো ? আমি কি তোমার ভাবি লাগি?

: কেন কাবিনে কি লেখা আছে বউয়ের সাথে ফাজলামি করা যাবে না।ফাজলামী করা আমার জন্মগত অধিকার।

: জি বুঝছি আপনার অনেক অধিকার আছে। এখন ফাজলামি বাদ দিয়া ঘরে যেয়ে বসেন, আমি নাশতা আনছি।

একেই বলে জুতো মেরে গরু দান। এতক্ষণ ঝেড়ে এখন নাশতা। ইচ্ছে হচ্ছে বলি শয়তান মহিলা,তোর নাশতা তুই খা। কিন্তু কথাগুলো মুখে বলার সাহস হলো না। কারণ বেশি সাহস ভালো না। শুধু আজ না। আমি দেখেছি যখনই আমি কোনো গান গাইতে চেষ্টা করি তখনই এই তিন নারী মানে বউ আর দুই মেয়ে আমাকে নাজেহাল করে ছাড়ে। বিশুদ্ধ ও ভালো গান সুর করে গাওয়ার চেষ্টা করেছি, কাজ হয়নি। একই প্রতিক্রিয়া। বাথরুমে গান গাইতে পারি না। কারণ যে কাজে বাথরুমে যাই, সে কাজে কনসেনট্রেট না করলে, সেই কাজ আবার ঠিকমতো হয় না। কিন্তু আমার গান গাইতে ইচ্ছে করে। আমার ধারণা আমার গলা ততটা খারাপ না, যতটা প্রতিক্রিয়া ওই তিন নারী দেখায়। আগে ভাবতাম আমার বউ হয়তো আমার প্রতিভা দেখে জেলাস ফিল করে, তাই এমন করে। কিন্তু মেয়ে দুটির প্রতিক্রিয়া দেখে আমি বড়ই হতবাক। ওরাতো হিন্দি বা বাংলা গানের অর্থই বোঝে না। সুর বোঝে বলেও মনে হয় না। তাহলে সমস্যাটা কোথায় ? আমি জানিনা। শুধু জানি এই দুনিয়ায় মূল্য পাইলাম না। আফসোস

বিশেষ দ্রষ্টব্য : সবাই বলে, পৃথিবীর সকল সফল পুরুষের পেছনে একজন নারী থাকে। আমার বেলায় উল্টো। আমার শিল্পী প্রতিভা বিকশিত না হওয়ার পেছনে এক নয়, দুই নয় তিন তিনজন নারী। আমার ভেতরে যে সুপ্ত প্রতিভা আছে, তা তো বিকশিত হতে দিচ্ছেই না বরং আরও গলা টিপে দম বন্ধ করে মারছে। এটাতো রীতিমতো ক্রাইম, শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কে জানে হয়তো আমার মাঝেই লুকিয়ে আছে একজন কিশোর কুমার বা মো. রফি।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত