ভাইব্রেট অন করা পকেটের মোবাইলটা এক প্রকার ভুমিকম্প তৈরী করেই বেজে উঠলো। এমনিতেই জ্যামের মধ্যে বাসে দাঁড়িয়ে থাকা যথেষ্ট পরিমান বিরক্তের, তার উপর ফোন আসায় বিরক্তির মাত্রা চরম লেভেলে পৌছে গেলো। ফোনটা হাতে নিয়ে দেখি আননোন নাম্বার।নাম্বারটা মনে মনে কয়েকবার পড়লাম, এই নাম্বার থেকে এর আগে কখনো আমার কাছে কোন ফোন এসেছে বলে মনে পড়লনা।
বাবা ছাড়া আমাকে সচরাচর তেমন কেউ ফোন দেয়না। হঠাৎ এই আননোন নাম্বার থেকে ফোন আসার পেছনে আমার কাছে কোন ব্যাখ্যা নেই। হতে পারে, আমার স্টুডেন্ট এর মা। হয়তো আজ শপিং অথবা কোথাও ঘুরতে যাবেন। তাই ফোন দিয়েছেন। আজ হয়তো পড়াতে যেতে না করবেন। নাহয় ভুলক্রমে অন্য কারো কাছে ফোন দিতে গিয়ে আমার কাছে চলে এসেছে। ফোন ধরার পরে যখন তার চেনা ব্যাক্তির সাথে আমার কোন মিল খুজে না পাবে তখন স্যরি রঙ নাম্বার বলে কেটে দিবে।
পরের বিষয় নিয়ে আমার কোন মাথাব্যাথা নেই। কিন্তু প্রথম বিষয়টা আমার কাছে যথেষ্ঠ বিরক্ত করে তুললো। যদি শপিং বা কোথাও ঘুরতে যেতেই হয় তাহলে আগে ভাগে বলে দিলেই তো হয়। হুদাই এই বিরক্তিকর বাস জার্নি না করালেও তো পারতো। ফোনটা ধরবো বলে হাতে নেওয়া মাত্রই কেটে গেল। দশ সেকেন্ড ব্যাবধানে আবার ফোন। এবার রিসিভ করে কানে ধরতেই ওপাশের এক মিষ্টভাষী রমনীর “হ্যালো” শুনেই মনটা জুড়িয়ে গেলো। এই সুমধুর কন্ঠকে কি বলা যেতে পারে, “শীতল ঝর্ণা??” নাহ উপমাটা বেমানান, তার থেকে “লেবুর শরবত” উপযুক্ত। তীব্র গরমে কলিজা ঠান্ডা করে দেয়ার ক্ষমতা রাখে।
“লেবুর শরবত” উপমাটা মনে হতেই নিজেই হেসে উঠলাম শব্দ করে। “হাসছেন কেন??” ওপাশ থেকে মিষ্টভাষী রমনী বলতেই হার্ডব্রেক এর মতো হাসি থেমে গেলো। আশেপাশে তাকাতেই দেখলাম মানুষগুলো কেমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কেমন যেনো নিজেকে বোকা বোকা মনে হলো। অবশ্য বয়স ছাব্বিশ হওয়া সত্ত্বেও আমার সম্পর্কে বাবা এখনো ধারনা রাখেন, আমি নাকি যথেষ্ঠ বোকা। “কে??” আমি প্রশ্ন করতেই ওপাশ থেকে মেয়েটা ঝরঝর করে উত্তর দিলো, “আমার নাম মেঘা। আপনি চিনবেন না আমাকে। আপনি কি রাহাত??”
একটা মেয়ে যাকে আমি চিনিনা সে আমার ফোন নাম্বার কোথা থেকে পেল সেটা চিন্তার বিষয়। কিন্তু মেঘা নামটা আমার পরিচিত, আমার প্রাক্তনের নাম। “মেঘ চিনি, কিন্তু মেঘা চিনিনা। এটা কি মেঘ এর ফিমেল ভার্সন??” একটু কৌতুকের সুরে আমি বলে উঠতেই মেয়েটা উত্তর দিলো, “দেখুন আমার জন্য এটা মোটেও ফাজলামির সময় না। আমি আপনাকে একটা বিশেষ দরকারে ফোন দিয়েছি।”
“আচ্ছা বলুন, কি দরকার?? আর আমার নাম্বার কোথায় পেলেন??
“আসলে আপনার নাম্বারটা একটা ব্লাড ব্যাংক থেকে পেয়েছি, আমার বাবার অপারেশনে আজ রাতের মধ্যে রক্ত লাগবে। ‘ও’ নেগেটিভ। কারো কাছে রক্ত না পেয়ে ব্লাড ব্যাংক গুলোতে খোজ করতেই একটা ব্লাড ব্যাংক থেকে আপনার নাম্বারটা দিয়েছে। আপনি কি আসতে পারবেন??? কৃতজ্ঞ থাকবো সারাজীবন”।
“আচ্ছা আপনি ডিটেইলস বলুন, কোথায় আসতে হবে?”
“আমি টেক্সট করে পাঠিয়ে দিচ্ছি।”
মেয়েটি ধন্যবাদ দিতে যাচ্ছিলো কিন্তু তার আগেই ফোন কেটে দিলাম। চলে এসেছি গন্তব্যস্থলে, বাস কন্ডাকটর তাড়া দিচ্ছে নামার জন্য।বাস থেকে নেমে দেখি রাস্তা ফাকা। আজ একটা রিকশাও নেই। ঘড়ির দিকে তাকালাম, আজ এমনিতেই আধাঘণ্টা লেট তাই রিকশার অপেক্ষা না করে অগত্যা হাটা শুরু করলাম। বিষয়টা এমন না যে আমি প্রতিদিন রিকশায় করে যাই। কিন্তু আজ দেরী বলেই রিকশার খোজ করছি। কিন্তু অবস্থা এখন এমন এখানে রিকশার জন্য দাড়িতে থাকার চাইতে টিউশনিটা বাচানো ফরজ। কিন্তু ভাগ্য বরাবরই আমার বামে থাকে। হেটে কদম দশেক সামনে আসতেই হঠাৎ কোথা থেকে এক রিকশা এসে মাত্র দাঁড়ানো একটা মেয়েকে নিয়ে চলে গেলো।
দাঁড়িয়ে আছি বিখ্যাত পিজি হাসপাতালের সামনে। এখানে দাঁড়িয়ে থেকে মানুষগুলোকে যথেষ্ঠ উপভোগ করা যায়। উচ্চবিত্ত থেকে শুরু করে নিম্নবিত্ত পর্যায়ের মানুষের আনাগোনা। গেটের কিনারে দাঁড়িয়ে অথবা বসে থাকা কিছু ভিক্ষুককে দেখা যাচ্ছে। এসের কারো চোখ নেই, কারো হাত অথবা পা। কেউ আবার অতি বৃদ্ধ।
হঠাৎ শোরগোলের শব্দ শুনে তাকাতেই দেখি একজন লোক একটা মোটামুটি যুবক বয়সের এক ছেলের শার্টের কলার ধরে রেখেছেন। প্রচন্ড রেগে আছেন বুঝা যাচ্ছে। ঘটনা দেখে মনে হলো, পকেট মারতে গেছিলো ছেলেটা কিন্তু মহাশয় হাতেনাতে ধরে ফেলেছেন। এবার বাকিটা আন্দাজ করেই বলা যায়, একজন দুজন করে ভিড় করবে। যে যা পারে কিল ঘুষি মারবে। অতঃপর পুলিশের হাতে স্থানান্তরণ করবে। কিন্তু সেটা না, যুবক ছেলেটা একজন রিকশা চালক। পাঁচ টাকা বেশী চাওয়ায় লোকটি তাকে মারতে চাইছিলো। ভাবলাম এগিয়ে যাবো। কিন্তু তার আগেই মেয়েটার ফোন।
“তো আসছেন কখন”। ফোন রিসিভ করা মাত্রই মেয়েটি বলে বসলো।
“আমি আসছিনা, আমার জরুরী কাজ আছে একটা।”
“কি বললেন আপনি??”
“হ্যা যা শুনেছেন ঠিক শুনেছেন, আমি আজ আসতে পারবোনা”।
“আপনি আসতে পারবেন না সেটা আগেও বলতে পারতেন।
আমি অন্য ডোনার খোজ করতাম। এখন আমি কোথায় খুজবো।” মেয়েটির কন্ঠে হতাশার সুর। কেদে ফেলবে ফেলবে অবস্থা। মেয়েটি হয়তো আরো কিছু বলতে চেয়েছিলো কিন্তু তার আগেই দুপ করে দিলাম কল কেটে। মোবাইলটা সুইচড অফ করে দিলাম। আমি জানি মেয়েটা এখন হতাশ হবে, কাঁদবে। আমার উপর রাগ হবে অনেক। রক্তের চিন্তায় তার মাথা কাজ করবে না। আমাকে কি অভিশাপ দিবে??
কিন্তু যখন জানবে তার বাবার জন্য রক্ত জোগাড় হয়ে গেছে। তখন কি সে বুঝবে রক্তদাতা আমি। নাকি বুঝবে না। আমি চাই সে না বুঝুক। আমার প্রতি তার ক্ষোভ থাকুক, থাকুক কিছু ভুল ধারনা। সে না জানুক, তার বাবার রক্তদাতা স্বয়ং আমি, যাকে সে দুই বছর আগে ছেড়ে গিয়েছিলো তার কোন এক জন্মদিনে দেখা করার পরিবর্তে একজন মুমুর্ষ রোগীকে রক্ত দিতে যাওয়ার কারনে। যেদিন সে প্রশ্ন তুলেছিলো ওই রোগী আমার লাইফে বড় কিছু নাকি সে। আমি স্তব্ধ হয়ে গেছিলাম তার এই প্রশ্নে। যেমন স্তব্ধ হয়েছিলাম রক্ত দেওয়ার কিছুক্ষন পুর্বে তাকে দেখে। আমি প্রথমে দেখা করতে চাইলেও মেঘাকে দেখে সামনে যাইনি আর। নার্সকে বলে এসেছি আমি চলে আসার আগ পর্যন্ত যেন মেঘা না জানে, রাহাত তার বাবার রক্তদাতার নাম।