অসুখ

অসুখ

-আমাদের ছেলেটাকে খুন করে ফেলি চলো। আচ্ছা এমন কোনো উপায় নেই যেভাবে মরলে ওর কম কষ্ট হবে? নেহালের মুখে এই কথা গুলি শুনে মাইশা চেঁচিয়ে বলে উঠলো

-তুমি কি মানুষ!! বাবা হয়ে নিজের ছেলেকে নিয়ে এসব ভাবতে লজ্জা করলো না তোমার?? নেহাল লজ্জায় মাথা নত করে ফেলল। আসলেই তো, বাবা হয়ে নিজের সন্তানকে খুন করার কোনো নিয়ম নেই। আজকালকার দিনে কেউ কেউ হয়ত তার ব্যতিক্রম করলেও নেহাল সেই ব্যতিক্রম লোকদের মধ্যে পড়ে না। তার পক্ষে সম্ভব না নিজের ছেলেকে মেরে ফেলা। কিন্তু তবুও একদিন ‘কীভাবে কাউকে কষ্ট না দিয়ে মেরে ফেলা যায়’ এটা লিখে গুগলে সার্চ দিয়েছিল।

-নেহাল
-হু
-সব ঠিক হয়ে যাবে।
-কিচ্ছু ঠিক হবে না মাইশা। কিচ্ছু ঠিক হবে না। আমাদের ছেলেটা আমাদের চোখের সামনে ধুকে ধুকে মারা যাবে। আর আমরা বাবা মা হয়ে কিচ্ছু করতে পারবো না। আচ্ছা বাদশা বাবর নাকি তার ছেলেকে নিজের প্রাণের বিনিময়ে বাঁচিয়েছিল, আমি সেরকম দোয়া করলে আল্লাহ শুনবে??

মাইশা কোনো জবাব দিলো না। চুপ করে রইলো। মাইশার এই চুপ থাকা টা নেহালের অসহ্য মনে হয়। মাইশা মাঝে মাঝেই এমন চুপ হয়ে যায়। কোনো জবাব দেয় না। আগে তো এমন ছিলো না। যখন নেহালের মন ভরসা মূলক কোনো কথা শুনতে মন চায় তখনই কেন মাইশা চুপ হয়ে যাবে? মাইশা কি এমন কিছু বলতে পারে না যেটাতে নেহালের মন টা শান্ত হয়।

নেহাল আর মাইশা হাসপাতালের করিডোরে দাঁড়িয়ে ছিল। মাইশা নেহালের কাধে হাত রেখে চুপচাপ তাকিয়ে রইলো। মেয়েটা বড্ড কথা বলতো। তাদের ১০ বছরের ছেলেটার অসুখ যেন মাইশার কথা গুলিকে এক নিমিষে শেষ করে দিয়েছে।

ইমন আবার কান্না করছে। কানে তালা ধরে যায় এমন কান্না। অসহ্য বেদনায় শরীর কুঁকড়ে যাচ্ছে। এতক্ষণ ইমন ঘুমিয়ে ছিল। অসহ্য ব্যথা ঘুম ভাঙিয়ে দিয়েছে। নেহাল আর মাইশা দৌড়ে ইমনের বেডের কাছে আসলো। ইমনের সেই সুন্দর মুখ টা নেই। কেমো থেরাপির জন্য ঝরঝরে চুল গুলিও নেই। চোখের নিচে কালি, ওজন অনেক বেশি কমে গেছে। হাড্ডি গুলি যেন বাইরে থেকেই গোনা যায়। সাদা বিছানার উপর মনে হয় কোন কঙ্কাল পড়ে আছে।

-বাবা, তোর কোথায় ব্যথা হচ্ছে? কি কষ্ট হচ্ছে আমাকে বল??
-মা… আমার আর ব্যথা সহ্য হচ্ছে না। আমাকে বাঁচিয়ে দাও মা। আমি বাঁচতে চাই মা।
-তুই বাঁচবি। আমার জীবন দিয়ে হলেও আমি তোকে বাঁচাবো। একটু সহ্য কর বাবা। সব ঠিক হয়ে যাবে।
-কিন্তু আমার সেই বন্ধুটাযে বলল আমি নাকি আর বেশিদিন বাঁচবো না। আচ্ছা মরে গেলে আমাকেও দাদুর মত মাটিতে কবর দিয়ে ফেলবে?? কবরে কি অনেক বেশি অন্ধকার? একটা লাইট লাগিয়ে দিতে পারবে? মাইশার এই কথা গুলি সহ্য হলো না। ছেলের গালে কষিয়ে একটা চড় মারলেন।

-তোকে বলেছি না এসব কথা আর বলবি না। তাও শুনিস না। তোর কিছু হয়ে গেলে আমরা কী নিয়ে বাঁচবো??

ডাক্তার ইমনকে দেখতে আসলেন। ইমনের অবস্থা আরো খারাপ হচ্ছে। ওর বাঁচার আশা নেই। ব্যথায় কোকাতে কোকাতে ইমন বলছে

-ডাক্তার কাকু আমাকে বাঁচিয়ে দিন। আমি বাঁচতে চাই। কতদিন ক্রিকেট খেলি না। ডাক্তার দরদী কণ্ঠে বলল
-তোমার কিছু হবে না খোকা। তুমি সুস্থ হয়ে যাবে।
-আমি আবার আগের মত দৌড়াতে পারবো? ক্রিকেট খেলতে পারবো??
-কেন পারবে না? অবশ্যই পারবে। আগের চাইতেও বেশি দ্রুত দৌড়াতে পারবে।

ডাক্তারদের রোজ চোখের সামনে অনেকের মৃত্যু দেখতে হয়। গম্ভীর মুখ নিয়ে ডেথ সার্টিফিকেট লিখতে হয়, রোগীর স্বজনদেরও স্বাভাবিক গলায় জানাতে হয় ‘ পেশেন্ট বেশিদিন বাঁচবে না। আপনারা মনকে শক্ত করুন।’
কিন্তু ড. সজীব স্বাভাবিক ভাবে এই কাজ গুলি করতে পারেন না। তিনি হয়ত এখনো ঠিকঠাক ভাবে ডাক্তার হয়ে উঠতে পারেন নি।

ছেলেটির কাছে মিথ্যা কথা গুলি বলতে যেয়ে তার গলা ভারি হয়ে আসছে, কথা গুলি আটকে আসছে। কেউ যেন বলছে ‘বাচ্চাটিকে এত মিথ্যে বলো না। পাপ হবে তোমার।’ তবুও তাকে বলতে হচ্ছে এসব। বারবার ভাবছেন সৃষ্টিকর্তা তাদের রিপোর্টকে ভুল প্রমাণ করে বাচ্চাটিকে বাঁচিয়ে তুলতে পারেন না? ইমনকে দেখে চলে যাচ্ছিলেন ডাক্তার। ইমনের বাবাও ডাক্তারের পিছু পিছু গেল।

-আপনি আপনার মন কে শক্ত করুন মি:নেহাল। ছেলেটি হয়ত আর কিছুদিন আপনাদের মাঝে থাকবে। বাকিটা আল্লাহর ইচ্ছা। এর জবাবে নেহাল যেটা বলল কোনো বাবা এমনটা বলতে পারে সেটা ডাক্তার সজীবের ধারণার বাইরে ছিল।

-আচ্ছা এমন কোনো ঔষধ আবিষ্কার হতে পারে না যেটা খেলে কষ্ট ছাড়া মারা যাওয়া যায়?? তাহলে আর এই কয়টা দিন আমার ছেলেকে এত কষ্ট সহ্য করতে হতো না।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত