তোমার কোন দোষ নেই

তোমার কোন দোষ নেই

— তোমার কি আর কিছু বলার নেই ? ( আমি )
— না,, ( সানজিদা )
— এত দিনের সম্পর্ক এত তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যায় ?
— এতবড় দুনিয়া যদি এক নিমেষেই একদিন ধংস হয়ে যাবে,, তবে সম্পর্ক আর কি ?

— তুমি তো জানতে আমি গরীব,,
— অস্বীকার তো করিনি এখনো,,,

— আমি তো জব পেয়েছি,, আর কিছু দিন সময় দাও তারপর আমরা বিয়ে করে ফেলবো,,,
— দেখ বাস্তব আর কল্পনা ভিন্ন প্রসঙ্গ,,, মা বাবা দুজনেই এ বিয়ে তে রাজি না,, আর তাদের মনে আঘাত করে আমি কিছু করতে পারি না,,

— আমার কি মন নেই??? নাকি আঘাত নেই???
— চুপচাপ

— অনেক কষ্ট করে বেচে থাকতে হবে আমার,,,
— চেষ্টা করো ভুলে যাও,,

— তুমি কি ভুলতে পারবে???
— মনে হয়,,

— তাহলে তুমি কি চাও????
— আমি চাই বাস্তবতা মেনে নিয়ে দুজনেই আলাদা হয়ে যায়,, দুজনের দুটি পথ আলাদা করে চলতে,,, আমি ভালো আছি,, তুমি ভালো থাকো,,

— কথা দিয়েছিলাম যদি কোনো দিন তোমার জীবনে আলোকিত মুগ্ধতার প্রদীপ জ্বালিয়ে দিতে না পারি,, চলে যাব তোমার জীবন থেকে,, জানিনা ভালো থাকবো কিনা তবুও চাই তুমি ভালো থাকো,,
— আবেগ কন্ট্রোল করে বাস্তবতা মেনে না-ও,,,

— আমাদের কি আর কোনদিন দেখা হবে না???
— আমি সেটা চাচ্ছি না,,,

— যদি হঠাৎ দেখা হয়ে যায়???
— আজাইরা পেচাল ভালো লাগে না,,

— একসময় লেগেছিল,,
— আমি আসি,,

মুক্ত স্নান স্বপ্ন গুলো ভাসিয়ে দিয়ে একা একা ইট পাথরের ব্যাস্ত শহরের ভিতর দিয়ে আনমনা হয়ে হেটে হেটে চলছি,, মনের অজান্তেই ভালবাসা অমলিন বেলায় ধরা দিল কোন এক গোধূলি সন্ধ্যা বেলা,, সানজিদার সাথে আমার পরিচয় প্রায় তিন বছর আগে,, আমি সেবার শীতের ছুটিতে কলেজের এক বন্ধুর বাড়িতে রংপুর বেড়াতে গেছিলাম,, রংপুর হতে ঢাকা আসার পথে সানজিদা ও আমি পাশাপাশি বসেছিলাম দুজনেই,,

— আমার নাম সানজিদা,, আপনার নাম কি??
— সজীব,,

— আগে পিছে কিছু নেই???
— আপনার???..

— মাসুমা আক্তার সানজিদা,,
— সাইফুল ইসলাম সজীব,,

— আপনার বাসা কি রংপুরে????
— না,, খুলনা বাগেরহাট,,,

— এখানে কি বেড়াতে আসছেন???
— হুমমম,, বন্ধুর কাছে,,

— আমি ঢাকা আগে দু একবার গেছিলাম,, তবে এখন একেবারে চলে যাচ্ছি,, ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেছি শহরে ভর্তি হব,, মা বাবা দুজনেই শহরে থাকেন,,।
— আচ্ছা,,

— আপনি কি বিরক্ত হচ্ছেন ???
— যেমন??

— এইযে ছোট্ট করে জবাব দেন,,
— না আসলে আমি ক্লান্ত, হঠাৎ করে ঢাকা যাচ্ছি,,

— ওহ সরি,, আমি ভাবলাম দুজনেই পাশাপাশি যাচ্ছি যদি কথা না বলি তবে কেমন অস্বস্তিকর মনে হবে,,
— ঠিক আছে সমস্যা নাই,,

ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম বগুড়ার কাছাকাছি ঘুম ভাঙ্গলো,, বাহ মেয়েটিও আমার কাধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছে,, মায়াবী চোখের পানে তাকিয়ে সত্যি ভালো লাগে,, হালকা বাতাস বইছে বিস্তীর্ণ বহমান প্রলেপ বুলিয়ে পরশয়ে বিদিশা বিভোর হয়ে,, শীত অনুভব হচ্ছে ভালোই মেয়েটি কেঁপে কেঁপে ওঠে বারবার,, আমার ব্যাগের ভেতর চাদর ছিল কিন্তু আমি জানালার পাশে তাই উঠতে পারছি না,, সত্যি সত্যি মেয়েটির ঘুম ভাঙ্গাতে ইচ্ছে করে না,, গাড়ি বগুড়ার হোটেল * Food Village * চলে এসেছে এখানে বিশ মিনিটের যাত্রা বিরতি দিছে,,

— এইযে শুনছেন??? (আমি)
— হুম বলেন,,

— চলেন ফ্রেশ হয়ে কিছু নাস্তা করে নিবেন,, গাড়ি যাত্রা বিরতি দিছে,,
— হুম চলেন,,

সে ঘুম ঘুম ভাবে তাকিয়ে আছে আমি তাকে বেরোতে বললাম,, নিজের ব্যাগ থেকে চাদর বের করে তাকে এগিয়ে দিলাম,, সে হয়তো এটা আশা করেছিল সাথে সাথে গ্রহণ করে নিল,, শুধুমাত্র দু কাপ কফি খেয়ে আবার বাসের ভিতরে বসে আছি,, সানজিদার ঘুম পুরোপুরি ভেঙে গেল মনে হয় কারণ সে স্বাভাবিক ভাবে আবার তার কথা বলা আরম্ভ করল,,

— আপনি ঢাকা কি করেন??? (সানজিদা)
— পড়াশোনা করি, এবার অনার্স শেষ হবে,, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়,, থাকি জামগড়া ফ্যান্টাসি কিংডমের পাশে,,

— আপনার কলেজ থেকে কাছাকাছি নাকি???
— না বেশ খানিকটা দুরে,, ওখানে আমার পরিচিত আংকেল আছে তার বাসায় আছি,, তার সন্তানের পড়াশোনার দায়িত্ব আমার,,

— আমি যাব উত্তরা ,, বাবা এয়ারপোর্টে জব করেন,,
— ওহহ আচ্ছা,,

কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু হঠাৎ করে মনে হয় পিছন থেকে কোন ট্রাক বা বাস প্রচন্ড জোরে ধাক্কা দিল,, আমাদের বাস রাস্তার পাশে বড়ো গাছের সঙ্গে বাড়ি লাগে নিউটনের সূত্র অনুসারে চলন্ত বস্তু বাহ্যিক বল প্রয়োগের জন্য দাড়িয়ে গেল,, সবকিছুই কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ঘটে গেছে,, সবাই মোটামুটি আতংকিত,, বাচ্চাদের চিৎকার কানে বাজে, বৃদ্ধরা আল্লাহর দরবারে হাত তোলে, পিছনের হিন্দু মহিলা ভগবান বলে দাড়িয়ে আছে,,

সানজিদা মাথায় আঘাত পেয়েছে মনে হয়, দরজা খুলে বের হওয়া যাবে না গাছের জন্য সেটা চুরমার হয়ে গেছে,, জানালা একমাত্র ভরসা নিজেকে বন্ধ করে বসে রইলে তো চলবে না ,, সানজিদাকে ধরে নামালাম তখন অনেক কষ্টে,, ব্যাগগুলো তার কাছে দিয়ে আমিও নেমে পরি,,

— এখন কি করবেন ? (সানজিদা)
— দেখি কি করা যায়,, বসে রইলে হবে না,, এখানে প্রচুর গাড়ি পাওয়া যায় তার যেকোন একটা ধরে ঢাকা যাব,, এ গাড়ির কি হবে কে জানে???

— আমি কি করবো ?
— চাইলে আমার সঙ্গে যেতে পারেন আর নাহলে এতগুলো যাত্রী আছে তাদের সাথে থাকতে পারেন,,

— আপনিও তো ঢাকা যাবেন,,
— হুম,,,

— তাহলে চলুন,,

একটা নাবিল ক্ল্যাসিক গাড়ি পেলাম কিন্তু সে যাবে গাজীপুর চৌরাস্তা,, আমি সাত পাঁচ না চিন্তা করে উঠলাম গাড়িতে কারণ চন্দ্রা নেমে গিয়ে লোকাক বাসে বাইপেল,,

— আপনি না হলে সত্যি বিপদ হতো,,
— হাহাহা

— হাসলেন যে???
— আমি নাহলে অন্য কারো সাথে যেতে পারতেন,, জীবন কারো জন্য থেমে রবে না,,

— সবাই তো এক না,,,
— তা ঠিক আছে,, আমরা ভোর ছয়টার দিকে চন্দ্রা পৌছলাম ,, সেখান হতে লোকাল বাসে বাইপেল গিয়ে নামলাম,,

— আপনি এখন মনে হয় যেতে পারেন,, আমি আশুলিয়া ক্ল্যাসিকে উঠিয়ে দিচ্ছি এগুলো উত্তরা এয়ারপোর্ট হয়ে মহাখালী যায়,,
— আমি চিনবো কি করে???

— বাহহহ আগের গাড়ি এক্সিডেন্ট না করলে কোই নামতেন??
— হাউজ বিল্ডিং,,

— এটাও হাউস বিল্ডিং যায়,,
— আপনার বাসা কি এদিকে???

— হুম সামনে,, লেগুনা করে ৫ টাকা ভাড়া,,
— আমাকে হাউস বিল্ডিং পর্যন্ত দিয়ে আসবেন??

— বলেন কি??
— খুব ভালো হতো,,

— আচ্ছা ঠিক আছে,, তাবে জামগড়া চলেন আমি আমার ব্যাগ রেখে আপনার সাথে যাব,,
— আচ্ছা ঠিক আছে,,

সানজিদা কে দাড় করিয়ে বাসায় ব্যাগ রেখে আসলাম কিন্তু কোন গাড়ি খালি পাওয়া যায় না,, এখন সাড়ে সাতটা বাজে গার্মেন্টস এর শ্রমিক ছুটে চলে কর্ম ক্ষেত্রে,, তাই বাসের ভিতরে তিল পরিমাণ ফাঁকা জায়গা নাই এদিকে মানুষ প্রচুর, অনেক কষ্টে একটা গাড়িতে উঠে পড়লাম কিন্তু তাকে বসাতে পারছি আমার যায়গা নাই,,

— আপনার মোবাইলটা দিবেন??? আমার টা বন্ধ হয়ে গেছে,, বাসায় কল দিতে হবে,,
— এই নিন,, কিছুক্ষণ পরে,

— রিসিভ করে না,, নিন ধরুন,,
— আবার চেষ্টা করে দেখুন,,

— লাগবে না,, হাউস বিল্ডিং হতে আমি বাসা চিনি,, রিক্সা নিয়ে সোজা খালপার বড় মসজিদ,,
— তাহলে সমস্যা নাই,, দুজনেই নর্থ টাওয়ারের সামনে দাড়িয়ে আছি,,

— আজকের বিষন্ন এই রাতের কথা আমার অনেক দিন মনে থাকবে,, (সানজিদা)
— হতে পারে,,

— আপনি কি এখান হতে বাসায় যাবেন???
— হুম,,

— ভালো থাকবেন আপনি,,
— আপনিও ভালো থাকবেন,,

তাকে রিক্সার ভিতর তুলে দিয়ে অনেকক্ষন তাকিয়ে রইলাম,, তারপর নিজের গন্তব্যের দিকে রওনা দিলাম কিন্তু
তার মুখ বেশী মনে পরে,, বাসের ভিতরে বসে দেখি একটা মেসেজ,, এ জীবনে আর কোনদিন যেন এমন উপকার করতে না দেখি, তবে সবাই আপন করতে চাইবে,, কিন্তু আজকের এই নিস্তব্ধতা বিদীর্ণ রাতে যার সাথে আমি নিশ্চিত হয়ে একটা নিশি পার করলাম,, তার সাথে সারাজীবন এভাবেই নিশ্চিন্ত, কাটাতে চাই,, বাসায় গিয়ে মেসেজ দিবেন,, ( সানজিদা) এটাই সেই শুরু,, তারপর থেকে পেরিয়ে গেছে প্রায় তিন বছর,,

একটু পরে সানজিদা কে পাত্র পক্ষ দেখতে আসবে,, আগে থেকে সবকিছু ঠিক আছে এখন শুধু আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হবে,, সানজিদা অনেক সুন্দর করে সেজে আছে,, সজীব এর নাম্বার হতে প্রায় পঞ্চাশ বারের বেশি কল আসছে কিন্তু সে রিসিভ করেনি,, অবশেষে মোবাইল সুইচ অফ করে দিছে কারন সজীব হয়তো ইমোশনাল কথা বলে তাকে দুর্বল করার চেষ্টা করবে,,, কিন্তু সে এখন তার মন খারাপ করতে চায় না,, সাড়ে পাঁচটার দিকে তাকে ছেলের সামনে নেয়া হয়েছে ছেলের বাবা আংটি পরিয়ে দিল,, হঠাৎ ছেলের বাবার ফোন টা বেজে উঠল,, অবাক হওয়ার মত কিছু কথা বলে সে বললো,,

— আপনাদের টেলিভিশন টা একটু অন করা যাবে??

— কেন বলুন তো??? (সানজিদার ভাই)

— বনানী এলাকায় নাকি ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড হচ্ছে,, কোন যায়গা কিছু জানা যায় কিনা,, আমাদের একটা অফিস আছে ওখানে,,

টিভি অন করা হলো ১১ তলা বহুতল ভবনে আগুন লেগেছে অনেক গুলো ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা নিয়ন্ত্রণে চেষ্টা করে যাচ্ছে,, হঠাৎ সানজিদার মনে হল সজীব এর নতুন জব বনানী এলাকায় হইছে,, তাই সে দ্রুত নিজের রুমে গিয়ে মোবাইল অন করে,, সজীব এর মোবাইল বন্ধ,, প্রায় ২৫ মিনিট আগে একটা মেসেজ আসছে সজীব এর মোবাইল হতে,,

অনেক বার কল দিলাম হয়তো তুমি অনেক বিজি আছো, আমাদের অফিসে আগুন লেগেছে সবাই বাঁচার চেষ্টা করে যাচ্ছে, আমি নিজে অনেককে বেরিয়ে যেতে সাহায্য করছি, কিন্তু আমার বেড় হবার ইচ্ছে ছিল না তাই নিস্তব্ধ হয়ে বসে আছি,, সবকিছুর মাঝে থেকেও কেউ কেউ আত্মহত্যার চেষ্টা করে,, আবার কেউ কেউ বেচে থাকার জন্য জীবনের সঙ্গে সংগ্রাম করে যাচ্ছে দিন রাত জাগ্রত হয়ে,, তোমার সাথে ভালবাসার ছায়া শুরু হয়েছে মেসেজ রিপ্লাই করে,, আর আজ সেটা মেসেজ দিয়ে সমাপ্তি হলো,, আশ্চর্য প্রথম মেসেজ টা ছিল তোমার আর শেষ মেসেজ টা আমার,,

সন্ধ্যা নেমে আসছে,, সমগ্র শহরের মাঝে জোনাকির আলো দেখা যাচ্ছে মাঝে মাঝে,, সানজিদা বসে আছে সিএনজি তে,, তার গন্তব্য বনানীর আগুন লাগা ভবনে আহতদের যে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ,, তারকা গুলো ফুটতে শুরু করেছে আকাশে ,, জোছনা নাকি আধার পুরোপুরি বোঝা যায় না,,

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত