ঘর্মাক্ত ললাট, বারবার স্বেদবিন্দু মুছিতেছেন রহমান মিয়া। নৈদাঘকাল পেরোতে এখনো বহুদিন বাকি। জমিতে শস্য ফলাইবার জো মাত্র নেই। মাঠের মাঝখানে ঠাঁই দাঁড়াইয়ে থাকা অশ্বত্থ বৃক্ষের তলে নিবৃত্তি লভিবার দরুণ পা বাড়াইলেন তিনি। মাঠের এ প্রান্ত হইতে ঐ প্রান্তে চক্ষু মিলিলে ধূধূ মাঠের উপরে মরিচিকার অবয়ব দৃষ্টিগোচর হয়। পাড়াগাঁয়ে এইবার দারুণ খাদ্য সংকট পরিবে ভাবিয়া সচকিত হন তিনি। ইহা হইতে পরিত্রাণ পাইবার পথ একমাত্র উপরে বসিয়া থাকা উনিই দূর করিতে পারিবেন। স্বগৃহে যাহা মজুত আছে, তাহা দিয়া দিন বিশেক চলা যাইবে। তাছাড়া ধার দেনা করিয়া বাকি দিন দশেক চলিবে। অতঃপর পাড়াগাঁয়ের সকল গৃহে খাদ্য ফুরাইবে। গাঁয়ের মাতব্বরের গুদামঘরে প্রচুর খাদ্য-শস্য মজুত আছে। তিনি বড় চতুর লোক। গাঁয়ের লোকের অভাবের কালে সহযোগিতা করেন বটে। কিন্তু পশ্চাতে তাঁহার কঠিন দাবি থাকে।
কিয়ৎকাল বাদে সন্ধ্যে ঘনাবে চারিপাশে। পাশের জমি হইতে মোল্লা সাহেব ডাকিয়া কহিলেন, “কিহে রহমান মিয়া, বাড়ি যাইবা না?” রহমান মিয়া নিচুস্বরে উত্তর করিলেন, হ্যাঁ হ্যাঁ। হাঁটতি থাহো। আইতাছি আমি। নিশুতি রাত, নিদ্রাহীন চোখ, নিশ্চুপ চারিপাশ। নিশ্বাসের শব্দ বিহীন অন্য কোনো শব্দ কর্ণকুহরে প্রবেশ করিতেছে না। পাশে রামিমের মা জনাবা নূরজাহান বেগম শায়িত আছেন। রহমান মিয়া মৃদুস্বরে কহিলেন, “ও রামিমের মা, আমাগো পোলায় কি কোনো খবর পাঠাইছে?” রামিমের মা পাশ ফিরিয়া শুইয়া উত্তর করিলেন, না গো রামিমের বাপ। পোলায় তো এইবার কোনো চিঠি পাঠাইলো না।
– শুনেছিলেম শহরে যাইয়া নাকি একখান চাকরি পাইয়াছে!
– হ, গত মাসের চিঠিতে তো তাই লেহা ছিল।
– আজ মাসের কয় তারিখ, জানো কিছু?
– হয় জানি, আজ মাসের শেষ দিন।
– আমাগো রামিম তো কোনো মাসে চিঠি পাঠাইতে ভুল করে না গো রামিমের মা। তয় এই মাসে এখনো পাঠাইলো না ক্যান?
– কাইলকের দিনটা দেহি।
– হ, দেহো। এইবার চিঠি আইলে কালাচান চাচাকে বইলে দিও, রামিমের সাথে দেখা হইলে যেন তাকে এ্যাকবার বাড়ি আইতে কয়। তাছাড়া চিঠিতেও লিইখা দিও।
– হ, তা দিবো। ভাবতাছি…..
– কী ভাবতাছো?
– ঘরের খাবার তো ফুরায়ে আইলো। এই মাসটা ঠিকমতো যাইবে না বোধ হয়।
– চিন্তা কইরো না। উপরে যিনি বইসা আছেন, তার উপরে ভরসা রাহো। দেখবে, সব ব্যবস্থা তিনিই করবেন।
– হয় গো রামিমের বাপ।
– রাইত তো অনেক হইলো। এহন ঘুমায়ে পড়ো। কাইল এ্যাকটু সকাল সকাল ডাইকা দিও।
টানা পাঁচদিন গত হইবার পর রামিমের চিঠি আসিলো। কালাচান মিয়া বাড়ির প্রবেশ দ্বারে দাঁড়াইয়া হাঁক ছাড়িলেন, “রামিমের মা, ও রামিমের মা, বাড়ি আছো নাকি।” রামিমের মা ঘর হইতে বাহির হইয়া দেখিলেন, কালাচান চাচা বাইসাইকেলের ঘণ্টি বাজাইয়া হাঁক ছাড়িতেছেন। তিনি ছোট ছোট পায়ে আগাইয়া গিয়া প্রলোভিত কণ্ঠে কহিলেন, আমাগো রামিম চিঠি পাঠাইছে? এইবার এতো দেরি হইলো ক্যান চাচা?
– শুধু চিঠি না মা। সাথে তোমার পোলায় মিষ্টিও পাঠাইছে। আমারে কইয়া দিছে, আমি যেন স্বযত্নে মিষ্টির প্যাকেট তুমার হাতে তুইলা দেই।
– ক্যান চাচা? পোলায় মিষ্টি পাঠাইছে ক্যান?
– তুমার পোলায় কইলো, এই মাস থেইকা নাকি বেতন বাড়াইয়া দিছে।
রামিমের মা পিয়ন চাচার হস্ত হইতে মিষ্টির প্যাকেটখানা লইয়া সেইখান হইতে একটা মিষ্টি বাহির করিয়া কহিলেন, নেন চাচা এই মিষ্টিডা আপনে খান। আর শুনেন, এবার যাইয়া আমার বাজানরে এ্যাকবার বাড়ি আইতে কইবেন। পিয়ন কালাচান মিয়া চিঠি দিয়া প্রস্থান করিলেন। নূরজাহান বেগম ঘরে গিয়া চিঠি খুলিয়া পড়িতে লাগিলেন।
“মা গো, কেমন আছো তুমি? বাজান কেমন আছে? আমাকে নিয়ে কোনো চিন্তা করো না। আমি ভালো আছি। আর শুনো, বাজানরে এখন অতো বেশি কাজ কাম করতে নিষেধ কইরো। বাজানরে বইলো, তোমার ছেলে এখন বড় একটা চাকরি করে। আর বেতনও বেশ ভালোই পায়। গতমাসে চিঠি পাঠাইনি কারণ, ভাবছিলেম বেতন পেয়ে একবারে পাঠাইয়ে দেবো। সাথে কিছু সঞ্চিত টাকাও ছিল। আর মা, আমি গ্রীষ্ম ফুরাইলে বাড়ি আসবো। তোমরা আমাকে নিয়ে কোনো চিন্তা করো না, কেমন?
রামিম”
নূরজাহান বেগম চিঠির খাম হইতে টাকাগুলো বাহির করিয়া দেখিলেন চকচকে অনেকগুলো নোট। এত বড় নোট শেষ কবে দৃষ্টিগোচর হইয়াছে, তা মনে করিতে পারিতেছেন না তিনি। সায়াহ্নে রহমান মিয়া বাড়ি ফিরিলে নূরজাহান বেগম তাঁহার হস্তে টাকাগুলো অর্পন করিয়া কহিলেন, এই দ্যাহো তোমার বাপে টাকা কত বড় বড় ট্যাহা পাঠাইছে। তুমি একদম চিন্তা কইরো না, এই গরমডা ভালোভাবেই পার হইবো।