অফিস থেকে বাসায় ফিরে ব্যাগটা বিছানায় রেখে নীলাকে বেশ কয়েকবার ডাকলাম। গায়ের টাই ও শার্টের বোতামগুলো সাধারণত নীলাই ধীরে ধীরে খোলার সময় সারাদিন কোথায় কি দেখেছে শুনেছে,কে কি বলেছে এসব অনেক আগ্রহ নিয়ে বলে। এই আহ্লাদী মেয়েটার যত্ন করে টাই আর শার্টের বোতামগুলো খোলার মায়ায় পড়ে গেছি। এই মায়া জিনিসটা অভ্যাসে পরিণত হলে আর সেটা ছাড়া অন্যকিছু ভাল লাগেনা। এসময় মাঝে মাঝে আমি দুষ্টমী করে ঘাঁমে ভেজা শরীরে নীলাকে আচমকা কোলে নিয়ে রান্না ঘরের দিকে এগোই। আর বলি দ্রুত এক কাপ কফি করো আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি কফি খেতে খেতে তোমার সব গল্প শুনবো। ও হ্যাঁ তোমার জন্য সারপ্রাইজ আছে একটা।প্রথম দিকে আমার কথায় কর্ণপাত না করে লজ্জায় লাল হওয়া মুখমন্ডল এদিক সেদিক ঘুরিয়ে বলতো”এই কি করছো ছাড়ো ছাড়ো কেউ দেখে ফেলবে।” লজ্জায় ভীত হওয়া চোখ দু’টো দেখে ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠতো। কিঞ্চিৎ সময়টুকুতে অবলিলায় শ্রেষ্ঠ সৌন্দর্যের প্রকাশ।
এজন্যই মনে হয় নিক্ষুত সৃষ্টিকর্তা নারীদের মাঝে লজ্জার আভা লেপ্টে দিয়েছেন। কোল থেকে নামিয়ে দিতেই নীলা তাড়াহুড়ো করে কফি বানাতে ব্যস্ত হয়ে যায়। তারপর কফিতে চুমুক দিতে দিতে নীলা রাজ্যের গল্প জুড়ে দেয় আমি মুগ্ধ শ্রোতার মত আগ্রহ নিয়ে পাগলীটার গল্প শুনি। এশার আযান না দেওয়া পর্যন্ত একের পর এক গল্প চলতে থাকে। নীলা সারপ্রাইজ এর কথা মনে করিয়ে দেয়। তখন পকেট থেকে ওর পছন্দের অনেকগুলো চকলেট বের করে দেই আর একটা চিরকুট দেই। চিরকুটে লেখা থাকে “তোমার টোল পড়া হাসিটা দেখার জন্য আজ তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরেছি। আর তোমাকে একদম ভালোবাসিনা,তবে তোমার মাথাটা আমার বুকে না রাখলে আমার ঘুমই আসেনা।
” অথবা কোনোদিন লিখলাম “আজকে তোমাকে শাড়ী পড়ে দেখার জন্য তাড়াহুড়ো করে অফিস থেকে ফিরছি। ঐ কমলা রংয়ের প্রিন্টের শাড়ীটা পড়বে। চোখে কাজল ছাড়াই তোমাকে বেশ লাগে। তুমি সাঁজুগুজু করবে আমি পাশে বসে দেখবো।” লজ্জাবতী বউটা চিরকুট পড়ে আর লজ্জায় লাল হয়ে আড় চোখে আমার দিকে তাকিয়ে চুপিচুপি হাসে। আমার যে কি ভালো লাগে। কোনোদিন অফিস থেকে ফেরার সময় কেনা একগুচ্ছ গোলাপ দিয়ে অবাক করে সুনীলের কবিতা দিয়ে ফিল্মি স্টাইলে প্রপোজ করি। নীলা লজ্জামাখা মুখে বলে “পাগল একটা।” একেক দিন একেক উপায়ে ইমপ্রেজ করি। বউকে এভাবে ইমপ্রেজ করার মধ্যে নতুন প্রেম প্রেম একটা ভাব আসে। আমি এই প্রেমময় সময়গুলো উপভোগ করতে ভুলিনা একদম।
আজ নীলার সাড়াশব্দ না পেয়ে ছাদে গেলাম। ছাদের একপাশে কর্ণারে দাড়িয়ে আছে মেয়েটা। কাছে গিয়ে ঘর্মাক্ত শরীরেই পেছন থেকে নীলার কাঁধে থুঁতনিটা রাখলাম। নীলা ফুঁপিয়ে কাঁদছে। কাঁধ থেকে থুঁতনি সরিয়ে হাত ধরে আমার দিকে ঘুরিয়ে নিলাম। চোখের পানি মুছিয়ে দিতে দিতেই বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম- “কি হয়েছে নীলা কাঁদছো কেনো? মা কিছু বলেছে? কোনো সমস্যা?” “আচ্ছা বলোতো আমি কি এতোই বাজে রান্না করি যে তুমি খেতে পারোনা? আর আমার রান্না যে তোমার খেতে ভালো লাগেনা আমাকে তো একবার বলতে পারতে তাই না?” নীলার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার পূর্বে ভেবে নিলাম গত এক সপ্তাহ নীলার রান্না নিয়ে কাউকে কিছু বলেছি না কি? নাহ্ মনে পড়ছে না। “আচ্ছা কে বলেছে তোমার হাতের রান্না ভাল না হুম? তুমিতো জানো দাওয়াত খেতে গেলেও আমি কম খাই। কারণ ফিরে এসে তোমার হাতের সু-স্বাদু রান্না খাব বলে।” “হয়েছে হয়েছে পাম কম মারো।
আমার হাতের রান্না যদি এতোই ভালো হতো তাহলে পাশের বাসার ভাবিকে বলতে না যে নীলার হাতের রান্না খেতে আজকাল ভাল লাগেনা ভাবি।” ওহ আমার মনে পড়েছে গত সোমবার রানু ভাবিদের বাসায় গেছিলাম একটু। উনার হাসব্যান্ড আমার কলিগ। আমাদের পাশের বাসায় থাকেন। তো কথায় কথায় ভাবি খাবার-দাবারের প্রসঙ্গ তুলে বললেন “আজকাল মাছ-গস্তের তরকারিগুলোও স্বাদ লাগেনা ভাই। “আমি শুধু হালকা হেসে সায় দিয়ে বলেছিলাম “আসলেই ভাবি।” মেয়ে মানুষের এই একটা সমস্যা সহজ কথা জোড়াতালি দিয়ে প্যাঁচ লাগানো। আমি কি এমন করেছি? শুধু ভাবির কথাটাকে সায় দিয়েছি মাত্র যাতে মন খারাপ না করে এই।
নীলাকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম পুরো বিষয়টা। এবার কিছুটা হলেও শান্ত হলো। আমার দিকে মায়াভরা অপরাধী দৃষ্টি দিয়ে বুকে মাথাটা গুঁজে বলল “Sorry কলিজা।” আমি মুচকি হেসে ভাবছি আসলে মেয়েদের মাঝে মধ্যে মিথ্যে দিয়ে হলেও রাগানো দরকার। পরে সুন্দর করে বুঝালে গর্জনের পর ভালোবাসার বৃষ্টি নামে বৃষ্টি। এই বৃষ্টিতে কঠিন রাগী পুরুষরাও ভিজে একাকার হতে চায়। অদ্ভুত এই নারী জাতি অল্পতেই বেঁকে বসে আবার অল্পতেই হৃদয় উজার করে ভালোবাসে। “আজকে তোমার পছন্দের খাবার রান্না করেছি। আযান দিচ্ছে তাড়াতাড়ি এশার নামাজ পড়ে আসো আমিও নামাজ পড়ে নেই তারপর খেতে দিবো।” “আচ্ছা ঠিক আছে।” বলে আমি নামাজে যাই।
প্রিয় মানুষগুলোর জন্য রান্না করার সময় রান্না না জানা মেয়েটাও সমস্ত পরিশ্রম দিয়ে চেষ্টা করে মজাদার রান্না তৈরির। যা খেয়ে অন্ততো প্রিয় মানুষটা প্রশংসা করে। এতোটুকুই চাওয়া তাদের। মসজিদ থেকে ফিরে এসে দেখি নীলা টেবিলে খাবার রেডি করে বসে আছে। দেশি মাগুর মাছ ঝল করে রান্না করেছে সাথে পুদিনা পাতার ভর্তা আর পটল ভাঁজি। নীলা একটা প্লেটে ভাত বেড়ে দিয়েছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম “তুমি খাবেনা?” “হুম খাবো। কিন্তু তুমি খাইয়ে দেবে কারণ আজকে তোমার পছন্দের দেশি মাগুর আর পুদিনা ভর্তা করা হয়েছে। তোমার হাতেই তোমার প্রিয় খাবারের স্বাদ ভাগাভাগি করতে চাই।”
আমি নীলাকে খাইয়ে দিচ্ছি সাথে আমিও খাচ্ছি। খেতে খেতে ভাবছি এই মানুষটা এতো অল্প সময়ে আমার কোনটা প্রিয় কোনটা অপ্রিয় সব জেনে নিয়েছে। সত্যি ভালোবাসলে মানুষ কতই না যত্নবান হয়ে ওঠে। আর আমিও কেমন ছোটবেলায় যখন গ্রামে থাকতাম মা ভাতিজা-ভাজতিদের একটু খাওয়াই দিতে বললে পারতামনা। অনেক রাগ করতাম। অথচ একটা তেইশ বছরের মেয়েকে আনন্দের সাথে আগ্রহ নিয়ে দিব্বি খাইয়ে দিচ্ছি। আমার গলায় ভাত আটকে যায়। নীলা দ্রুত পানি খাইয়ে দেয়। এই একই ঘটনা ঘটতো ছোট বেলায় ভাই-বোনদের গলায় ভাত আটকালেও কেউ কারও এঁটো গ্লাসে পানি পান করতামনা। আজ দুই বছর যাবৎ নীলার সাথে একি গ্লাসে নিয়মিত পানি পান করছি। মায়াভরা ভালোবাসা অকল্পনীয় জিনিসগুলো স্বাভাবিক করে দেয়।
আমাদের কোমল হৃদয় সব সময় ভালোবাসার দাসত্ব্য করে। বাবা মায়ের দিকে তাকালেই বোঝা যায়। বৃদ্ধ বয়সেও তারা একে অপরের কত যত্ন নেয়। ব্যথাতুর স্থানে তৈল মালিশ করে দেয়,ঔষধ খাইয়ে দেয়। ঝগড়া নেই একে অপরের সব কথা প্রত্যুত্তর ছাড়াই মেনে নেয়। কেউ কাউকে ছাড়া কিছু খায়না। বাজারে আব্বু একটা বড়া ভাঁজা খেলে আম্মুর জন্যেও নিয়ে আসে। অকৃত্রিম ভালোবাসার পূর্ণদৈর্ঘ সিনেমার মত বৃদ্ধদের প্রেম দেখলে মনে হয় পৃথিবী টিকে থাকুক অনন্ত যৌবনার প্রেমের মত সাবলীল ভাবে।
অফিস থেকে ফিরার পথে ভার্সিটি জীবনের বন্ধু রাজের সাথে দেখা হল। মোহাম্মদপুর সিকশন রোডের মাথায় টঙের দোকানে বসে রং চা পান করতে করতে দুজনে হারিয়ে যাই ক্যামপাসের দিনগুলোতে। অসম্ভব সুন্দর ছিল দিনগুলো। সারাদিন ক্লাসে অ্যাসাইনমেন্ট আর ক্লাস টেস্টের প্যারা শেষে সন্ধ্যায় টিউশনি। হাত খরচ কমিয়ে টিউশনির কিছু টাকা জমিয়ে রাখা। আর সেই টাকায় শীতের ছুটিতে বন্ধুদের সাথে সাঁজেক, হিমছড়ির মত প্রকৃতির রাজ্যে হারিয়ে যাওয়া। জ্যোছনা কেনার স্বামর্থকে হার মানিয়ে জ্যোছনাবিলাসের মুহূর্তগুলো দুই বন্ধু চায়ের ধোঁয়ায় ভাসিয়ে তুলি। রাজ একটা সিগারেট জ্বালিয়ে অন্ধকারে নিকোটিনের বাষ্প ছড়িয়ে দিয়ে সেদিকেই তাকিয়ে থাকলো। আমার জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তার ভাবনার ছেদ পড়ল।
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বিষন্ন মনে বলল “সুখ কোথায় দস্ত? জানিস মাঝে মাঝে ঘুমাতে পারিনা। মাস শেষে এক দেড়লক্ষ টাকা হাতে আসে সংসারে ইচ্ছে মত খরচ করার পরও অনেক টাকা থেকে যায়। এখন টিউশনি থেকে যা পাই সেটাই সংসারের সব খরচ শেষে থেকে যায় কিছু। কিন্তু সেই ক্যামপাস জীবনে টিউশনির টাকায় রোজ মনির সাথে রিকশায় চড়ে ইট পাথরের শহরে ঘুরে বেড়ানো। টিএসসিতে বসে রফিক মামার বাদাম খেয়ে বিকেল পার করানোর দিনগুলোর মত তৃপ্তি পাইনা রে কোথাও।” আমি চুপ করে থাকি। রাজ আবার বলতে শুরু করে “জানিস আবির কিছুদিন আগে আমার অফিসের পিয়নের মেয়ের বিয়েতে দাওয়াত খেতে যাই। কাকতালীয় ভাবে সেখানে মনির সাথে দেখা হয় আমার।
একটু মোটা হয়ে গেছে মেয়েটা। কাজল আঁকা চোখে চাহনীটা সেই আগের মতই মায়াবী আছে। সাথে একটা দুই বছরের মেয়েও ছিল। আমিতো ঐ রকমই স্বপ্ন দেখেছিলাম। আচ্ছা বল তো আমার কি স্বপ্ন দেখা দোষের ছিল? ও তো চাইলেই গ্রাজুয়েশনটা কমপ্লিট করা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারতো। পারতো না? অথচ আমাকে কিছু না জানিয়েই বিয়ে করে নিলো। আমার অনুভূতিগুলোর কি কোনো মূল্য ছিলনা? যদি এভাবে মাঝ পথে ছেড়ে চলে যাবে তবে কি প্রয়োজন ছিল জায়গা দেওয়ার?” সিগারেটটা অনেকক্ষণে মিইয়ে গেছে সেটার দিকে তাকিয়ে রাজও নিরব হয়ে গেলো। আমি কিছু বলতে পারিনা। ভালোবাসার মত এতো বিশাল স্বপ্নলোকের কল্পনা জগৎ ভয়ংকর।
আমি রাজের ডান হাতে চাপ দিয়ে বলি “ছাড় না বন্ধু ওসব সবকিছু আমাদের ভাগ্যে থাকেনা। আর নতুন ভাবিকে নিয়ে আয় একদিন আমাদের বাসায় বেড়াতে। তোর ভাবির হাতের রান্না কিন্তু অনেক সুস্বাদু খেয়ে যা একদিন। রাজ বিষন্ন মনে মৃদু হেসে বলে “ঠিক আছে আসব একদিন। আর তুইয়ো ভাবিকে নিয়ে আসিস সময় করে। আমি সামনে ঐ বাসস্টপ এর পাশের ফ্লাটে থাকি।” ঠিক আছে বলে বিদায় জানিয়ে আমি বাসস্টপের দিকে এগিয়ে যাই। আচ্ছা না পাওয়ার গল্পগুলোতে কি আসলেই শুধু ভাগ্যের দোষ থাকে নাকি এটাকে আমরা অজুহাত হিসেবে দাড় করি? সত্যি কি সম্পর্কের মৃত্যু ঘটে? মাঝে মাঝে আমার মনে হয় সম্পর্কের মৃত্যু ঘটে না, কিছু মানুষ সম্পর্ককে হত্যা করে। কিন্তু হাস্যকর ব্যাপার হচ্ছে, সেই সব হত্যা কারী কে আমরা চির জীবন ভালোবেসে যাই।
বাসের পেছন দিকটায় দেখি বেশ কিছু সিট ফাঁকা। অফিস ছুটির সময় হলে সিট পেতাম না। রাজের সাথে গল্পে অনেকটা সময় পার করায় সিট পেয়ে গেলাম। কাঁচের জানালার পাশ দিয়ে সোডিয়ামের বাতির আলো টিকরে পড়ছে ভেতরে। সে আলো অপেক্ষা করে আমি ভাবতে থাকি আসলে ভালোবাসা কতটা ভয়াবহ! দুজনের আলাদা সংসার হয়েছে। কর্মজীবনেও রাজ সফল। অথচ মন সেই পুরোণো স্মৃতির আবডালে পাতা নাড়ে। কি অদ্ভূত ভালোবাসা। পাবোনা জেনেও পাওয়ার তীব্র আকাংখা মানুষকে পীড়া দেয়,অস্থির রাখে। উচাটন মনে বিস্ময় বাসা বাঁধে। আমার মনে পড়ে ক্যামপাস জীবনে রাজ আর মনি’র কত মধুর সম্পর্ক ছিল। ছেলেটা প্রিয়তমাকে উপহার দেওয়ার জন্য অতিরিক্ত টিউশনি করাতো।
একাডেমিক রেসাল্ট খারাপ করেও আনন্দে থাকতো। হুট করেই ছেলেটা পাগলের মত হয়ে যায়। পরে শুনি গার্লফ্রেন্ড এর বিয়ে হয়ে গেছে। একদিন রাতে আমার মেসে আসে হাত দু’টো ধরে সে কি কান্না। একুশ বছরের যুবকের আবেগ যে এতোটা মোলায়েম আমার বুঝে আসেনা। আমার তখন থেকেই ভালোবাসার প্রতি একটা ভয় কাজ করতে শুরু করে। মনি আমাদের এক বছর জুনিয়র ছিল। আমি কন্টাক্ট করে মেয়েটার সাথে একবার দেখাও করে ছিলাম। মেয়েটা আমাকে বলেছিল “ভাইয়া রাজের মন মানুসিকতা যে এতো ছোট আমি ভাবতে পারিনি।” কথাটা শুনে আমি একটা বড় ধরণের ধাক্কা খাই। আমি জিজ্ঞেস করি “কেনো এমন মনে হল আপু?”
মনি বলে “জানেন ভাইয়া রাজের সাথে আমার সম্পর্ক পরিবার কোনো ভাবে মেনে নিবে না। আমার বিয়ে হওয়ার পর ফোন বন্ধ। আর রাজ আম্মুর নাম্বারে মেসেজ দিছে ‘তুমি কিভাবে আমাকে ছেড়ে অন্যের বিছানায় যাবে মনি?’ ছিঃ এমন মেসেজ কেউ কাউকে দেয় বলেন? ভাবুন একবার কত বাজে ছেলে।” এসব শুনে কি বলব আমি বুঝতে পারিনা। আচ্ছা আমার কি কিছু বলার ছিল? প্রিয় মানুষটা অন্যের হয়ে যাচ্ছে।
সাঁজানো স্বপ্নগুলো সব মিথ্যে হয়ে যাচ্ছে। যাদের সাথে এমন হয় তাঁদের সেই সময়ের অনুভূতিগুলো কেমন আমার মত ভালোবাসাহীন বোকা ছেলের বোধগম্য নয়। জানিনা সত্যি আমি জানিনা কাউকে ভালোবেসে হারানোর বেদনাবোধ কতটা জোরালো ও কষ্টকর। তবে রাজকে দেখে কিছুটা আঁচ করতে পেরেছিলাম সেসময়। গ্রাজুয়েশন শেষ করার দুই বছরের মাথায় রাজ প্রশাসন ক্যাডারে নিয়োগ পায়। যেদিন পোষ্টিং হয় আমাকে ফোন করে বলেছিল “দস্ত মনি আজ পর্যন্ত একটু অপেক্ষা করতে পারত না? এইতো কয়েকটা বছর। সেও তো একটু হলেও ভালোবেসেছিল। সামাণ্য অপেক্ষার কষ্টটা মানিয়ে নিতে কি বেশিই কষ্ট হত?” ফোনের অপাশে আড়ষ্ঠ কণ্ঠস্বর নাকের জল টানার শব্দ। ফোন কেটে দেয় রাজ।
বুঝতে পারি ছেলেটা ভাল নেই। ছোট বেলায় আমার এক খালাতো বোন বলতো “হাজারো পূর্ণতা একটি অপূর্ণতার কাছে পরাজিত। আর তা হচ্ছে ভালোবাসার মানুষটিকে না পাওয়ার অপূর্ণতা।” আপু সাংসারিক জীবনে সুখি ছিল তারপরও কেনো যেনো সেদিন ছাদে রাতের জ্যোছনাময় মুহূর্তে ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে এ কথা বলেছিল আজও অজানা। পৃথিবীর মানুষগুলো এক রঙের না হলেও কিছু মানুষের না পাওয়ার গল্প গুলো ঠিকি নীল রঙের। এমন নীল রঙা গল্পগুলো মাঝে মাঝে আমাদের ভেতরে নাড়া দিয়ে ওঠে। আর পাশের সাংসারিক মানুষটাকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে নিজের নির্ঘুম রাত কাটে চোখ লাল হয়ে এলার্জি সমস্যায় ভুগি। এ রোগের অসংখ্য রোগী। এভাবেই স্বল্প এজনমের কত সময় পেরিয়ে যায় অবেলায়।
শীতের সকাল মসজিদ থেকে এসে বেশ কিছুক্ষণ বাসার পাশের মাঠে হাঁটিহাঁটি করলাম। বাসায় এসে কাউকে না পেয়ে ছাদে গিয়ে দেখি নীলা পশ্চিমের ফুলের গাছগুলোর কাছে বসে আব্বু-আম্মুর দিকে তাকিয়ে আছে। আব্বু-আম্মু ছাদের উত্তরে চেয়ারে বসে। ওদিকটাই শীতের সকালের মিষ্টি রোদ পড়েছে। আম্মু কবিতা আবৃত্তি করছে আর আব্বু মুগ্ধ শ্রোতার মত উপভোগ করছে। আমার এই দৃশ্য দেখে মনে হচ্ছে সপ্তদশ শতাব্দীর রোমান্টিক যুগল খুব ভাব জমিয়ে প্রেম করছে। যে প্রেমে কলঙ্কের ছটা নেই। মা আবৃত্তি করছে “তুমি আসবে বলে মায়ায় জড়াইনি হৃদয় তুমি আসবে বলে, তুমি আসবে আঁধারে সাঁঝের বাতি হয়ে আমি আজও ব্যকুল প্রতিক্ষায় পথ চেয়ে–” বৃদ্ধ বয়সেও মায়ের আবৃত্তি অষ্টাদশী বালিকার কণ্ঠকে ম্লান করার মত।
কবিতাটা আব্বুর নিজের লেখা। আব্বু যখন কলেজে পড়তো তখন লিখেছিল। আব্বুর তিনটে ডাইরিতে শুধু কবিতা। কবিতাগুলো পড়লে মনে হয় আব্বু বাল্যকালে ডাসা একজন প্রেমিক ছিল। কিন্তু কবিতাগুলো নাকি আব্বু কেবল কল্পনা দিয়েই লিখেছিল। আব্বুর জীবনে নাকি নায়িকা শূণ্য ছিল। আব্বুকে কলেজ জীবনের প্রেম নিয়ে প্রশ্ন করলে বেশ রসকতার সহিত বলেন “এই কালা হ্যাঙলা মানুষটার দিকে কোনো মেয়েই চেয়ে দেখেনি। কি যে দুঃখ বাবা।” বাবার কথা শেষ হতেই মা বলে ওঠে “জানি সব জানি,এতো এতো প্রেমের কবিতা প্রেমিকার জন্যই লিখেছিলে।” আব্বু হাসতে হাসতে বলে “হুম আবিরের আম্মু কর্ণফুলি নদীতে রোজ নৌকাতে করে ঘুরেছি প্রেমিকা নিয়ে। আমি হতাম মাঝি।
মাঝে মাঝে গান ধরতাম– সব সখিরে পার করিতে নেবো আনায় আনা তোমার বেলা নেবো সখি তোমার কানের আম্মু থামিয়ে দিয়ে “ঢং! সেটাতো আমাকে বিয়ে করার পর এভাবে প্রেম করেছো আমার সাথে।” আব্বু হেসে ওঠে তখন। আমি অবাক হই আব্বু আম্মু বিয়ের পর কত সুন্দর সময় কাটিয়েছেন। তাই তখনি ইচ্ছে হয় বিয়ের আগে প্রেম করবোনা। আব্বু-আম্মুর মত বিয়ের পর জুটিয়ে প্রেম করবো। নীলার কাছে যেতেই আব্বু-আম্মুকে ইশারা করে বলে উঠলো “এই দু’টো মানুষের ভালোবাসা দেখলে হিংসে হয়। গর্বও হয় যে এই মানুষগুলোর ভালোবাসায় নিজেকে সিক্ত করতে পেরে। তুমিও কি আমাকে বুড়ো বয়সে এমন ভালোবাসবে?” আমি নীলার হাতে হাত রেখে হালকা চাপ দিয়ে বলি “যদি তুমি ওমন করে কবিতা আবৃত্তি শোনাতে পারও,তবে কথা দিচ্ছি আমিও বাবার মত মুগ্ধ শ্রোতা হবো।” নীলা ফিনিক হেসে বলে “চলো নাস্তা করবো। তোমার অফিস আছে দুপুরের খাবার এখনো টিফিনে সাঁজাইনি।”
আব্বু-আম্মুকে ডেকে নিচে নামি। সবাই একসাথে নাস্তা করি। নীলা আমার টাই বেঁধে দেওয়ার সময় কোমরে হাত দিয়ে কাছে টেনে কপালে চুম্বন করি। আর বলি “সারাদিন আমার চাঁদ যেনো আঁধারে লুকিয়ে থাকে, ভুল করেও কারও নজরে যেনো না আসে।” নীলা সরিয়ে দিয়ে বলে “ঢং করোনা তো এখন,কাজ আছে অনেক।” আমিও বাধ্য ছেলের মত নিরব হয়ে থাকি। টাই বাঁধার পর নীলা বলে “একটু হালো তো।” আমি হালতেই নীলা কপালে চুম্বন করে বলে “আমার সূর্যটা যেনো সারাদিনে মেঘে ঢাকা থাকে।” আমি হাসতে হাসতে বলি “এজন্যই বেটে মেয়েকে বিয়ে করা মজা। জুতা পড়া ছাড়া কপাল ছুঁয়ে দিতে পারেনা। তবে বুকের মধ্যে মাথা গুঁজে নিয়ে হৃদয়ের কম্পন বোঝানো যায়।” নীলা রাগী ভাব নিয়ে বলে “আমি বেটে না তো যাও না লম্বা মেয়ে বিয়ে করে আনো।” আমি নীলার রাগ না ভাঙ্গিয়ে হাতে একটা চিরকুট দিয়েই অফিসের উদ্দেশ্যে বের হলাম।
দুপুর হতেই নীলার ফোন। অফিসের কাজের চাপের মধ্যেই ফোনটা রিসিভ করি। নীলা আদুরে সুরে বলে “তুমি এমন কেনো বলোতো? বউকে রাগিয়ে দিয়ে আবার আবেগঘন চিঠি দিয়ে বউকে প্রেমের প্রস্তাব দাও। তুমিতো জানোই তোমার প্রেমে এই মেয়েটা আত্মহারা হয়ে হাবুডুবু খায়।” দ্রুত লাউডটা কমিয়ে দেই। পাশের চেয়ারে বসা আমার কলিগ ফিরোজ ভাই বলে ওঠে “কি আবির ভাই ভাবিকে কি এমন জাদু করেছেন নতুন করে প্রেম করতে চায়?” আমি চুপ করে থাকি। নীলা ফোন কেটে দেয়। আজকে বাড়িতে গেলে বারোটা বাজাবে আমার। নীলা সব সময় বলে কথা বলার সময় লাউড না দিতে।
আর অফিসে অনেক ব্যাক সাউন্ডের জন্য নরমাল স্পিকারে আমি শুনতে পাইনা তাই নীলার কথা খেয়াল না করেই লাউড দেই। অঘটন সময় নিয়ে পূর্বে জানিয়ে ঘটেনা। এটা আচমকা ব্রেক থ্রো মারে অকস্মাৎ মন মস্তিষ্কে কাঁপুনি দেওয়ার জন্য। বাসায় ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। ঘরে ঢুকে দেখি নীলা কম্বল মুড়িয়ে শুয়ে আছে। একবার ডাকলাম কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে মায়ের ঘরে যাই। মায়ের ঔষধ গুলো দিয়ে বললাম সবাই খেয়েছে কি না? মা বলল “সবাই খেয়েছে,তবে বউমার হাবভাব দেখে মনে হলো কিছু একটা হয়েছে। বিছানায় যাওয়ার আগে আমাকে বলেছে আম্মু টেবিলে খাবার আছে আপনার ছেলে আসলে বলবেন খেয়ে নিতে।
আমি আর কিছু বলিনি।” পাশ থেকে আব্বু বলল “কিরে কোনো কিছু নিয়ে ঝগড়া করেছিস না কি?” আমি ঈষৎ হেসে বলি “না বাবা এমনিই দুপুরে ফোনে কথা বলা নিয়ে একটু সমস্যা হয়েছিল।” বাবা হাসতে হাসতে বলে “মাঝে মাঝে এমন অভিমানে সম্পর্ক একে অপরের আরও কাছে টানে শুধু অভিমান ভাঙানোর কৌশলটা জানলেই হলো। ” আমার কৌতুহল বাড়লো আমি জিজ্ঞেস করলাম “আম্মুও কি এমন অভিমান করতো?” মা আমার দিকে বোকার মত দৃষ্টি দিয়ে আবার আব্বুর দিকে তাকালো। আব্বু আম্মুর দিকে তাকিয়ে বলল “নারীরা ভালোবাসার মানুষের কাছে স্বভাবতই অভিমানী। তাঁরা চায় মানুষটা বাড়তি ভালোবাসা দিয়ে সমস্ত অভিমান মুছে দিক।তবে নারী কোমলমতী হলেও প্রিয় মানুষটার দুষ্টমী বেশ উপভোগ করে।” আমি হাসতে হাসতে বলি “ওহ আব্বু তাই না। বাহ্ মুগ্ধ হলাম তোমার অভিজ্ঞতার ঝুলিতে। যতোদিন আছি এভাবেই দিয়ে যাও মাই ডিয়ার গুরুজন।
আচ্ছা তোমরা ঘুমাও এখন।” খাবার টেবিলে গিয়ে দেখি ভাত বরফের মত ঠান্ডা। তাও ইচ্ছে করেই খেয়ে নিলাম। বিছানায় গিয়ে কয়েকবার ডাকলাম নীলাকে। কোনো কথা না বলে পাশ ফিরে কম্বলটা আরও আয়েশ করে মুড়ে নেয়। আমিও বালিশে নিজে মাথা রেখে নীলার মাথাটা বুকে নিলাম। কানের কাছে ফিসফিস করে বললাম “ঠান্ডা ভাতগুলো খেতে অনেক কষ্ট হয়েছে।” এবার জোরে জোরে নিঃশ্বাস এর শব্দ পেলাম। আমার বুকে ভাল করে জায়গা করে নিয়ে শাসনের সুরে বলল “আবার এমন ভুল করলে আরও ঠান্ডা ভাত খেতে হবে বলে দিলাম।” আমি কিছু না বলে ডান হাতের আঙুল দিয়ে নীলার চুলে বিণি করতে থাকলাম। নীলা ঘুমিয়ে পড়ে।
মান অভিমানের সাংসারিক জীবন এভাবেই চলতে থাকলো। কিছুদিন পর ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে আমার পোষ্টিং হল। নিজের শহরে পোষ্টিং পেয়ে পরিবারের সবাই খুশি। যদিও এটার জন্য কিছু পয়সাকড়ি খোয়াতে হয়েছে। আজকাল এসব বড় কিছু না বড় বাবুদের পকেট ভরলে কলম একটু দ্রুতই চলে। নিজের শহরের কর্মজীবনে ডোন্ট কেয়ার একটা ভাব আছে। আমার মত সুবিধাবাদী হলে তো আর কথাই নেই। দু এক ঘন্টার জন্য অফিস ফাঁকি দিয়ে এখানে সেখানে ঘুরে আবার পরিবারের কাজও করা যায়। মানুষ স্বভাবতই সুযোগ সন্ধানী আমি ব্যতিক্রম হব কেনো?
নিজের শহরে একটা বছর বেশ ভালই কাটছিল। কয়েকদিন আগে আগ্রাবাদ লাকীপ্লাজা মার্কেটে নীলার কলেজ জীবনের বান্ধুবী মীমের সাথে দেখা। বিয়ের চার বছরের মাথায় দুইটা সন্তানের মা। বাবুগুলোকে কোলে নিয়ে নীলা ভীষণ আদর করতে শুরু করে। এটা সেটা কিনে দেয়। নীলা অন্যরকম আনন্দে অভিভূত ছিল। সেদিন বাড়ি ফিরে নীলার আমার সাথে অন্যরকম আচরণ করা শুরু করে।আমি স্বাভাবিক ভাবেই নেই পুরো বিষয়টা। তার কিছুদিন পর হঠাৎ ঢাকা থেকে চিঠি আসলো এক সপ্তাহের ট্রেনিং এ যেতে হবে ঢাকায়। অগত্য উপায় না পেয়ে ট্রেনিং এ যাই। সপ্তাহব্যাপী ট্রেনিং শেষ করে সন্ধ্যায় ঢাকা টু চট্রগ্রাম ‘তূর্ণা’ এক্সপ্রেসে বাড়ির পথে যাত্রা করলাম।
বাসায় পৌছে দেখি ঘড়িতে তখন সকাল নয়টা বেজে একুশ মিনিট। মা’কে বারান্দায় বসে কাঁদতে দেখে বুকটা ধক্ করে উঠলো। মা’কে এভাবে কখনো কাঁদতে দেখিনি। তড়িঘড়ি কাঁধের ব্যাগটা মেঝেতে রেখে মা কে জিজ্ঞেস করি “কি হয়েছে মা কাঁদছো কেনো?” মা চুপ করে থাকে। নীলা, নীলা.. করে ডাকতে ডাকতে রুমে ঢুকে দেখি নীলা নেই। বাইরে বের হবো এমন সময় টেবিলের উপরে থাকা একটা খামের উপরে চোখ জোড়া আটকে গেলো । টেবিল থেকে খামটা তুলে ভেতরের কাগজগুলো বের করলাম। মাথাটা ঘুরে গেলো। মায়ের কান্নার ব্যপারটা মুহূর্তে স্পষ্ট হলেও পুরো ঘটনা আমার কাছে মিথ্যে মনে হতে লাগলো। নীলার নাম্বারে ফোন করলাম ফোন বন্ধ। আকাশটা যেনো মাথায় ভেঙ্গে পড়লো। নীলা কেনো আমাকে হঠাৎ এভাবে ডিভোর্স দিলো? এর ছোটখাঁটো কোনো কারণও চিন্তাযুক্ত মস্তিষ্কে ধরা দিলো না। হতবিহ্বল আমি ভীষণ ভাবে ভেঙ্গে পড়লাম। খামের সাথে একটা চিঠিও ছিল। ডাইরীর পাতার মোড়ানো চিঠিটা ভাঁজ গুলো খুলে পড়া শুরু করলাম “আমি জানি তুমি আমাকে ভীষণ ভাবে ভালোবাস। তোমার ভালোবাসা উপেক্ষা করে শুধু আমি না কোনো নারীই ছুটে পালানোর ক্ষমতা রাখেনা।
তবে জানো ভালোবাসার বাইরেও মানুষের একটা জীবন আছে। আমার খুব ইচ্ছে “মা” ডাক শোনার। গত পাঁচ বছরের সংসার জীবনে এই একটা ইচ্ছে আমাকে সব সময় পীড়া দিয়েছে। আমার ডাক্তার বান্ধুবীর কাছে যখন আমরা দুজন গিয়েছিলাম তখন সে আমাকে সব খুলে বলে যে তুমি আমাকে কখনো মা হওয়ার সুখ দিতে পারবেনা। তারপরও তোমার ভালোবাসার জাল থেকে আমি বেরিয়ে আসতে পারছিলাম। আমি কখনো চাইনি তুমি আমার কাছে থেকে কষ্ট পাও। কিন্তু সেদিন মিমের বাবুগুলো দেখে বুকটা ফেটে যাচ্ছিলো। আমি পারছিলাম না ভাগ্যের দোহাই দিয়ে নিজের অস্থির শূণ্য মনকে স্বান্ত্বনা দিতে। এখন শরৎ এর মেঘের মত হয়তো আমি নিজেকে মুক্ত করে তোমার থেকে পালিয়ে বেড়াবো কিন্তু তোমার ভালোবাসায় সিক্ত হওয়া মন সব সময় তোমাকে মনে রাখবে। আমাকে খোঁজার চেষ্টা করিওনা। আর পারলে ক্ষমা করে দিও প্লিজ।”
আমি চোখে ঝাপসা দেখি। পৃথিবীটা কেমন যেনো ফ্যাকাসে মনে হয়। আর এই ফ্যাকাসে পৃথিবীর নিষ্প্রয়োজন কীট মনে হয় নিজেকে। বেঁচে থাকার ইচ্ছে হারিয়ে যায়। কিন্তু বৃদ্ধ মা-বাবার শেষ সম্বল টুকু কেড়ে নেওয়ার অধিকার কি আমার আছে? আমি পারিনা তাদের ছেড়ে যেতে। এর বছর খানেকের মাথায় আমার ডিভোর্সী মামাতো বোনের সাথে আমার বিয়ে ঠিক করে বাবা-মা। আমি বারবার না করি কিন্তু মা আমার হাত দু’টো ধরে কান্না জড়িত কণ্ঠে বলে “বাবা তোমার কষ্ট আর সহ্য করতে পারিনা প্লিজ না করো না।” আমি প্রত্যুত্তর করতে পারিনা। কয়েকদিন পর মামাতো বোন আমাকে ফোন দেয়। অনিচ্ছা সত্ত্বেও কথা হয় অনেক কথা। সুখ দুখের গল্প। প্রিয়ার মানে আমার মামাতো বোনের মাতাল স্বামীর প্রহারের মত দুর্বিষহ গল্প,আমার প্রিয়জন ছেড়ে যাওয়ার গল্প । ধীরে ধীরে দুটি শূণ্য ক্ষরা অনুর্বর হৃদয়ে মোলায়েম ভালোবাসার আবাদ হয়। পারিবারিক ভাবে প্রিয়ার সাথে আমার বিয়ে হয়।
মাস ছয়েক পরে প্রিয়া ভোর বেলা আমাকে ঘুম থেকে ডেকে দেয়। কাঁচা রসুন ভিজিয়ে দিয়ে আমাকে খাইয়ে দেয়,সাথে মধুও দেয়। আমি অপরাধীর মত মলিন হাসি। ডাক্তার বলেছে কাঁচা রসুন শুক্রাণুর ঘনত্ব বাড়ায়। আল্লাহ্ রহমত করলে ভাগ্য বাস্তবতার পরিবর্তন হয়। মেয়েটা সে অনুযায়ী কাজ করে মধ্যরাতে উঠে নামাজে কান্না করে। আমি বুঝতে পারি ভালোবাসার রং একই রকম না,একেকজনের কাছে একেক রকম। ঘুম থেকে উঠে ওযু করে আমি মসজিদে যাই।
সময়গুলো আগের মতই মুগ্ধকর হতে থাকে। বাসা থেকে ফোন করে আম্মু বলে প্রিয়া অসুস্থ। অফিস থেকে ছুটি নিয়ে দ্রুত বাড়িতে ডাক্তার নিয়ে আসি। ডাক্তার বিমর্ষ ভাব কাটিয়ে মুখে হাসির রেখা টেনে বলে “অভিনন্দন আবির ভাই। ভাবি সুখবর দিতে চলেছে। আপনি বাবা হতে চলেছেন।” আমি ভাষা হারিয়ে ফেলি। ডাক্তার রাজকুমারকে জড়িয়ে ধরি। এ আনন্দ প্রকাশের ভাষা আমি কোনো বাংলা অভিধানে পাইনি। আশেপাশের প্রতিবেশীদের মিষ্টিমুখ করাই। আমি আনন্দে আত্মহারা হই বারবার। শুকুরিয়া জানায় পরম করুণাময়ের কাছে। আমার ফ্যাকাসে পৃথিবীতে প্রাণের সঞ্চার ঘটে। আমার অনাগত সন্তান যেনো আমার ফ্যাকাসে পৃথিবীর প্রাণ। প্রিয়া ও আব্বু-আম্মু আমার আনন্দ দেখে খুশিতে বলে পাগল হয়ে গেছি আমি।