হায়েজ

হায়েজ

কিছুদিন আগে আমার ফার্মেসীতে দুইটা বোরকা পরা মেয়ে আসে নেপকিন কিনতে।দোকানে প্রচন্ড ভিড় থাকায় মেয়ে দুটো ভদ্রভাবেই এক কোণে দাঁড়িয়ে ছিল।আমি ওদের বয়সের ব্যাপারে অজানা ছিলাম কেননা মেয়ে দুটো সম্পূর্ন পর্দার ভিতরে ছিল।মেয়ে হিসেবে শুধু শনাক্ত করতে পেরেছি একটা মেয়ের গলার আওয়াজ শুনে তাও খুব আস্তে কথা বলছিলো।

দোকানের ভিড় কমার সাথে সাথেই আমি তাদের কাছে জিজ্ঞাস করি তাদের কি লাগবে।মেয়ে দুইটার মাঝে একজন আমাকে আস্তে বলে নেপকিন লাগবে।আমি উপরের তাক থেকে নেপকিন নামাচ্ছিলাম এমন সময় আমার দোকানের বরারবর বটগাছের নিচে বসে থাকা সিয়াম বলে উঠেঃ

>ও হিমেল!!কি দাও,রুটি নাকি?তো রুটি বিক্রি শুরু করলা কবে থাইকা?

সিয়ামের সাথে রাব্বি বসে ছিল।কথাটা বলার পর দুজনই উচ্চস্বরে হেসে উঠে।যেন কি এক মহৎ কথা বলে ফেলেছে। আমি ভ্রু-কুচকে ওদের দিকে চাইলাম।মেয়ে দুইটাও ওদের দিকে চাইলো।ওরা আবার বলা শুরু করলঃ

>কি দিন আসলো রে ভাই ফার্মেসীতেও আজকাল রুটি বিক্রি করা শুরু করসে।হায়রে!!

আমি ওদের কথাগুলো শুনে চুপ করেই রইলাম।এলাকার চরম বখাটে ওরা,ওদের থামানো পসিবল না।তাই চুপ করাটাই ভাল মনে করলাম।

মেয়ে দুইটার মাঝে একজন হয়ত রেগে গিয়েছিল তাই ওদের দিকে একটু অগ্রসর হতে গেল আর ওমনিতেই সাথে থাকা মেয়েটা হাতে ধরে রাখলো।মেয়ে দুইটা দাঁড়িয়ে আমার কাছ থেকে নেপকিনের প্যাকেটটা নিয়ে তাদের ব্যাগে ভরে।আর আমার টাকাটা দিয়ে সিয়াম আর রাব্বির উদ্দেশ্যে যায়।

মেয়ে দুইটা সামনে যখন যাচ্ছিলো আমার মনে হচ্ছিলো গিয়েই দুইটার গালে কষিয়ে চড় বসাবে।কিন্তু মেয়ে দুটো গিয়ে রাব্বি আর সিয়ামের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।মেয়ে দুটো সামনে যাওয়াতে ওদের হাসি বন্ধ হয়ে যায় ওরা বসা থেকে দাঁড়িয়ে যায়।এটা যেন কেমন একটা ব্যাপার যে আমাদের অনিচ্ছাতেও হুজুর আর পর্দাবতীদের সামনে দাঁড়িয়ে যেতে হয়।

হয়ত আল্লাহ তাদের সম্মান এভাবেই বুঝিয়ে দেয়।উপস্থিত দুটা মেয়ের মধ্যে একজন ছেলে দুইটার উদ্দেশ্যে সালাম জানায়।ওরা মেয়ে দুইটাকে টিজ করল আর মেয়ে দুইটা তার উত্তরে সালাম জানালো।আমি অবাক হয়ে দোকান থেকে বের হয়ে ওদের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।সিয়াম আর রাব্বি কাঁচুমাচু অবস্থায় মেয়েটার সালামের জবাব নিলো।তারপর মেয়েটা বললঃ

>ভাই আপনারা কি মুসলিম? দুজন একে অপরের দিকে চেয়ে জবাব দিলোঃ

>হ্যা।কিন্তু কেন?

>আল হামদুলিল্লাহ।

আমি মেয়েটার আল হামদুলিল্লাহ পড়া শুনে আশ্চর্য হয়ে গেলাম।মুসলিম হওয়াতে আল হামদুলিল্লাহ পড়ার কি হলো কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। তারপর মেয়েটা আবার জিজ্ঞাস করলোঃ

>আপনাদের কারো কি বোন আছে?

সিয়াম জবাব দিলোঃ

>আছে!!এইসব জেনে আপনার কি লাভ?শুধু কথা প্যাঁচাবেন না।কি বলার বলুন?

>প্রাপ্তবয়স?

>হুম।আরে যা বলার বলুন তো মেজাজ খারাপ হচ্ছে।

>আপনি কি আমার একটা কাজ করে দিবেন?

রাব্বি চুপ করে আছে।আর সিয়াম রেগেমেগে জবাব দিচ্ছেঃ

>আমি আপনার কাজ করব কেন? মেয়েটা মিনতির স্বরে বললঃ

>ভাই প্লিজ।এটা আমার ঈমানকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।

ছেলেটা চোখ বড় করে চেয়ে রইল।আর আমি ভাবতে লাগলাম কি এমন কাজ হতে পারে যে এই বখাটেরা করে দিবে।আর তা একজনের ঈমানের সাথে যুক্ত?সিয়াম বললঃ

>আচ্ছা বলুন কি কাজ? মেয়েটা ব্যাগ থেকে সিয়ামের উদ্দেশ্যে নেপিকিনের প্যাকেটটা বাড়িয়ে দিয়ে বললঃ

>আপনার বোন প্রাপ্তবয়স তার হয়ত হায়েজ হয় তাকে গিয়ে এটা দিয়ে দিয়েন। সিয়াম মেয়েটার কথা শুনে দুই কদম পিছে গিয়ে দাঁড়ালো আর রাগের স্বরে বললঃ

>কি বলছেন এইসব,আমি আমার বোনকে এটা দিতে যাবো কেন? মেয়েটা সিয়ামের কথার জবাব না দিয়ে বললঃ

>প্রায় ১৪০০ বছর আগে আমাদের একজন নবী দুনিয়াতে ছিল তিনি একটা কথা বলেছিলেন আপনি কি তা জানেন?

সিয়াম ভ্রু-কুচকে বললঃ

>কি কথা?

>“তোমরা ততক্ষণ পর্যন্ত পরিপূর্ণ ঈমানদার হতে পারবে না যতক্ষণ পর্যন্ত তুমি তোমার নিজের জন্য যা পছন্দ কর তা তোমার ভাইয়ের জন্যও পছন্দ কর”। [বুখারি,কিতাবুল মাযালিম]

হাদিসটুকু বলে মেয়েটা বলতে লাগলঃ

>পৃথিবীতে যে শুধু ভাইয়েরাই বাস করে এখানে কিন্তু এমনটা বুঝাচ্ছে না।এখানে বুঝানো হয়েছে তুমি নিজের জন্য যা ভালো মনে করো অন্যের জন্যও তাই ভাল মনে করো।মুসলিম ভ্রাতৃত্ব অনুসারে আপনার বোন আমার বোন লাগে।আর আমি যেহুতে আমার হায়েজের সময় নেপকিন ব্যবহার করা ভাল মনে করেছি আমার বোনের জন্য যদি ভাল মনে না করি তাহলে আমি পরিপূর্ন ঈমানদার হতে পারবো না।তাই আপনি প্লিজ এটা আপনার বোনকে নিয়ে দিয়ে দিবেন।

মেয়েটার কথা শুনে আমি একদম হা করে তাকিয়ে ছিলাম।এ কি রকম ব্যাখ্যা দিলো।সিয়াম আর রাব্বির অবস্থা একদম খারাপ দুইজন প্রচন্ড ঘামছিলো।সিয়াম কাঁচুমাচু করে বলতে লাগলঃ

>কি বলছেন এইসব,আমার বোন আপনার বোন হয় কিভাবে?

>দেখুন তিনি আরো বলেছেনঃ

‘মুমিনগণ একজন মানুষের মতো, যার চোখ আক্রান্ত হলে সমস্ত শরীর আক্রান্ত হয় আর তার মাথা আক্রান্ত হলে সমস্ত শরীর আহত হয়।’ (মুসলিম)

>হতে পারে আমি মুমিন না।তবুও এই কথা অনুসারে আপনার বোন আমার একটা অংশ।তার যখন হায়েজ হয় তখনকার অবস্থা আমার জানা আছে।প্রায় সময় রক্ত পড়ে।ব্যাথায় কুকড়িয়ে উঠে।এমন ব্যাথা যে চোখ দিয়ে পানি বের হয়ে আসে।আপনি কি সেই সময়টা কল্পনা করতে পারেন।আমি করছি,আমার ব্যাথা লাগছে মনে।প্লিজ ভাই আপনি এটা আপনার বোনকে নিয়ে দিয়ে দিন।

আমি লক্ষ্য করলাম সিয়াম আর রাব্বির শরির কাঁপছে।আমি একজন মুগ্ধ শ্রোতার মতো মেয়েটার কথা শুনছিলাম।সিয়াম হয়ত তার ভুল বুঝতে পেরেছিল যার কারনে ও কাপা কন্ঠে বলে উঠলঃ

>আমাকে ক্ষমা করবেন,আমার ভুল হয়েছে।আমি এইসবের কিছুই এত গুরুতর নেইনি।

>নিবেন না কেন?যেখানে আল্লাহ তা’আলা তার নবীর উপর আয়াত নাজিল করে বলছেনঃ

>(হে নবী) তারা আপনার কাছ থেকে (মহিলাদের মাসিক) ঋতুকাল (ও এই সময় তাদের সাথে দৈহিক মিলন)সম্পর্কে জানতে চাইবে;আপনি তাদের বলেন (আসলে মহিলাদের) এই (সময়টা) হচ্ছে (অপবিত্র ও) কষ্টকর অবস্থা।

(সূরা বাকারা-২২২)

>আল্লাহ মানব জাতিকে স্পষ্ট জানিয়ে দিচ্ছেন এই সময়টা আমাদের জন্য একটা কষ্টকর অবস্থা তবুও আপনারা এই সময়টাকে নিয়ে হাসি ঠাট্টা করে আল্লাহর আয়াতের অসম্মান করছেন।

কেন আমরা তো ভিন্ন কোন গ্রহের প্রাণী না।আমরাও মানুষ,আপনি আপনার বোনকে একটা নেপকিনের প্যাকেট দিতে লজ্জা পান কিন্তু আরেক মেয়েকে ওই প্যাকেট কিনতে দেখে টিজ করেন এ কেমন পুরুষত্ব?নিজেকে বদলান দুনিয়া বদলে যাবে।

কথাটা বলেই মেয়ে দুটো চলে গেল।আমি আরো লক্ষ্য করলাম সিয়াম আর রাব্বির চোখে জল ছলছল করছে আর গালও লাল হয়ে আছে।আমি যখন ভেবেছিলাম মেয়েটা গিয়ে চড় মারবে ওদের গালে তখন ঠিক এমন মুখই কল্পনা করেছিলাম।মেয়েটা ওদের গালে চড়ই মেরেছে কিন্তু বুঝের চড় যে চড় খেলে মানুষ আজীবন শুধরে যায়।আমিও মেয়েটার কথায় নিজেকে কিছুটা শুধরে নেই।

এই ঘটনার পরে প্রায় সময় সিয়াম আর রাব্বিকে আমি মাথা নিচু করে মসজিদে যাতায়াত করতে দেখতাম।ভাবতে পারেন যেই ছেলে দুটো আশে পাশে সব সময় মেয়ে খুঁজতে ইভটিজিং করার জন্য সেই ছেলে দুটো মাথা নিচু করে চলে।আমি তাদের এর রহস্য জিজ্ঞাস করেছিলাম তারা বলেছিলঃ

>ভাই আমার আল্লাহ বলেছেন ” ‘হে নবী! মুমিন পুরুষদের বলে দিন তারা যেন তাদের দৃষ্টি অবনমিত রাখে এবং যৌন পবিত্রতা রক্ষা করে চলে।(সূরা আন নূর-৩০)

আমি ছেলে দুটোর কথা শুনে অবাক হয়ে যাই।কিভাবে সম্ভব এত পরিবর্তন?তারপর আমার মনে পরেঃ

>আর যারা (আল্লাহর উপর) ঈমান আনলো আল্লাহ তা’আলাই হচ্ছেন তাদের সাহার্য্যকারি (বন্ধু),তিনি (জাহেলিয়াতের) অন্ধকার থেকে তাদের (ঈমানের) আলোতে বের করে নিয়ে আনেন। (সূরা বাকারা-২৫৭)

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত