রাত ১টা বাজে।অফিস থেকে ফিরে বাসায় যাচ্ছিলাম।নীলক্ষেত পার হয়ে যখন মোড় নিলাম।এর কিছু দূর সামনে যেয়ে এক যুবতী লিফট নেওয়ার জন্য হাত দেখাচ্ছিল।।বয়স আনুমানিক আর কত হবে, ২৫ এর মত। গাড়ি দাড় করলাম।
– আপনি নীল আহমেদ। সহকারী পুলিশ সুপার(মেয়েটি)
– হ্যা,কিন্তু আপনাকে চিনলাম না।আপনার পরিচয়?
(আমি রীতিমত অবাক হয়ে গেছি।এই শহরে আমাকে খুব কম লোকই চিনে।আর আমি তেমন বেশী লোকের সাথে মিশতে ও ঝামেলা পছন্দ করি না। এই যুবতী আমাকে কিভাবে চিনে!!! )
-আমি মীম তাবাসসুম।
– ও।কিন্তু আমাকে কিভাবে চিনেন?
– স্যার,কিছু মানুষের আলাদা কিছু বৈশিষ্ট্য থাকে যার মাধ্যমে তাকে চেনা যায়।কিন্তু আমি আপনাকে আগে থেকেই জানি।কীভাবে সেটা না হয় অন্য একদিন বলব।
– ও আচ্ছা। গাড়ি চলতে শুরু করলাম।মেয়েটিকে চেনা চেনা মনে হচ্ছে। হয়ত কোথাও দেখেছি।যাই হোক আমি আমার মত করে চলতে থাকলাম আর চুপ থাকলাম।খিলখেত এ এসে মেয়েটি ব্রেক করতে বলল। আর ধন্যবাদ দিয়ে নেমে গেল।সাথে শুধু একটা কার্ড রেখে গেল আর আমার কার্ড টা চাইল। আমি দিলাম। যদি পরে কখনও আলাপ হয় সময় করে।মেয়েটা অসম্ভব সুন্দর।নজর কাড়া চেহারা।যে কেউই এই মেয়েকে দেখে স্থির থাকতে চাইবে না।আমি আত্মসংযমী হওয়ায় বুঝি বেশি আবেগে লাগে নি। এসব ভেবে চলতে চলতে বাসায় আসলাম।
বাইরে থেকে আয়াতের কান্না শুনতে পাচ্ছি। ছেলেটা খুব পাজি।আমাকে ছাড়া থাকতেই চায় না।জানি না মা একে কিভাবে সামলায়।সারাদিনে না হয় কমপক্ষে দু বার ভিডিও কল দেয়া লাগে আম্মুকে।না হলে আয়াত কোনভাবেই থামবে না।কাল পাত্রীর বাবা আর মা আসার কথা আমাকে দেখতে.।অবাক হওয়ার কিছু নেই।আমি অবিবাহিত।আর এই আয়াত?? আয়াতকে চিনতে হলে ফিরে যেতে হবে ৩বছর পিছনে।তখন আমি সবে মাত্র জয়েন্ করেছি এই চাকরিতে। তারপরে একটা কেজের দেখাশোনার জন্য হসপিটালে গেলে একটা বাচ্চার কান্না শুনতে পাই।আর এটাও জানতে পাই যে সে বাচ্চার বাবা নেই,মা বাচ্চাকে জন্ম দেওয়ার সময় মারা যায়।কিন্তু বাচ্চাকে দেখাশোনার জন্য আর কেউ নেই। আমি বিষয়টা উপলব্ধি করে বাচ্চাটির দায়িত্ব নেই।বাচ্চাটাকে দুধ পান আমার বেস্ট ফ্রেন্ড উর্মি চৌধুরী করিয়েছিল তার স্বামীর অনুমতিতে।পরবর্তীতে আমি তার কাছে আয়াতকে নিয়ে আসি আমার কাছে। তখন থেকেই আয়াত আমার কাছে থাকে।
এই হলো আয়াতের পুর্ব পরিচয়।আজ কনে পক্ষ থেকে আমাকে দেখতে আসার কথা। মাকে বিষয়টা জানিয়ে আমি তবুও অফিসে গেলাম।অফিসে যাওয়ার পর আমার ইমেইলে একটা মেইল পেলাম।ইমেইল টা পড়ে আমি অবাক হলাম।গতকালের লিভ নেওয়া সেই মিম তাবাসসুম একজন এইডস আক্রান্ত রোগী। তিনি আমার হেল্প কামনা করেছেন।তার পুরো ঘটনা টা এখন শোনা জরুরী হয়ে গেল।আজিমপুরের দিকে একটা ফাকা জায়গায় মিমের সাথে দেখা করতে টেক্সট করে দিলাম বিকাল ৫টায়। আমি আজ অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ফেরার প্রস্তাব করলে সবাই অবাক হল অফিসের।আমি তাদের তোয়াক্কা না করেই চললাম আজিমপুরের দিকে।কিন্তু মিম টেক্সট করে একটা বাসায় ডাকল।
আমি সেখানে যেয়ে বাসার নিচে দাড়াতেই বেশ কয়েকটা মেয়ে এসে আমাকে ভেতরে যেতে অনুরোধ করল।আমি উপড়ে উঠতে উঠতে আমাকে মাঝখানে যথেষ্ঠ স্পেস রেখে তারা আমার সামনে ও পিছনে চলল।আমি বরাবরই অবাক হলাম।এছাড়া আরও একটা বিষয়ে অবাক হলাম যে তাদের প্রত্যেকেই শালীন পোশাকে আবৃত ও হিজাব পরিহিত। আমি দশ তলায় উঠে গেলাম।এরপর সেখানে থেকে লিফট করে আমাকে একেবারে ছাদে নেওয়া হল। সাথে একটা যুবক ছিল যার বয়স আনুমানিক ২০ এর মত হবে।অবশেষে আমি ছাদে পৌছালাম।সেখানে মিমকেও সেই একই পরিধানে দেখে অবাকই হলাম বটে।তবে মুখ টা বাইরে রাখা,যাতে আমি চিনতে পারি।- সালাম স্যার,(মিম)
– হুম,আমি বেশি লেট করব না। আমি তোমার পুরো ঘটনা টা শুনেই চলে যাব।আমার অনেক কাজ আছে। (আমি)
– ওকে স্যার। আপনার যেমন ইচ্ছে।
– তুমি কিভাবে এইডস আক্রান্ত হলে?
– স্যার,এটা এক বিশাল ঘটনা।তবুও সংক্্ষেপ করে বলি।
– হ্যা, তাই হোক।
– আমার বয়স দশ ছিল।আমি আগে থেকেই কিছুটা শারীরীক ভাবে নার্ভাস ফিল করি।
এর আগে ডাক্তার দেখিয়েছিল।কিন্তু ডাক্তার তেমন আগ্রহ দেখায় নি।এরপর আমি ও আমার মা একদিন এক অভিজ্ঞ ও বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের কাছে যাই। তখন তিনি জানান যে আমি এইডস আক্রান্ত। এরপর বিস্তারিত বর্ননার মাধ্যমে জানতে পারি বাবা ব্যবসার কাজে প্রায় বাইরে যেতেন।একবার অসুস্থ শরীর নিয়ে বাইরে গেলে আর ফিরে আসেন নি। আমি তখন মায়ের গর্ভে ছিলাম। পরিশেষে বুঝতে পারি আমরা যে আমার বড় ভাই ও বোন যখন মায়ের গর্ভে ছিলেন তখন বাবা এইডস আক্রান্ত ছিলেন না।কিন্তু আমার সময়ে বাবা এইডস আক্রান্ত ছিলেন আর তখন তিনি আমেরিকায় ছিলেন ব্যবসার কাজে।
– ওহ সো স্যাড।তিনি পরবর্তীতে একজন এইডস আক্রান্ত মহিলার সাথে মিলন করেছিলেন। যার ফলে তোমার অবস্থা এই।তোমার মা কোথায়?
– মা ৩ বছর আগে মারা গিয়েছেন।এটা আমাদের বাসা।আমি এখানে তেমন থাকি না।
– ওহ। এরা কারা?
– স্যার এরা প্রত্যকেই এক একজন ধর্ষিতা মেয়ে।
অভাবের চোটে এই ঢাকা শহরে অন্যের বাসায় কাজ করে। কিন্তু এই মেয়েদের বাড়িওয়ালারা জোর করে ধর্ষন করে। এর পর নানা বাহানায় বাসা থেকে বের করে দেয়।আমি তাদের এখানে থাকতে দিয়েছি। আমি মিমের কথা শুনে হতবাক।আর এই সব মেয়েদের চোখে পানি।তারা কাদছে। কিন্তু তাদের কান্না দেখার মত মানুষ এ শহরে কেউ নেই। গতকাল কথা শেষ করে এসেছিলাম। আজ অফিসে যেতেই একজন কনস্টেবল এসে জানালো এসপি স্যার আমাকে ডেকেছেন উপড়ে।এটা প্রায়দিনের কাজ,তাই রুমে ঢুকেই এসপি স্যারের কাছে গেলাম।
– May I come in, sir.
– Yes,come in..
– আসস্লামুয়ালাইকুম স্যার,কেমন আছেন?
– হ্যা ভালো আছি। নীল সাহেব,দেখুন এই কেজের ফাইলটা তাড়াতাড়ি ইনপভেস্টিগেশন করে কাজ করতে হবে।আর সে দায়িত্ব আমারই কিন্তু আপনার হেল্প প্রয়োজন আমার।
– ওকে স্যার।স্যার,এটা অফিসার ইনচার্জ আবুল আহসানকে দিয়ে করলেই তো হয়।
– ওনাকে দিয়ে হবে না।মেয়র সাব আমাকে কাল এই বিষয়টা সমপর্কে অবহিত করেছেন।
– ওকে স্যার।
– এখন আপনি আসতে পারেন।
আমি ফাইলটা হাতে নিয়ে চলে এলাম।আমার সাথে একজন উর্ধতন কর্মকর্তার দায়িত্ব ও আছে। কিন্তু একি ফাইলের অপরাধী ব্যক্তি মিম। সব ফাস হলে তো আমিও ফাঁসবো। এখন কিভাবে কি করবো কিছুই বুঝতে পারছি না।
মিমের সাথে অফিসে যোগাযোগ করার কোন উপায় নাই। যদি ধরা খাই।এর চেয়ে বাসায় যেয়ে সব কাজ করা যাবে বলে কাজে মন দিলাম।ফাইল টা নাড়াচাড়া করছিলাম আর দেখছিলাম এর ভিতর কি লিখে মিমকে দোষারোপ করা হয়েছে। কিন্তু ফাইল রিপোর্টে অফিসার ইঞ্চার্জ এবং ইন্সপেক্টর ইনভেস্টিগেশন করে যেটা জেনেছেন তাতে পুরো দোষ টা মিমের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছেন।আর এসবে সহায়তা করেছে গোয়েন্দা সংস্থা।
ঢাকা শহরের ৫০ জন ব্যবসায়ীসহ/অন্যান্য লোক এইডস আক্রান্ত হয়েছে।কারন হিসেবে মিমের কিছু শারীরিক ডিএনএ মিলে যায় তাই তারা মিমকে দোষারোপ করে মামলা করেছে। আমি অবাক হয়ে গেছি। কারন এর আগে ৫ টা মার্ডার আমি আমার ইচ্ছাকৃত ভাবে নিজের বন্দুক থেকে ৫ টা রেপিস্টকে মেরেছি।কোর্টে তারা পার পেয়ে গেল।কিন্তু তাদের কেজ গুলোতে কাজ করতে যেয়ে মাদক ব্যবসায়ী হিসেবে বন্দুক যুদ্ধে নিহত দেখিয়েছি।এ ছাড়া আমার বিবেকের আদালতে আর কিছু করার ছিল না।দুনিয়ার আদালত যখন অপরাধীদের খালাস করে, তখন বিবেকের আদালতে তাদের শাস্তি নিশ্চিত করে একজন বিবেকবান মানুষ।
এই কণ্টকাকীর্ণ পৃথিবীতে নিজের অধিকার নিজেই করে নিতে হয়। এখানে কেউ কাউকে জায়গা করে দেবে না।পারলে অন্যের জায়গা টাও রাঘব বোয়াল দখলে নেবে।আমার মার্ডার করার বিষয়টা ইনটেলিজেন্স ডিপার্টমেন্ট হয়ত বুঝতে পারছে।সাবধান হলাম আমিও।মিমের কেজটা স্টার্ট হয়ে গেল।আমি মিমের সাথে আর যোগাযোগ করি নি। প্রতিপক্ষ হিসেবে একজন পাবলিক প্রসিকিউটর এসেছেন যিনি ভার্সিটিতে আমার চেয়ে ১ বছর সিনিয়র ছিলেন। নাম মুস্তাফা আবিদ। খুব ভাল লোক।জানি না এখানে কিভাবে তিনি এলেন। মিমের পক্ষ হিসেবে একজন সিনিয়র প্রসিকিউটর আসলেও আমার মনে হয় না যে আমরা কেজ টা জিততে পারব। তাই যা করার আমাকেই কিছুটা পথ করতে হবে।
কেজ টা শুরু হলে কেজের প্রতিপক্ষের কথা যে মিম একজন স্বাভাবিক ব্যক্তি যদিও তিনি এইডস আক্রান্ত রোগী।মিম নিজেই ৫০ জন মালদার লোকের মাঝে মিলে তাদের মধ্যে এইডস ছড়িয়েছে।কেজ টাইম শেষ হলে আমি জজের সাথে দেখা করতে গেলাম মিমের উকিলকে সাথে নিয়ে। জজ সাব সেরকম সুবিধার ব্যক্তি বলে হয় না আমার।আমরা পরদিন থানা কাস্টোরিতে গেলে মিমের সাথে উকিল দেখা করলেন আর কিছু ঔষধ দিলেন।যেগুলো খেলে সে মেণ্টাল হয়ে যাবে, কারন ঔষধ গুলো ব্রেনে আঘাত করবে। বিষয়টা শুধু সাথের পুলিশ কনস্টেবল জানলো।আমি অফিসার ইনচার্জকে এ বিষয়ে নানা তথ্য জিজ্ঞেস করলাম। এর মধ্যে উকিল ফিরে আসলে তাকে চোখ টিপে বের করে দিলাম।এর কিছুক্ষন পর আমি অফিসার ইনচার্জকে সাথে নিয়ে বের হলাম।
আজ ৩ মাস হল আমাকে মিম একজন মানসিক রোগী হিসেবে পরিচিত।কারন ঐ দিনে তাকে কোর্টে উঠানো হলে সে একজন মেন্টাল ব্যক্তি হিসেবে স্বীকৃতি পায়। আর বাদী পক্ষের ৫০ জনই উপযুক্ত প্রমানের ভিত্তিতে ধর্ষক বলে চিহ্নিত হয়।অবশেষে নিজের খালে নিজেই পড়ল। তাদের কিছু জনের জরিমানা ও যাবজ্জীবন কারাদন্ড হয়।শেষ কেজটিতে মিমের পক্ষে লড়েছেন একজন ইয়ং মহিলা উকিল।যার সাথে আগামীকাল আমার বিবাহ।