সুঁই সুতো

সুঁই সুতো

ঘরের গুছানো কাপড়গুলো অগোছালো দেখেই বুঝে ফেললাম ঘরে ভাইয়া ঢুকেছিল। চটজলদি হ্যাণ্ডব্যাগের ভেতরে ঘেঁটে দেখলাম, ব্যাগে রাখা দুইশো পঞ্চাশ টাকা উধাও! বুঝতে বাকি রইলো না, টাকাটা আমার এই ‘বাঁদড়’ ভাইটা ছাড়া আর কেউ নেয়নি। বয়সে বড় হলেও কাজ করে ছোটদের মতো। কিছু বলতেও পারি না, সইতেও পারি না।

এটুকুই না! আমার ড্রেসিং টেবিলে রাখা পারফিউম নিতে গিয়ে তেলের বোতল ফেলে দিয়েছে টেবিলে। সেই তেল চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে মেঝেতে পড়ে থাকা আমার নতুন জামাটার উপর! নাহ! আর না! আজ ভাইয়া আসুক। আজ ওর একদিন কি আমার একদিন! মায়ের কাছে বিচার দিয়ে কোন লাভ নেই। মা সবসময় একতরফা বিচার করে ছেলের সাফাই গায়। বলে, “তোর ভাই এখন চাকরি করছে না। ছোটবোনের ব্যাগ থেকে না বলে টাকা নিলে সেটা চুরি হয়ে যায়? যখন চাকরি করবে তখন কি তোকে টাকা দিবে না? শুধু শুধু আমার ছেলের নামে বদনাম করিস না!”

-“আশ্চর্য! আমার টিউশনির বেতন থেকে তোমার ছেলে টাকা সরিয়ে নেয় আমি কিছু বলবো না? ঠিকাছে! এখন থেকে এটাই করতে হবে। কিছু বলবো না, শোধ নিবো নীরবে।” ভাইয়া বাসায় আসতেই অভিনয় করলাম সব স্বাভাবিক, এখনও আমার কিছু নজরে পড়েনি। আমাকে স্বাভাবিক দেখে ভাইয়াও স্বাভাবিক থাকার অভিনয় করলো। ভালো করে একগ্লাস লেবুর শরবত বানিয়ে নিয়ে গেলাম ভাইয়ার কাছে। বললাম, “ভাইয়া, নাও।” ভাইয়া একনজর গ্লাসের দিকে তাকিয়ে এরপর আমার দিকে সরুচোখে তাকালো। বলল, “শরবত?”

– হু।
– শরবতে কি মরিচ দিয়েছিস?
– লেবুর শরবতে লাল মরিচ দিলে রং পাল্টে যেতো। রং দেখেও বুঝতে পারছো না?
– থুতু দিয়েছিস?
– ছিহ! আমি কি তোমার মতো খারাপ নাকি?
– তাহলে কি মিশিয়েছিস সত্যি করে বলতো?
– লেবুর রস আর চিনি।
– আচ্ছা যাহ! খাচ্ছি।

ভাইয়া অতঃপর আমাকে বিশ্বাস করে ঢকঢক করে শরবত শেষ করলো। আজ ভাইয়া বুঝবে, কতো ধানে কতো চাল! সারাদিন গুণে গুণে পুরো সাতবার ও টয়লেটে আসা যাওয়া করেছে। এখন কাহিল শরীর নিয়ে বিছানায় পড়ে কোঁকাচ্ছে। সুন্দর ফর্সা চেহারাখানি শুকিয়ে এতোটুকু হয়ে আছে। মায়ের বকুনি খাওয়ার পরও আমার এতোটা অনুতাপবোধ হয়নি, যতোটা এখন ওর শুকনো মুখ দেখে হচ্ছে। কাছে গিয়ে কপালে হাত রাখতেই বুঝতে পারলাম, গায়ে জ্বর এসে যাচ্ছে। ভাইয়া ঝটকা মেরে হাত সরিয়ে দিল আমার! দাঁত কামড়ে বলল, “তোকে বিশ্বাস করা ভুল হয়েছিল আমার। তুই হচ্ছিস মহিলা মীরজাফর! যাহ! সামনে থেকে যাহ!”

– তোমার গায়ে তো জ্বর ভাইয়া! নাপা খাবে?
– এক্সপায়ার ডেটের নাপা খাইয়ে মারবি? নতুন বুদ্ধি করেছিস, না?
– তুমি তো জানোই আমি নাপা ঘরে এনে রাখি। যাতে প্রয়োজনে হুটহাট কাজে লেগে যায়। এনে দেই, খেয়ে নাও।
– মা’কে তখনই বলেছিলাম ডাস্টবিন থেকে যেন তোকে তুলে না আনে। তুই এমনভাবে শোধ নিবি, ভাবি নাই।
– আমাকে ডাস্টবিন থেকে এনেছে? তোমাকে কি তাহলে মার্কেট থেকে এনেছে?
– হা, দেখিস না আমি কতো সুন্দর?

তোর মতো বান্দর নাকি? কালকে আমার একটা চাকরির ইন্টারভিউ আছে। ইন্টারভিউতে যেতে পারবো কি না আল্লাহ জানে! আমি ভাইয়ার সামনে থেকে উঠে চলে গেলাম। যতোক্ষণ সামনে থাকবো আমাকে নানাভাবে রাগাবে। যুদ্ধে পরাজিত সৈনিকের মতো নত মস্তিকে প্লেটে ভাত বেড়ে ভাইয়ার সামনে রাখলাম। নাপা ভেঙে খাইয়ে দিলাম। খেয়ে দেয়ে শুতেই ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়ল ভাইয়া। কপালে হাত দিয়ে অনুভব করলাম ওর জ্বর এখনও কমেনি। মাথার পাশে বসে কাপড় পানিতে ভিজিয়ে পট্টি দিতে লাগলাম ভাইয়ার কপালে। কখন যে ঘুমে চোখ লেগে এলো টেরও পেলাম না।

ঘুম ভাঙলো মায়ের ডাকে। “কিরে! রাত বাজে ৩ টা! এখনও এখানে পড়ে ঘুমাচ্ছিস! তোর ঘরে গিয়ে ঘুমা। ওর জ্বর কমে গেছে। সকালবেলা আল্লাহর রহমতে সব ঠিক হয়ে যাবে।” ভাইয়ার কপালে হাত রেখে দেখলাম, সত্যিই জ্বর নেমে গেছে। এখন চিন্তার কিছু নেই। আরেহ! ওর জ্বর হয়েছে তাতে আমার চিন্তার কি? দোষ তো ভাইয়ারই! শুরু তো করেছিল ভাইয়াই! আমার কি দোষ! হুহ! দুপুরবেলা ঘুম ভাঙলো ভাইয়ার ডাকে। ধড়মড়িয়ে উঠে বসলাম। চোখ বড় করে বললাম, “ভাইয়া? তোমার ইন্টারভিউ এর খবর কি?”

– তুই যেমন দোয়া করেছিলি।
– মানে কী? আমি তো ভালোই দোয়া করেছি।
– এজন্যই ভালো হয়েছে। আল্লাহর রহমতে চাকরিটা হয়ে গেছে!
– সত্যিই!
– সত্যিই।

আমি কি এটা নিয়ে মিথ্যা বলবো? এখন থেকে তোর ব্যাগ থেকে আর কোন টাকা নিবো না।
ভাইয়ার কথা শুনে আমি লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেললাম। কি বলবো বুঝতে পারছি না। ভাইয়া এবার আমার দিকে একটা শপিং ব্যাগ এগিয়ে দিল। এটা এতোক্ষণ খেয়াল করিনি। কারণ ও ব্যাগটা নিজের পিছনে লুকিয়ে রেখেছিল। আমি ব্যাগটা হাতে নিয়ে বললাম, “কি আছে এটাতে? নাকি ফাঁকা?”

– খুলেই দেখ না।

আমি ব্যাগ খুলে দেখলাম ওর ভেতর কারুকাজ করা খুব সুন্দর একটা জামা! রঙটা আমার খুব পছন্দের! বেগুণী রঙের! আমি অবাক চোখে ভাইয়ার দিকে তাকালাম। ভাইয়া বলতে লাগল, “কাল তোর নতুন ড্রেসটাতে তেল ফেলে নষ্ট করে ফেলেছিলাম। তাই তোর জন্য আরেকটা নতুন ড্রেস নিয়ে আসলাম।”

– টাকা কোথায় পেলে?
– আমার ব্যাংকটাতে খুচরো খুচরো কিছু টাকা জমিয়েছিলাম। সেগুলো দিয়েই আজকে কিনে ফেললাম। ভাবলাম তোর জন্য কিছু নিয়ে যাই।

আমি আর চোখের পানি ধরে রাখতে পারলাম না। ভাইয়াকে জাপটে ধরে কেঁদে ফেললাম। ভাইয়া আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলতে লাগলো, “কি করিস পাগলী…” বুঝতে পারছি ভাইয়ার গলাও জড়িয়ে আসছে।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত