আলোর পথে

আলোর পথে

তার ভাগ্যে নকল নোট গুলোই পরে । আর ছেঁড়া নোট তো আছেই । ড্রাইভার গুলা এতো বজ্জাত যা বলার মতো না । সুযোগ বুঝে নকল আর ছেঁড়া নোট গুলোই তার হাতে ধরিয়ে দেয় । আর এমন একটা কাজে নোট দেখে নেওয়ারও সময় থাকে না ।

আট লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে ট্রাফিক পুলিশের চাকরিটা নিয়েছেন জামাল হোসেন এখন পর্যন্ত চার লাখ টাকাই উঠে আসেনি । আবার ঢাকা শহরে বউ বাচ্চা নিয়ে থাকাটা যেন রাজ সিংহাসন ভাড়া করে থাকার সমান । আর বউয়ের চাহিদার তো কোন শেষই নেই । তারা তো মনে করে ঘুষের টাকায় তার স্বামী শাড়ি গহনা কিনে দিবে তাতে আবার সমস্যা কি ?

কিন্তু সে তো জানেনা এই ঘুষ নামের অপকর্মটা করতে কতটুকু পরিশ্রম আর সাধনা করতে হয় । বিছানার মাঝে ছড়িয়ে দিয়েছে নোট গুলো । বিশ পঞ্চাশ আর একশো টাকার নোট । টাকা গুলোর মাঝে হয়তো মিশে আছে কতো পরিশ্রম কত দীর্ঘশ্বাস জামাল হোসেন তা জানে না । জামাল হোসেন শুধু জানে তার আট লাখ টাকার ঘুষের চাকরী, বাড়ি ভাড়া বউ এর চাহিদা ছেলের স্কুল এবং আনুসাঙ্গিক খরচ সব মিলিয়ে সরকার যে বেতন দেয় তার কানা কড়িও মেটানো সম্ভব হয় না । তার চিন্তায় বাধা আসে তার স্ত্রী রুমার কথায় । কি সব হাবিজাবি নকল আর নোংরা নোট নিয়ে আস একটু দেখে শুনে নতুন নোট আনতে পার না । স্ত্রী রুমার কথায় একটু হাসেন জামাল হোসেন ।

– এই গুলো আমার জমিদারের খাজনার টাকা না এই গুলো ঘুষের টাকা । ঘুষের টাকা এর থেকে ভালো হয় না । কত জোড় জবস্তি করে যে টাকা গুলো আদায় করি তুমি কি জান ?? তারা কলিজা ছিঁড়ে দিতে চায় কিন্তু টাকা দিতে চায় না। এই সব ঘুষের টাকা নিতে বিবেকে বাধে কিন্তু কিছু করার নাই । বুঝছ !!

– এই শোন না । জুয়েলারী থেকে ফোন দিয়েছিল নেকলেসটা নাকি বানানো হয়ে গেছে, নিয়ে আসতে বলছে । তুমি টাকাটা কখন দিবা বলো ।

– আরে তুমি তো দেখি বড় জ্বালাতন কর । বাবার পেনশনের টাকা থেকে আট লাখ টাকা আমাকে দিয়েছেন । তার টাকা ফেরত দিতে হবে না ?? আমার তো আরো ভাই বোন আছে, নাকি !! আমি এতো কথা শুনতে চাই না এই মাসের ভেতরেই আমার নেকলেস এনে দিবে, তা না হলে আমি আমার বাবার বাড়ি চলে যাব ।

রুমা রাগ করে বালিশ নিয়ে তার ছেলে সজিবের ঘরে শুয়ে আছে । নিজেকে খুব একা একা লাগছে । বিষণ্নতায় ভরে আছে মনটা । আসলে সে এই রকম ছিল না । সৎ আর মেধাবি ছাত্র ছিল সে । মাস্টার্স পাস করার পরেও কোন চাকরি পাচ্ছিল না সে । একটা চাকরির জন্য কত জায়গায় ধন্না দিয়েছে সে তার কোন ইয়াত্তা নেই । রিটেন এবং ভাইবাতে পাস করার পরেও আট লাখ টাকা দিয়ে চাকরিটা নিতে হয়েছে তার । বাবার পেনশনের টাকাটা নিয়েছে সে কিন্তু এখনো বাবার পুরো টাকা ওয়াদা মাফিক ফেরত দিতে পারেনি । জীবনটা আসলেই এতো জটিল কেন ?? একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসে বুকের ভেতর থেকে তার ।

জামাল হোসেন কিছুদিন যাবৎ খুব বেশী বেপরোয়া । যার তার কাছ থেকে ঘুষের টাকা আদায় করছে । এমন কি দুই,পাঁচ টাকার নোটও বাদ যাচ্ছে না । জামাল হোসেন এক বৃদ্ধ সিএনজি ড্রাইভারের সাথে তর্কে জড়িয়ে গেছেন বৃদ্ধ বলছে তার গাড়ির কাগজ পত্র সব ঠিক আছে কিন্তু জামাল হোসেন বলছে তার কাগজ পত্র ঠিক নাই এবং দুই শত টাকা তাকে অবশ্যই ঘুষ দিতে হবে। কিন্তু বৃদ্ধ কিছুতেই কোন টাকা পয়সা দিবে না

ঝগড়ার এক পর্যায়ে জামাল নিজের নিয়ন্ত্রন হারিয়ে ফেলে । নিজের পশুত্বটা বেড়িয়ে আসে । স্ব জোড়ে বৃদ্ধের গালে একটা থাপ্পর বসিয়ে দেয় । বৃদ্ধ থাপ্পর খেয়ে ঘটনার আকর্ষিকতায় একেবারে ‘থ’ হয়ে যায় । সে ভাবতেই পারেনি তার ছেলের বয়সী কোন যুবক তার গায়ে হাত দিতে পারে । জামাল হোসেন তাকিয়ে আছে বৃদ্ধের দিকে । বৃদ্ধ লোকটি অপমানে লজ্জায় একেবারে লাল হয়ে গেছে । হলুদ বর্ণের চোখ দিয়ে পানি ঝরছে । স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে লোকটা মনে মনে কি যেন বলছেন । তার চেহারটাই বলে দিচ্ছে সে কথা ।

থাপ্পরটা দিয়ে অনুশোচনায় ভুগছে জামাল হোসেন । তার বাবার বয়সী লোকটার গায়ে হাত তোলা ঠিক হয়নি । যখন জামাল হোসেন বৃদ্ধ লোকটি কে কিছু একটা বলতে যাবে ঠিক তখনই রাস্তার অপর পাশে একটা একসিডেন্টের শব্দ পাওয়া গেল । একটা স্কুল ভ্যান রাস্তায় উল্টে পড়ে আছে । কোন একটা বাস ধাক্কা দিয়ে চলে গেছে । বাচ্চারা চিৎকার চেঁচামেচি করছে ।

দৌড়ে জামাল হোসেন স্কুল ভ্যানের দিকে এগিয়ে যায় । কিন্তু তার জন্য যে দৃশ্যটা অপেক্ষা করছিল তার জন্য সে মোটেও প্রস্তুত ছিল না । তার ছেলে সজিব রাস্তায় পড়ে আছে রক্তাক্ত অবস্হায় তবে মৃত্যু ঘটেনি । ভ্যান থেকে ছিটকে পড়ে যাওয়ার পরে তার ডান হাতের উপর দিয়ে অন্য একটি গাড়ি চলে গেছে । হাতটা একেবারে থেঁতলে গেছে, কোন মতে চামড়ার সাথে ঝুলে আছে । জামাল দিশেহারা হয়ে যায় । নিজের ছেলেকে কোলে নিয়ে দিকবেদিক ছুটিতে থাকে একটা গাড়ির খোঁজে,ছেলেকে হাসপাতাল নেওয়ার জন্য । কিন্তু ভাগ্য আজ তার পক্ষে নেই । আজ গাড়ি গুলো যেন তাকে দেখে পালিয়ে যাচ্ছে ।

সজিবের ডান হাতটা সম্পূর্ণ কেটে ফেলতে হয়েছে । জামাল লক্ষ্য করে এটা সজিবের হাত নয় নিজের হাত । হাত শূন্য নিজের ছেলেকে দেখে নিজের হাত কিছুক্ষণ কামড়াতে থাকে জামাল । সে বুঝতে পারে বৃদ্ধ লোকটিকে থাপ্পর মারার শাস্তি এটা । কিছু কিছু কৃত কর্মের ফল খুব দ্রুত সংঘটিত হয়, হোক সেটা নিজের উপর দিয়ে নয় তো বা সন্তানদের উপর দিয়ে ।

পরিশিষ্ট :- জামাল ট্রাফিক পুলিশের চাকরি টা ছেড়ে দিয়েছে তার সাথে সাথে স্ত্রী কেও ডিভোর্স দিতে চেয়েছিল কিন্তু সজিবের কথা চিন্তা করে তা করেনি ।

দামী ফ্ল্যাট বাসাটা ছেড়ে দিয়ে তারা এখন ছোট্ট একটা ফ্ল্যাট বাড়িতে উঠেছে । জামাল হোসেন এখন সৎ উপায়ে টাকা উপার্জন করে । ডিম ভাজা আর সাদা ভাতের বাষ্পায়িত ধোঁয়ায় রুমা আর জামাল হোসেন সুখের মানেটা খুঁজে বেড়ায় । তাদের মাঝে এখন আর নেই উচ্চ বিলাসীকতা আর অনাকাঙ্খিত চাহিদা ।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত