নাভীর আশেপাশের কালো দাগগুলো স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে। উৎপলের দেয়া পাতলা ফিনফিনে নীল রঙের শাড়িটা পড়ে বারান্দায় বসে আছি আমি সেঁজুতি। এই কয়েকদিন হলো সবাইকে ছেড়ে, উৎপলের চাকরির সুবাদে এই মফস্বলে এসে ঠেকেছি। দোতলা একটা বাড়িতে এসে ঠেকেছি,বাড়িটা খুব সুন্দর তবে বাড়ির ডিজাইনটা বড্ড সেকেলে।ছোটো খাটো একটা প্রাসাদ বললে ভুল হবে না।
সেই দুপুর থেকে একটানা বৃষ্টি শুরু হয়েছে এখন পর্যন্ত থামা থামি নেই অথচ এই মুহূর্তে সন্ধ্যার আলোআঁধারি আর বাহিরের কালো মেঘ মিলে আমার আশেপাশে একটা ভুতুড়ে পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম ঘরের ভিতর সন্ধ্যাপ্রদীপ দিতে হবে বলে কিন্তু লাইট অন করতেই বুঝতে পারলাম এইমাত্র লোডশেডিং হয়েছে।
ভয়ে বুকটা কেঁপে উঠলো।উৎপলটা এখনো আসছে না।কোথায় মোমবাতি রেখেছি এমুহূর্তে ঠিক মনেও করতে পারছি না তাই গুটিশুটি মেরে খাটের উপর বসে রইলাম। খাটের এক সাইডে একটা বিশাল জানালা,হালকা বৃষ্টির ছিটা সেখান থেকে গায়ে এসে লাগছে সাথে ঠান্ডা বাতাস।ভয়ে উঠে গিয়ে জানালা টাও বন্ধ করতে পারছি না। এরমধ্যে হঠাৎ বাহির থেকে একটা মেয়েলি কন্ঠ ভেসে আসলো,
-আফা,আপনে মনে হয় এই বাড়িতে নতুন আইছেন। তাই না? আমি ভয়ে ভয়ে উত্তর দিলাম,
-হু মেয়েটা আবার বলে উঠলো,
-আফা এই নীল শাড়ি টায় আপনারে খুব মানাইছে তবে শাড়িটা খুব পাতলা।এই বলে মেয়েটা হেঁসে উঠে আবার বললো,
-আফা আপনি আমারে দেখে ভয় পাইতেছেন কেন?সামনে দুই বাড়ির পর আমার বাড়ি।আমার নাম জবা।খোপে হাঁস-মুরগি গুনতে গিয়ে দেখি ৩ টা হাসঁ নিখোঁজ তাই খুঁজতে বের হইছি কিন্তু কপাল খারাপ পাই নাই।এই বলে মেয়েটা চুপ হয়ে গেলো। জবা আমার প্রতিবেশী হওয়ায় ভয়টা একটু কমে এলো যদিও ওকে আমি এখন পর্যন্ত দেখিনি তবে মনে মনে ভাবলাম কালই ওদের বাড়ি গিয়ে ওদের সাথে একটু ভাব করে আসবো। উৎপল এখনো আসছে না এই ভেবে কলিজা টা ছ্যাঁত করে উঠলো।হঠাৎ মেয়েটা বলে উঠলো,
-আফা,আপনে মনে হয় ভাইয়ের কথা ভাবতাছেন, চিন্তা কইরেন না সে একটুপরে আইসা পড়বো।আফা আপনারে দেইখা আমার বড্ড দুঃখী মানুষ মনে হয়। তয় আফা আপনার দুঃখ আর এক রাইত পর্যন্ত থাকবো তারপরই আপনি মুক্ত।
আপনার স্বামী অন্য একজনরে পছন্দ করে আবার আপনারে ভাল ও বাসে তাই আপনারে সে একেবারে দূরে সরাইতে পারে না তাই আপনারে একাকী এই নির্জন বাড়িতে নিয়া আইছে। আপনার পা থেকে কোমর অবধি যে দাগগুলো দেখতেছেন ওগুলো আপনার স্বামীর তন্ত্রমন্ত্রের ফল।আজ অমাবস্যা রাইতে আপনার এই দাগগুলো গলা অবধি দগদগে ঘায়ে রুপান্তরিত হবে তারপর কালো একটা জবা এনে আপনার শরীরে ছুঁয়ে দিলেই হবে আপনার জীবনের সমাপ্তি। এই অদ্ভুত কালো জবা ফুলটা কিন্তু আমার গাছেই পাওয়া যাবে! জানেন আফা আপনার ফুটফুটে ২ টা বাচ্চা হইবো। একটা পোলা আর একটা মাইয়া।আপনার জীবনের আজ সবচেয়ে বড় একটা ফাঁড়া কাইটা যাইবো আফা।
আপনে অনেক সুখী হইবেন।আপনার স্বামীর পকেটে আইজ একটা সাদা কাগজ থাকবো তারমধ্যে গোলাপি রঙের কালি দিয়া কিছু লেখা থাকবো, ওইটা আজ সে পোড়াতে পারলেই আপনার পুরো শরীর আগুনে মতো ঝলসে যাইবো।তাই আইজ রাইত ২ টায় আপনি আপনার ৩ ফোটা রক্ত ফালাইয়া ঐ কাগজটারে পোড়াইয়া ফেলবেন।যার ক্ষতি করা হবে সেই কাগজে যদি তার একবিন্দুও রক্ত পড়ে তাহলে তান্ত্রিকের মন্ত্রের শক্তি লোপ পায়। এই বলে মেয়েটা সেখান থেকে চলে গেলো। মেয়েটাকে আর দেখা গেলো না।তবে এই মুহূর্তে বাচ্চার কথা শুনে সেঁজুতি হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। কেউ জানে না, এই পৃথিবীর কেউ জানে না সেঁজুতির মনে কতটা কষ্ট।তবে উৎপলের ব্যাপারে কথাগুলো সেঁজুতির একেবারে পছন্দ হলো না কারণ উৎপল সেঁজুতিকে অনেক ভালবাসে।
হঠাৎ দরজায় কে যেনো কড়া নাড়লো।এরমধ্যে কারেন্ট ও চলে এলো।দরজা খুলতেই দেখা গেলো উৎপল দরজায় এসে হাজির সাথে আরো দু’জন লোক কারণ উৎপল আজ প্রচন্ডভাবে অ্যাকসিডেন্ট করেছে এবং পায়ে ভয়ংকরভাবে ইনজুরি হয়েছে।উৎপলের এ অবস্থা দেখে সেঁজুতির কান্না আরো দ্বিগুণ বেড়ে গেলো। রাত ২ টা হঠাৎ এক ভয়ংকর স্বপ্নে সেঁজুতির ঘুম ভেঙে গেলো। সেঁজুতি স্বপ্নে দেখলো একটা কালো ছায়ামূর্তি তার ভিতর থেকে বেরিয়ে দূরে ছিটকে গিয়ে ভয়ংকর ভাবে আর্তনাদ করছে সাথে আশেপাশে একটা বিশ্রী উটকো গন্ধে ভরে ছেয়ে গেছে। সেঁজুতির হঠাৎ মনে পড়লো সন্ধ্যাবেলা সেই মেয়েটার কথা। সাথেসাথে উৎপলের প্যান্টের পকেটে সেই হিজিবিজি লেখা কাগজটা দেখে আঁতকে উঠলো সেঁজুতি।
কাগজটা হাত দিয়ে ধরতেই কয়েকবার কেঁপে উঠলো।সেঁজুতি আর দেরি করলো না সাথেসাথে পাশে থাকা ফল কাটার ছুরিটা নিয়েই হাতে একটা পোঁচ দিয়ে ৩ ফোঁটা রক্ত সেই কাগজে ফেলে পুড়ে দিলো রান্না ঘরে নিয়ে।
সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার যেটা ঘটলো সেই হলো এই কাগজের টুকরো দিয়ে এক চিলতে লাল ধোঁয়া উড়ে গেলো!
আর উৎপল পায়ে হাত রেখে বিড়বিড় করে বলতে লাগলো কালো জবা, সেই কালো জবা! কিন্তু উঠে গিয়ে সেটা আনার শক্তি তার ছিলো না।কিন্তু সেঁজুতি যদি কাগজটা না পুড়ে ফেলতো তাহলে সেই কালো জবাটা নীল রং ধারণ করতো এবং যেকোনো ভাবে সেই সময়ের মধ্যে সেঁজুতির অপমৃত্যু ঘটতো। এখন সেঁজুতি বুঝতে পারলো কেন উৎপল প্রায়ই রাত করে বাড়ি ফেরে আর কেনইবা সে আজ সেঁজুতিকে নীল শাড়ি পড়তে বলেছে।আর এও বলেছে আজ উৎপল তাকে একটা সারপ্রাইজ দিবে যাতে তার শরীরের দাগগুলো ম্যাজিকের মতো উবে যাবে।সেঁজুতি মনে মনে ভাবে তাহলে তার সারপ্রাইজটা ছিলো আমার মৃত্যু!
সেজুতির আর ঘুম আসছে না।একটু পর প্রেগন্যান্সি টেস্ট করে সে জানতে পারলো সত্যিই দীর্ঘবছর পর আজ সেঁজুতি মা হতে চলেছে।প্রচন্ড খুশিতে উৎপলকে কথাটা বলার জন্য সে ঘরে ছুটে গেলো কিন্তু কথাটা বলার আগেই উৎপলের ফোনে একটা কল আসলো, সেটা সেঁজুতি রিসিভ করতেই অপরপাশ থেকে কেউ বলে উঠলো,
শিল্পা গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছে।এই শিল্পাই ছিলো উৎপলের বন্ধু, হয়তো একে পেতেই সে বলি দিতে চেয়েছিলো সেঁজুতিকে। বাহিরে ফজরের আজানের ধ্বনি শোনা গেলো।সেঁজুতি আর ১ সেকেন্ড ও দাঁড়ালো না, ঘর থেকে বেরিয়ে দৌড়ে চলে গেলো ঠিক দুই বাড়ি পেরিয়ে একটা মাঠে যার পাশে গাছগাছালি ঘেরা ছোট একটা বাড়ি। সেখানে গিয়ে দেখা গেলো এক বৃদ্ধা ওজু করছে পুকুরপাড়ে।তাকে জবার কথা জিজ্ঞেস করতেই সে বললো,
-জবা তো আরো তিনবছর আগেই মারা গেছে।এক বৃষ্টির রাতে জবা হাসঁ খুজতে বাহিরে বেরিয়েছিল কিন্তু আর ঘরে ফেরেনি, চৌধুরীর বাড়ির খালি প্রাসাদে তাকে কয়েকজন মিলে ধর্ষন করে সেখানে গলা কেটে ফেলে যায়।কথাটা বলেই বৃদ্ধা আঙ্গুল দিয়ে দেখালো পুকুরপাড়ে একটা কবর যাকে ছায়া দিয়ে ঢেকে আছে অনেকগুলো জবাফুল গাছ।সেখান থেকে লাল লাল রক্তজবা ঝরে ঝরে ভেসে বেড়াচ্ছে পুকুরে।সেখান থেকে টুপ করে একটা কালো জবা পানিতে পড়লো আর সেটা আস্তে আস্তে ডুবে গেলো পানির অতল গভীর থেকে গভীরে।