এখন জীবন যেমন

এখন জীবন যেমন

‘মুরুব্বি, সত্যি করে বলেন তো কি দরকারে বাসা থেকে বেরিয়েছেন?’ ‘বললামই তো। ওষুধ কিনতে বারাইছি।’ ‘না, ওষুধ কিনতে বের হন নাই। নাহলে সাথে প্রেসকিপশন থাকতো। আপনি নিজের যে ঠিকানা বললেন সেখানে অসংখ্য ওষুধের দোকান আছে। তবুও আপনি এতদূরে এসেছেন। বলেন কি কাজে বেরিয়েছেন?’ ‘আমি আসলে বাজার করতে বেরিয়েছি। বাসায় চাল-ডাল কিছুই নাই। সত্যি বলছি।’ ‘আবার মিথ্যা বলছেন মুরুব্বি। বাজার করতে বেরিয়েছেন, তাও আবার ব্যাগ ছাড়া। ভণিতা ছেড়ে আপনি এবার সত্যিটা বলুন। নাহলে কিন্তু কঠোর হতে হবে আমাকে।’ ‘ইয়ে মানে… বাবা রে, সত্যি বলতে কি আমি আসলে বিড়ি খেতে বেরিয়েছি।’

দাদার বয়েসী বৃদ্ধের কথা শুনে প্রচন্ড হতাশ হলো পুলিশ কনস্টেবল আজাদ। এমন মানুষগুলোর নিরাপত্তা দিতে সারাদিন রাস্তায় থাকতে হয় ভেবে মেজাজ খারাপ হলো। হাতে থাকা লাঠি শক্ত করে চেপে ধরে রেখেছে। দাদার বয়েসী না হলে এই লোকটার পাছা পিটিয়ে লাল করে দিতো। বৃদ্ধ হাসি হাসি মুখ নিয়ে আজাদের দিকে তাকিয়েই আছে। আজাদ এক মুহূর্ত ভাবে, এই লোকটা মৃত্যুপুরীতে ঘুরতে বেরিয়েছে। বয়সের ভারে এক পা ইতোমধ্যে কবরে, তার উপর করোনার ভয়াবহতা। এসবে না মরলেও তামাক-বিড়ি খেয়ে ঠিকই ধুকে ধুকে মরবে। দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে আজাদের।

‘দিনে কয়টা বিড়ি খান?’ ‘বেশি খাই না। ৩/৪টা হলেই দিন চলে যায়।’ আজাদ তার সহকর্মী কামরুলকে ডাক দেয়। তার কাছ থেকে এক প্যাকেটের অর্ধেক সিগারেট নিয়ে নেয়। ‘এটা ধরুন আর সোজা বাসায় চলে যান। মরবেনই যখন নিজের বাসার ভেতর মরুন। ফের কখনো রাস্তায় পেলে বয়সের তোয়াক্কা করবো না। কঠিন শাস্তি দিবো।’ ধমক পাওয়ার পরেও হাসিমুখ করে বাসার পথে রওনা দেয় বৃদ্ধ। আজাদ বুঝে উঠতে পারে না বৃদ্ধকে সিগারেট দেওয়াটা ঠিক হলো কিনা। অবশ্য না দিয়ে উপায় ছিলো না। বৃদ্ধকে দেখে বোঝাই যাচ্ছিল তিনি বিড়ি-সিগারেট না নিয়ে বাসায় ফিরতো না।

সারাদিনের অসংখ্য ঝুট-ঝামেলা কাটিয়ে সন্ধ্যার পর ছুটি মেলে আজাদের। বাড়িতে ফিরতে ফিরতে অবশ্য রাতই হয়। যদিও এখন ডিউটির কোন নির্দিষ্ট সময়সীমা নেই। প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাসের জন্য পুরো জেলাশহর লকডাউন করা হয়েছে। থানা থেকে কল আসলেই ডিউটিতে ছুটতে হয়। বাড়িতে সেভাবে সময় দিতে না পারলেও যখনই সুযোগ পায় বাসায় চলে আসে। দুই মেয়ের জন্য সবসময় মন পোড়ে তার। বড়টার নাম আসমা, এবার ৮ বছরে পা দিলো। ছোটটার নাম আমেনা, সামনের মাসে বয়স ৫ বছর হবে। তরতর করে মেয়ে দুটি বড় হয়ে গেল। টেরই পায়নি আজাদ। চাকরির কারণে পরিবারকে সময়ই দিতে পারে না। ভালো পুলিশ হতে পারলেও ভালো বাবা হতে পারছে না সে।

পুলিশ হওয়া সত্বেও নিজের বাড়িতে ইদানিং চোরের মতো ঢুকতে হয় আজাদকে। ভয়ে থাকে কখন কোনদিক থেকে ছোট মেয়েটা এসে জড়িয়ে ধরে, আদর করে কোলে নিতে বলে। কিন্তু সেটা তো হতে দেওয়া যাবে না। আজাদ সারাদিন এদিক-সেদিক ডিউটিতে যায়। জনসমাগম ঠেকায়, মানুষের মাঝে থাকতে হয়, প্রয়োজনে হাসপাতালে যেতে হয়, করোনা আক্রান্ত রোগীদের খোঁজ-খবরও রাখতে হয়… কখন কার সংস্পর্শে থাকছে হিসেব নেই। এই অবস্থায় আর যাই হোক সন্তানদের কাছে যাওয়া যায় না। বাড়িতে গিয়েই তাই প্রথম কাজ হয় নিজেকে জীবাণুমুক্ত করা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হওয়া। এন্টিসেপ্টিক সাবান দিয়ে গোসল করে তবেই ঘরে প্রবেশ করে আজাদ। রাতের খাবার খেতে বসলে প্রথমে দুই মেয়েকে মুখে তুলে খাইয়ে দিতে হয়। আর সেটা খুব আনন্দ নিয়েই করে আজাদ। ‘বাবা, তুমি তো বাড়ির বাইরে যেতে নিষেধ করেছো আমাদের। তাই না?’ ছোট মেয়ে আমেনা জিজ্ঞেস করে। ‘হ্যা মা। বাড়ির বাইরে এখন খুব বিপদ। ভাইরাস বেরিয়েছে। সে ভাইরাসে মানুষ মারাও যাচ্ছে।’ ‘তাহলে তুমিও কাল থেকে বাইরে বেরুবা না। আমাদের সাথে থাকবা। আমরা সারাদিন খেলবো।’ ‘আচ্ছা মা। বাইরে বেরুবো না। আমরা সারাদিন খেলবো।’

অনিচ্ছাসত্বেও মিথ্যের আশ্রয় নিতে হয় আজাদের। মেয়ের মন খুশি করে। এমন অসংখ্য ছোট ছোট মিথ্যের আশ্রয় নিয়েই সংসার চালিয়ে যাচ্ছে আজাদ। এসআই রাজিব সাহেব ডেকে পাঠিয়েছেন আজাদকে। ডাক পেয়ে হুরমুর করে হাজির হলো সে। ‘ডিউটি কেমন চলে?’ ‘জ্বি স্যার ভালো।’ ‘কোনকিছুর প্রয়োজন আছে?’ ‘না স্যার। সব ঠিক আছে।’ ‘বিড়ি-সিগারেট লাগবে না আপনার?’ ‘আমি তো বিড়ি-সিগারেট খাই না স্যার।’ ‘আপনি না খান, জনসাধারণকে তো ঠিকই খাওয়ান। সব খবরই তো রাখি। তা এইভাবে জনসেবা কে করতে বলেছে?’ কোন জবাব খুঁজে পায় না আজাদ। বৃদ্ধকে সিগারেট দেওয়ার খবরটা যে এসআই সাহেবের কান পর্যন্ত এসেছে সেটা বুঝতে পারেন।

‘আপনার কাজ জনসাধারণ যেন রাস্তা-ঘাটে না বেরোয় সেটা নিশ্চিত করা। এক্ষেত্রে কেউ অবাধ্য হলে প্রয়োজনে লাঠিপেটা করা। এর বাইরে আর কোনপ্রকার জনসেবার দরকার নেই। কথাটা মনে রাখবেন দয়া করে।’
‘জ্বি স্যার। মনে থাকবে।’ এসআইকে সালাম জানিয়ে ডিউটিতে ফিরে যায় আজাদ। মন-মেজাজ প্রচন্ডরকম খারাপ হয়। মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয় আজকে কাউকে পেলে হয়, পিটিয়ে পাছার ছাল তুলে ফেলবে। চাকরি জীবনে খুব কমই নিজের বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে। এটা তার জন্য ভীষণ লজ্জাকর। এমনটা দ্বিতীয়বার হতে দিতে চায় না সে।

রাস্তা-ঘাট প্রায় ফাঁকা। এর মাঝেই আসর ওয়াক্তের আযান ভেসে আসে কানে। নামাজটা পড়া দরকার। আজাদ নিকটবর্তী মসজিদের দিকে পা বাড়ায়। কিন্তু পৌছে গিয়ে দেখে মসজিদে ইতোমধ্যে দশজন লোক প্রবেশ করেছে। আরও কয়েকজন আসছিল, কিন্তু আজাদকে দেখে উল্টোপথে হাঁটা দিয়েছে তারা। হতাশ হয় আজাদ। ঘোষণা করা হয়েছিল মসজিদে পাঁচজনের বেশি লোক প্রবেশ নিষেধ। সবাই যার যার বাড়িতে নামাজ আদায় করবে। করোনা ভাইরাস নিয়ন্ত্রণ না হওয়া অবধি এ ঘোষণা কার্যকর থাকবে। অথচ মানুষ তা মানছেই না। জনসমাগম রোধের কত চেষ্টা করা হচ্ছে। আসলে জনসাধারণ নিজে থেকে সচেষ্ট না হলে হাজার চেষ্টা করেও এই সমস্যার সমাধান পাওয়া যাবে না।

নামাজ শেষ হওয়া পর্যন্ত মসজিদের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে আজাদ। তারপর সকলে বেরুলে আজাদ আক্রোশ প্রকাশ করে। বিধি-নিষেধের কথা জানায়। ইমাম সাহেব জানালেন তিনি মাইকে অসংখ্যবার সবাইকে সতর্ক করেছেন। এটাও জানিয়েছেন পাঁচ জনের বেশি মসজিদে না ঢুকতে। আপাতত সবাই যেন বাসায় বসে নামাজ আদায় করে। সবকিছু শুনে আরও একবার সবাইকে সতর্ক করে দেয় আজাদ। এরপর ডিউটিতে ফিরেই যাচ্ছিল এমন সময় পেছন থেকে ইমাম সাহেব ডাক দেন। বললেন নামাজটা আদায় করে যেতে। তিনি অপেক্ষা করবেন, আজাদের নামাজ শেষ হলে তারপর মসজিদ বন্ধ করবেন। খুশি হয় আজাদ। খুশিমনে নামাজটা আদায় করে। থানা থেকে জরুরি কল এসেছিল। একটি গ্রামে যাবার নির্দেশ এসেছে। ওসি, এসআই তারা ইতোমধ্যে রওনা দিয়েছেন। আজাদদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে সদর হাসপাতাল থেকে কয়েকজন ডাক্তার ও নার্সকে সঙ্গে নিয়ে আসার। তাই করা হলো।

ঘটনাস্থলে পৌছে জানা গেল ভোররাতে একটি মেয়ে শিশু মারা গেছে। বয়স চার বা পাঁচ। আজাদ মৃত শিশুটির মুখটি দেখলো। মেয়েটির মায়াভরা মুখটি দেখে নিজের ছোট মেয়ের কথা মনে পড়ে গেল। সমবয়সীই হবে তারা। অকালে একটি প্রাণ ঝরে গেল ভেবেই বুকটা কষ্টে ফেটে যায়। মেয়েটির মৃত্যুর কারণ জানতে চাইলে বাবা-মা জানান জন্মের পর থেকেই শ্বাসকষ্ট ছিলো। নিয়মিতই ডাক্তার দেখাতে হতো। বেশ কিছুদিন পুরো শহর লকডাউন থাকায় ডাক্তার দেখাতে যাওয়া হয়নি। গতরাতে হুট করেই শ্বাসকষ্ট বেড়ে যায় মেয়ের, জানায় শ্বাস নিতে খুব কষ্ট হচ্ছে। ভেবেছিল সকাল হলে ডাক্তারের কাছে যাবে। কিন্তু ভোর রাতেই প্রাণ হারায় মেয়েটি।

আজাদ কি বলবে ভেবে পায় না। এত অল্প বয়সে মৃত্যু মেনে নেয়া কঠিন। কিন্তু ঘটনা এখানেই শেষ নয়। মূল ঘটনাই শুরু হয় মেয়েটির মৃত্যুর পর। করোনা সন্দেহে মৃত মেয়েটির জানাজা পড়াতে রাজি হয়নি স্থানীয় ইমামরা। এমনকি পুরো গ্রাম বা মসজিদের কেউ রাজি হয়নি লাশ রাখার জন্য কোন খাটিয়া দিতে। এমন অমানবিক আচরণের কথা শুনে স্তম্ভিত হয়ে যায় আজাদসহ বাকি সবাই। ভোররাতে মারা গেছে শিশুটি। অথচ শিশুটির বাবা-মা সকাল ৯টা পর্যন্ত পাড়া-প্রতিবেশী, চেয়ারম্যান, ইমাম ও স্থানীয় ক্ষমতাসীন ব্যক্তিদের দ্বারে দ্বারে ঘুরেও কোনপ্রকার সহযোগিতা পায়নি। বাধ্য হয়ে তারা পুলিশে যোগাযোগ করেছে। এসব শুনে থরথর করে কাঁপতে থাকে আজাদ। রাগে, কষ্টে, ঘৃণায় শরীর রি-রি করে ওঠে।

ওসি এবং এসআই সাহেবের অনুমতি নিয়ে মৃতের বাড়িতেই কবর খুঁড়তে শুরু করে আজাদ। সহযোগিতা করে বাকি পুলিশরাও। হাসপাতাল থেকে আসা ডাক্তার-নার্স মেয়েটিকে গোসল করিয়ে কাফনের কাপড় পরায়। এরপর মৃতের পরিবার, উপস্থিত পুলিশ ও ডাক্তার-নার্সদের নিয়েই জানাজা পড়া হয়। দাফন-কাফন সম্পন্ন করা হয়। বেলাশেষে বাড়ির পথ ধরে আজাদ। রাত হয়ে আসে। নির্জন চারপাশ। বাইরে কোথাও কেউ নেই। আনমনে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির সামনে এসে পড়ে। বাড়িটার দিকে তাকায় একনজর। সব কেমন যেন ঝাপসা লাগে। আজাদ খেয়াল করে অশ্রুতে চোখ ভিজে এসেছে।

সারাদিনের অসংখ্য ঘটনা, মানুষের অমানবিকতা, মৃত্যুর মতো করুণ পরিণতি দেখে ভেতরটা ভারী হয়ে এসেছে। এতকিছু নিতে পারছে না আজাদ। কান্নায় ভেঙে পড়ে মুহূর্তেই। নিষ্পাপ শিশুর মতোন ডুকরে কাঁদতে থাকে। আশেপাশে এমন কেউই নেই যে আজাদের এই কান্না দেখবে। অবশ্য আজাদ জানে, উপরে একজন আছেন যিনি সব দেখছেন। আজাদ কান্নারত অবস্থায় সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করে, তার কাছে মানুষের প্রাণ ভিক্ষা চায়। মানুষ যেন নিজের বিবেক বিসর্জন না দেয় সেই প্রার্থনা করতে থাকে।

শত কষ্ট-যন্ত্রণার মাঝেও আজাদ বিশ্বাস হারায় না। সে সৃষ্টিকর্তার উপর বিশ্বাস রাখে। বিশ্বাস রাখে নিজের উপরেও। এই কষ্টের অন্ধকার রাত একসময় ফুরোবে। আলো ফিরে আসবে আবার। ফিরে আসবে সুদিন।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত