শেষ বসন্তে

শেষ বসন্তে

-“আরে কাশফু এটা তোর হবু বর না? আরে ঐ যে রাস্তার ঐ পাশে হলুদ পান্জাবি পড়া। ঐদেখ আবার ফুলও কিনছে। তুই সাথে নিয়ে বের হওয়ার কথা বললি আর তো বলল শহরের বাইরে যাবে, কাজ আছে।এখন দেখলি তো কি কাজ? নিশ্চয়ই প্রেমিকার সাথে দেখা করতে যাচ্ছে। হাতে দেখ শপিং ব্যাগও দেখা যাচ্ছে নিশ্চয়ই শাড়িও কিনেছে। কি ধান্দাবাজ ছেলেরে বাবা! এদিকে তোর সাথে বিয়ে ঠিক করে রেখে অন্যদিকে প্রেমিকার সাথে লুতুপুতু করে বসন্ত পালন করতে যাচ্ছে।”

-“বলা শেষ হয়েছে? এবার থাম। তুই এভাবে কেন ভাবছিস? হতেও তো পারে ও আমাকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্যে মিথ্যে বলেছে। এগুলো হয়তো ও আমার জন্য কিনছে। সব সময় নেগেটিভ কেন ভাবিস বল তো।ওর সাথে কয়েকবার ফোনে কথা হয়েছে আমার।ও মোটেও এমন ছেলে নয়।”

-“চোখে দেখেও আজকাল মানুষ প্রতারতদের চিনতে পারে না তুই ফোনে দু-তিন বার কথা বলেই চিনে ফেললি।”

-“তুই দেখিস ও এখন আমাদের বাসার দিকেই যাবে।”

-“কোনোদিনও যাবে না। একটা কাজ কর, তুই ওরে ফোন দে। জিজ্ঞেস কর কোথায় আছে? দে ফোন দে।”

-“আরে কি দরকার?”

-“তুই ফোন দে। নাহলে আমার কাছে ফোনটা দে। আমি ফোন দিচ্ছি। দেখিস ঐ ছেলেরে আজ কি করি আমি। শয়তান! আমার বান্ধবীরে সহজ সরল পাই… সে গাছেরও খাবে তলারও কুড়াবে।দেখাচ্ছি মজা।”

-“চুপ কর প্লিজ। আচ্ছা আমি ফোন দিচ্ছি। কিন্তু তুই একদম চুপ থাকবি।কোনো কথা বলতে পারবি না। ওকে?”

-“ওকে। আগে তুই ফোন দে।”

প্রথমবার রিং হয়ে কেটে গেল। বিপরীত পাশ থেকে কোনো সাড়া পেল না কাশফিয়া। দ্বিতীয় বার ফোন দিতেই ফোনটা কেটে দিল। এবার মনটা বেশ খারাপ হলো তার।

-“কি সাহস! দেখলি ফোন কেটে দিল। নিশ্চয়ই কোনো গন্ডগোল আছে। তাহলে ফোন কাটবে কেন? দে আবার ফোন দে।”

-“আরে কি দরকার? দেখছিস তো কেটে দিল। আর দেওয়া লাগবে না।”

-“আরেকবার দিয়ে দেখ।”

তৃতীয়বার রিং হতেই বিপরীত পাশের লোকটা ফোনটা তুলল।

-“হ্যালো, বলো।”

-“কোথায় তুমি?”

-“আমি তো একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজে শহরের বাইরে এসেছি। তোমার কি ঠান্ডা লেগেছে। কথা এমন শোনা যাচ্ছে কেন?”

ততক্ষণে কাশফিয়ার গাল বেয়ে দু ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে গেছে।

-“চুপ করে আছো যে…

-“না কিছু না। রাখছি। পরে কথা বলল। তোমার গুরুত্বপূর্ণ কাজ শেষ হলে ফোন দিও।”

-“ঠিক আছে।”

ফোনটা কেটে চোখের পানি মুছল কাশফিয়া। কি সুন্দর করে সাজিয়ে মিথ্যে কথাগুলো বলল শ্রাবণ। শ্রাবন! কাশফিয়ার হবু বর। এই সপ্তাখানেক আগেই তাদের বিয়ে ঠিক হয়েছে। শ্রাবণের সাথে কথা বলে ছেলেটাকে বেশ ভালো মনে হয়েছিল কাশফিয়ার। তাই বিয়েতে মত দিয়ে দিয়েছিল। আজ সত্যিই মনে হচ্ছে, মানুষ চেনা খুব কঠিন! খুব!

-‘আরে তুই কাঁদছিস কেন?ভালোই হয়েছে আগে ভাগে সব জানতে পেরেছিস। না হলে তো তোর সর্বনাশ হয়ে যেত।”

-“চল। খিদে পেয়েছে আমার। কোথাও গিয়ে বসি।।কিছু খাই।”

-“আরে দাঁড়া আগে তামাশাটা দেখে নেই।ঐ দেখ সিএনজি নিচ্ছে। নিশ্চয়ই এখন প্রেমিকার কাছে যাবে। আরে তুই তো বলছিলি তোকে সারপ্রাইজ দিতে যাবে। আমি তো জানতাম তোর বাসা উত্তরা। তোর সো কল্ড ভালো ছেলে তো উত্তরার বিপরীত দিকে যাচ্ছে।”

-“ঐদিকে তাকানোর দরকার নাই। চল এখান থেকে তুই।”

-“আরে যাব মানে। তুই দাঁড়া। দেখ আমি কি করছি। আমার সহজ সরল বান্ধবীর জীবন নিয়ে খেলা। খেলাচ্ছি তাকে। ঐ সিএনজি এই।”

-“কোথায় যাবেন?”

-“সামনের ঐ সিএনজিটাকে ফলো করবেন। যতদূর যাবে আমরাও ততদূর যাব।”

-“কি হচ্ছে কি? আমরা ওকে ফলো করব কেন? তুই…

-“তুই গাড়িতে উঠে বস। শুধু দেখ কি করছি আমি। এমন সিচুয়েশন তৈরি করব না আম এবং ছালা দুটোই হারাবে। আজ যদি ওর মুখোশ না খুলেছি আমি আমার নামও রুশা না। খুব বলতি না, তুই খুব ভাগ্যবান এজন্য শ্রাবণের মতো ছেলে তোর জীবনে এসেছে। এখন দেখ….

সত্যি কি শ্রাবণের জীবনে এমন কেউ আছে? একটাবার শ্রাবন তো আমাকে সবটা বলতে পারত। আমি নিজেই সরে যেতাম ওর জীবন থেকে। প্রথম দিন বলেনি ঠিক আছে।কিন্তু ফোনে তো বেশ কয়েকবার কথা হয়েছে তখন অন্তত বলতে পারত। কি দরকার ছিল এভাবে ঠকানোর? আমি মনে যে ওর জন্য ভালোবাসা তৈরি হয়েছে সেটা কিভাবে মুছে ফেলব আমি? তবুও দূরে সরে যাব আমি। ভালো থাকুক ও তার ভালোবাসার মানুষের সাথে। আমারটা না হয়….

-“আরে সিএনজি তো হাসপাতালের সামনে এসে থামল। আরে ও তো হাসপাতালের ভেতরে যাচ্ছে। নিশ্চয়ই কোনো ডাক্তার মেয়ের সাথে প্রেম। মেয়ে কাজের জন্য বের হতে পারছে না।তাই উনি উপহার নিয়ে হাসপাতালে চলে আসছে দেখা করার জন্য। কি প্রেম! বাপ্রে!দেখছি ভেতরে গিয়ে।”

-“তুই যা। আমার ভেতরে যেতে ইচ্ছে করছে না।”

-“তুই যাবি না মানে? তোকেও যেতে হবে চল।”

এক প্রকার টেনে কাশফিয়া কে নিয়ে ভেতরে গেল রুশা।

-“আরে কোনদিকে গেল দেখতে তো পারছি না। দাঁড়া খুঁজে তো ওকে বের করবই আমি।”

বেশ কিছুক্ষণ এদিকে সেদিকে শ্রাবণকে খুঁজল ওরা। দেখাতে না পেয়ে নিরাশ হয়ে এক জায়গায় বসে পড়ল দুজনে।

-“আমার মনে হয় কি কাশফু ও আমাদের দেখতে পেয়েছে। তাই কোনোরকমে পাশ কাটিয়ে আমাদের চোখ এড়িয়ে বেরিয়ে গেছে। নাহলে মুহুর্তের মধ্যে এভাবে হাওয়া হওয়া যায়।”

-“চল আমরা চলে যাই।”

-“আরেকটু বস। কাউকে জিজ্ঞেস করে দেখি দাঁড়া।”

বিশ মিনিট পরে শ্রাবনকে দেখতে পেল ওরা। মুখটা পুরো ভার হয়ে আছে তার। ছোখদুটো ফুলে আছে। এখনও চোখের পানি পড়ছে তার। হাত দিয়ে চোখের পানি মুছতে মুছতে দৌড়ে হাসপাতাল ছাড়ল শ্রাবন। কাশফিয়া হাত তুলে ডেকেছিল তাকে শ্রাবণকে। কিন্তু সে ডাক শ্রাবণের কান অব্দি পৌঁছালো না।

-“নিশ্চয়ই মেয়ের সাথে ঝগড়া হয়েছে। ব্রেকআপও হতে পারে। দেখলি না কেমন মুখ ভার করে বেরিয়ে গেল।”

-“এবার কিন্তু ঠাস করে একটা চড় লাগিয়ে দিব রুশা।তোর ফালতু বকবকানি গুলো বন্ধ করবি? তুই দেখছিলি ও কাঁদছিল। আজ প্রথম আমি কোনো ছেলের চোখে পানি দেখলাম।”

-“আবার গলে গেলি তো।তুই…..

-“এক্সকিউজ মি, একটু শুনবেন।”

-“জ্বি ম্যাম বলুন।”

-“একটু আগে যে একটা ছেলে কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে গেল, উনার কি কোনো পেশেন্ট আছে হাসপাতালে?”

-“আরে উনি তো মি.শ্রাবন।”

-“হুম। মি.শ্রাবণের কথাই জানতে চাইছি। উনার কেউ কি হাসপাতালে ভর্তি আছেন।”

-“আছেন বলতে ছিলেন। দশ মিনিট হবে মারা গেছেন।”

-“মারা গেছেন?”

-“হুম। প্রেমিকা ছিলেন উনার। আজ থেকে দুবছর ধরে মেয়েটা এই হাসপাতালে আছে।আছে বলতে যন্ত্রপাতির সাথে ছিল আরকি। না থাকার মতো ছিল। শুধু নিঃশ্বাসটাই….

কাশফিয়া আর রুশা দুজনে একবার দুজনের মুখ চাওয়াচাওয়ি করল।

-“আচ্ছা কি হয়েছিল মেয়েটার? একটু প্লিজ বলবেন।”

-“সেই দিনটার কথা আমার এখনও বেশ মনে পড়ে। সেদিনও পহেলা ফাল্গুন ছিল। আমাদের একটা ও.টি ছিল। ও.টি থেকে বের হতেই উনি পেশেন্ট নিয়ে হাসপাতালে ডুকলেন। একদম রক্তে মাখামাখি হয়ে। সাথে সাথে মেয়েটাকে ও.টি তে নেওয়া হল।উনি ডাক্তারের পা জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিলেন। বলেছিলেন শুধু মেয়েটাকে বাঁচিয়ে দিতে। ডাক্তার সাহেব তার সর্বোচ্চটা দিয়ে চেষ্টা করেছেন।মেয়েটাকে বাঁচাতে পেরেছিলেন তিনি। কিন্তু মেয়েটা কোনোদিন কথা বলে নি আর। সেদিন থেকে এ পর্যন্ত একবারের জন্য চোখও খোলে নি। খুব খারাপভাবে Accident হয়েছিল।সেদিন চোখে অন্যরকম কিছু দেখেছিলাম আমি। খোঁপায় থাকা বেলীফুলের মালাটা রক্তে লাল হয়ে গিয়েছিল।আর মি.শ্রাবনের বুকটা। সেই রক্ত তিনি এখনও হয়তো মুছতে পারেন নি।আজ দুবছর ধরে দেখছি….

-“উনি কি মাঝে মধ্যে এখানে আসেন দেখা করতে?”

-“মাঝে মাঝে না। উনি রোজ আসেন। সকালে অফিস যাওয়ার আগে একঘন্টা বসেন আর রাতে অফিস থেকে ফেরার পথে এক ঘন্টা। ছুটির দিন বিকেল বেলা আসেন। পুরো ঘড়ি ধরা তিন ঘন্টা বসে থাকেন। ফেস্টিবল গুলোতেও আসেন। এ ধরেন পহেলা বৈশাখ, ফাল্গুন, দুই ঈদ মেয়েটার জন্মদিন। সবসময় একটা শাড়ি আর বেলীফুলের মালা নিয়ে আসেন। এ দুবছরে কতগুলো শাড়ি জমেছে।”

-“আমি একবার মেয়েটাকে দেখব প্লিজ। একবার নিয়ে যাবেন….

-“আপনি…

-“প্লিজ। এক্ষুনি হয়তো মেয়েটার সব আত্নীয়স্বজন চলে আসবে। তার আগে একবার প্লিজ…

-“কিন্তু আমরা এভাবে অচেনা কাউকে…

-“প্লিজ…

গলাটা ধরে এলো কাশফিয়ার।

-“ওকে। আসুন। আমি বলে দিব আপনি কোনো রিলেটিভস্।”

পা গুলো কাঁপছে কাশফিয়ার। তবুও সাহস নিয়ে ভেতরে গেল।বেডের ওপরে পা হতে মাথা পর্যন্ত সাদা কাপড় দিয়ে কাউকে ঢেকে রাখা হয়েছে।কাঁপা হাতে মুখের ওপর থেকে কাপড়টা সরালো কাশফিয়া। একটা নিষ্পাপ হাসি দিয়ে রয়েছে মেয়েটা। কাশফিয়ার চোখ থেকে দু ফোঁটা পানি গড়িয়ে মেয়েটার গালে পড়ল। হাত দিয়ে তা মুছে দিল কাশফিয়া। মাথার কাছে খুব সুন্দর একটা টেডিবিয়ার রাখা। তাতে লেখা, আই লাভ ইউ জুঁই। মেয়েটার নাম হয়তো জুঁই। একে একে সবকিছু নেড়ে চেড়ে দেখল কাশফিয়া।

-“কাউকে না কখন আমি এতটা ভালোবাসতে দেখি না। মেয়েটা মরে গিয়েও স্বার্থক। এক বিশাল আকাশ ভালোবাসা সাথে নিয়ে গেছে। বাই দ্য ওয়ে আপনি মি.অর্ণবের কি হোন?”

-“হবু স্ত্রী…

নার্স চোখ বড় করে কাশফিয়ার দিকে তাকাল। কিন্তু ততক্ষণে রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেছে সে।

-“শুনুন…

নার্সের ডাক আর কাশফিয়ার কানে পৌঁছালো না। কাশফিরার পেছন পেছন রুশাও দৌড় দিল।

-“কাশফু শোন?”

-“সব প্রেমিক খারাপ হয় না রে। সবার উদ্দেশ্য খারাপ থাকে না। আমি তোকে বলেছিলাম না আমি ভাগ্য করে ওকে পেয়েছি। আজ আবার প্রমানিত হলো আমার ভাগ্য কতটা ভালো। না হলে ও আমার জীবনে কখনও আসত না কখনও না…

-“কিন্তু তুই কোথায় যাচ্ছিস?”

-“তুই বাসায় চলে না। আমার একটা কাজ আছে শেষ করে আসছি।”

একটা সিএনজি ডেকে কারো সাথে কথা বলতে বলতে বেরিয়ে গেল কাশফিয়া। সিএনজিওয়ালাকে বারবার তাড়া দিচ্ছিল দ্রুত চালানোর জন্য।অপেক্ষার সময় যেন শেষ হতে চায় না। সিএনজি থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে দৌড়ে সামনের দিকে গেল কাশফিয়া। কিছুদূর যেতেই শ্রাবনের দেখা পেল সে। উদাস নয়নে আকাশ পানে তাকিয়ে আছে সে। শব্দহীনভাবে শ্রাবণের পাশে গিয়ে বসল সে।

-“আমার কিন্তু জুঁইকে বেশ হিংসে হচ্ছে। আমি যদি ওর জায়গায় থাকতাম….

আর কিছু বলতে পারল না কাশফিয়া। আকাশের থেকে দৃষ্টি নামিয়ে কাশফিয়ার দিকে ঘুরল শ্রাবন। কাশফিয়া কাঁদছে। নিজেকে আর আটকে রাখতে পারল না সে।কাশফিয়াকে জড়িয়ে চিৎকার দিয়ে কাঁদতে শুরু করল সে।চোখের পানি মুছে নিজেকে শান্ত করল কাশফিয়া।

-“একটু পর তো ওর দাফন-কাফন সম্পন্ন হবে। যাবে না তুমি?”

-“কি করে নিজের ভালোবাসাকে এভাবে মাটিচাপা দিয়ে দিব। তুমি কেনো এসেছ এখানে? এখানে এসে ওকে পেয়েছিলাম আমি আবার এখানেই হারিয়েছিলাম। তুমি চলে যাও। নাহলে ওর মতো তুমিও…

-“আমি হারাবো না। একবার চলো শেষবারের মতো দেখবে ওকে।”

-“ঐ যে দেখতে পারছো ঐ জায়গায়টায় ঠিক ঐ জায়গাটায় আমার জুঁই হারিয়েছিল। দেখতো পারছো তুমি।”

-“প্লিজ শান্ত হও। আমার সাথে এসো।”

জানাজা শেষে জুঁইকে মাটি দেওয়ার জন্য নিয়ে যাওয়া হলো। শেষ বারের মতো এক মুঠো মাটি হাতে নিল শ্রাবণ। চোখে তার অঘোরে পানি। শব্দ করে বলল, কোনো এক বসন্তে তুমি আমার জীবনে এসেছিলে, কোনো বসন্তে দূরে সরে গেছিলে আর আজ শেষ বসন্তে একবারে হারিয়ে গেলে।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত