একজন বাবা

একজন বাবা

স্যার আমার মেয়ের লাশটা দিয়ে দেন। লাশে কাটাকাটি করলে মেয়েটা কষ্ট পাবে। আমি বয়স্ক মানুষটির দিকে করুন দৃষ্টিতে তাকালাম। তার চোখ বেয়ে পানি পরছে। মানুষটির ধারণা আমার মতো একজন পুলিশের এস আই চাইলেই ময়নাতদন্ত ছাড়াই লাশটিকে দিয়ে দিতে পারবো। আমি হাত দিয়ে ইশারা দিয়ে শান্তনার জন্য বললাম, আপনার মেয়ের হত্যাকারীর শাস্তি হউক এটা কি আপনি চান না ? লোকটি চোখ মুছে দ্রুত গলায় বললো, জ্বী স্যার। চাই, অপরাধীর কঠিন শাস্তি চাই। একটু আগে যে লোকটি চোখ দিয়ে পানি ফেলেছে, মেয়ের খুনির শাস্তির কথা শুনে সেই লোকটি দ্রুত সহজ থেকে কঠিন হয়ে গেলো। সেই কঠিন চোখে একই সাথে ঘৃনা এবং ক্রোধ ফুটে উঠেছে।

স্যার, আমার মেয়েটা মৃত্যুর মতো অপরাধ করতেই পারে না! এর পেছনে কেউ না কেউ আছে, যে আছে সে মানুষ না। অমানুষটাকে ধরবেন তো স্যার ? আমি মাথা নিচু করে বললাম, দেখুন পুলিশের কাজ পুলিশ করবে। তবে আপনাদের কাজ আপনারা করতে হবে, তবেই সম্ভব। মানুষ একজীবনে কখনোই প্রিয় মানুষটাকে হাড়াতে চায় না। মেয়েটি তার একমাত্র মেয়ে। তার কাছে হয়তো মেয়েটি সবচেয়ে প্রিয় মানুষ ছিল। প্রিয় মানুষটির অপরাধীর শান্তির জন্য বাবার গভীর আগ্রহ ফুটে উঠেছে। তিনি চেয়ার থেকে উঠে আমার পায়ে জড়িয়ে ধরলেন।

আরে করছেন কি ? পা ছাড়েন। লোকটি নাছোড়বান্দা। আমি হাত দিয়ে ধরে দাঁড় করিয়ে বললাম, অপরাধীকে ধরতে কিংবা অপরাধীর অপরাধ শনাক্ত করতে ময়নাতদন্ত করতে হয়। মানুষটির চোখ দিয়ে আবারো পানি পরছে। পুলিশে চাকুরিতে জয়েনের পর এই ধরনের পরিস্থিতিতে আমাকে অনেকবার পরতে হয়েছে। প্রথম প্রথম এই ঘটনাগুলো আমাকে যন্ত্রনা দিতো, প্রচন্ড যন্ত্রনা। এখন আমার কাছে আগের মতো প্রচন্ড যন্ত্রনাদায়ক মনে হয় না। তবে মানুষটির চোখের পানি মনের ভেতরে যন্ত্রনার মতো অস্বস্তি তৈরি করে দিয়েছে। আমি কনস্টেবল হাবীবকে ডেকে লোকটিকে সাথে দিয়ে লাশটির কাছে গেলাম।

অল্প বয়সী মেয়ে, বয়স আঠারো কিংবা কুড়ি হবে। যতটুকু ফর্সা হলে একটি মেয়েকে রুপবতী বলা হয়, মেয়েটি তার চেয়ে ও ফর্সা। মেয়েটি ওড়না পেচিয়ে পাখার সাথে ফাঁস দিয়ে ঝুলে আছে। ঝুলে থাকার কারণে গালের একদিকে রগ ফুলে কালো হয়ে গেছে। আমি ডুকতেই হাবিলদার জসিম স্যালুট দিয়ে বললো, স্যার এটা আত্মহত্যা, এই যুগের মেয়েরা অনেক সাহসী। দেখলেন স্যার, কিভাবে ফাঁস লাগাইছে, মরণে ও ভয় নাই ! চুপ করো জসিম। জসিম চুপ হলো না। বিড়বিড় করে বললো, প্রেম-পিরিতির যুগ। ছেলের লগে হয়তো ঝগড়া হইছে, দিছে গলায় ফাঁস লাগাইয়া। জসিম শুনো, বকবক না করে তারাতারি পাখার বাধন খুলে লাশ নামাও।

ভিড় ঠেলে একজন মাঝবয়সী মানুষ আমার কাছে দৌঁড়ে আসলো। তার চোখে ভয়ের ছাঁপ। তিনি হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, স্যার আমি এই বাড়ির মালিক। বাড়ি ভাড়া দেওয়ার বয়সে কখনো এমন ঘটনা ঘটেনি। দেখলেন স্যার জীবনের মায়া ভুইলা গিয়ে কেম্নে আত্মহত্যার পথ বেঁছে নিয়েছে। মাইয়্যা মানুষের শরীরে এতো রাগ থাকলে হয় আমি বললাম, রাগ কিংবা ভালবাসা, তবে এই ধরণের মৃত্যুর কারণ খুঁজে বের করা খুবই কঠিন। বাড়ির মালিক আমাকে থামিয়ে দিয়ে কানের কাছে এসে বললো, স্যার আমার কোন সমস্যা হবে নাতো ? পৃথিবী খুবই স্বার্থেঘেরা জায়গা। যেখানে মানুষ লাশের সামনে দাঁড়িয়ে ও নিজের স্বার্থের কথা ভুলে না। আমি বরফ শীতল গলায় বললাম, টেনশনের কোন কারণ নেই। এটা আত্মহত্যা, হত্যার সামনে যখন আত্ম শব্দটা যোগ হয় তখন সকল দায়ভার লাশ নিজেই বহন করে! স্যার, ও স্যার। জসিমের শঙ্কিত গলা। আমি মোঁড় ঘুরে দ্রুত সামনে এগিয়ে যেতেই জসিম শীতল গলায় বললো, স্যার লাশের গায়ে পানি। লাশের তো পুরু শরীর ভিজে আছে।

ঘড়িতে রাত এগারোটা বেজে দশ মিনিট। লাশের বাবার বর্ননা অনুযায়ী মেয়েকে গলায় ফাঁস অবস্থায় রাত দশটা বাজে দেখেছে। এতো রাতে মেয়ে গোসল করার কথা নয়! যদি আত্মহত্যাই করতে হয়, তাহলে গোসল করতে হবে কেন ? প্রশ্নগুলো মাথায় আসতে পুরো শরীরটি একবার কেঁপে উঠলো। আমি ভালো করে লক্ষ্য করে দেখলাম, মেয়েটার পুরো শরীরটা এখনো ভিজে চুপসে আছে। বুঝাই যাচ্ছে ফাঁস দেওয়ার সামান্য কিছু সময়ের আগেই গোসল করেছে। একসময় মানুষ পুলিশ এবং লাশ দুটিকেই ভয় পেতো। এখন মানুষের মন থেকে সেই ভয়টি উঠে গেছে। যেখানেই পুলিশ দেখতে পাবে ঘটনার আসল কারণে জানতে জনতা সেখানেই ভিড় জমাবে। পাঁচ তলা বাড়িটির যতো ভাড়াটিয়া ছিল, সবাই আস্তে আস্তে ভিড় জমাতে শুরু করেছে। দেখা যাবে আর কিছুক্ষণ এখানে থাকলে ভিড় সামাল দেওয়াই কষ্টকর হয়ে যাবে। জসিমকে দিয়ে লাশ পাটিতে মুড়িয়ে দ্রুত গাড়িতে তুললাম।

লাশ নিয়ে থানায় আসতে আসতে রাত বারোটা বেজে গেছে। থানা থেকে প্রতিদিন রাত এগারোটায় বাসায় ফিরে যেতে হয়। ছোট মেয়ে তন্নী ও তার মা খাবার নিয়ে অপেক্ষা করে। যতোক্ষণ না যাবো মা-মেয়েই কেউ খাবে না! আমি চেয়ারে চুপচাপ বসে আছি। আমার পাশে মেয়ের বাবা ও বাড়িওয়ালা বসে আছে। লাশ নিয়ে আসার সময় সামান্য কিছু জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাদেরকে এনেছিলাম। তারা ও চুপচাপ বসে আছে। দশ মিনিট পর সেন্ট্রি এসে বললো, স্যার লাশ ময়নাতদন্তের জন্য রেডি। আপনি বললে শুরু করবে।

মোবাইলে ফোন বাজছে। তাকিয়ে দেখি তন্নী ফোন দিয়েছে। ফোন ধরে কি বলবো বুঝতে পারছি না। লাশ ময়নাতদন্তের অনুমতি দিয়ে বাসায় যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালাম। স্যার আমাদেরকে কি এখানেই থাকতে হবে ? বাড়িওয়ালার নরম গলা। বাড়িওয়ালাকে বললাম, চলেন আমার সাথে। আপনাকে বাসায় পৌঁছে দেই। বাড়িওয়ালাকে নিয়ে গাঁড়িতে উঠলাম। মেয়ের বাবাকে ও অনেকবার রিকোয়েস্ট করেছি বাসায় পৌঁছে দেওয়ার জন্য। তিনি শ্লেষা জড়ানো স্বরে বললেন, স্যার আমি এখানেই থাকবো, ময়নাতদন্ত শেষে মেয়ের লাশ নিয়ে তবেই বাড়ি ফিরবো।

আমি নরম গলায় বললাম, সবকিছু কমপ্লিট হতে সকাল হয়ে যাবে। আপনি চলুন আমার সাথে তিনি আসলেন না। মৃত্যুর পরে ও মেয়ের প্রতি বাবার ভালবাসা দেখে অভিভূত হয়ে ভাবলাম, শুধুমাত্র বাবার কষ্টের কথা ভেবে কোন মেয়ে যদি জীবনকে এগিয়ে নিতে চাইতো, তাহলে এগিয়ে যাওয়ার পথে হাজারো ব্যর্থতা তুচ্ছ মনে হতো….

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত