ঘুমটা ভেঙ্গে গেল ফোনের অসহনীয় আওয়াজে। মাঝে মাঝে ইচ্ছা করে ফোনটা সব সময় সাইলেন্ট রাখি কিন্তু কি করবো, নেহাত অফিসের ফোন আছে। তবে আমার ঘুম ভাঙ্গার কারন অফিস নয় বরং একজন পেইন। সেই পেইনের নামটা হলো তনু। তবে আমি তাকে পেইনই ডাকি। যাই হোক,এবার ফোনটা ধরা যাক নয়ত মহারানী একটু বেকেঁ বসতে পারে।
— হুমম তনু বলো।
— তিনটা ফোন দেওয়ার পর ফোন তুললে। এত যখন বিজি থাকো তাহলেফোনটা না ধরলেই পারতে।
— ওকে আগামীবার থেকে এটাই করবো।
— কি হয়েছে?
— না না কিছু না। তুমি বলতে থাকো আমি হজম করছি?
— হুমম, এবার শুনো ফেব্রুয়ারি তো চলেই আসলো। আমাকে নিয়ে শপিংয়ে যাবে না।
— ওই হ্যাপি নিউ ইয়ারে না ৭ হাজার টাকার শপিং করে দিলাম।
— তুমি এভাবে শপিংয়ের খোটা দিতে পারলে, যাও আর কথাই বলবো না। (কাদুঁ কাদুঁ ভাব)
— আরে কাদোঁ কেন?ওকে ওকে নিয়ে যাবো নে।
— হি হি হি লাভিউ বাবু
কথাটা বলেই ফোনটা রেখে দিলো। এই মেয়ের বাবু বাবু শুনতে শুনতে কবে জানি আমাকে আবার পলিওর টিকা নিতে যেতে হয়। সকল চিন্তা আপাতত বাদ দিয়ে বিছানা ছাড়লাম। তারপর ফ্রেশ হয়ে, খাওয়া দাওয়া করে অফিসের উদ্দেশ্যে বের হলাম। অফিসে বসে একটা ডিজাইন বানাচ্ছিলাম। তখনই আমার কলিগ তুহিন সাহেব আমার ডেস্কের সামনে একটা চেয়ার টেনে বসলেন। আমি ওনার দিকে তাকাতেই ওনি মৃদু একটা হাসি দিলো। তখন আমিই বললাম…
— কি ব্যাপার তুহিন সাহেব? মনে হচ্ছে কিছু বলতে চাচ্ছেন?
— আসলে রাজ ভাই, কিছু টাকা ধার হবে?
— সেটা না হয় হবে কিন্তু আপনার মুখে এমন কালো মেঘ কেন?
— আসলে হয়েছে কি তোমার ভাবির বায়না দিন দিন বেড়েই চলেছে?
— ভাবি? ভাবি আসলো কই থেকে?তুহিন ভাই আপনি তো বিয়েই করেন নি।
— আরে ভাই আমার গার্লফ্রেন্ডের কথা বলছি।
— হুমম সেটাই। তারপর বলেন?
— কি বলবো ভাই কষ্টের কথা?
এই যুগে গার্লফ্রেন্ড পালা আর একটা হাতি পালা এক ব্যাপার। শালার কোন ভাবেই তাদের সন্তুষ্ট করা যায় না। এক তো আমাদের উপর নজর দারি করবে আবার উনিশ থেকে বিশ হলে চোখের পানি দিয়ে ব্ল্যাকমেইল করবো। ওদের মুখে হাসি ফোটানো আর এভারেস্ট জয় করা আজকাল সমান ব্যাপার। ওদের মন কখন যে কি চেয়ে বসবে সেটা বুঝা মুশকিল।ওদের পছন্দের রংয়ের শার্ট পড়তে হয়। আবার কোন দিন একটু ভুল করে ওদের পছন্দের বাইরে চলে গেলে। ডায়লগ দিবো “তুমি আমায় একটুও ভালবাসো না, জানি তো “। আমি কোন কথা না বলে কাজ থামিয়ে দিয়ে তুহিন ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে রইলাম। আসলেই ওনি একটা কথাও ভুল বলে নি। আমি নিজেও একই রোগের রোগী।
— আচ্ছা তুহিন ভাই গার্লফ্রেন্ডের প্যারা থেকে মুক্তি পাওয়ার কোন পথ নাই।
— পথ জানা থাকে কি আমি তোমার কাছে টাকা ধার চাইতে আসি।
–সেটাই তো।
পকেট থেকে বের করে তুহিন ভাইকে ২ হাজার টাকা দিলাম। ওনি মাথায় হাত দিয়ে হাটতে হাটতে চলে গেল। সত্যিই তো গার্লফ্রেন্ডের প্যারা বলে কথা। তুহিন ভাইয়ের কথা গুলো যতই ভাবছি ততই তনুর কথা মনে পড়ছে। গতমাসে বাসায় ১৬ হাজার টাকা দিয়ে ছিলাম আর ৭ হাজার টাকা আমার পেইনের পিছনে খরচ হয়েছে। এবার জানি বাসায় কত দিতে পারি? না এবার এই প্যারা থেকে মুক্তি পেতেই হবে। কিন্তু সেটা কিভাবে?সামনে ফেব্রুয়ারি আসছে বলে কথা। মাঝে মাঝে ওই সকল ছেলেদের নিয়ে চিন্তা হয়, যারা বেকার কিন্তু প্রেম করে। আরে ভাই, এমন একটা তিমি মাছের বায়না চালাস কেমন করে? আমাকে তো কেউ একটু টিপস দে। কয়েক দিন পর,সকালে ঘুম ভাঙ্গলো তনুর ফোনে। মেয়েটা আমায় জ্বালিয়ে মারলো।
— হুমম তনু বলো(ঘুম ঘুম চোখে)
— ওই তুমি এখনো ঘুমাচ্ছো?
— তো বন্ধের দিন ঘুমাবো নাকি জেগে জেগে দিনের আকাশের তারা গুনবো।
— জোকস বন্ধ করো আর ১ ঘন্টার মাঝে রেডি হয়ে জিয়া উদ্যানে আসো। ওইখান থেকে যমুনা ফিউচার পার্ক যাবো।
— জানু নিউ মার্কেটে গেলে হয় না।
— না হয় না। তারাতারি আসতে বলছি,তুমি আসো।
— ওকে।
তনুর নাম নিয়ে মনে মনে নিজেকে কয়েকটা বকা দিয়ে বিছানা ছাড়লাম। শালার ফাটা কপাল আমার,প্রেম করার জন্য এই মেয়ে ব্যতিত আর কেউ জুটলো না। আজকাল জি এফ না থাকলে ক্ষেত পাবলিক আর জি এফ থাকলে (…..) বলবো না,বুঝে নেন।
সকালে কোন রকমে খেয়ে রওনা দিলাম জিয়া উদ্যানের দিকে। জিয়া উদ্দান এমন একটা জায়গা যেখানে একা গেলে নিজেকে নিজেই ক্ষিস্তি করবেন। চারপাশে শুধু কাপল আর কাপল। বাসে করে জিয়া উদ্যানে আসলাম। সকাল সকাল মানুষ একটু কম তবে যা আছে সবই স্কুল পালানো পোলাপান। ওরা যে বয়সে প্রেম শুরু করছে, আমি তো সেই বয়সে কম্বলের দৈর্ঘ্য আর প্রস্থ বের করতে চিন্তা করতে হতো। একা একা হাটতে লাগলাম। তনুকে ফোন দিতেই তনু বলল,”তুমি ১০ মিনিট বসো, আমি লিপস্টিকের লাস্ট টার্চটা দিয়েই আসছি। ” তার মানে ওই মাইয়া এখনো রেডিই হয় নি। ঈশ্বর জানেন আমাকে কতক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। আচ্ছা কেউ যদি জানেন তাহলে একটু বলবেন প্লিজ যে মেয়েদের ১০ মিনিট আসলে কয় ঘন্টায় হয়। দূরে একটা লোককে দেখলাম একা বসে আছে আর নিজের হাতের গোলাপ ফুল নিয়ে একটাই কথা বলে যাচ্ছে। প্রথমে পাগল ভাবলাম কিন্তু চেহারা আর ড্রেস দেখে এখন কৌতুহল জাগলো তাই সামনে এগিয়ে গেলাম। লোকটা আমাকে দেখে মনে হয় বিরক্ত হলো। আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল..
— ভাইয়া কি কিছু বলবেন?
— আসলে তেমন কিছু বলার নেই তবে আপনি ফুল হাতে নিয়ে ফুলের সাথেই কথা বলছেন।
— আরে এটা তো আমার জি এফ কে দিবো। আর এটা পাগলা বাবার ফু দেওয়া ফুল। যেন জি এফ আমার বশে আসে। কাউকে বলবেন না যেন।
— কেন ভাই?জি এফকে বশে আনা লাগবো কেন? এমন কি হইছে?
— ভাইসাব আর বইলেন না।আমি বিবাহিত কিন্তু আমার বউ আছে।
— ওরে শালা,তারপর মামা দুইটা চালাও কিভাবে?
— আরে মিয়া আগে শুনেন,পরে কমেন্ট করেন?
— ওকে তারপর?
— আমার বউ আছে কিন্তু আমি চাইছি একটা প্রেম করতে। মানে টু টাইমিং যাকে বলে কিন্তু আমার জি এফ কেমন করে যেন বুঝে গেছে আমার বউ আছে। এখন সে উঠতে বসতে আমার কাছে টাকা চায় আর না দিলেই বলে বউকে বলে দিবে। আর বউ জানলে আমি শেষ ভাই।
— একেই হয়ত বলে মাইনকা চিপায় পরা।
— হুমম
— আচ্ছা তাহলে আপনি আপনার জি এফকে এই তাবিজ পরা ফুল দেওয়ার ট্রাই করেন। আমি গেলাম?
— ওকে,কিন্তু ভাই একটা কথা?
— হুমম বলেন।
— ভাই ভুলেও প্রেম কইরেন না আর ভুলেও বিয়ার পর বউ থাকতে অন্য কারো সাথে প্রেম তো ভুলেও না।
— ভেবে দেখবো, টা টা লোকটাকে বিদায় দিয়ে চলে আসলাম। লোকটা আসলেই সেই মাপের চাপে আছে। হঠাৎ ফোনটা বেজেঁ উঠলো, তাকিয়ে দেখি তনুর ফোন।
— হুমম তনু, তমি কি চলো আসছো?
— না বাবু মাত্র বাসা থেকে বের হইছি। তুমি একটু বসো, আর মাত্র ২০ মিনিট লাগবে।
বলেই ফোনটা কেটে দিলো। এখন আমি হাসবো নাকি কাঁদবো সেটাই ভাবছি। প্রায় এক ঘন্টা যে মেয়ের লাগে শুধু লিপস্টিকের লাস্ট টাচ দিতে, তার সাথে কিভাবে ভবিষ্যৎ এর প্ল্যান করবো। একটা বেঞ্চে বসে বাদাম খেতে ছিলাম তখনই তনু এসে পাশে বসলো। একবার ওর দিকে তাকিয়ে আবার খাওয়ায় মন দিলাম।
— কি হলো রাজ?দেখেও যেন দেখছো না।
— না মানে লিপস্টিকের লাস্ট টাচ মানে টা বুঝার চেষ্টা করছি। আদৌ কি এক ঘন্টা লাগে লিপস্টিকের লাস্ট টাচ দিতে। যদি এক ঘন্টাই লাগে লাস্ট টাচ দিতে তাহলে ঠিক ঠাক লিপস্টিক দিতে কতটুকু সময় লাগতে পারে।
— দেখো রাজ এভাবে বলবে না। ভাল করে দেখো, আজ আমি অল্প মেকআপ করেছি।
–আজ রোদ না থেকে বৃষ্টি থাকগো তাকলে বুঝা যেত।
— কী????
— আরে চলো, দেরি হয়ে যাচ্ছে তো। তুমি তো যমুনা ফিউচার পার্কে যাবে।
— হুমম চলো।
গার্লফ্রেন্ডকে যতই খোচা মারো না কেন,একবার শুধু শপিং এর কথা বলে দেখো, ও তোমায় কত্তো ভালবাসবে। এয়ারপোর্টের বাসে করে যমুনা ফিউচার পার্কে আসলাম। বাস থেকে নামতেই গলাটা শুকিয়ে আসছে আর পকেটে বার বার হাত চলে যাচ্ছে। এখানে আসতেই যেন তনুর ভালবাসাটা বেড়ে গেলো। আমার হাত ধরে হাটতে লাগলো। যেন আমি হারিয়ে যাবো। শপিং মলে ডুকতেই ঠান্ডা আবহাওয়ার মাঝে আমি ঘামতে লাগলাম। আসলে যমুনা ফিউচার পার্ক শপিং মলে সব কিছুর দামই আমার কাছে দ্বিগুণ লাগে।
— রাজ হঠাৎ এমন চুপ হয়ে আছো কেন?
— আরে না, এমনি। তুমি দেখো।
তনু আমাকে সাথে নিয়ে একের পর এক দোকান ঘুরতে লাগলো। কিন্তু মেডাম পছন্দই করতে পারছে না। আমি শুধু উপরওয়ালার কাছে বলছি আজ যেন তনুর কিছুই পছন্দ না হয়। তখনই তনু বলে উঠলো…
— এই রাজ এদিকে আসো। দেখো এই ড্রেসটা কত্তো সুন্দর। আমি ড্রেসটা দেখার বদলে আগে প্রাইজটা দেখলাম। প্রাইজ ছিল ৩৯৯০ টাকা। বাহ,আর ১০টার জন্য ৪ হাজার বাকি রাখলো কেন?
— আমি এটা নিবো?
— আরে এটা ভাল না। দেখো রং চলে যাবে।
তখনি কোথা থেকে একজন সেলসম্যান এসে বললো “না মেডাম এই কাপড়ের কোন প্রকার রং যাবেন না।মেড ইন ইন্ডায়া ” বাহ্ কি টাইমিং এদের। ইচ্ছা করছে, দেই একটা চাপায়।তখনই তনু বলল…
— আমি এটাই নিবো। আমি আর কোন কথা শুনবো না।
— হুমম নাও নাও, যা ইচ্ছাই নাও।
— ও সত্যি বাবু। ঠিক আছে।
মুখের কথা মুখেই রয়ে গেল আর মেডাম চলে গেল অন্য ড্রেস দেখতে।আর আমি একটু পর পর আমার মানিব্যাগটার উপর হাত ভুলিয়ে যাচ্ছি। এমন ভাবে আরো ৪টা ড্রেস কিনলো আর আমি শুধু নির্বাক দর্শক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। মাঝে মাঝে প্রশ্ন করতে ইচ্ছা করে, মেয়েরা যে এত বড় ব্যাগ নিয়ে ঘুরে, আসলে ওই ব্যাগে থাকেটা কি? সব খরচ তো তো ওই আমাদের বাচ্চা ব্যাগটা থেকেই হয়। তনুর সাথে ঘুরতে ঘুরতে আমি ক্লান্ত।মেয়ের প্রথমে কিছু পছন্দ হয় না আর এখন যা দেখে তাতেই গলে গলে পড়ে। যেন বাপের টাকায় শপিং করতে আসছে। এখন বুঝতে পারছি ওই লোক কেন বউ থাকতে আরেক মাইয়ার প্রেমে পড়ছিল। যাই হোক,তনুর পিছনে থেকে ওর সব শপিংয়ে সাপোর্টই দিলাম। তনু তখন বলল…
— বাবু আমার হয়ে গেছে। এই চারটা ড্রেসই নিবো। এবার চলো কাউন্টারে।
— হুমম চলো।
পকেট থেকে মানিব্যাগটা বার করে মাত্র টাকা বের করতে যাবো তখনই ফোনের আওয়াজে ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। তার মানে এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিলাম। এখন মনে একটা শান্তি শান্তি ভাব আসছে। ফোনটা হাতে নিয়েই তাকিয়ে দেখি তনুর ফোন। এই মেয়েটা আমায় জ্বালিয়ে মারলো। এক তো স্বপ্নেও শপিং করায় আর এখনও ফোন দিয়ে এটাই বলবে মনে হয়।
— হুমম তনু বলো।
— ওই এত সকালে ঘুমিয়ে আছো নাকি?
— বন্ধের দিন আর কি করবো বলো?
— ১ ঘন্টার মাঝে রেডি হয়ে জিয়া উদ্যানে চলে আসো নয়ত আমাদের ফোন আলাপটা তোমাদের রান্না ঘরের গিন্নির কাছে চলে যাবে।
— ওই না।
— তাহলে সোনা বাবু তারাতারি আসো।
— হুমম।
ফোনটা কাটতেই অর্নি চা হাতে ঘরে প্রবেশ করবো। আমার দিকে চা বাড়িয়ে দিতে বলল,”কার ফোন ছিল?”।তখন মুখ ফসকেঁ বলে ফেললাম,”বসের সাথে একটু কাজ আছে,আর্জেন্ট ডেকে পাঠিয়েছি।”অর্নি স্বাভাবিক ভাবে বলল,”ওকে নাস্তা করে যাও।
অর্নি আমার বিয়ে করা বউ। তনুর প্যারায় পড়ে দিনকাল উচ্ছন্নে যাচ্ছিল। তখন বাবা মায়ের কথায় বিয়ে করি। একবার ভাবচ্ছিল তনুর কথা বাসায় বলবো কিন্তু এই মেয়ে যে পরিমান খরচ করে, সেই কথা ভেবে তনুর ব্যাপারটা বাসায় চেপে যাই। বিয়ের পর তনুর সাথে ব্রেকআপ করে ফেলবো সেটাই ভেবে ছিলাম কিন্তু টু টাইমিং করতে গিয়ে এমন ভাবে আমি ক্লিন বোল্ড হয়ে যাবে বুঝি নি। এখন কিভাবে যেন তনু আমার বিয়ের খবরটা পেয়ে গেছে। ও এখন কথায় কথায় ভয় দেখায়। আজ বুঝলাম ভোরের স্বপ্ন আসলেই সত্যি হয়। আর বিছানা ছাড়তে ছাড়তে ভাবতে লাগলাম কোন বাবার কাছে গেলে ফুঁ দেওয়া গোলাপ পাবো জি এফ বশ করার। আপনারা কেউ কি কোন বাবাকে রেফারেন্স করতে পারেন।