তন্নির চোখে জল

তন্নির চোখে জল

হ্যাঁ, এখন আমার সবকিছু মনে পড়ছে। কোচিংয়ে যাওয়ার জন্য সকালে ফার্মগেটের উদ্দেশ্য রওনা দিয়েছিলাম। বাস থেকে নামার পর মাথা চক্কর দিয়ে রাস্তায় পড়ে যাই। এর পর আর আমার কিছুই মনে নেই। কে আমাকে হাসপাতালে এনেছে সেটাও আমি জানি না। এখন আমার চাচাত ভাই বলছে আমাকে চারদিন আগে হাসপাতালে আনা হয়েছে। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে ঘটনাটা আজ সকালেই ঘটেছে।

আমি একটি মেয়ে হয়ে আমার ভালোবাসার মানুষের সাথে আরেকটি মেয়েকে কিছুতেই মেনে নিতে পারব না। রাতুল এতদিন আমাকে বলেছিল সোনালি শুধুই তার বন্ধু। আমিও মেনে নিয়েছিলাম, বন্ধু থাকতেই পারে।
কিন্তু কয়েকদিন আগে যখন লাবন্য, সুস্মিতা, তুলি সব বান্ধবীরা এসে বলতে লাগল, তন্নীরে তুই মনে হয় আর রাতুলকে তোর ভালোবাসা দিয়ে আগলে রাখতে পারলি না। তখনই হৃদয়টা কাচের টুকরোর মত ফেটে যাচ্ছিল। তারপর থেকেই শুনতাম, কেউ এসে বলত রাতুল আর সোনালীকে দেখলাম সিনেমা দেখতে গেল। কেউ এসে বলত সোনালীকে দেখলাম রাতুলের কাঁধে মাথা রেখে শুয়ে আছে। সবাই মোটামোটি শতভাগ নিশ্চিত রাতুল আর সোনালীর মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক চলছে। আর নিজেকে মানাতে পারিনি। রাতুল তাহলে কেন বলে সোনালী শুধুই তার বন্ধু? তাহলে সোনালীর সাথে যে সময় দেয় বা ঘুরাফিরা করে সেটা আমার সাথে হওয়ার কথা। কারণ তার ভালোবাসার মানুষ আমি।

ছুটে গিয়েছিলাম রাতুলের কাছে, অনেক ঝগড়া হলো দুজনের মধ্যে। সেই থেকে আজও পর্যন্ত রাতুলটা যোগাযোগ করেনি আমার সাথে। চিন্তায় ভাবনায় ঠিকমত খেতে পারি না। রাতে ঘুমাতে পারি না। চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে। পাগলের মত হয়ে গেছি আমি। যাকে এতটা ভালোবাসি তার কাছ থেকে এতটা কষ্ট, অবহেলা আর ছলনা সহ্য করাটা কীভাবে সম্ভব? অসুস্থ হয়ে গিয়েছি আমি। তবুও কোচিং বাঁধা দেইনি। সকালেও না খেয়েই কোচিংয়ের জন্য বেরিয়ে পড়েছিলাম। বাস থেকে নামার পরও আমি স্বাভাবিক ছিলাম। কিন্তু হঠাৎ একটি মেয়েকে রাতুলের সাথে রিক্সায় দেখলাম। মাথাটা কেমন যেন চক্কর দিল, রাস্তায় পড়ে গেলাম। এর পর আর কিছুই মনে নেই।

আজ দশদিন পর বাসায় ফিরলাম হাসপাতাল থেকে। ঐ দশ দিনের প্রথম চারদিন নাকি আমি বার বার স্মৃতি হারিয়ে ফেলেছিলাম। রাস্তায় যখন পড়ে গিয়েছিলাম তখন আমার মাথার পিছনের দিকটা ফেটে গেছে। ডাক্তার বলে দিয়েছে যদিও আমি স্মৃতি ফিরে পেয়েছি, তবুও আমার ভুলে যাওয়ার সমস্যাটা থাকবে। আমি অনেক কিছুই ভুলে যাই, মনে রাখতে পারি না। জীবনের ঘটে যাওয়া কিছু কিছু অংশ প্রতিদিন মুছে যাচ্ছে, মনে রাখতে পারছি না। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমার আর আমার ভালোবাসা রাতুলের কাহিনী ডায়রীতে লিখে রাখব, তাহলে ভুলে গেলেও আবার মনে রাখতে পারব।

ধীর গতিতে লেখা শুরু করলাম কলেজে চারদিনের দিন ক্লাসে হঠাৎ রাতুলকে দেখে চমকে গেলাম। রাতুল একই কলেজে আমার ক্লাসে এটা কী করে সম্ভব? ওর বাড়ি তো নরসিংদী, ঢাকায় কোথায় থাকে? আর এতদিন পরে দেখে কী করব কী বলব ঠিক বুঝে ওঠতে পারছি না। রাতুল মনে হয় আমাকে দেখেনি এখনো। দেখলে নিশ্চয় স্কুল জীবনের কথা মনে পড়ত। আমি তখন দশম শ্রেণীতে পড়ি। আমার বাড়িও নরসিংদী। রাতুল পড়ত কালীকুমার বয়েস স্কুল আর আমি গার্লস স্কুল, রাস্তার এপার আর ওপার।

তখনই আমি আবিষ্কার করলাম একটি ছেলে আমাকে অনুসরণ করে। স্কুলে আসতে যেতে পেছন পেছন হাঁটত। টিফিনের সময় রাস্তা পেরিয়ে এপারে চলে আসত। এসেই ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থাকত। তবে কখনো কিছু বলত না। রাতুল দেখতে অনেক সুন্দর। আমি তখন জানতাম না রাতুল কিসে পড়ত। তার বন্ধুরা নাম ধরে ডেকেছিল বলে নামটা এখনো মনে আছে আমার। ওর তাকিয়ে থাকাটা আমার কাছেও ভালো লাগত। আমার কিশোরী মনটাও রাতুলের মুখ থেকে কিছু শুনতে চাইত। কিন্তু সে শুধু বোকার মত তাকিয়েই থাকত। পরবর্তীতে এস. এস. সি পরীক্ষার পর আর রাতুলের খোঁজ পাইনি। আমি ঢাকায় চাচার বাড়িতে চলে এলাম।

কলেজে পরেরদিন আমি ইচ্ছে করেই রাতুলের আশেপাশে ঘুরে বেড়াতাম, কিন্তু সে তাকাত না। মনে হতো সে নিজেকে নিয়ে খুব ব্যস্ত। আশে পাশে কেউ আছে কিনা সেটা মনে হয় তার দেখার প্রয়োজন নেই। একসময় সে দেখেছে, কিন্তু সে অবাক হয়নি। সেই আগের স্বভাব, এখনো বোকার মত তাকিয়ে থাকে। এতদিন পর দেখা হলো, কোথায় তাড়াতাড়ি এসে কথা বলবে সেটা না করে শুধু তাকিয়েই থাকে। পরেরদিন রাতুলের তাকিয়ে থাকা দেখে কাছে এগিয়ে গেলাম, কিন্তু নিজে কিছুই বলছি না। হঠাৎ চোখের দৃষ্টি নিচে রেখে রাতুল বলছে…

—কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলে তুমি? আমি তোমাকে কত খুঁজেছি।
— আমি তোমাকে কোথায় খুঁজব? আমিও তো জানি না তুমি কোথায় থাকতে?
— তো ঢাকায় কোথায় এলে?
— চাচার বাড়িতে। তুমি কোথায় ?
— হোস্টেলে।

এমন কিছু স্বল্প কথা দিয়েই রাতুলের সাথে আবার নতুন করে পরিচিত হলাম। এবং এই কথাগুলোই প্রথম কথা ছিল, আগে শুধু তাকিয়ে থাকত। এর মাস ছয়েক পর হঠাৎ একদিন পাশে বসে অন্যদিকে তাকিয়ে রাতুল বলছে,,

— একটা কথা বলতে চেয়েছিলাম তোমাকে।
— বলো বলো (শুনার আগ্রহটা বেশি কাজ করছিল)
—না মানে তন্নী, তুমি আমাকে ভালোবাসতে পারবে?

আমি তোমাকে অনেক আগে থেকে সেই স্কুলে থাকতেই ভালোবাসতাম। এখন তোমাকে পেয়ে আর হারাতে চাই না।” আমি খুশিতে কী জবাব দিব বা বলব সব ভুলে গেলাম। এই কথাটা শোনার জন্য কত অপেক্ষা করেছি। এক মূহূর্তের জন্য নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ মনর হলো। রাতুল আবার বলছে,,

— কী হল তন্নী? তুমি কি আমাকে ভালোবাসতে পারবে না?
— হ্যাঁ অবশ্যই পারব।

বলেই চলে এসেছি। রাতুল অবশ্য ডাকছিল, “এই তন্নী, ভালোবাসতে পারলে আবার পালাচ্ছ কেন?” আমি যে কেন পালাচ্ছি আমি জানি। আমি এই খুশির অশ্রুজল আমিই দেখব শুধু আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে। এর পরের দিনগুলো অনেক আনন্দেই কেটেছিল। দুষ্টু মিষ্টি ভালোবাসায় ভরপুর ছিল দু’জনার জীবন। যত কঠিন মনের মানুষই হোক, প্রেমে পড়লে কাউকে ভালোবাসলে তার মধ্যে পরিবর্তন আসবেই। ভালোবাসার মত ভালোবাসলে অবশ্যই ভালোবাসা সুন্দর ও পবিত্র। পাগলের মতই ভালোবাসতাম রাতুলকে। মানুষের জীবনের সুখের দিনগুলো মনে হয় বেশি দিন থাকে না। পরীক্ষা দেয়ার পর রাতুল মেডিকেলে চান্স পাওয়ার জন্য চেষ্টা করতে লাগল। আমিও যতটা পারতাম উৎসাহ দিতাম। তখন সেই সময়ে কোচিং থেকে সোনালী নামের মেয়েটির সাথে রাতুলের পরিচয় হয়।

তারা নাকি ভাল বন্ধুও। কিন্তু হঠাৎ রাতুলের পরিবর্তন দেখে প্রায়ই বলতাম, তোমার বন্ধু আমার কাছ থেকে তোমাকে কেড়ে নিবেনা তো? তখন রাতুল বলত, “আমি তোমাকে কথা দিয়েছি আমি তোমার ছাড়া অন্য কারো নই। সোনালী আমার শুধুই বন্ধু” রাতুল কথা দিয়েছিল ঠিকই কিন্তু কথা রাখতে পারেনি। রাতুল আমার না সোনালীর হয়েছিল। রাতুল আজও জানে না রাতুলের সাথে ঝগড়ার পর থেকে দিনের পর দিন চিন্তা ভাবনায় না খেয়ে খেয়ে আমি অসুস্থ হয়ে পড়েছি। আর দিন দিন আমার জীবনের কিছু কিছু স্মৃতি ভুলে যাচ্ছি। চোখের জলই মনে হয় আমার ভালোবাসার প্রতিদান।

সাত মাস পর রাতুল আমার কাছে ছুটে এসেছে। আমার কাছে ক্ষমা চেয়েছে অসংখ্যবার। রাতুল আমাকে আগেরমত ভালোবাসতে চায়। সে তার ভুলের জন্য অনুতপ্ত। কিন্তু আমি রাতুলকে ফিরিয়ে দিয়েছি। সোনালী আর রাতুল একসাথেই মেডিকেল কলেজে পরীক্ষা দিয়েছে। কিন্তু সোনালী চান্স পেলেও রাতুল মেডিকেল কলেজে চান্স পায়নি। এর পর থেকেই সোনালী আস্তে আস্তে রাতুলের সাথে যোগাযোগ কমিয়ে দেয়। সর্বশেষ সম্পর্ক ছিন্ন। বাহ কী তাদের ভালোবাসা? ভালোবাসা তাদের কাছে কত সস্তা মনে হয়। চাইলাম পাইলাম, পেয়ে হারালাম, হারিয়ে আবার খুঁজলাম। ভালোবাসা তাদের কাছে কত সস্তা।

একবছর পরের ঘটনা আজ আবার বালিশ ভিজিয়ে কেঁদেছি আমি। আজ আমি রাতুলের সাথে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে ফেলেছি। সোনালীর কাছ থেকে রাতুল যখন আমার জীবনে ফিরে আসতে চেয়েছিল, তখন তাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম। এর পর থেকে বারবার রাতুল আমার কাছে ছুটে আসত তাকে ক্ষমা করে দেয়ার জন্য। তাকে ভালোবাসার জন্য। শেষ অবধি আমি রাতুলকে ক্ষমা করে দিয়েছিলাম। কারণ আমি যে রাতুলকে বড্ড বেশি ভালোবাসি।

ক্ষমা করে দেবার পর থেকে আবারো জীবনে রচিত হলো নতুন প্রেম কাহিনী। সব দুঃখ কষ্ট ভুলে আবারো ভালোবাসতে শুরু করেছি রাতুলকে। কিন্তু “চোখের জলে যার জীবন গড়া, দুঃখ তার দরজায় বারবার কড়া নাড়ে।” রাতুল একটি পার্টটাইম চাকুরী জোগাড় করে। সেখানকার এক মেয়ের সাথে রাতুল নতুন করে সম্পর্ক তৈরী করে।
এবারও রাতুল বলছে মেয়েটা তার শুধুই একজন বন্ধু। তবে যার ঘরে আগুন লাগে সে বিদ্যুৎ চমকালেও ভয় পায়। আমি সব খবর পেয়ে গেলাম। রাতুলের নতুন প্রেমের খবর সব জানার পরও রাতুল সব অস্বীকার করে। আমার সাথে রাগারাগি করে। পাল্টাতে থাকে আবার আগের মত করে।

গত পরশু সব আসল খবর জানতে পেরে আমি রাতুলের সাথে চিরদিনের জন্য সব সম্পর্ক ছিন্ন করে দিয়েছি। ভার্সিটির বান্ধবীরা আমাকে একা দেখলেই আমাকে সময় দেয়। আমাকে হাসানোর চেষ্টা করে। আর আমি বোকা মেয়ের মত ওদের জড়িয়ে ধরে বাচ্চা মেয়ের মত কান্না করে ফেলি। আমি কিছুতেই স্বাভাবিক হতে পারছি না। মাথাটা প্রায় সময় ব্যথা করে। ঔষধ খাওয়ার পরও একই অবস্থা। ডাক্তার বলেছে চিন্তা ভাবনা কমাতে। কিন্তু আমি তো তা কমাতে পারি না। জীবন পাতার অনেক স্মৃতিই আস্তে আস্তে ভুলে যাচ্ছি, কিছু মনে রাখতে পারি না।

আর আমি চেষ্টা করছি রাতুলকে যেন ভুলে যাই। কিন্তু ভুলতে পারি না। চোখ দুটো সারাক্ষন শুধু রাতুলকেই খুঁজে ফিরে। যে রাতুল কখনো আমার না, তাকেই ভুলতে পারি না। মনে পড়ে বার বার। এখন পড়তেও অনেক কষ্ট হয়। অনেক পড়া মনে রাখতে পারি না। তবে রাতুলটা ঠিকই মনের গহীনে আছে, তাড়াতে পারছি না। গভীর রাতে অন্ধকারে আমার দুই চোখে বৃষ্টি হয়। রাতুল কোনোদিনও জানতে পারবে না কিছু। কখনো বুঝবে না আমি যে রাতুলটাকে কত্ত ভালোবাসি। ” সব ভালোবাসা পূর্ণ পায় না। কিছু ভালোবাসা থাকে হৃদয়ের গহীন কোণে, আর কিছু ভালবাসা ঝরে পড়ে চোখের জল হয়ে।”

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত