নাট্যকার

নাট্যকার

আমি আর নিলয় ভার্সিটির নিম তলায় বসে বাদাম খাচ্ছি। আমাদের আশে পাশে আরো অনেকেই গ্রুপ করে বসে আড্ডা দিচ্ছে বা ক্লাসের পড়া বুঝে নিচ্ছে। আমাদের ভার্সিটির এই নিমটা অনেকটা বড় আর এর ছায়াও নির্মল শান্ত লাগে তাই ক্লাস শেষ একটু বসে রইলাম। একটু পরেই বাসায় চলে যাবো। ভার্সিটি জীবনটা দেখতে দেখতে ৩ বছরের উপর কেটে গেল। এখন তো মাত্র আর হাতে একটা বছর আছে তাই যতটা পারি ভার্সিটিতে সময় দেই। বসে বসে নিলয় আর আমি কত কথা বলছিলাম। এর মাঝে বাধাঁ হয়ে আসলো ঔন্দ্রিলা। ও হচ্ছে ২য় বর্ষের ছাত্রী। গত এক মাস হলো ও আমাকে জ্বালিয়ে মারছে। আর ওর জ্বালানোর কারন হলো ও আমায় ভালবাসে। কিন্তু আমার পক্ষে ওকে ভালবাসা একদমই সম্ভব না। ঔন্দ্রিলা আমার সামনে এসে দাড়ালো। তাই আমি বসা থেমে উঠে দাড়ালাম।

— কি হয়েছে? আবার এখানে কেন? গতকাল না তোমায় বললাম আমি অন্য একজনের সাথে রিলেশন করি কিন্তু আবার কি হলো?

— দেখো আমায় বার বার মিথ্যা বলবে না। তুমি যে কারো সাথে রিলেশন করো না আমি জানি।
— ওই দেখো এবার কিন্তু আমার রাগ হচ্ছে আর তুমি আমায় তুমি করে ডাকার সাহস পেলে কোথায়? তুমি জানো না আমি তোমার সিনিয়র।

— সিনিয়র দেখেই তোমার প্রেমে পরেছি আর প্রেমে পরলে তুমি করে বলতে হয়।
— দেখো আমি আর তোমাকে নিতে পারছি না। এবার এখান থেকে যাও নয়ত..
— নয়ত কী?
— নয়ত আমি এখান থেকে চলে যাবো।
— কে তোমায় ধরে রাখছে এখান থেকে যেতে? আর তাছাড়া তোমার তো ক্লাস শেষ তাই তুমি এখন বাসায় যেতেই পারো।

— ধুর তোমার সাথে কথা বলাটাই বৃথা। বলেই পাশ কাটিয়ে চলে যাবো তখন আবার ঔন্দ্রিলা পিছন থেকে ডাক দিলো।
— আরে রেগে চলে যাচ্ছো কেন?তোমাকে কিছু একটা দেওয়ার ছিল।
— কী?(ওর দিকে তাকিয়ে বললাম)

আমার দিকে একটা রঙ্গিন কাগজ এগিয়ে দিলো। বাহ্ বেশ তো, রঙ্গিন কাগজের উপর আবার রং করা রয়েছে। কিন্তু এতে লেখা আমি তোমায় ভালবাসি।এটা দেখেই রাগটা বেড়ে গেল।

— ওই এইসব কি?
— কেন পড়তে পারো না বুঝি?
— কেন পড়তে পারবো না, এই তো লেখা আছে আমি তোমাকে ভালবাসি?
— ও আমিও তোমায় ভালবাসি।
— ওই কি বাজে বকছো? আমি কি তোমায় প্রপোজ করলাম যে আমার প্রপোজের উত্তর দিচ্ছো?
— হুমম তাই তো কাগজটা পড়ে বললে।
— তুমি আসলে একটা মানসিক রোগী। তাছাড়া আর কিছু নয়।

আমি রাগ দেখিয়ে কাগজটা জমাট করে ঢিল দিয়ে ফেলে দিলাম। কোথায় পড়েছে দেখি নি তবে ঔন্দ্রিলার মনটা খারাপ হয়ে গেছে এটা বুঝলাম।আমি পাশ কাটিয়ে চলে আসতে লাগলাম। নিলয় আমায় বার বার বলতেছে আমি ঔন্দ্রিলাকে এতো অপমান করি কেন কিন্তু আমি কি করবো? আমার যে এইসব রিলেশনের প্রতি কোন টান নেই। ভার্সিটির গেটের সামনে আসতেই পিছন থেকে একটা ডাক শুনতে পেলাম ” ওই কালো শার্ট “। আর আমি তো কালো শার্ট পরেছি তাই পিছনে ফিরে তাকালাম। দেখি একটা কালো থ্রি পিছ পরা মেয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসছে আর ওর হাতে একটা কাগজ।আর কাগজটা চেনা চেনা লাগছে। আরে এটাই তো একটু আগে আমি ঢিল মারছিলাম। মেয়েটা আমার সামনে এসে আমায় পা থেকে মাথা অবধি ভাল করে দেখে নিলো। তারপর আমার দিকে কাগজটা এগিয়ে দিয়ে বলল…

— এটা কি?
— কেন জানেন না? ছোট থেকে কি লেখাপড়া করেন নি? বই,কলম,খাতা এইসব বুঝি চিনেন না। এটা একটা কাগজ।
— আমি এইসব বলছি না। এতে কি লেখা?
— আমি তোমাকে ভালবাসি।
— আপনি কোন সাহসে আমায় ভালবাসার অফার দেন।নিজেকে কি ভাবো হে?
— আরে আপনাকে…
— আমাকে কি হে?

আর কখনো যদি এইসব কাগজ দিয়েছো তো আপনাকে কষিয়ে একটা চড় দিবো।
বলেই হনহন করতে করতে চলে গেল। আচ্ছা এটা কেমন হলো? আজ কার মুখ দেখে যে ঘুমটা ভাঙ্গছে। আমি ঔন্দ্রিলাকে যে কারনে বকলাম ঠিক সেই কারনেই আমিও বকা খেলাম তবে বিনা দোষে। আর এই ফাজিল মেয়েটা তো বুঝতেই চাইলো না আমি বলতে চাইছিলাম ” আপনাকে আমি এটা দেই নি “। কিন্তু এই মেয়ে তো কিছু শুনলোই না বরং একাই বকবক করে চলে গেল। আর এই দিকে নিলয় হাসতেছে। মনটা বলছে ওর দাতঁ গুলো ভেঙ্গে দেই। শুধু শুধু এত্তো গুলো কথা শুনতে হলো।

এভাবে কয়েকটা দিন কেটে গেল। তবে ঔন্দ্রিলা আমার পিছন ছাড়ছে না আর ওই দিকে ওই মেয়ের সাথেও মাঝে মাঝে আমার দেখা হচ্ছে আর ওই মেয়ে শুধু শুধু আমায় দেখলে চোখ গরম দেখায়। একদিন কিছু বই নিয়ে আমি লাইব্রেরী ভবন থেকে বের হয়ে আমার ক্লাস রুমের দিকে যাচ্ছিলাম আর সেই ঔন্দ্রিলা এসে আমার পথ আটকে দাড়ালো। দেখে মনে হচ্ছে ওর মন খারাপ আর আমায় সরি বলবে। হয়ত আর ডিস্টার্ব করবে না বলে এসেছে। আমি বললাম..

— কি হলো?
— কিছু কথা ছিল।
— হুমম বলো।
— আচ্ছা আমায় এতো এড়িয়ে চলো কেন? জানো আজ পর্যন্ত আমি কয়টা প্রপোজ পেয়েছি।
— তাহলে যাও রিলেশন করো।
— না সব রিজেক্ট করে দিয়েছি।
— বেচেঁ গেল ওই ছেলে গুলো, যাদের তুমি রিজেক্ট করেছো। নয়ত ৫ দিন রিলেশন করে ওরা তোমায় রিজেক্ট করতো।

— রাজ এবার বেশি বেশি হচ্ছে।
— ও মা তুমি বুঝি আমাকে বিরক্ত কম কম করো।
— আর বিরক্ত করবো না কিন্তু আমার একটা শর্ত রাখতে হবে?
— কি শর্ত?
— আমি তোমায় একটা জিনিস দিবো। যদি তুমি সেটা গ্রহন করো তাহলে তোমায় আর বিরক্ত করবো না।
— ওকে কি দিবে তারাতারি দাও?
এটা বলতেই ঔন্দ্রিলা আমার দিলে একটা গোলাপ বাড়িয়ে দিলো। আর আমি পুরো শকড। এটা কি হলো? এ মেয়ে তো হেব্বি চালাক। তখন ঔন্দ্রিলা আবার বলল..

— কি হলো নাও?
— গোলাপটা নিলে আর বিরক্ত করবে না তো।
— একদমই না।

আমি ওর হাত থেকে খুব স্বাভাবিক ভাবে ফুলটা নিলাম। কিন্তু আমি ফুলটা নেওয়ার সাথে সাথে ঔন্দ্রিলা লাফিয়ে উঠলো। আমি ওর দিকে তাকাতেই ও হাসতে হাসতে পাশ কাটিয়ে লাইব্রেরীতে চলে গেল আর আমি সামনের দিকে যেতে লাগলাম। কিছুটা সামনে এসে ফুলটাকে লক্ষ্য করে দেখি ফুলের পাপড়ি গুলোতে লেখা আছে। কি লেখা পড়ার চেষ্টা করায় বুঝলাম যে ” আই লাভ ইউ আর বেশি বেশি ডিস্টার্ব করবো “। এটা দেখে মাথার রক্তই গরম হয়ে গেল আর ফুলটা ঢিল মারলাম। কিন্তু কথায় আছে না ” যেখানে বাঘের ভয় সেখানে সন্ধ্যা হয় “। ঠিক ফুলটা গিয়ে একটা মেয়ের উপর পরলো আর মেয়েটা আগের মেয়েটাই। যে আমায় গতবার এই কাজের জন্যই ইচ্ছা মত কথা শুনিয়েছে। আমি ডানে বামে না তাকিয়ে সোজা হাটাঁ দিলাম। গতবার তো সাথে নিলয় ছিল। কিছু হলে সামলে নিতে পারবো কিন্তু এখন তো আমি একা আর মেয়েটা যদি আমায় কিছু বলে বা অপমান করে তাহলে তো সমস্যা।
আমি চলে যেতে চাইলেও মেয়েটার ডাকে পিছন ফিরতেই হলো…

— আচ্ছা আপনি আমায় বিরক্ত কেন করছেন বলেন তো? গতবার কাগজ আর আজকে ফুল। তাও বার বার ঢিল মারলেন। এতে কি প্রমান করতে চান? যদি আপনি আমায় ভালই বাসেন তাহলে শুনেন এইসব আমার পক্ষে করা সম্ভব না।

— আসলে… ( কিছু বলতে না দিয়ে থামিয়ে দিলো)
— থাক আর কিছু বলতে হবে না। আপনার মত এমন ছেলেদের আমার চেনা আছে। প্রথমে মেয়ে পটাবেন আর তারপর মেয়ে রাজি হলে মেয়ের মন নিয়ে খেলবেন।
— ওই আমি এমন না।
— তাহলে তো ভাল কিন্তু আপনার নামটা কি?
— আমি রাজ।
— ও ভাল আর হ্যাঁ আমার নাম নিরু।

মেয়েটা আর না দাড়িয়ে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। আচ্ছা আমার সাথে এইসব কি ঘটছে। আমি তো ইচ্ছা করে কিছু করছি না। ওরে ঔন্দ্রিলা এমনি তোমার পেইন সামলাতে পারি না আর এই নিরুর ঝাড়ি কেমনে সামলাবো। এভাবে অনেক গুলো দিন কেটে গেল।তবে এর মাঝে ঔন্দ্রিলা অনেক সিরিয়াস হয়ে যাচ্ছে। আজ বসন্ত উৎসব আর আমাদের ভার্সিটিতেও উৎসব লেগেছে। মেয়েরা বাসন্তি রংয়ের শাড়ী আর ছেলেরা একই রংয়ের পাঞ্জাবীতে ভার্সিটির চেহারাই যেন বদলে গিয়েছে। আমিও আজ পাঞ্জাবী পরেছি তবে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছি। আর ভার্সিটিতে সকাল থেকে একটা অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে। অনেকেই যার যার মত গান,নাচ বা নাটকে অংশ গ্রহন করছে। তাই আমিও বন্ধুদের কথায় একটা গান গাইলাম। তবে যখন গান গাইছিলাম তখন কাউকে লক্ষ্য করে গান গাই নি। মঞ্চ থেকে নেমেই বন্ধুদের কাছে যাবো তখনই সামনে এসে দাড়ালো নিরু। বাহ্ আজ নিরুকে তো বেশ লাগছে। কিন্তু আজ তো আমি নিরুকে ঢিল মারি নি কিন্তু ও আমার কাছে কেন?তখন নিরু বলল…

— বাহ্ বেশ গাইলেন তো।
— ধন্যবাদ তবে শুধু চেষ্টা করলাম। আর আপনাকে শাড়ীতে বেশ লাগছে। কিন্তু আজ আমি তো আপনাকে কোন ভাবে বিরক্ত করি নি তবে আপনি আমার সামনে কেন?
— কেন আপনার সাথে কথা বলতেও বুঝি আপনার ঢিল পাওয়ার অপেক্ষায় থাকতে হবে?
— আরে না
— আমি আসলে আপনার গানের জন্য ধন্যবাদ দিতে আসলাম।
— ওকে ধন্যবাদ দিতে হবে না তবে স্বাগতম।
— আচ্ছা আরেকটা কথা,আমরা কি ফ্রেন্ডশীপ করতে পারি?
— মনে হয় না কারন আমি আপনার বয়সে বড় হতে পারি।
— তো কি হয়েছে?
— ওকে ফ্রেন্ড।

এভাবে নিরুর সাথে আমার ফ্রেন্ডশীপ তৈরি হয়ে যায় আর কথা বার্তা,শেয়ারিং, কেয়ারিং চলতে থাকে। তবে আমি শুধু মন থেকে ওরে ফ্রেন্ড ভেবে কথা বলি কিন্তু অন্য দিকে ঔন্দ্রিলার পাগলামি চলতে থাকে। আমাকে আর নিরুকে কথা বলতে দেখলে ওর যেন শরীরে আগুন জ্বলে। আর আমায় ইচ্ছা মত কথা শুনিয়ে দেয়। নিরুর সাথে আমার বন্ধুত্বটা ফোন আদান প্রদানে চলে যায় আর কথা গুলো আপনি থেকে তুমিতে চলে আসে । একদিন রাতে শুয়ে আছি তখন নিরুর ফোন আসলো আর আমিও রিসিভ করলাম…

— হুমম নিরু বলো।
— এতো রাত হয়েছে। এখনো ঘুমাও নি নাকি জি এফের সাথে ফোনে কথা বলছিলে।
— আরে না। আমার ঘুমাতে একটু লেটই হয়।
— আচ্ছা যাই হোক, রাজ তোমার কাছে রিলেশন মানে কি?
— রিলেশন মানে দুইটা মনের মিল। কিছু অনুভব আর কিছু অনুভূতি। তবে সব কিছুতে দুইজনের মত থাকতে হবে। তবে এক তরফা রিলেশন গুলো অযথা কষ্ট।

— হুমম ঠিক । আচ্ছা রাজ তুমি কাউকে ভালবাসো না।
— ওই অনেক রাত হয়েছে। এইসব প্রেম পিরিতের স্বপ্ন দেখা বন্ধ করে লেখাপড়ায় মন দাও।
— হুহ ওকে শুভ রাত্রি ।

নিরুর কথা বার্তায় কেমন যেন ঔন্দ্রিলার স্পর্শ পাচ্ছি। যা আমি কখনো চাই না আর রিলেশনে তো আমি জড়াতেই পারবো না। যাই হোক, দুইজনকে বুঝিয়ে দিতে হবে সব কিছু। সকালে ভার্সিটি এসেই ঔন্দ্রিলার ভবনের সামনে দাড়িয়ে আছি। আমাকে দেখে তো ঔন্দ্রিলা পুরো অবাক। ও আমার সামনে এসে কিছু বলার আগেই আমি বললাম…

— কিছু বলার দরকার নেই। যদি আমায় একটু সময় দিতে পারো তাহলে আমার সাথে চলো।

ও আমার কথা মত কিছু বলল না বরং বাচ্চা মেয়ের মত আমার পিছু পিছু আসলো। আমি নিরুকে ফোন দিয়ে ভার্সিটির ক্যান্টিনে আসতে বললাম আর ঔন্দ্রিলাকে নিয়ে ক্যান্টিনে গেলাম।একটু পর নিরুও চলে আসলো। এখন দুইজনই আমার দিকে তাকিয়ে আছে।তারপর আমি বললাম…

–ঔন্দ্রিলা আমায় লাভ করো আর নিরুও হয়ত মনে মনে আমায় পছন্দ করো যা আমার ধারণা। কিন্তু এখানে দুইজনকে ডেকে আনার কারন হলো আমি আগেই একটা রিলেশনে জড়িত। আমার কথা শুনে দুইজনেই শব্দহীন হয়ে গেল। তারপর আমি আমার জীবনের কাহিনীটা বলতে শুরু করলাম…

তখন আমি কলেজে পড়ি আর বাবার সরকারী চাকরীর জন্য আমাদের পরিবারটা বদলি হয়ে আগ্রাবাদে চলে আসে। এতে আমার লেখাপড়ার সমস্যা দেখা দেয়। তাই আমাকে চট্টগ্রাম থেকে ট্রান্সফার করে অাগ্রাবাদের একটা কলেজে ভর্তি করে দেয়। বাবা ৫ তলা একটা বাসার ২ তলার একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নেন। যেহেতু এখানে কাউকেই চিনি না তাই রুম থেকে বের হই না। শুধু প্রয়োজন মত কলেজ আর বাড়িই ছিল আমার পথ চলা। একদিন সন্ধ্যার দিকে আমার মনটা বড্ড খারাপ ছিল। আগের বাসার কথা আর বন্ধুদের অনেক মনে পড়ছে তাই ভাবলাম একটু এই বাসার ছাদ থেকে ঘুরে আসি। এতে মনটাও ভাল হবে আর কারো সাথে পরিচয় হলেও হতে পারে। তাই মাকে বলে ছাদের দিকে গেলাম। আমি ছাদে আসতেই একটা টিয়া পাখি কি যেন বলতে লাগলো?টিভিতে অনেক পাখিকে কথা বলতে দেখেছি কিন্তু বাস্তবে এই প্রথম দেখলাম। তাই আমি পাখির খাচাঁর সামনে যেতেই একজন বলে উঠলো “Don’t touch “। কথাটা শুনেই আমি পাশে তাকিয়ে দেখি একটা মেয়ে গিটার হাতে বসে আছে। তখন আমি বললাম…

— পাখিটা কি আপনার?
— হুমম তাই তো জানতাম কিন্তু আপনি কে? এই বাসায় আগে কখনো দেখি।
— ২ তলায় নতুন ভাড়া এসেছি।
— ও আচ্ছা।
— আচ্ছা আপনার পাখিটা কি কথা বলতে পারে?
— হুমম কিন্তু সবার সাথে বলে না।
— ও আচ্ছা, তা আপনি কি গিটার বাজাতে পারেন?
— না তবে এটা আমার ভাইয়ের গিটার আর ছবি তোলার জন্য এনেছি।
— ও আচ্ছা।
— ওই আপনি এতো বেশি প্রশ্ন করছেন কেন?
— কোথায় বেশি প্রশ্ন করলাম? এখানে নতুন তো তাই একটু জানতে চাচ্ছি।
— ও ঠিক আছে ।

তারপর আর কথা না বলে আমি ছাদ থেকে বাইরের পরিবেশটাকে দেখে নিচ্ছি। আর মেয়েটা গিটারে টুং টাং আওয়াজ করছে। যদিও পারে না তবুও চেষ্টা করছে। বাতাসে মেয়েটার চুল গুলো এলোমেলো করে দিচ্ছে আর আমি এক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম।

— এই যে অমন করে কি দেখছেন?
— না কিছু না। (মেয়ের কথায় ভ্রম কাটলো)

আবার অনেকটা চুপচাপ হয়ে গেলাম। ভাবলাম নিচে চলে যাই কিন্তু তখনই মনে হলো মেয়ের নামটাই তো জানা হয় নি। তাই কিছু না ভেবে বললাম…

— আচ্ছা আপনার নামটা কী?
— ওই নাম দিয়ে আপনার দরকারটা কি আর আপনি এত্তো প্রশ্ন কেন করছেন?
— সরি আচ্ছা আমি নিচেই চলে যাই।

মেয়েটা অনেক শয়তান। একটু ভদ্রতার সহিত কথা বললে কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেত।আমিও আর কথা না বলে নিচে দিকে যেতে যাবো তখন মেয়েটা ডাক দিলো…

— এই যে শুনেন
— হুম।
— আমার নাম শামা।
— ও আমি রাজ

এরপর আর কথা না বলে চলে আসি। যতটা ফাজিল ভেবে ছিলাম ততটা ফাজিল না তবে ওতোটাও ভাল না। এই দিকে তো কাউকে চিনি না। অন্তত কারো সাথে চেনা পরিচিত হওয়া উচিত।

সকালে কলেজের ড্রেস পরে কলেজের যাওয়ার জন্য বের হতে যাচ্ছি। নিচ তলা দিয়ে বের হতেই মাথার উপর এসে পানি পরলো আর আমি তো ভিজে গেলাম। উপরে তাকিয়ে দেখি তিন তলার বেলকনি থেকে মেয়েটা জিব্বায় কামড় দিয়ে তাকিয়ে আছে। আমি কিছু বলতে যাবো তখনই মেয়েটা দৌড়ে রুমে চলে গেল। বেশ ফাজিল মেয়ে তো। নূন্যতম সরি বলার দরকার মনে করলো না। প্রথম দেখায় আমার সাথে ভাব নিলো আর এখন এই অবস্থা। সামনে আমার কপালে কি আছে উপরওয়ালাই জানে। এরপর রুমে গিয়ে ড্রেস বদলে কলেজে চলে গেলাম। ওইদিন রাতে ছাদে গিয়ে চাদঁ দেখছিলাম। হঠাৎ শামার কথায় পিছনে ফিরলাম…

— চাদঁ দেখছেন বুঝি।
— হুমম
— আমি শুনেছি যদি কারো মন খারাপ থাকে তাহলে সে নাকি চাদঁ দেখে।
— কিছুটা সত্য তবে মন ভাল থাকলেও চাদঁ দেখে।
— হুমম ঠিক তবে যদি মন ভাল থাকায় চাদঁ দেখে তাহলে তার মুখে হাসি থাকার কথা কিন্তু আপনার মুখে তো হাসি নেই।

— আসলে পুরান বন্ধুদের কথা খুব মনে পরছে। এখানে এসে এখনো কোন বন্ধু পাই নি আর আপনার সাথে ক্রমাগত ভুল বুঝাবুঝি চলছে।

— ও আচ্ছা সকালে এই পানি ফেলার জন্য সরি। আসলে বেলকনির ফুলের টপ গুলোতে পানি দিতে গিয়ে ভুলে পানিটা বাইরের দিকে পড়ে গেছিল।

— ঠিক আছে।
— এখনো কি আমার উপর রাগ করে আছেন?
— না তো, আমার মন খারাপ থাকলে আমি কম কথা বলি।
— ও আচ্ছা আমরা কী বন্ধু হতে পারি?
— হুমম তবে আপনি না ডেকে তুমি করে ডাকলে খুশি হবো?
— আচ্ছা।

শুরু হয়ে যায় শামার সাথে আমার বন্ধুত্বের পথ চলা। ও অনেকটাই অলস তবে ভাল কবিতা বলতে পারে। এভাবে আমাদের মাঝে অনেকটা সময় পার হয়ে যায়। এই এলাকার মাঝেও আমার অনেক বন্ধু হয়ে যায়। দেখতে দেখতে এইচ.এস.সি পরীক্ষাটা চলে আসে আর শামাও পরীক্ষার্থী ছিল। দুইজনে একসাথে বসে লেখাপড়া করতাম আর অনেক দুষ্টামী করতাম। এভাবে আমাদের পরীক্ষাটাও চলে গেল। একদিন ছাদে বসে বসে আমি শামার টিয়া পাখির সাথে কথা বলছি আর শামার ছাদে আসার জন্য অপেক্ষা করছি। একটু পরেই শামা আসলো আর আমাকে বলল…

— রাজ কিছু কথা ছিল তোমার সাথে?
— হুম বলো।আমাকে কিছু বলতে গেলে বুঝি তোমার পারমিশন প্রয়োজন।
— না তবে কথাটা খুব সিরিয়াস।
— ওকে আমিও সিরিয়াস। বলো কি বলবে?
— বাসায় আমার বিয়ের কথা চলছে। হয়ত ভাল পাত্র পেলে বিয়ে হয়েও যেতে পারে।
— ( কোন কথা বলতে পারলাম না। কোথায় যেন আটকে গেলাম)
— কিছু বলবে না।
— কি বলবো? বিয়ে তো খুব ভাল কথা।
— হুমম ঠিকই বললে।

আমার উপর রাগ দেখিয়ে শামা চলে গেল তবে মনে হলো শামা কান্না করছিল। এভাবে কয়েকটা দিন চলে গেল।এর মাঝে প্রায় ২ মাস কেটে যায়। শামার সাথে আমি ঠিক মত কথা বলি না। আসলে এখন মাত্র কলেজ লাইফ শেষ করেছি। এখনো কোন ভার্সিটিতে ভর্তি হই নি আর এখনই শামার বিয়ের কথাটা আমি মেনে নিতে পারি নি। সত্যি বলতে আমিও শামাকে ভালবাসি তবে বুঝাতে পারছি না আর বলতেও পারছি না। আমি পরিবারের কথা ভেবে চুপ হয়ে থাকি। ইচ্ছা ছিল কোন ভার্সিটিতে টিকলে আমি শামাকে বলবো আমি শামাকে কতটা ভালবাসি।

কিন্তু একদিন যখন আমি ভার্সিটি ভর্তি পরীক্ষার কোচিং করে বাসায় ফিরছিলাম তখন দেখি শামা একটা ছেলের কাধেঁ মাথা দিয়ে রিকশা দিয়ে যাচ্ছে। শামার বিয়ে কি ঠিক হয়ে গেল নাকি। অনেক গুলো প্রশ্ন মাথায় চলতে লাগলো। বাসায় এসে মাকে বললাম শামার বিয়ের ব্যাপারে কিছু জানে কি না? মা বলল ওনি এইসব কিছু জানে না।
তাই রাতে ছাদে অপেক্ষা করতে লাগলাম শামার। প্রায় এক ঘন্টা অপেক্ষা করার পর যখন ভাবলাম চলে যাবো তখনই শামা আসলো তবে ও ফোনে কথা বলতে বলতে। বাহ্ শামা ফোনও কিনেছে কিন্তু আমায় কিছু যানালো না। এক প্রকার রাগ হলো। এরপর শামা ফোনে কথা বলা শেষ হলে আমার দিকে তাকালো আর আমি বললাম…

— শামা তোমার কি বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে?
— না তো কেন?
— আজ দেখলাম একটা ছেলের সাথে তোমাকে। তার কাধেঁ মাথা দিয়ে আছো।
— ও আচ্ছা, ও হলো সৌমিক আর ও আমার বয়ফ্রেন্ড।
— তোমার বয়ফ্রেন্ড আছে আর আমি ভাবলাম…
— তুমি ভাবলে আমি তোমায় ভালবাসি আর ওই দিন তোমায় বিয়ের কথা বলে ছিলাম তোমার মনের কথা জানার জন্য কিন্তু আমি তো অনেক আগে থেকেই রিলেশনে আছি। ওর কথা গুলো আমার খুব খারাপ লাগে আর আমি রাগে শামাকে একটা চড় মেরে বসি।

— কথা গুলো বলতে তোমার লজ্জা করে নি আর আমি তোমার কি ক্ষতি করেছি যে আমার ইমোশন নিয়ে মজা করলে। আমি তো সত্যিকারের ভালবাসতাম। তোমার মত মেয়ের জন্য আজ মেয়ে সমাজের এতো খারাপ অবস্থা।
আমি কথা গুলো বলে ছাদ থেকে চলে আসি। এরপর আর কখনো শামার সামনে যাই নি। ওরে দেখলেও অন্য দিকে তাকিয়ে চলে যেতাম। আর শামার উপর রাগ দেখিয়ে ভার্সিটি ভর্তি পরীক্ষায় জোর দেই আর ভাগ্য সহায় থাকায় টিকেও যাই। এরপর আর কখনো কোন মেয়েকে ভালবাসতে পারি নি আর কখনো পারবোও না। আমার কথা শেষ হতে ঔন্দ্রিলা আর নিরু চুপ করে বসে আছে তবে নিরুর চোখ দিয়ে পানি পরছে। মনে হচ্ছে ওর জীবনের কোন অতীত মনে পরে গেছে। যা ও ভুলে ফেলে এসেছে। আর কোন কথা না বলে ঔন্দ্রিলা আর নিরু আমার সামনে থেকে উঠে যে যার মত চলে গেল।

ওরা চলে যেতেই আমার পিছনের ছিটে বসা একটা মেয়ে এসে আমার সামনে বসলো আর আমার দিকে চোখ বাকিঁয়ে তাকিয়ে মুচকি একটা হাসি দিলো। আর এই মেয়েটা হলো শামা। এতখন আমার জীবনের গল্প বলে ঔন্দ্রিলা আর নিরুকে যে রাজ আর শামার গল্পটা বললাম এটা আসলে আমার বন্ধু শান আর এই নিরুর গল্প। তাই গল্পটা বুঝতে পরে নিরু কেদেঁ দিয়েছে। এখন যদি নিরু সত্যি শানকে বুঝতে পারে তাহলে হয়ত শানের জীবনে ফিরার চেষ্টা করবে। কারন শান এখনো নিরুকে ভালবাসে। আর আমার সামনে বসা শামা হলো আমার ক্লাস মেট। ও আমায় বলল…

— বাহ্ বেশ ভাল গল্প সাজাতেঁ পারো তো।
— শুধু গল্প নয় বরং নাটকও করতে পারি।
— এখানে যে ঔন্দ্রিলাকে দেখলে এটা আমার কাজিন। ওর সাথে প্লেন করে নিরুকে আমি ফাসাঁই। আর বার বার দেখে দেখে ওর দিকে ঢিল মারতাম। আসলে নিরুকে বুঝাতে চেয়ে ছিলাম সত্যিকারের ভালবাসা আজও তার জন্য অপেক্ষা করে আছে। এখন যদি নিরু বুঝতে পারে তো ভাল।

— বাহ্ রাজ তোমার তুলনা হয় না। তবে নিরু আর শানের গল্পে এই আমার নাম শামা না লাগালেও পারতে।
— হুমম ঠিকই বললে। আমি তো গত তিন বছর ধরে অন্য কোন মেয়ের সাথে প্রেম করি যে অন্য কারো নাম বলবো।
— হা হা তাও ঠিক। চলো আজ নদীর পাড়ে ঘুরতে যাই। অনেক দিন এই শান আর নিরুকে মিলানোর চক্করে আমায় সময় দাও তো।
— ওরে আমার আইলসা গার্লফ্রেন্ড চলো ঘুরে আসি।

এরপর শামার হাত ধরে আমি নদীর পাড়ের উদ্দেশ্যে বের হয়ে যাই। তবে এখন বলতে পারি না নিরু নিজের ভুলটা বুঝতে পারলো কি না? তবে বুঝতে পারলে ওরই লাভ ছিল। আসলে শান নিরুকে বড্ড ভালবাসে আর আমি শামাকে অনেক ভালবাসি।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত