ডাকাত দলের গোঁফওয়ালা ব্যাক্তিটির আমার জন্য একটু দয়া হল। সে তার গায়ের চাদর আমাকে দিয়ে বলল, “একদম নাক বরাবর সোজা হেঁটে যাবি। পেছন ফিরে তাকালেই চাকু তোর পেটে ঢুকিয়ে দেব। আবার তাকিয়ে দেখিস কী? যা বলছি।”
আমি আর একবারও পেছন ফিরে তাকানোর সাহস পাইনি। মাটির রাস্তা দিয়ে অচেনা পথ ধরে হেঁটে চললাম। শেষ সম্বল বলতে এই চাদরটা আর পরনের জাঙ্গিয়া। আর সবকিছুই কেড়ে নিল ডাকাতরা। শানুর কথামত মেথিকান্দা রেল স্টেশনে নেমে একজনের কাছে জানতে চেয়েছি পলাশতলীর রাস্তা কোনটা? রাত তখন নয়টা বেজে চল্লিশ মিনিট। লোকটির দেখানো পথ ধরে হাঁটছিলাম। দুইজন রিক্সাওয়ালা আগুন পোহাচ্ছিল। এত করে বললাম, আমাকে একটু পলাশতলী নিয়ে যান। উল্টো মুখ বাঁকিয়ে বলল, নবাবি না করে হেঁটে যান। হাঁটলে শরীর গরম থাকে, শীত কম লাগে।
আমি তাদের এমন কথায় কিছুটা আহত হলাম। অপরিচিত জায়গায় রাতের বেলা হেঁটে যেতে ভয় লাগারই কথা। শেষ পর্যন্ত ভয়টা সত্যি হল। ছোট ব্রীজের নিচ থেকে বেরিয়ে এল চারজন মানুষ। একজনের হাতে হারিকেন। আমি কখনো হারিকেন হাতে নিয়ে ডাকাতি করতে শুনিনি। চারজনের গায়েই কালো চাদর। চারজন থেকে দুইজন আমাকে পেছন থেকে হাত চেপে ধরেছে। একজন আমার চোখের কাছে হারিকেন নিয়ে এল। অন্যজন বলছে, “একদম শব্দ করবি না। শব্দ করলেই চাকু ঢুকিয়ে দেব পেটে। সাথে কী আছে সব বের কর। যাবি কোথায়? কার বাড়ি?” আমি আমতা আমতা করে বললাম, পলাশতলী সরকার বাড়ি। বলার পর একজন আরেকজনের দিকে তাকাচ্ছে। তারপর একজন আরেকজনকে বলল, আরে কিছু হবে না। আমি থাকতে ভয় কিসের? যদিও লোকটি আমাকে বলেছে যা আছে বের করার জন্য, কিন্তু আমাকে কিছুই করতে হয়নি। তারাই আমার মোবাইল, মানিব্যাগ, হাতঘড়ি সব নিয়ে গেল। পেছন থেকে একজন বলল, জ্যাকেট খোল। তোর এত শীত কিসের? খোল জ্যাকেট।
শুধু জ্যাকেট নয়, তারা আমার টি-শার্ট, প্যান্ট আর জুতো সবই নিয়ে গেল। তখন তাদেরকে খুব গরীব টাইপের ডাকার মনে হল। গ্রামের মানুষরা রাতের বেলা এই রাস্তায় গেলে কত আর ডাকাতি করতে পারে? জাঙ্গিয়ার জন্য ইজ্জত রক্ষা পেল। শেষে চাদরটি দেয়াতে এখন গায়ে দিয়ে হাঁটতে পারছি। এতক্ষন শীত না করলেও এখন শীত লাগছে। জানি না আর কতদূর হাঁটতে হবে। রাত দশটায় রাস্তাঘাট এতটা নীরব হয়ে যাবে ভাবিনি। শীতের রাত, রাস্তায় কেউ প্রয়োজন ছাড়া বের হয় না। আশেপাশে কোনো দোকানও দেখা যায় না। এক কাপ চা খেলে ভালো লাগত। কিন্তু এখন আমার কাছে টাকা নেই।
শানু আর আমি দু’জন দু’জনকে ভালোবাসি দুই বছর ধরে। তার সাথে পরিচয়টাও এই ট্রেণেই। আমি ঢাকা থেকে বন্ধুর সাথে ভৈরব যাচ্ছিলাম। আমার এক অদ্ভুত রকমের ইচ্ছে হল। বন্ধু শামীমকে বললাম, আমরা যাব লোকাল ট্রেণে। যাতে সব স্টেশন ধরে। তাহলে যাবার পথে সব স্টেশন, স্টেশনে থাকা মানুষজন, মানুষের কথা বলার ধরণ, চাল-চলন সব দেখতে পাব। শামীম প্রথমে আপত্তি জানালেও আমার ইচ্ছের কাছে পরাজিত হয়ে কর্ণফুলি ট্রেণের টিকেট কিনে আনল। একেকটা স্টেশন পাড়ি দেয় আর লোকজন ট্রেণে বাড়তে থাকে। এক সময় দেখা গেল, সিটে যতজন বসে আছে তার চারগুণ মানুষ আমাদের চারপাশে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। গরমে সিদ্ধ হবার উপক্রম। শামীম চোখ রাঙ্গিয়ে বলল, লোকাল ট্রেণের মজা কেমন আজ বুঝবি। নরসিংদী স্টেশন থেকে চারটি মেয়ে উঠল। তাদের পরনে গায়ে হলুদের শাড়ি। চারজন মেয়েই দাঁড়িয়ে আছে। আমি একবার শামীমের কানের কাছে মুখ নিয়ে বললাম, মেয়েগুলোকে সিট ছেড়ে দিলে কেমন হয়? সে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, সিট একবার ছাড়লে আজ আর সিট পাবি না। চারিদিকে তাকিয়ে দেখ, যে যার মত যাচ্ছে।
একটি মেয়ে মনে হয় আমাদের কথাগুলো শুনতে পেয়েছে। তার চোখ আর মুখের ভঙ্গি তেমনটাই আভাস দিচ্ছে। কেমন করুণ করে তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে চোখের চাহনিতে আকুতি চানিয়ে বলছে, একটু উঠুন না। পুরুষ মানুষ দাঁড়িয়ে গেলে কী সমস্যা? আমার মায়া হয়নি। শামীম বলেছে একবার সীট ছাড়লে আর পাব না। তাছাড়া তারা চারজন। আমি উঠলেও শামীমের পাশে নিশ্চয় তারা বসবে না।
-একটু চেপে বসুন না। আমরা দাঁড়িয়ে যেতে পারব। আমার বোনটা গতরাতে নাচতে গিয়ে পায়ে ব্যথা পেয়েছে। তার দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে। দুইজনের সীটে তিনজন বসা যায়। একটু চেপে বসেন।
মেয়েটির কথায় আমি শামীমের দিকে একবার তাকিয়ে একটু চেপে গেলাম শামীমের দিকেই। শামীম চোখ রাঙ্গিয়ে নিজেও একটু চেপে বসল। মেয়েটি তার বোনকে বলছে, এই শানু, বস এখানে। শানু নামের যে মেয়েটি বসতে এসেছে তাকে চড়ুই পাখির মত দেখাচ্ছে। চিকন মেয়েদের দেখলে আমার চড়ুই মনে হয়। যেন বাতাসে ধরে রাখলে ওড়ে যাবে চড়ুই পাখির মত। শামীম আমাকে খোঁচা মেরে বুঝাতে চাইল, মেয়েটার দিকে এভাবে তাকিয়ে থাকলে তারা কিছু মনে করতে পারে। আমি চোখ ফিরিয়ে নেই।
আমি মেয়েটির মাথা আমার কাঁধ থেকে তিন চারবার সরিয়ে দেবার পরও মাথা রাখছে। আমার কাঁধে মেয়েটি মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে এতে আমার ভালো লাগার কথা। কিন্তু সামনের সীট আর দাঁড়িয়ে থাকা দু’জন আমার আর ঘুমন্ত মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আছে। তারা মনে হয় এমন দৃশ্য কোনোদিন দেখেনি। মেয়েটির বড় বোন একটু নুয়ে বলল, থাক ঘুমাক। সারারাত গায়ে হলুদে সজাগ ছিল। কিছু মনে করবেন না।
আমার মনে হল আমি স্বপ্ন দেখছি। কারো ছোট বোন একজন অপরিচিত ছেলের কাঁধে মাখা রেখে ঘুমালে সে এমন কথা বলতে পারে আমার ধারণা ছিল না। কিন্তু মনে মনে আমি খুশি। এমন খুশি, যে খুশিতে আমি একা থাকলে অবশ্যই হাত পা ছুঁড়ে কিছুক্ষন নাচতাম। মেয়েটি গভীর ঘুমে মগ্ন। তার গরম নিঃশ্বাস আমার কাঁধের সাথে মনকে পুঁড়িয়ে দেয়। তার জন্য অতীতের ভালোলাগা যা ছিল সব হৃদয় থেকে সরে গিয়ে মেয়েটির জন্য জায়গা করে দিতে লাগল। শামীম খোঁচা মেরে বারবার আমার কল্পনাতে ব্যাঘাত ঘটায়।
-আপনার ফোনটি একটু দিবেন? আমার ফোনে চার্জ নেই। মা’কে ফোন করে বলব আমাদের নেয়ার জন্য স্টেশন লোক পাঠাতে। মেয়েটি এমনভাবে কথা বলে যেন আমার পরিচিত। যদিও আমাকে আপনি করে বলছে, কিন্তু দেখে মনে হচ্ছে মেয়েটি আমার বড় হবে। আর আমার কাঁধে যে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে সে আমার ছোট হবে। কত ছোট সেটা অনুমান করতে পারছি না। আমি ফোন দিলাম মেয়েটির হাতে।
কাঁধ থেকে মাথা তুলে মেয়েটি বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেল। খুব লজ্জায় পড়েছে মনে হচ্ছে। ঘুম ভেঙ্গে যখন দেখল সে শুয়ে আছে অপরিচিত কোনো ছেলের কাঁধে, তখনই হঠাৎ চমকে গিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। মেয়েটির বড় বোন বলল, “উঠলি কেন? তোর না পায়ে ব্যথা? আর দুইটা স্টেশনই। মা’কে ফোন করে বলেছি ফিরোজ মিয়াকে স্টেশনে পাঠাতে।” আমি মেয়েটির নাম জানি। তার বোন তাকে শানু নামে ডেকেছিল। তারা মেথিকান্দা নামক স্টেশনে নেমে গেল। যাবার সময় বলল, ধন্যবাদ তোমাকে। আমি কিছু বলতে ভুলে গেছি। যে মেয়েটা এতক্ষন আমাকে আপনি করে বলল। এখন মনে হয় বুঝে গেছে আমি তার ছোট হব। অমনি তুমি করে বলে গেল। মেয়েগুলো নেমে যাবার পর আমার প্রচন্ড মেজাজ খারাপ হল। আবার শানু নামের মেয়েটি আমার কাঁধে মাথা রাখার কথা মনে হতেই মন ভালো হয়ে গেল।
দু’দিন পর শানু ফোন দিয়ে সরি বলল। আমি খুবই অবাক হয়েছি। কিছুতেই মনে করতে পারছিলাম না আমার ফোন নাম্বার আমি তাদের কখন দিলাম। তখন শানু বলল, তার বড় বোন আমার ফোন থেকে তার মায়ের কাছে ফোন করেছিল। দিনদিন কেমন বোকা হয়ে যাচ্ছি। সহজ জিনিস মাথায় আসে না। শানুর সরি বলার কারণ হিসেবে সে আমার কাঁধে মাথা রাখার কথাটি উল্লেখ করেছে। সাথে সাথে আমি ধন্যবাদ দিতে ভুল করিনি। আমার ধন্যবাদের কারণ জানতে চাইলেও আমি আমার কাঁধে মাথা রাখাকেই উল্লেখ করেছি। তখন অন্য কিছুর সাথে পরিচয় হলাম। হাসির সাথে, যে হাসির সাথে আমার এতকাল পরিচয় ছিল না। হেসে কুটি কুটি হওয়া মনে হয় এই হাসিকেই বলে। শানুর হাসি শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমি চুপ করে রইলাম। তখন বলল, “একদিন আমাদের বাড়িতে আসবেন। আমি আপনার কাঁধে মাথা রাখায় যদি কষ্ট পেয়ে থাকেন। সেই কষ্টের প্রতিদান হিসেবে আমি নিজ হাতে রান্না করব, আপনার দাওয়াত রইল।”
-শুধু খাওয়ালে প্রতিদান হবে না, নাচ দেখাতে হবে। শুনেছি খুব ভালো নাচতে পারেন।
-নিশ্চয় আপু বলছে? আজ খবর আছে ওর।
-কী করবেন? শাস্তি দিবেন মনে হচ্ছে। আপনার প্রশংসার জন্য শাস্তি পেতে হবে?
-এই শুনুন, দাওয়াত বাদ। আমি কাউকে নাচ দেখাতে পারব না।
সেদিনের প্রথম কথা বলা থেকে আজ অবধি আর থামিনি। কথার জালে, মায়ার বাঁধনে আটকা পড়ে গেছি। প্রেমের চোরাবালিতে হাবুডুবু খেয়েছি। রাতের পর রাত জেগে জেগে কথা বলেছি। শানু সারাজীবন আমার কাঁধে মাথা রাখার বায়না ধরল। আমিও তার জন্য হৃদয় কুটিরে ঘর বানিয়ে সাজাতে শুরু করেছিলাম।
শানুর মুখে শুনেছি সে তার বাবাকে অনেক ভয় পায়। শুধু সে নয়, সরকার বাড়ির সবাই শানুর বাবাকে প্রচন্ড রকমের ভয় পায়। তাই শানুর বাবা যখন তার বিয়ে ঠিক করে ফেলল, শানু মুখ ফোটে কিছু বলার সাহস পায়নি। আমাকে ফোনে কেঁদে কেঁদে বলেছে, শাওন আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাও। এক সপ্তাহ পর আমার বিয়ে। যা করার তাড়াতাড়ি করো। আজ সকালে শানু ফোন করে বলল, “দিনের বেলা আমি বের হলে ধরা পড়ে যাব। আর রাতের বেলা আমি একা কোথায় যাব? তুমি রাতের বেলা আটটা নয়টার দিকে পলাশতলী বাজারে এসে ফোন দিও। আমি তখন বেরিয়ে আসব।”
মেথিকান্দা স্টেশনে নেমে শানুকে বলেছিলাম আমি রেলগাড়ী থেকে নামলাম। তুমি তৈরী হও। আমি পলাশতলী এসে আবার ফোন দেব। পলাশতলী যাওয়ার আগেই আমার সবকিছু ডাকাতদের হাতে। পলাশতলী বাজারে গিয়ে কোনো দোকান থেকে ফোন করতে হবে শানুকে। টাকা না থাকলেও সমস্যা নেই। শানুকে বলব সাথে কিছু খরচের টাকা আনতে। কিন্তু চাদর আর জাঙ্গিয়া পরে শানুকে নিয়ে যাব কিভাবে? ওর একটা ভাই থাকলে ভালো হত। কোনো প্যান্ট থাকলে নিয়ে আসতে পারত। লুঙ্গি হলে চলবে কিনা ভাবছি। আমি আবার ঠিকমত লুঙ্গি পরতে পারি না। তবুও ইজ্জত বাঁচাতে লুঙ্গিটাই ভালো কাজে দিবে।
চাদর দিয়ে গা ঢেকে রাখলেও নিচ থেকে হাঁটু অবধি খোলা। ভেবেছিলাম রাতের বেলা কেউ সেটা খেয়াল করবে না। কিন্তু বেঞ্চে বসা লোকজন এমনভাবে তাকাচ্ছে যেন মনে হচ্ছে এখানে কোনো জন্তু এসেছে। আমি শুধু দোকানদারকে বললাম, ভাই একটা ফোন করব। তিনি বললেন, এটা তো চায়ের দোকান। ফোন করার দোকান নয়। আমি তবুও বললাম, আপনাদের কারো ফোন হবে? আমি এক মিনিট কথা বলব। বেঞ্চ থেকে একজন দোকানদারকে ইশারায় আমার হাঁটুর দিকে দেখাচ্ছে। দোকানদার দোকান থেকে বেরিয়ে এসে আমাকে আবারো আপাদমস্তক দেখে নিলেন।
-বাড়ি কোথায় আপনার? কার কাছে এসেছেন? দোকানদারের প্রশ্নে বোকার মত তাকিয়ে আছি। কী উত্তর দেব আমি? সরকার বাড়ির কথা বললেও তো ধরা পড়ে যাব।
-কী হল? চুপ করে আছেন কেন? ডাকাত দলের কেউ নাকি আপনি? সাথের সাঙ্গোপাঙ্গোদের ফোন করে এখানে আসতে বলবেন?
-দেখুন, আপনারা আমাকে ভুল বুঝছেন। আসলে ডাকাতরাই পথে আমার টাকা পয়সা, মোবাইল, জামাকাপড় সব নিয়ে গেছে।
পাশ থেকে একজন বলে উঠলেন, আগে বেঁধে রাখুন। তারপর নিজেই বলবে পরিচয়, আর কোথায় যাবে?
আমার কলিজা শুকিয়ে যাবার অবস্থা। উপস্থিত চার পাঁচজন আমাকে ঘিরে রেখেছে। আমি শুধু বলেছি বাড়ি ঢাকা। কিন্তু কোথায় এসেছি তার কোনো জবাব নেই আমার কাছে। লোকজন মনে হচ্ছে ক্ষেপে গেছে। কোথায় এসেছি এটা না বললে মারতেও পারে। একজন তো লাঠি খুঁজতে আরম্ভ করল। উপায় না পেয়ে বলেই দিলাম, আসলে আমি সরকার বাড়ি এসেছি। ডাকাতরা সব নিয়ে গেছে। তাই ফোন করতে চেয়েছিলাম। অন্ধকারে বাড়ি চিনতে পারছি না।
-আস্সালামু আলাইকুম সরকার সাহেব। ঢাকা থেকে একজন মেহমান আসছে আপনার উদ্দেশ্যে। কিন্তু ডাকাতরা উনার সব নিয়ে গেছে। হ্যাঁ, আমাদের সামনেই আছে। রফিকের চায়ের দোকানে। হ্যাঁ, আচ্ছা ঠিক আছে।
কথাগুলো বেঞ্চে বসা এক লোকের। তিনি কখন সরকার বাড়িতে ফোন দিল বুঝতেই পারছি না। একজন বলল, রফিক ভাই সরকার সাহেব বলেছে উনাকে সরকার বাড়ি নিয়ে যেতে। আমরা দু’জন দিয়ে আসি। চলেন ভাই। আপনার আর কোনো সমস্যা নেই, আগে বলবেন তো আপনি সরকার বাড়ি যাবেন। চলেন, আপনাকে আমরা নিয়ে যাচ্ছি।
মধ্যরাত, আমাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে এই বাড়ির সবাই। দুইজন আমাকে সরকার বাড়িতে দিয়ে চলে গেছে। আমার বেগতিক অবস্থা দেখে কাজের ছেলেটা লুঙ্গি আর শার্ট দিয়ে গেল। আমি লুঙ্গি পরতে পারি না। কোনো রকমে কোমড়ে আটকিয়ে কাঠের চেয়ারে বসে আছি। এর মধ্যে শানুর সাথেও দেখা হল। বাতির আলোতে বুঝা যায় শানুর চোখ ছলছল করছে। আমি এখনো শানুর কথা কিছু বলিনি। শানুর বাবার রক্তচক্ষু দেখে ভয়ে শরীর কাঁপছে। এভাবে ধরা পড়ে যাব ভাবিনি।
-তার মানে তুমি বলতে চাচ্ছ, দোকানের সামনের লোকজনের কাছ থেকে বাঁচতে বলেছো সরকার বাড়ির কথা। কিন্তু তুমি সরকার বাড়ি চিনো কিভাবে? দেখো, আমি খুব রাগী মানুষ। আমাকে উত্তেজিত করো না। বলো, সব সত্যি বলো। এই ফিরোজ, দড়ি আর লাঠি নিয়ে আয়।
-আমি, আমি পানি খাব।
সরকার সাহেব শানুকে পানি আনতে বললেন। শানু পানির গ্লাস দেয়ার সময় তার হাত কাঁপছে। আমার কলিজা লাফাচ্ছে। পানি খাওয়া শেষ করে বললাম, আসলে আমি কোথায় এসেছি জানি না। সব গ্রামেই সরকার বাড়ি, ভূঁইয়া বাড়ি, খন্দকার বাড়ি থাকে। সেই অনুমানে বলেছি। আমাকে ছেড়ে দিন, আমি ঢাকায় চলে যাব। সরকার সাহেব ফিরোজ নামের ছেলেটির হাত থেকে লাঠি নিয়ে তেড়ে এলেন আমার দিকে।
-বাবা, বাবা সে আমার বন্ধু। তোমাকে ভয়ে বলতে পারিনি। শানুর কথা শুনে সবাই চুপ হয়ে গেল। কেউ কোনো কথা বলছে না। সরকার সাহেব চেয়ার ছেড়ে উঠে গেলেন। শানুর মা আমার কাছে এসে নিচু গলায় বললেন, আসো তুমি। যা হবার সকালে হবে, এখন আসো তুমি।
এখন আমার জোছনা ভালো লাগছে না। দিনের মত ফর্সা দেখা যায়। আমি আর শানু খড়ের গাদার আড়ালে কথা বলছি। শানুর বাবা ঘুমিয়ে আছেন। দু’জনই নীরব। ফিরোজ আর মধ্যবয়সী লোকটা গেইটে না থাকলে এখন পালানোর ভালো সুযোগ ছিল। কিন্তু পালাতে পারি ভেবেই গেইটের কাছে পাহাড়া। শানু কান্না করছে। খুব ইচ্ছে করছে তার গাল বেঁয়ে নামা পানি মুছে দেই। আমি তবুও বললাম, শানু তুমি কেঁদো না। একটা ব্যবস্থা ঠিক হয়ে যাবে। যদি পথে ডাকাত না ধরত, তাহলে তো তোমাকে নিয়ে এতক্ষনে ঢাকায় পালিয়ে যেতাম। আমারতো কোনো দোষ পেছন থেকে শানুর বাবা আমার চুল টেনে ধরলেন।
-শানুর মা, তুমি তোমার মেয়েকে ঘরে নিয়ে যাও। আর এই হারামজাদাকে আমি দেখছি। এই তুই কী বললি? পালিয়ে যাবি আমার মেয়েকে নিয়ে? আমার মুখ থেকে শব্দ বের হচ্ছে না। সরকার সাহেব ঘুমিয়ে ছিলেন। কখন সজাগ হলেন নাকি এখনো ঘুমাননি সেটা ভাববার সময় নেই এখন।
-ছয়দিন পর আমার মেয়ের বিয়ে। লোকজন জানাজানি হবে, নয়তো এখন তোর পিঠের ছাল তুলে লবন লাগিয়ে দিতাম। তোর বাবার ফোন নাম্বার দে তাড়াতাড়ি। কেমন সন্তান জন্ম দিয়েছে তা জানুক। আমার মেয়েকে নিয়ে পালাবে, কত বড় সাহস। আশেপাশে শানু নেই। তার মা নিয়ে গেছে। শানুর বাবা আমার চুল ছেড়ে দিয়ে দাঁতে কিড়মিড় করছেন। এই বাড়ির আরো তিন চার জন উপস্থিত হয়েছেন। ভোর রাতে শানুর বাবা ফোন দিলেন আমাদের বাড়িতে। কী বললেন আমি কিছুই জানি না। বাবা অনেক কষ্ট পাবে। তার ছেলে একটা মেয়ে সংক্রান্ত ব্যাপারে আটক হয়েছে। এটা অবশ্যই লজ্জাকর অবস্থা। ভালোবাসলে আর কী কী পরীক্ষা দিতে হয় আমার জানা নেই।
সকাল নয়টায় এক আজব ঘটনা ঘটল। মাফলার দিয়ে মুখ বেঁধে এক লোক প্রবেশ করল সরকার বাড়িতে। তার হাতে একটি ব্যাগ। আমার দিকে দুইবার তাকালো লোকটি। সরকার সাহেব বেরিয়ে এলেন। লোকটি গিয়ে সরকার সাহেবের সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে কী যেন বলছে। বাড়ির এত বড় উঠান পেরিয়ে সে কথা আমার নিকট আসেনি। লোকটি ব্যাগ দিয়ে চলে গেলেন। আমি বসে অপেক্ষার প্রহর গুণছি।
-এই ছেলে এদিকে আসো। শানুর বাবার কথায় এগিয়ে গেলাম। তিনি আমার হাতে ব্যাগটি ধরিয়ে দিয়ে বললেন, “ডাকাতকে মানুষ ভয় পায়। আর এই সরকার বাড়ির নাম শুনলে ডাকাতও ভয় পায়। তুমি ডাকাতদের কাছেও বলেছো সরকার বাড়ির পরিচয়। রাতে তারা তোমার সব নিয়ে গেলেও এখন ফিরিয়ে দিয়ে গেছে। নাও, দেখো সব ঠিক আছে কিনা।” আমি ব্যাগ নিয়ে সব এক এক করে বের করে দেখি আসলেই সব জিনিস ফেরত এসেছে। অবাক হবার মতই ঘটনা। শানুর বড় বোন আমাকে দেখে পুরোই অবাক হয়ে গেলেন। একটু আগে স্বামী আর একটি ছোট বাচ্চা নিয়ে এই বাড়িতে প্রবেশ করলেন। আমাকে দেখে কী বলবেন কিছুই বুঝতে পারছেন না। সেই যে ট্রেণে দেখা, আর আজ আমি তাদের বাড়িতে।
-কেমন আছেন আপনি? আমাদের বাড়িতে আপনি এটা তো বিশ্বাসই হচ্ছে না। আমি মুচকি হাসি দিয়ে বললাম ভালো আছি। তিনি জোরে ডাকলেন তার মা’কে।
-মা, ঐ মা। তুমি জানো কে উনি? ঐ যে মিতুর গায়ে হলুদ থেকে ফিরার পথে শানু এক লোকের কাধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছিল বলেছিলাম না, শানু যে পায়ে ব্যথা পেল। এই তো সেই ছেলে। অনেক ভালো মনের মানুষ। ছিঃ ছিঃ, আমার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়েছে সেটা এমন চিৎকার করে বলার কী আছে? সরকার সাহেব শুনলে তো….
-ছেলেটা যে আধঘাট বেঁধে এসেছে সেটা আগেই বুঝেছি। সেজন্যই ছেলেটার বাবাকে খবর দিয়েছি। কিছুক্ষনের মধ্যে আসবে বলে। এই সেরেছে। যা ভেবেছি তাই। সরকার সাহেব সব শুনে ফেলেছে। আমার কপালে কী আছে আল্লাহ ভালো জানে।
বাবা, বড় চাচা আর মামা এলেন সরকার বাড়ি। আমি ভেবেছিলাম রাতে ফোনে দুই চারটা কথা শুনিয়েই তিনি ক্ষান্ত হবেন। কিন্তু এখন দেখি ঘটনা উল্টো। মামার হাতে মিষ্টির প্যাকেট আর চাচার হাতে ব্যাগে কী যেন। বুঝা যাচ্ছে না, তবে ফলমূল হতে পারে। আমাকে আটকে রেখেছে আর আমাকে ছাড়িয়ে নিতে মিষ্টি আনতে হবে? বাবা অগ্নিচোখে আমার দিকে একবার তাকিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। মামা হাত ইশারায় বুঝালেন, চিন্তা করিস না আমরা তোকে নিতে এসেছি।
সরকার সাহেব আমার বাবা আর চাচাদের ঘরের ভিতর নিয়ে গেলেন। এমন সময় আরো একটি অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। উঠানের ঐ প্রান্তের এক ঘর থেকে শানু বেরিয়ে নলকূপ থেকে পানি নিতে এল। আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে। এ কেমন অদ্ভুত আচরন? ভোর রাতে আমার সামনে যে মেয়েটা দাঁড়িয়ে কাঁদছিল সে এখন হাসছে। হতে পারে বাবা আমাকে ছাড়িয়ে নিতে এসেছে সেটা জেনে মুচকি হাসছে। কিন্তু আমাকে ছাড়িয়ে নিলেও ছয়দিন পর যে তার বিয়ে সেটা ভেবে ওর দুঃখ লাগছে না?
রাগী মানুষের মায়া বেশি। এই কথাটা এতকাল শুনে এসেছি। শানুর বাবাকে দেখে সেই মায়ার সাথে সত্যিকারভাবে পরিচয় হবার সুযোগ হয়েছে। সরকার সাহেবের কোনো ছেলে নেই। দুইটা মেয়ে, তিনি রাগী হলেও মেয়েদের তিনি অনেক ভালোবাসেন। রাগ বেশি থাকায় সেই ভালোবাসা প্রকাশ পায় না। শানু তখন মুচকি হাসছিল, কারণ সে জানে হয়তো ভালো কিছু হতে যাচ্ছে। আমাকে আর শানুকে রেখে ঘরের ভিতর আমাদের অভিবাবকরা কী বলেছে আমরা জানি না। জানবার প্রয়োজনও মনে করছি না। মামা এসে বললেন হা কর। আমি হা করতেই মামা আমার মুখে মিষ্টি ঢুকিয়ে দিলেন। মামার হাত বেয়ে রস পড়ছে। আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই মামা বললেন, বেশ রাগী মানুষ। তবে রাজী হয়েছেন। আমি ভাবলাম যাক, আমাকে ছেড়ে দিতে রাজী হয়েছেন এটা তো খুশির খবর। কিন্তু বাবা আর চাচা যখন বেরিয়ে এলেন তখন মামা আবার এসে বললেন, মেয়েটার সাথে কিছু বলার থাকলে দুয়েক মিনিটে বলে আয়। আমরা এখনই রওনা দেব। বিয়ের আগে বেশি কথা ভালো দেখায় না। বিয়ের পর যত খুশি কথা বলিস।
আমি এমন কথার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। মামা এটা কী বলে গেলেন? সেটা পরে ভাবা যাবে। আগে দেখা করে আসি শানুর সাথে।
খড়ের গাদার আড়ালে আমরা দু’জন। ভোর রাতে এখান থেকেই দু’জনকে ধরেছিল কথা বলার অপরাধে। এখন যে আমরা কথা বলছি এটা অনেকেই জানে। মামা জানে, শানুর বড় বোন আর মা জানে। শানু একাধারে হেসেই যাচ্ছে। আমার হাসি পাচ্ছে না। আমার মন খারাপ দেখে শানু বলতে লাগল, “আপু বিয়ে করেছে নিজের পছন্দে। তাই বাবার খুব ইচ্ছে ছিল উনার পছন্দ করা ছেলেকে আমি বিয়ে করি। কিন্তু রাতে যখন তুমি ধরা পড়েছো তখন আমি মায়ের কাছে সব বলে দিয়েছি। মা আমার অনেক ভালো বন্ধু।
আমি যেমন বাবাকে অনেক ভয় পাই, তেমনি বাবা আমার মা’কে ভয় পান। কারণ মা কান্না শুরু করলে দুই তিনদিন একই কথা বলতে থাকবে আর কান্না করবে। খাবে না পর্যন্ত। মা যখন বাবা’কে বললেন, তোমার মেয়ে ছেলেটাকে পছন্দ করে। তোমার মেয়েই আসতে বলেছে ছেলেটাকে। ছেলেটার কোনো দোষ নেই। তখন বাবা দাঁতে কিড়মিড় করলেও কিছু বলতে পারেনি। মা বললেন, ফোন করে একটা সমস্যা দেখিয়ে আগের বিয়েটা বন্ধ করো। মায়ের কথাতেই বাবা তোমার বাবাকে ফোন করে সব বললেন। এজন্যই তোমার বাবা মিষ্টি নিয়ে উপস্থিত। এবার কিছু বুঝেছো?” আমি বললাম, এখনো পুরোপুরি বুঝিনি।
-আরে গাঁধা, আমার বিয়ে তোমার সাথেই হচ্ছে। তবে মাস দেড়েক পর। আমি খুশিতে শানুকে জড়িয়ে ধরলাম। শানু ফিসফিস করে বলছে, ছাড়ো। ছাড়ো তাড়াতাড়ি, কেউ দেখে ফেললে তোমার কাছে আর বিয়ে দিবে না আমাকে। আমি ভয়ে ছেড়ে দিলাম। শানু একাধারে হাসছে। এই হাসির ঝনঝন শব্দ এতদিন মোবাইলে শুনেছি। আজ সামনা সামনি দেখছি। কী মায়ায় ভরা হাসি। তাইতো শানুকে এত ভালোবাসি।