বমি

বমি

লিনা ভাবি আমার চাচাত ভাই তৌফিকের বউ। বেশ সুন্দরী। আমাদের বাসায় তার অবাধ যাতায়াত। আমার বউয়ের সাথে গলায় গলায় ভাব। কিন্তু ইদানীং আমার বউ তাকে দু’চোখে দেখতে পারে না। লিনা ভাবির অপরাধ হচ্ছে , একদিন মুখ ফসকে সে বলে ফেলেছে, এই বয়সেও ভাইকে বেশ হ্যান্ডসাম লাগে!

এরপর থেকেই বাসায় ৫৪ ধারা জারি হয়েছে, লিনা ভাবির সাথে কোন কথা বলা যাবে না। লিনা ভাবিকে যে বউ আর পছন্দ করছে না এটা সে তাকে বুঝতে দেয় না।দেখা হলে ঠিকই হাসিমুখে কথা বলে। শুধু আমার ক্ষেত্রে ৫৪ ধারা জারি বহাল! লিনা ভাবির বোনের বিয়ে। আমাদেরকে সপরিবারে দাওয়াত দেওয়া হয়েছে। ভাবিদের দেশের বাড়ি কুমিল্লা । দাওয়াত পেয়ে বউ বেশ উসখুস করছে। দুইমাস আগে তার ভাইয়ের বিয়েতে ভাবিরা তিনদিন লাগিয়ে দাওয়াত খেয়ে এসেছে, এখন তাদের দাওয়াত কবুল না করে উপায় কি? আমি তাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে রাজি করলাম।

ভাবির স্বামী তৌফিক ভাই একটা কাজে চিটাগং গেছেন। তিনি ওখান থেকে সরাসরি বিয়ে বাড়ি চলে যাবেন। আমরা একটা মাইক্রোবাস ভাড়া করলাম।কথা হলো,ভাবী থেকে যাবেন,আমরা পরের দিন ঢাকা ফিরে আসবো ।যাত্রী সাতজন। আমাদের সাথে দুই ছেলেমেয়ে এবং ভাবির দুই মেয়ে। সকাল দশটার দিকে আমরা রওনা হলাম কুমিল্লার দিকে। আমি আমার বউ বাচ্চাসহ সামনে, ভাবি তার বাচা কাচ্চা নিয়ে পিছনে বসেছেন।গাড়ি ঢাকা চিটাগং রোডে কিছুক্ষণ চলার পর ভাবির ছোট বাচ্চা বমি করা শুরু করলো। গাড়ির ড্রাইভার পলিথিন বের করে দিল বমি করার জন্য।

আমি শুচিবাই গ্রস্ত মানুষ। কারও বমি দেখলে আমারও বমি চলে আসে। আমি চোখমুখ শক্ত করে গাড়িতে বসে রইলাম। কিছুক্ষণ পর বুঝতে পারলাম তার বড় বাচ্চাও বমি করতে শুরু করেছে। আমার ছেলে মেয়েদের গাড়ি চড়ার অভ্যাস আছে। আমার মেয়ে বললো, আব্বু ওদের বমি করা দেখে আমারও বমি চলে আসছে। বউ কটমট করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। যেন ওদেরকে আমি বমি করতে শিখিয়ে দিয়েছি! আমি আস্তে করে বললাম, এমন কঠিন চোখে তাকিয়ে আছো কেন? আমি কি ওদেরকে বমি করতে বাধ্য করেছি? বউ হিসহিস করে বললো, বমি দেখলে আমার রাগ লাগে। আমি জীবনেও কোনদিন বমি করি নাই। কারও সামনে বমি করাকে আমার অভদ্রতা মনে হয়। বমি ভদ্রতা অভদ্রতা দেখে হয় না। পরিস্থিতি অনেক সময় বাধ্য করে। আমি জীবনেও কারও সামনে বমি করবো না। মরে গেলেও না! কক্ষণো না!!

ওদের বমি করা দেখে আমার ছোট বাচ্চার বমিভাব এসে গেল।বাচ্চা চিৎকার করে বললো, গাড়ি থামাও!
গাড়ি থামানো হলো। ছোট বাচ্চা গাড়ি থেকে নেমেই বমি করে দিল।বাচ্চাদের পরিস্কার করে গাড়িতে বসেছি, কিছুক্ষণ চলার পর আবার পিছনে বমি! অবস্থা দেখে আমারও নাড়িভুড়ি উল্টে আসতে চাইছে। আমার বাচ্চারা মুখ চেপে বসে আছে। ভয়াবহ অবস্থা! ড্রাইভার বললো, ভাই এসি বন্ধ করে দেই,তাহলে বমি ভাব কম হবে। অনেক সময় এসির কারনেও অনেকের এই সমস্যা হয়।

প্রচন্ড গরম। এসি বন্ধ। জানালা খুলে দেওয়া হলো। কিছুক্ষণ পর আবিস্কার করলাম, লিনা ভাবি জানালা দিয়ে মাথা বের করে বমি করা শুরু করেছেন! আমার তখন দম যায় যায় অবস্থা। বমি চেপে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছি, আমার চোখ দিয়ে অবিরত পানি পড়তে লাগলো। বউ কানের কাছে মুখ এনে বললো, তুমি কাঁদছো কেন?

আমি বললাম, কাঁদছি না।এমনিতেই চোখে পানি চলে এসেছে। এমনি এমনি পানি আসবে কেন? ওনাকে বমি করতে দেখে? হা। সত্যিটা বলার জন্য ধন্যবাদ। ওনার জন্য তোমার যে এতো মায়া জানতাম না! আরে কি আশ্চর্য! উনার বমি করা দেখে আমার খারাপ লাগছে। তাই চোখে পানি চলে এসেছে।   আমার চোখে তো পানি আসছে না।এতোটাই যখন খারাপ লাগছে মাথায় হাত বুলিয়ে দাও।বমি মুছিয়ে দিয়ে এসো। লিনা ভাবি বললেন, ভাই কিছু মনে করবেন না,আমরা গাড়িতে চড়তে পারি না আপনাদেরকে সমস্যায় ফেললাম।

বউ থমথমে গলায় বললো, তোমার ভাই কিছু মনে করেনি! গাড়ি আবার থামানো হয়েছে। নাকেমুখে পানি দিয়ে ফ্রেস হয়ে এক দোকানে বসে চা খেলাম। বমি নাশক টেবলেট কেনা হলো। তাদের তিন জনকেই সে টেবলেট খেতে দেওয়া হয়েছে । গাড়ি আবার চলতে শুরু করলো। এসি বন্ধ। সব জানালা খুলে দেওয়া হয়েছে। তাদের তিনজনকেই পলিথিন বের করে দেওয়া হয়েছে। আমার ছেলেমেয়েরা চোখমুখ শক্ত করে বসে আছে। মনে হচ্ছে যে কোন সময় তারাও বমি করে ফেলবে! ছোট বাচ্চা বললো, আব্বু ওরা এতো বমি করে কেন?আমার খারাপ লাগছে।

কাচপুর ব্রীজ পার হয়ে গাড়ি জ্যামে আঁটকে আছে। নট নড়নচড়ন অবস্থা। আমাদের পাশেই বড় একটা বাস দাঁড়িয়ে আছে।বউ পিছনে হেলান দিয়ে চোখ বুঝে আছে। আমিও চোখ বুঝে আছি, হঠাৎ বউয়ের চিৎকার শুনে চোখ মেলে চাইলাম।ঘটনা কী? চোখ মেলে তাকিয়ে দেখি বউয়ের কোলে যে যেন এক প্লেট খিচুড়ি ঢেলে দিয়েছে। আমি বললাম, খিচুরি পেলে কোথায়? খিচুড়ি তোমার প্রিয় সেটা জানি,তাই বলে কোলে নিয়ে খেতে হবে? বউ চিৎকার দিয়ে বললো, রাবিশ!!

রাবিশ বলছো কেন? খিচুড়ি তোমার প্রিয় এটা ঠিক আছে, তাই বলে তোমাকে কোলে রেখে খেতে বলবো এতোটা অভদ্র আমি নই! বউ আবার চিৎকার দিয়ে বললো, বমি! হায় হায়! বমি! কে করলো এমন কুকাজ? পিছন থেকে বাচ্চারা বললো, আমরা করি নাই। ভাবি বললেন, আমিও তো করি নাই। তাহলে করলো কে? ড্রাইভার পিছনে ফিরে দেখে বললো, মনে হয় জানালা দিয়ে এসেছে! আমি গাড়ি থেকে বের হয়ে দেখি, ঘটনা সত্যি। একজন অল্প বয়সী মেয়ে বমি করেছে। গাড়ির গায়ে বমি লেগে আছে। আমি কিছু বলতে গেলাম, তার আগেই বাস ছেড়ে গেলো!

বউ কোলে বমি নিয়ে বসে আছে। আমি চোখমুখ বন্ধ করে টিস্যু পেপার বের করে বমি মুছে যাচ্ছি। শাড়ি নষ্ট হয়ে গেছে। বোতলের পানি দিয়ে শাড়ি ধোওয়ার পরও দাগ থেকে যাচ্ছে। বউ বললো, গাড়ি ঘুরাও আমি বিয়ে খেতে যাবো না! আমি তাকিয়ে দেখি, তার চোখ দিয়ে দরদর করে পানি পড়ছে। আমি বললাম, ঘটনা কী? কাঁদছো কেন? কলেজ জীবনের বয়ফ্রেন্ডের কথা মনে পড়েছে? বেচারা হতাশ হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো ! অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে তাকে বিয়ে বাড়ি যেতে রাজি করলাম।

গাড়ি চলতে শুরু করেছে। বউ চোখ বুঝে আমার কাঁধে মাথা রেখে শুয়ে আছে। আমিও চোখ বুঝে থেকে বমি ভুলে থাকার চেষ্টা করছি। হঠাৎ বউয়ের শরীরের একটা ঝাঁকুনি টের পেলাম, তারপর হড়হড় করে বমি।বমি করে সে আমার কোল ভাসিয়ে দিয়েছে!! অনেক কষ্টে বিয়ে বাড়ি পৌছলাম। কথা ছিল একদিন বিয়ে বাড়ি থাকবো। কোনরকমে কিছু খাওয়াদাওয়া করলাম,তারপর আবার রওনা দিলাম ঢাকার উদ্দেশ্যে। সেদিন হাড়ে হাড়ে টের পেলাম, বমি জিনিসটা কতটা সংক্রামক!

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত