মন্দবাসার গল্প

মন্দবাসার গল্প

নীলুর বাবা আমাদের এলাকার এলাকায় পোস্টিং হয়ে এলেন ডিসি হিসেবে।নীলু তখন এএইচ এস সি দিয়ে মেডিকেলের কোচিং এ ভর্তি হয়েছে।আমি তখন সবে মাত্র মেডিকেল কলেজে তৃতীয় বর্ষে পড়ি।স্কুল মাস্টারের ছেলে হয়ে ডিসির মেয়ের সাথে প্রেম করার সাহস দেখানো উচিত ছিলো কী ছিলো না এটা তর্ক সাপেক্ষ, কিন্তু ছুটিতে বাড়ি এসে কোচিং এ ক্লাস নিতে এসে এই মেয়েকে দেখার পরেই আমার কেমন জানি বিষাদ গ্রস্থ ভালোলাগা এবং খারাপ লাগা কাজ করতে শুরু করলো।

ভালো লাগার কারণ ছিলো অবশ্যই নীলু,আর বিষাদ লাগার কারণ হলো অতি সুন্দর জিনিসে কাটা থাকে,হাত দিতে গেলে ফুটে যাবে এই ভেবে।একই সাথে খারাপ লাগার কারণ হলো বয়স আমার যতই ২০ হোক আমি একজন শিক্ষক,সেই হিসেবে ছাত্রীর প্রেমে পড়া বড়ই অশোভন কাজ,কি লজ্জা, কি লজ্জা।

এই একই সাথে ত্রিমুখী অনুভূতি নিয়ে আমি যখন খিচুড়ি মার্কা অবস্থায় দিন যাপন করছিলাম,তখনই মড়ার উপর খাড়ার ঘা হয়ে এলো নীলুর বাসা থেকে তাকে পড়াবার আমন্ত্রণ। এক মাসের ছুটিতে বাড়ি এসে বেশ ভালো বিপদেই পড়লাম,সাধারণ মানুষ হলে এক কথা,এই ডিসির বাড়ি রোজ নিয়ম করে যাওয়া আর বাঘের খাচায় ঢোকা আমার কাছে একই ব্যাপার ছিলো।

সব কিছু মিলিয়ে মোটের উপর দুইটা ব্যাপার ছিলো অনুকূলে এক.নীলুদের বাড়ির নাস্তা এইসব দামী দামী খাবার আমি কমই খেয়েছি জীবনেদুই.নীলুকে রোজ দেখতে পাওয়া। দুই নম্বর বিষয়টার ব্যাপ্তিকাল যেন বাড়ে সে কারণে দেড় ঘন্টার জায়গায় দুই আড়াই ঘন্টা পড়াতেও আমার সমস্যা ছিলো না। নীলুর বর্ণনা একটু খানি দেয়া যাক,না থাক আমি বর্ণনা দিতে গেলে কমতি থেকে যাবে,বা ভুল হবে।মোট কথা নীলুকে বর্ণনা করার মত শব্দ আমার কাছে ছিলো না।আমার শুধু মনে হতো ভিঞ্চি সাহেব নীলুকে দেখলে আফছোছেই আরেকবার মারা যেতেন যে মোনালিসা আঁকিয়ে এত সময় নষ্ট করেছেন,ক্লিওপেট্রা নিশ্চিত হিংসায় জ্বলে যেতো নীলুকে দেখে।

সেই হিসেবে আমার মত মোটামুটি কালো,বেশখানিক মোটা আর খুবই অল্প চুল আলা কোন ছেলের প্রেমে নীলুর পড়া উচিত নয়,আমি নিজে নীলু হলেও আমাকে থাপড়াইতাম নীলুর সাথে প্রেম করতে চাইবার অপরাধে। ভালো সময় বেশীদিন থাকে না,আমার ছুটি শেষ হয়ে গেলো।মনে বিশাল দুঃখ কষ্ট নিয়ে আমি চলে গেলাম আবার,এর মাসখানিক পর নীলু মেডিকেলে পরীক্ষা দিলো।নীলুর মেডিকেলে চান্স হলো না।উপর থেকে কেউ বোধহয় অন্য কিছু ভাবছিলেন,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়ে বসলো এই মেয়ে।যাক শিক্ষক হিসেবে নিজের মান সম্মান তো থাকলো।

নীলুকে এক মাস পড়িয়েছিলাম,এর ভেতর আমার সাথে সে প্রয়োজন ছাড়া তিনটা কথা বলেছে। তার একটা ছিলো আজকে খুব গরম,আরেকটা ছিলো ভাইয়া আপনি এই সিনেমাটা দেখেছেন? সিনেমার নাম ভুলে গেছি,তবে সেটা কোন রোমান্টিক সিনেমা ছিলো না যে তা থেকে অন্য কিছু ভাববো।তো আমিও আমার জীবন নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম,নীলুও রঙিন থেকে আস্তে আস্তে ধূসর হয়ে হয়তো পুরোটাই বিবর্ণ হয়ে যেতো যদি না একদিন বিকেলে দোয়েল চত্ত্বর থেকে মেয়েটা আমাকে ডাক দিতো। এই যে ভাইয়া,ইমরান ভাইয়া? আমি সুমধুর গলায় আমার নাম ডাকা দেখে অবাক হয়ে পিছনে তাকিয়ে দেখি নীলু। নীলুকে দেখেই আমার পেটের ভেতরে সুড়সুড়ি দিতে দিতে পুরোনো প্রেমটা জেগে উঠলো আবার,একই সাথে রাগ হতে লাগলো।ভালোই তো ছিলাম বাপু,আজ কেন দেখা হয়ে গেলো।

এতকাল ধরে যা ঘটেছিলো সেগুলো ছিলো প্রেমে পড়ার জন্যে,কিন্তু দুজন দুজনকে ভালোবাসার জন্যে কোন ঘটনা এখনও ঘটেনি দেখে সৃষ্টিকর্তা হয়তো ভাবলেন ইনাফ ইজ ইনাফ।এবার কিছু একটা করতে হবে। সেই কিছু একটা করারনোর জন্যেই কী না একদিন টিএসসির সামনে থেকে রাস্তা পার হতে গিয়ে দেখি আমি একড়া রিকশার সাথে দুমড়ে মুচড়ে পড়ে আছি,বেশ কায়দা করে আমার একটা পা রিক্সার চাকার ভেতর ঢুকে আছে।১০ সেকেণ্ডের ও কম সময়ের ঘটনা টা ব্রেন টের পাবার পর যখন ব্যাথায় চিতকার দিতে যাবো,তখনই আবারো সেই গলা। আশ্চর্য তো,এমন হাবাগোবা মানুষ হয়? এতদিন ঢাকায় থেকেও রাস্তা পার হতে পারেন না? চিতকারের বদলে মুখ খুব কষ্টে হাসি হাসি হয়ে গেলো। আরে না না,আমি এম ফাইন।

-আই এম ভেরী ভেরী ফাইন। তুমি কেমন আছো নীলু?

আমার কথার সুরে অন্য কিছু ছিলো কী না কে জানে,কেন জানি মনে হলো নীলু কয়েক মিলি সেকেন্ড চুপ করে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো।

-কেমন ফাইন আছেন তা তো দেখতেই পাচ্ছি,আর আমি কেমন আছি তা এই সময়ে জানার জন্যে খুব উপযুক্ত না।
চলেন হাসপাতালে চলেন,হাঁটতে পারবেন তো?
-পারবো না মানে,দৌড়াতে পারবো।

এই বলে আমি উঠে দাঁড়াতে গিয়েই কটাস করে একটা শব্দ হলো। আমি বলে উঠলাম,”ওহ ফাইইন” বলেই মাটিতে পড়ে গেলাম। আমার মত হাতির কাছাকাছি মানুষকে কিভাবে নিলু টেনে রিক্সায় তুলেছিলো তা এখনও রহস্যই হয়ে আছে।ভাঙা পা নিয়ে আমরা মেডিকেলের দিকে যাচ্ছি। আমার মনে গান বাজছে তোমায় ঘিরে চুপটি বসেএএএ থাকা,আমি বুঝে গেলাম আমি বেশ উচ্চ দরের প্রেমিকের শ্রেণীতেই পড়ি।ভাঙা পা নিয়ে যে প্রেমের গানে কলি ভাবে সে অবশ্যই মহৎ প্রেমিক।

নিজের মেডিকেল কলেজ হওয়ার সুবাদে ডাক্তার, বড় ভাই,বন্ধু, জুনিয়র সবার সাথেই পরিচিত আমি।ছাত্র ওয়ার্ডে ভর্তি হলাম।স্যার বললেন একটা হাড্ডি ডিসপ্লেস হয়ে গেছে,তিন সপ্তাহ প্ল্যাস্টার করে রাখা লাগবে।বন্ধুরা খবর পেয়ে দেখতে এলো,এই অসুস্থ অবস্থায় আমার পাশে থাকার মত কোন আত্মীয় ঢাকা শহরে ছিলো না,কিন্তু হল লাইফে কিছু পাওয়া না যাক এমন দু চারটা ভাই ব্রাদার বন্ধু পাওয়া যায়।আমাকে জ্বালানোর জন্যে তারাও পালাক্রমে আমার পাশের বেডে থাকতে লাগলো।নীলু আমাকে এসে ভর্তি করিয়ে দিয়ে গিয়েছিলো,হাসপাতালে এনেছিলো এই টুকুই অনেক ছিলো।আমি আর বেশী কিছু আশা করিও নি।আমার স্কুল মাস্টার বাবা শিখিয়েছিলেন কম আশা, কম দুঃখ।সেই নীতিই আমি মেনে চলবার চেষ্টা করি। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে পরের দিন দুপুরে নীলু হাতে একটা বড় টিফিন ক্যারিয়ার নিয়ে চলে এলো।বন্ধু নয়ন পাশে বসে আমি যে কত বড় গরু তা নিয়ে বিশাল বক্তব্য দিচ্ছিলো,নীলু ঢুকতেই তার মুখ হা হয়ে থেমে গেলো।

– আরে নীলু যে,কেমন আছো?শরীর ভালো?
-আপনি দুনিয়ায় এই এক কথা ছাড়া কিছু জানেন না আর? আর আমার স্বাস্থ্য নিয়ে এত সচেতন আপনার না হলেও চলবে।

আরে বসো বসো আমি ইশারায় নয়নকে বাইরে যেতে বললাম।কিন্তু দুনিয়ায় মানুষ আছে তিন ধরণের। ভালো মানুষ,খারাপ মানুষ,আর নয়ন।হারামজাদা আমার ইশারা না বোঝার ভান করে চুপচাপ বসে রইলো।

– এই নেন,নিজে রান্না করে এনেছি।হাজার হোক আপনি আমার শিক্ষক।আমার একটা দায়িত্ব আছে।
– আরে কী দরকার ছিলো এত কষ্ট করবার?
-যতটা ভাবছেন ততটা কষ্টও আমি করি নি।বাইরের ছাইপাঁশ খেয়ে স্বাস্থ্য তো বানাচ্ছেন দিন দিন। নিন খেয়ে নিন।

নীলু টিফিন বাটি খুলে মুরগীর রোস্ট,বেগুন ভাজা,বাসমতি চালের ভাত আর চিঙড়ীর ঝোল বের করলো। এই সময় নয়ন বলে উঠলো

– আরে আপু কি করো?
-কেন ভাইয়া?
-ইমরানের তো এসব খাওয়া মানা,স্যাররা নিষেধ করেছেন।

আমি হতাশায় মাথা নেড়ে বুঝলাম আমার জীবনের অনেক ভুলের একটা এই ছেলের সাথে বন্ধুত্ব করা।হাসপাতাল থেকে বের হয়েই আমার জীবন থেকে সকল প্রকার নয়ন নিষিদ্ধ করে দিতে হবে।ইট ইজ হাই টাইম।

নীলু আসতো রোজ দুপুর গড়ালে,আমি অবাক হচ্ছিলাম।সারাদিন ভার্সিটির ক্লাস করেই এই মেয়ে এত কষ্ট করে কেন রোজ আসছে? রোজ রান্না করে নিয়ে আসতো,আমি খাদ্য প্রেমিক।আরাম করে খেতাম। নীলু চুপ করে বসে দেখতো,এই মেয়েকে দেখে বোঝার উপায় নেই এর বাবা ডিসি,কোনদিন সচিব টচিব হয়ে যাবেন কিছু একটা। কোনদিন অকারণে কথা না বলা মেয়েটাও রোজ নিয়ম করে আমাকে দেখতে আসতো,চারদিন পর হাসপাতাল থেকে রিলিজ দিয়ে বললো বাসায় গিয়ে রেস্ট নিতে। নীলু আমার জিনিস গোছ করে দিলো,রিক্সায় তুলে দেবার আগে বললো

– সাবধানে থাকবেন,চোখের চিকিৎসা টাও করায় নিয়েন।
– কেন?
-আপনি তো কানা,না রাস্তা পার হবার সময় গাড়ি দেখেন,না চারপাশের মানুষ।

রিক্সা চলতে শুরু করলে আমি ভাবতে লাগলাম আচ্ছা মেয়েটার কথায় কী অভিমান ছিলো? অনুরাগ? পাক্কা ৩২ দিন পর ঢাকায় ফেরারপর আমার মনে হল নীলুর খোঁজ নেয়া উচিত।আমি উচিত কাজ সহজে করতে পারলাম না,কারণ আমার কাছে ওর মোবাইল নম্বর ছিলো না।আমি ঘুরতে লাগলাম ঢাকা ভার্সিটি এলাকা দিয়ে,রোজ দুপুর বেলা।কিন্তু দেখা হয় না।পুরো ৫৬ ঘন্টা গরু খোঁজার পর আচমকা দেখা হলো একদিন ফুলার রোডের পাশে।

– নীলু,এই নীলু? ও ওর এক বান্ধবীর সাথে ছিলো।আমার ডাকে ঘুরে তাকালো।

– কেমন আছো? তোমার ফোন নাম্বার টা দাও তো? বান্ধবীর সামনে আচমকা এমন ভাবে আসায় হয়তো চমকেই গেছিলো একটু। নাম্বার দিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলো

– আপনার খবর কি? সুস্থ?

-ফাইন,আই এম ভেরীই ফাইন।

বাসায় থাকার একটা মাস আমার করার কিছু ছিলো না,আমি শুয়ে শুয়ে বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের বিভিন্ন আজাইরা প্যাচাল নিয়ে ভাবতাম।এইসব ভাবনার বাইরে নীলুকে নিয়েও আমি ভাবতাম।এইসব ভেবে ভেবে আমি এই সিদ্ধান্তে আসতে পারলাম যে,নীলুকে আমি ভালোবাসি।অনেক অনেক, জীবনের চেয়েও ভালোবাসার মত কিছু অবশ্য হয় নি।তবে আমি ওকে ভালোবাসি,এবং ও ভালোবাসুক বা নাবাসুক এই কথাটা ওকে জানানো দরকার! ঢাকায় ফিরে অতি বিশ্রী হাতের লেখায় চিঠি লিখে ফেললাম একটা ” নীলু জানো, আমি তোমাকে ভালোবাসি-” এইটুক লেখার পর আর কিছু আসে নি মাথায়। নীলুকে ফোন দিয়ে বললাম,

– আজ বিকেলে একটু বের হই চলো।

– কেন?

-আরে তুমি আমার জন্যে এত কিছু করলে, তোমারে ট্রিট দেবো।

– আমি কি আপনার ট্রিটের আশায় এইসব করছি? নীলু অভিমানী সুরে বলে উঠল। এই মেয়ে দেখি খুবই ঘিরিংগি বাজ।আমি সংশোধনের সুরে বললাম,

– আরে না না,তাও চলো না।

– আচ্ছা ।আমি আসবো।

বিকেলে নীলু এলো, আমি শার্ট পরে একটু বেশ ফর্মাল লুক নিয়ে এলাম। কেমন আছো নীলু? ওমা,আপনি শার্ট পরেন কেন? শার্ট পরলে আপনার বিশ্রী ভুড়িটা আরো বিশ্রী ভাবে ফুটে ওঠে।

সে সময়টাতে আমার ভেতর বেশ অস্থিরতা কাজ করছিলো।জীবনে প্রথম বার প্রেমপত্র দিতে এসেছি,একটু নার্ভাস হওয়া উচিত।এর আগে ক্লাস টু তে এক মেয়েকে বলেছিলাম তুমি আমার বউ হবা?সে মেয়েটি স্যারের কাছে নালিশ করতে পারতো,বা বাবা মার কাছে নালিশ করতে পারতো,না মেয়েটা ওসবের কিছুই করে নি।তখন মেয়েটি আখ খাচ্ছিলো,খেতে খেতেই কথা শুনে আমার নাকে বাড়ি মারলো।আমার নাক দিয়ে গল গল করে রক্ত বের হচ্ছিলো,আমি প্রেমে ব্যর্থ হবার কষ্টের থেকেও নাকের কষ্টে বেশী কাঁদছিলাম।সে বহুকাল আগের কথা।এতদিনে আর এইসব করা হয় নি,অনভ্যাসে বিদ্যা হ্রাস আমার। নীলু এক কাপ কফি নিলো,অতি নার্ভাসনেসে আমি গপগপ করে খেতে লাগলাম।খাওয়া শেষে যাবার আগে আমি নীলুর হাতে আমার চিরকুট গুজে দিয়ে কোন কথা আর না বলে একরকম পালিয়ে চলে এলাম! তার পরদিন নিলুর ফোন,

-ইমরান ভাই,ফ্রি আছেন?

-কেন বলো তো?

-বিকেলে একটু আমার হলের সামনে আসেন,কথা আছে।

নীলুর কন্ঠ কেমন শোনা যাচ্ছিলো,একারণেই বোধহয় ডিসির মেয়েরে প্রেমপত্র দিতে নেই।পুলিশে টুলিশে না ধরিয়ে দেয়! বিকেলে অতি সাবধানে আমি নীলুর হলের দিকে গেলাম।মেয়ে রাজি না হোক আপত্তি নেই- কিন্তু কোনভাবেই যেন অঙ্গহানি না হয়। আমাকে অবাক করে দিয়ে নীলু এসবের কিছু বলল না। কেবল একটু হতাশার সুরে বলল,

-আপনি জীবনে কোন মেয়েরে প্রেমপত্র দিয়েছেন? আমি চুপ

-কথা বলছেন না কেন?

-ইয়ে মানে নীলু, আসলে,,,,

-আপনি চুপ থাকুন! আমি ভেবেছিলাম আমার যার প্রেমে পরবো সে হবে দারুন রোমান্টিক! আর এখন কি না যে ছেলে একটা চিঠি ও ঠিক করে লিখতে পারে না তার প্রোপোজালেও আমি রাজি হতে যাচ্ছি,অদ্ভুত ব্যাপার।

-মানে?

-আপনার মানে বুঝতে হবে না,এমন গোবর গণেশ ই থাকবেন,আমি মানে বুঝায় দিবো।একটা রিক্সা ডাকেন। আজ আমার ঘুরতে ইচ্ছে করছে!

নীলুকে প্রোপোজ করেছিলাম ওর প্রেমে পড়ে বা ফ্যাসিনেশন থেকে,কিন্তু ওকে ভালোবাসা শিখলাম প্রেম টা হয়ে যাবার পরে।অদ্ভুত এক মায়ার সম্পর্ক হয়ে গেলো,নীলু আমার উপর অনেক বেশী অধিকার দেখাতো না,রুটিন করে দেখা করতেই হবে বা ফোন দিতে হবে এমন ব্যাপার ছিলো না। আমার জগতে আমি, ওর জগতে ও ছিলো।সারাদিন ক্লাস ওয়ার্ড টিউশনি নিয়ে আমি হয়তো ওকে সময় দিতে পারতাম না তেমন,অভিযোগ করতো না।রোজ রাতে ওর সাথে কথা বলা ওই ২০-২৫ মিনিট আমার সারাদিনের সব ক্লান্তিকেই ভুলিয়ে দিতো।প্রতি বৃহস্পতিবার অবশ্যই দেখা করতাম আমরা।বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যার দিকে ওকে হলের সামনে নামিয়ে দিতাম।মেয়েটা ছিলো শান্ত,সেই শান্ত দীঘির খবর আমি পেয়েছিলাম।আসার আগে আস্তে করে বলতো সাবধানে যাবেন। একদিন নীলুর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,

-তুমি আমাকে এখনো আপনি করে বলো কেন?

-তুমি করে বলার জন্যে তো একটা জীবন পড়েই আছে।

কে বলেছে এক জীবন পূর্ণ করতে হাজার মুহূর্ত লাগে? নীলু ছিল আমার জীবনের পৃর্ণতার সবটুকু।সেই জীবনের দিনগুলো আস্তে আস্তে গড়াতে থাকে,আমি পাশ করে নামের আগে ডাক্তার বসিয়ে নিয়ে ভাবি নীলুকে পাবার দাবিটা বুঝি আরো জোরালো হল!

আর তাই ইন্টার্নশীপের শেষ দিকে এক বিকেলে আমি নীলুর বাবার সাথে দেখা করি।এরপরের গল্পটা খুব সাধারণ হতে পারত-নীলুর বাবা আমার আর নীলুকে মেনে নিলো,আমরা বিয়ে করলাম,জীবন সুখে শান্তিতে কাটতে লাগলো,ঘর ভর্তি আমাদের বাচ্চাকাচ্চা হলো। কিন্তু পাঠক, বাস্তবতা কি আমাদের কল্পনার মত এতই সহজ? এত সহজ যদি জীবনের সব লাইন হতো তবে কি আজ আপনাদের সামনে আমি আসতাম? নীলুর বাবা, কোন অংক কষেই নীলুর পাশে আমাকে কোনভাবেই যোগ্য মনে করতে পারেন নি! শেষ যেদিন দেখা হয়েছিল নীলুকে তখন ভর দুপুরের শান্ত দীঘির চেয়ে শান্ত দেখাচ্ছিল।

-আমাদের আর দেখা হবে না?

-দেখা না হবার চান্স বেশী,নীলু।

-বাবা বিয়েটা দিয়েই দেবেন।

-ছেলে কী করে?

-আমেরিকা থাকে,ইঞ্জিনিয়ার।

-ওহ ফাইইন,ভেরী ফাইন।তোমার পাশে মানাবে।

-আপনি এখনো ফাইজলামি করছেন?

-আরে ধুর বোকা মেয়ে,আসলেই বলছি।তোমার পাশে আমি যে বড্ড বেমানান এটা বুঝতেই আমার এত বছর লেগে গেলো।

-আপনি আমাকে ভালোবাসেন? আপনার ইচ্ছে করে নি কখনো আমাকে নিয়ে খুব দূরে চলে যেতে?

– নীলু, তুমি তোমার বাবাকে যেমন কষ্ট দিতে চাও নি বলে আমায় পাঠিয়েছিলে তেমনি আমিও আমার স্কুল মাষ্টার বাবাকে কষ্ট দেওয়ার কথা ভাবতে পারি না।তারচেয়ে আমরা দুজনই কষ্টে থাকি, তারা বরং সুখী হউক!

-আপনি সাবধানে থাকবেন,যত্ন নিবেন।আরেকটা কথা, আপনি আরেকটু সাহসী হবেন। না হলে জীবনে অনেক কষ্ট পাবেন!

-আজকেও আপনি বলছো,তুমি করে বলার জন্যে কিন্তু এক জীবন আর পাবে না। নীলুর আর আমাকে ‘তুমি’বলা হয় নি। হয়তো অভিমানেই সম্ভোধন উহ্য রেখে নীলু বলেছিল,

– আমি আসি।

হুট করে নীলু এসেছিলো আমার জীবনে,অগোছালো আমাকে গুছিয়ে হুট করেই চলে গিয়েছিলো। আমি ভেবেছিলাম আমার সাথে নীলুর বা নীলুর সাথে আমার এই মানব জনমে আর দেখা হবে না।কিন্তু আমি যা ভাবি তা আর কবেই বা ঠিক হল? আজ প্রায় ২০ বছর পর,হ্যাঁ ২০ বছর তো হবেই।এতকাল পরে এসে নীলুকে দেখলাম আমি শিকাগোর নর্থ ওয়েস্টার্ন মেমোরিয়াল হাসপাতালে।মনের অজান্তেই কত কথা মনে পড়ছিলো। ক্রসম্যাচিংয়ের রিপোর্টগুলো সামনে নিয়ে ডক্টর স্মিথ এ নিয়ে তেরতম বার আমাকে জিজ্ঞেস করল,

-আপনি কি শিওর মি.ইমরান?

-অবশ্যই ডাক্তার

-কিন্তু আপনি নিজেও একজন ডাক্তার,আপনি জানেন এই বয়সে আপনি একটা কিডনী দিলে সেটা আপনার জন্যে রিস্কি হতে পারে

-যদি কিন্তুর চেয়ে বড় কথা আমার কিডনীটা পেলে একটা ১৫ বছরের বাচ্চা ভালো হয়ে যাবে

-কিন্তু আপনি একজনকে চেনেন না,ইভেন ডোনার হিসেবে আপনি নিজের নাম ও এক্সপোস করতে চাইছেন না।

-কে বলেছে চিনি না? নিজের থেকেও ভালো চিনি ডক্টর

-বাট মি.ইমরান আরেকবার ভাবুন আপনার কিন্তু কয়েকটা রিস্ক ফ্যাক্টর রয়েছে।যদি এমন হয় আপনি আর জেগেই উঠলেন না?

-তাতে কিছু যায় আসে না ডক্টর স্মিথ,আমার বয়স ৪৬,আমি অবিবাহিত। এই পৃথিবীর যা যা দেখার শখ ছিলো,পাওয়ার শখ ছিলো তার সব কিছুই আমি পেয়েছি,দেখেছি।আমি মারা গেলেও কারো কিছু যায় আসে না।বাট ছেলেটাকে দেখেছো তুমি? মাত্র ১৫ বছর বয়স,ছেলেটার মা বাবা কে দেখেছো? কি দিশেহারা হয়ে আছে।ছেলেটা না থাকলে অনেক কিছু যায় আসে,নীলুর যায় আসে।

-what?

-nothing, I’m ready.বাট আমার পরিচয় টা কিন্তু জানবে না কেউ।

অপারেশন টেবিলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আমাকে।জীবনে নিজে তো কম অপারেশন করি নি,তাও আজ ভয় ভয় লাগছে।নীলু আমায় সাহসী হতে বলেছিল হয়তো এতগুলি বছর পেরিয়েও আমি ঠিকঠাক সাহসী হতে পারলাম না! মাথার ভেতর কেমন বেজে চলেছে একই বারান্দা জুড়ে,হবে শীত রোদ্দুরে রোজই দেখা কোন হঠাৎ দুপুরে,যদি মনে হয় দূরে তুমি একা।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত