অফিসে ঢুকার আগে পারভীনকে বললাম, “ মিস পারভীন, আপনি কি একা? আপনাকে জানিয়ে রাখি। আমিও একা। ” পারভীন আমার অফিসের দলিল নিয়ন্ত্রণকারিনী।
সে কেমন একটা হাসি দিলো। নিজের টাই কোট দেখলাম ঠিকই আছে! আবার বললাম, “ আমার কথাটা আপনি ভেবে দেখতে পারেন। আমি শান্তশিষ্ট বোকাসোকা একজন ভদ্র ছেলে। স্বামী হিসেবে দারুণ হবো সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নাই! ” পারভীন এবার মুচকি হেসে বললো, “ স্যার, এখনই বিয়ে করার কোনো চিন্তা নাই আমার। ” মেয়েটার চোখ খুলে দিতে আবার বললাম, “ আপনাকে আরো জানিয়ে রাখি। আমি গত সপ্তাহে আরেকটা গাড়ি নিয়েছি। গাড়ির সিটগুলো খুব নরম। বসতে আরাম। ”
পারভীন আবার শান্ত গলায় বললো, “ স্যার, অফিসের কাছেই আমার বাসা। হেঁটে গেলেও বেশি সময় লাগে না। ”
মেয়েটাকে বুঝানো গেলো না। নিজের রুমে গেলাম। আমার ব্যক্তিগত সহকারীকে বললাম, “ রাজিব, পত্রিকায় একটা বিজ্ঞাপন দেওয়ার ব্যবস্থা করো পাত্রী চেয়ে। আমি আর একা থাকতে পারছি না! ” রাজিব আমার দিকে যেভাবে তাকালো মনে হচ্ছে অজগর সাপ দেখছে! তাঁর এরকম চাহনি দেখে বললাম, “ এভাবে কী দেখছো? আমি কী ছেলে মানুষ না? আমার কী বিয়ে করার দরকার না? ” রাজিব মাথা নাড়ালো।
“ হ্যাঁ স্যার করার দরকার আছে। আমি দেখছি খবরেরকাগজের অফিসে কথাবার্তা বলে। ”
“ যাও আমার জন্য চা সিঙ্গারা আনতে বলো। ”
পাঁচ মিনিটের মধ্যে একটা মেয়ে চা সিঙ্গারা নিয়ে এলো। এই মেয়ের নাম ইয়াসমিন সুলতানা। তাঁর কাজ কিন্তু চা সিঙ্গারা বানানো না। কিন্তু সে এটা এতো ভালো মানায় যে দিগুণ বেতন দিয়ে চা সিঙ্গারা বানানোতে নিযুক্ত করেছি।
সাদা শার্ট, চুলগুলো পরিপাটি আর মুখে সবসময় হাসি। এই মেয়েটাকে বিয়ে করলে খারাপ হয় না। টেবিলে চা রাখার পরে বললাম, “ মিস ইয়াসমিন দাঁড়ান। ”
“ জি স্যার। ”
“ আপনাকে জানিয়ে রাখি আমি এখনো একা। চারদিকে তলব লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। যেকোনো মুহূর্তে দুকা হয়ে যেতে পারি। ” ইয়াসমিনের হাসি মুখটায় লজ্জা ভর করলো।
“ জি স্যার! ”
“ জি স্যার, জি স্যার না করে ব্যাপারটা বুঝতে চেষ্টা করেন।
আমিও একা, আপনিও একা! আপনাকে আরেকটা ব্যাপার জানিয়ে দিচ্ছি। আমি পরশু থেকে জিমে যাচ্ছি। দৈনিক দুই ঘন্টা জিম করবো। ” ইয়াসমিন হেসে বললো, “ জি স্যার! ” মেয়েটা এতো জি স্যার জি স্যার করে, মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। কিন্তু সে মেয়ে হিসেবে চমৎকার তাই মেজাজ দেখাতে পারলাম না। আবারো বললাম, “ আপনাকে আরো জানিয়ে রাখি আমার বিয়েতে সাকিব আল হাসানকে দাওয়াত করা হবে। তবে শিশির ভাবীকে নিয়ে আসতে মানা করে দিয়েছি। শুধু আলাইনাকে নিয়ে আসবে। ” ইয়াসমিন অবাক হয়ে বললো, “ কেনো স্যার? ”
“ কারণ আমি চাই আমার বিয়েতে কোনো মেয়ে মানুষ না আসুক! ”
“ জি স্যার। ”
আমার ব্যাপারে অগ্রাহ্যতা দেখে অবাক হলাম। ছেলে হিসেবে আমি খারাপ না। কথাবার্তা সোজাসাপটা বলি। এটাই মনে হয় তাঁদের ভালো লাগে না।
“ আচ্ছা আপনি যান, আর শুনেন। আপনার একা কোনো বান্ধবী থাকলে আমার কথা বলবেন। যদি আপনার প্রেমিক থাকে! ” ইয়াসমিন সঙ্গে সঙ্গে মাথা নাড়িয়ে বললো, “ আচ্ছা স্যার! ” স্যার স্যার করে সে চলে গেলো। কিছু মেয়ে আছে স্যার ছাড়া যেন আর কিছুই বলতে পারে না। কিন্তু মাস শেষে বেতন কিন্তু কারো থেকে কম নেয় না! রাজিব ফিরে আসলো আবার।
“ স্যার, কাল বাংলাদেশ প্রতিদিনের মাঝে বিজ্ঞাপন দেয়া হয়েছে। ”
“ বাহ, বেশ ভালো কাজ করেছো। ”
“ জি স্যার, বাহিরে একটা সাংবাদিক অপেক্ষা করছে।
আপনার একান্ত সাক্ষাৎকার নিবেন এই অফিসের ব্যাপারে। আমি কী তাঁকে আসতে বলবো? ” মাথা নাড়ালাম। রাজিব মেয়েটাকে আসতে বললো। মেয়েটা প্যান্ট আর জামা পরেছে। জামার নাম কী আমি জানি না। পাঞ্জাবির মতো অনেকটা। সে বসেই বললো, “ মিস্টার গালিব। আপনার ব্যাপারে অনেক অভিযোগ উঠেছে যে। ” সে এটুকু বলতেই আমি থামিয়ে দিলাম।
“ আপনার নাম কী? ”
“ আমার নাম টিকলি! ”
“ টিকলি? টিকলি কোনো নাম হয় নাকি?
আচ্ছা আপনি কী একা? ” মেয়েটা থেমে থেমে কথা বলছে না। চোখে চোখ রেখে কথা বলছে। সাংবাদিকেরা বেশ চালাক হয়। বললো, “ জি না স্যার। আমি একা না। আমার মা বাবা ভাই বোন সবাই আছে। ” “ আপনার কী প্রেমিক আছে? ” এবার মেয়েটা থেমে গিয়ে বললো, “ নাহ! আপনি কাজের কথায় আসুন। ”
“ আচ্ছা টিকলি, আমি কাজের কথাই বলছি। আপনাকে জানিয়ে রাখি আমি একা। যদি আপনিও একা হোন। আমার ব্যাপারে ভেবে দেখতে পারেন। আমি বোকাসোকা শান্ত একটা ছেলে। স্বামী হিসেবে চমৎকার হবো সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নাই! তবে যদি আপনি দুকা হোন, তাহলে বার্তাটি আপনার কোনো বান্ধবীর কাছে প্রেরিত করে সাহায্য করবেন। তবে অবশ্যই বান্ধবীটি যেন একা হয়! ” মিস টিকলি রাজিবের দিকে একবার তাকালো। তারপর বললো, “ স্যার, এসব কথা ছাড়ুন। কাজের কথায় আসুন। ” “ কাজের কথা যদি বলি। তবে আমি আপনাকে জানিয়ে রাখি। আমি আজকাল অফিস থেকে দুই ঘন্টা আগে বাসায় ফিরছি। দুই ঘন্টা জিমে কাটাই। তার উপর সেদিন একটা গাড়ি কিনলাম, সিটগুলো বেশ আরামদায়ক। ”
টিকলি উঠে পড়লো। রাজিবকে বললো, “ আরেকদিন আসবো আমি। আজকে যাচ্ছি। ” আমি আবারো থামিয়ে বললাম, “ আপনি চাইলে আমার নাম্বারটা নিয়ে যেতে পারেন। আমার নাম্বার পেতে আপনার তেমন কোনো কষ্ট হবে না। রাজিবকে বললেই দিয়ে দিবে। ” মেয়েটা হনহন করে বেড়িয়ে গেলো! রাজিব বললো, “ স্যার, কাজটা কী ঠিক করলেন? মেয়েটা তো সাংবাদিক! ” আমি রাজিবকে ঝারি দিয়ে বললাম, “ সাংবাদিক মেয়েদের কী মন নাই? ”
“ তাইতো স্যার, এই কথাটা আমি ভেবে দেখিনি! ”
“ তুমি কোনো কথাই ভেবে দেখো না। এটা তোমার অভ্যাস। অবশ্য এজন্যই আজও তুমি টিকে আছো! ”
অফিসের কোনো কাজে মন বসছে না। বত্রিশটা বছর পেরিয়ে গেলো একা একা। আর থাকা যায়? মানে মানুষের কী কোনো আহ্লাদ ইচ্ছা থাকতে পারে না? মানুষ কী একটু বিয়ে করতে পারে না? আমি জানি না আশেপাশের মেয়েদের কী হয়েছে! আমাকে পাত্তাই দিচ্ছে না! অথচ আমি দেখতেও খারাপ না। টাকা পয়সাও যে নাই। সে কথাও বলা যাবে না। দুপুর একটা বাজে রাজিবকে বললাম, “ তুমি অফিসটা দেখো আমি বাহিরে যাবো। ”
“ কেনো স্যার? ”
“ নিজের পাত্রী নিজেকেই খুঁজতে হয়। অন্যকে সে দায়িত্ব দিলে। পাত্রীর বদলে অনেক কিছু খুঁজে বের করতে পারে! গাড়িটা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। মতিঝিল পর্যন্ত যেতেই গাড়িতে পেট্রোল শেষ। কোনোরকমে একটা পাম্পের সামনে গিয়ে দেখি একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে কালো কালো শার্ট প্যান্ট পরে! মনে হচ্ছে পেট্রোল পাম্পের মহিলা প্রহরী!
অবাক লাগছে আমার কাছে। গাড়িটা পাম্পের ভেতরে এক জায়গায় দাড় করিয়ে মেয়েটার কাছে গেলাম।
“ আচ্ছা, তোমার নাম কী? ” মেয়েটা বেশ সাবলীলভাবেই বললো, “ আমার নাম মেধা স্যার। আপনাকে কীভাবে সাহায্য করতে পারি? ”
“ মেধা স্যার! নামটা বেশ সুন্দর তো। আর আমাকে আপনার সাহায্য করা লাগবে। সাহায্যের জন্যই এলাম। ”
“ জি না স্যার, আমার নাম মেধা জাহান। বলুন কীভাবে সাহায্য করতে পারি? ”
“ মেধা জাহান?
আপনাকে জানিয়ে রাখি, জাহান নামটা বেশ সুন্দর। এর অর্থ হচ্ছে পৃথিবী। আমি এরকম মজার মজার তথ্য নিয়ে ঘুরেই বেড়াই! কথা সেটা না। কথা হলো, আপনাকে জানিয়ে রাখি যে আমি একা। চারদিকে তলব লাগিয়ে দেয়া হয়েছে, কখন দুকা হয়ে যাই তার ঠিক নাই। আমি চাচ্ছি আপনি এই সুযোগটা হাতছাড়া করবেন না। ভয় পাবার কিছু নেই। আমি বোকাসোকা ভদ্র একজন ছেলে। কথা কম বলি। স্বামী হিসেবে দারুণ হবো তাতে কোনো সন্দেহ নাই! ” মেয়েটা ফিক করে হেসে দিয়ে বললো, “ স্যার আমি বিবাহিত! ” দীর্ঘশ্বাস নিলাম। দেখলাম পাশেই আরেকটা মেয়ে একই কাজ করে। সে মুখ টিপেটিপে হাসছে। সে মনে হয় অবিবাহিত। কাছে গিয়ে বললাম।
“ দেখুন, আপনার নাম কী আমি জানি না। তবে আপনাকে জানিয়ে রাখি, আমি বোকাসোকা ভদ্র নম্র একটা ছেলে। একা আছি কিন্তু চারদিকে তলব লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে কখন দুকা হয়ে যাই কোনো ঠিক নাই! ” মেয়েটা কেমন সোজাসাপটা বলে দিলো, “ আমার দুইটা বাচ্চাও আছে স্যার! ” মেজাজ খারাপ হলো। প্রত্যেকটা দারুণ মেয়েই বিয়ে করে নিয়েছে! যে এখনো করেনি সে আমার কথা বিবেচনায় রাখছে না! এখানকার ব্যবস্থাপক বেশ চতুর বলতে হবে। কোনো অবিবাহিত মেয়েকে চাকরী দেয়নি। নাহলে প্রেমের বন্যা বয়ে যেতো! গাড়িতে পেট্রোল নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দিলাম। বাড়িতে গিয়ে গোসল করে আমার এক বান্ধবীকে ফোন করবো। সে আইন নিয়ে পড়ছে। দারুণ মেয়ে। সেও যদি রাজি না হয় তাহলে তাঁর ছোট বোনকে জানিয়ে রাখবো আমি একা। ছোট বোন এবার নিয়ে চারবার উচ্চমাধ্যমিক দিয়েছে। কিন্তু পাশ করতে পারছে না! তাঁর ধৈর্য আর হাল না ছেড়ে দেওয়া আমাকে মুগ্ধ করে।
বাড়িতে গিয়ে কলিং বেল চাপলাম। একটা অপূর্বা মেয়ে দরজা খুলেছে! তাঁকে তো আগে কোনোদিন আমাদের বাড়িতে দেখিনি! এই মেয়েটাকে যেভাবেই হোক মানাতেই হবে। বললাম, “ নতুন? মানে এই বাসায় নতুন? ” মেয়েটা কিছুই বললো না। আমার দিকে কেমন রাগি চোখে তাকালো! বাহ চোখ দুটোও নদীর মতো! রাগ দেখাক আর যাই করুক। আমি আবারো বললাম, “ আপনাকে জানিয়ে রাখি, এই বাড়িতে একমাত্র সন্তান আমি। শান্তশিষ্ট ভদ্র, নরম মতো বোকা, লাজুক একটা ছেলে আমি। কথা কম বলি। স্বামী হিসেবে দারুণ হবো সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নাই! ”
মেয়েটা ড্যাবড্যাব করে চেয়েই থাকলো। কেই এই রমণী তা তো জানি না। কিন্তু তাঁকে আমার ঘরণী হতেই হবে। থেমে আবারো বললাম, “ আপনাকে জানিয়ে রাখি, আমি হুমায়ূন আহমেদ পড়া শুরু করে দিয়েছি। রোমান্টিকতায় অতি শীঘ্রই পরিপক্বতা লাভ করবো আশা করছি। আপনাকে আরো জানিয়ে রাখি, আমি সেদিন একটা নতুন গাড়ি কিনেছি। গাড়ির সিটগুলো বেশ আরামদায়ক। এখানেই শেষ না। আমি কিন্তু রোজ দুই ঘন্টা করে জিম করি! ”
এর মাঝেই মেয়েটা বললো, “ আম্মা, আপনার ছেলের কান্ড দেখে যান! আমি অবাক হলাম! বিয়ের আগেই আমার আম্মাকে সে আম্মা ডাকছে! মধুর মতো লাগলো শুনতে। মেয়েটাকে মনে হয় আম্মা পছন্দ করে রেখেছে! কিন্তু আম্মা দেখি হাতে ঝাঁটা নিয়ে এসেছে! মেয়েটার হাতে দিয়ে চলে গেলো। আর কিছু বললো না! আমি আবারো বললাম, “ আপনাকে জানিয়ে রাখি। এটুকু বলতেই সে বললো, “ রাখ বেটা তোর জানিয়ে রাখা! ” বলেই ঝাঁটা দিয়ে সমানে মারতে শুরু করলো! আমি প্রতিরোধ গড়ে তোলার আগে বললাম, “ কী ব্যাপার আপনি আমাকে মারছেন কেনো? ”
“ শ্বশুরের পোলা, আমি তোর বৌ। আর তুই আমার সাথেই মাতলামি করিস? ” ঝাঁটার বারি খেতে খেতে মনে হলো। হ্যাঁ এই মেয়েটাই আমার বৌ। প্রত্যেকদিন রাতে এই মেয়েটার সাথেই আমার মারামারি হয়। আম্মা বলে দিয়েছিলো আরেকদিন যদি অফিস থেকে ফেরার সময় বার হয়ে আসি। তাহলে বৌয়ের হাতে ঝাঁটা তুলে দেবে! আমার আম্মা আবার এক কথার মানুষ! সে ঝাঁটা দিয়ে মারতে মারতে শার্ট ময়লা করে ফেলেছে! কলারে ধরে বললো, “ আজকে কেনো তুমি অফিস থেকে আসার সময় বার হয়ে আসলে? কোন মেয়ের বিরহে? বলো নাহলে আজকে মেরেই ফেলবো! অনুমতি আছে! ” আমি শার্টার কলার থেকে তাঁর হাত সরিয়ে বললাম, “ আমি অফিস থেকে আসার সময় আমি বারে যাইনি! তোমার কসম! ”
“ আবার আমার কসম খায়! ঢং করো? আমি কিছু বুঝি না নাকি? অফিস থেকে আসার সময় বার হয়ে না আসলে মাতলামি করছিলে কেনো? ” আমি তাঁর হাতদুটো ধরে বললাম। “ আমি তো অফিসে যাওয়ার সময় বার হয়ে গেছিলাম! ” আমার কথা শুনে বৌয়ের মাথায় হাত! গাল মুখ ফুলিয়ে অসহায়ের মতো বললো, “ তাহলে তো আজকে অনেক মেয়েরই হাত ধরা হয়ে গেছে না? সত্যি বলো! ” এর মাঝেই আবার আম্মা বললো, “ রাখ বৌমা, ঝাঁটাতে কাজ হবে না। আমি আরো শক্ত কিছু এনে দিচ্ছি!