একটি একদিনের গল্প

একটি একদিনের গল্প

রাত আটটা। এই মুহূর্তে বাড়ির পরিবেশ থমথমে। ঘটনা অবশ্য তেমন জটিল কিছু না। আজ সকালে বাবার বিশ্বস্ত বন্ধু সেলিম ফোন দিয়ে বলেছেন, গতকাল তিনি আমার ছোটবোন নীলুকে এক ছেলের সাথে রিক্সায় হাত ধরে ঘুরাঘুরি করতে দেখেছেন। ব্যস! বাবার মাথা চক্কর দিতে বেশি সময় লাগলো না। উনার বড় মেয়ে অর্থাৎ আমি প্রেম করে লুকিয়ে বিয়ে করেছিলাম। একই ঘটনার যাতে পুনরাবৃত্তি না হয় তাই বাবা একদিনের ভেতরেই নীলুর বিয়ে ঠিক করে ফেলেছেন। আগামীকাল সন্ধ্যার পর বিয়ে। এই খবর শুনে নীলু এখন পর্যন্ত তিনবার বেহুশ হয়েছে। মেয়েটার কর্মকান্ডে আমি যতটা না বিরক্ত, তারচেয়ে বেশি হতাশ। এত দুর্বল হলে চলে? আমাকে দেখেও কিছু শিখলো না! ওর চোখে মুখে পানি ছিটাতে ছিটাতে আমি এখন ক্লান্ত। শেষমেষ পুরো গ্লাসের পানিটাই ওর মুখে ঢেলে দিলাম। এবার সে হুড়মুড়িয়ে উঠে বসল। আমি বললাম,

–“নেক্সট টাইম বেহুশ হওয়ার আগে নিজের মুখে পানি ঢালার জন্য কাউকে ব্যবস্থা করে তারপর বেহুশ হবি। বুঝলি?” আমার ‘ন্যাড়া’বর শ্রাবণ পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। বাবার রাগ এখনও ওর ওপর থেকে পড়েনি। শ্রাবণকে শ্বশুরবাড়ি আসতে গেলে মাথা ন্যাড়া করে আসতে হবে, এই শর্তেই বাবা ওকে মেনে নিয়েছেন।মেয়ে পালিয়ে নিয়ে বিয়ে করার এটাই ওর একমাত্র পার্মানেন্ট শাস্তি। যাইহোক, শ্রাবণ গ্লাস ভর্তি পানি হাতে নিয়ে নীলুর পাশে বসে আমাকে বলল,

–“তুমি এবার রেস্ট নাও। আমি দেখছি।” আমাদের কার্যকলাপ দেখে নীলু কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলল,

–“আমি কী সাঁধে বেহুশ হচ্ছি?” আমি বললাম,

–“সেটা তো জানি না। তবে এটা ভালো করে জানি যে, তুই চৌদ্দবার বেহুশ হলেও এই বিয়ে ভাঙ্গতে পারবি না। তারচেয়ে বরং হুশে আয়। কিছু করা গেলেও করা যেতে পারে।” শ্রাবণ নীলুকে জিজ্ঞেস করলো,

–“ছেলেটার নাম কী?”
–“শাহেদ।”
–“ওকে ফোন করেছিলে?”
–“না।”
–“ওকে ফোন করে সবটা বলো। দেখো কী বলে।”
–“মোবাইল তো বাবার কাছে।”
–“ঠিক আছে, আমার মোবাইল থেকে করো।” নীলু ভ্যাবলার মতো বলল,

–“ওর নাম্বারতো আমার মুখস্থ না। কোথাও লিখেও রাখিনি।” শ্রাবণের মুখের ভঙ্গিটা এমন হলো যেন তিতা করোলা খেয়ে ফেলেছে। নাক-মুখ কুঁচকে বলে উঠলো,

–“এ কেমন প্রেমিকা তুমি! নিজের প্রেমিকের মোবাইল নাম্বারটাও মুখস্থ না! তুমি তো প্রেমিকা নামের কলঙ্ক।
নীলু ঠোঁট কামড়ে বসে রইলো। শ্রাবণ আবার বলল,

–“ফেসবুকে একটা মেসেজ দিয়ে রাখো। ফেসবুকে এড আছ তো?” নীলু জোরে জোরে মাথা ঝাকালো। আমি মুচকি হেসে শ্রাবণকে বললাম,

–“বাবা যদি জানতে পারেন তুমি ওর প্রেমের ব্যাপারে উৎসাহ দিচ্ছো, তাহলে তোমার মাথায় যেন আর কোনকালেও চুল না ওঠে সেই ব্যবস্থা করে ফেলবেন।” শ্রাবণ ভ্রুঁ কুঁচকে আমার দিকে তাকালো। আমি তার কুঁচকানো দৃষ্টি উপেক্ষা করে বললাম,

–“তোমার স্টাডিয়ামে কিছু এলো?”
–“মানে?”
–“মাথায় কোনো বুদ্ধি এসেছে?”
–” ওহ। না, এখনও আসেনি। তবে চিন্তা করোনা। কিছু একটা ব্যবস্থা ঠিকই করে ফেলবো।”

বসার ঘর থেকে বাবার হুংকার শোনা গেল। সম্ভবত কারো সাথে ফোনে কথা বলছেন, “একবার ঐ হারামজাদার দেখা পাই আমি। থাপড়িয়ে ওর গাল যদি লাল না করেছি, তবে আমার নামও আব্দুল খালিক না। কতবড় সাহস! আমাকে মেয়েকে নিয়ে রিক্সায় ঘুরে?” বাবার কথাবার্তা শুনে আমি নীলুর দিকে ঘুরে তাকালাম। কিন্তু ততক্ষণে সে আবারও বেহুশ হয়ে বিছানায় পড়ে আছে। রাত একটা। আমি ঘুমানোর চেষ্টা করছি। কিন্তু শ্রাবণের যন্ত্রণায় সেটা সম্ভব হচ্ছে না। একটু পর পর সে আমার কাঁধ ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে ডেকে তুলছে,,,

–“এই মিলি! ঘুমিয়ে পড়লে নাকি?”
–“হুঁ।”
–“বোনের এই দুর্দিনে তোমার ঘুম আসছে কী করে?”
–“জানি না।”
–“আমি একটা বুদ্ধি পেয়েছি বুঝলে।”
–“খুব ভালো।”
–“না শুনেই বলে দিলে খুব ভালো?”

আমি এবার উঠে দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে হেলান দিয়ে বসলাম। বালিশটা নিজের কোলে নিয়ে ডান গালে হাত রেখে হাই তুলতে তুলতে বললাম,

–“শোনাও” শ্রাবণ আগ্রহের সাথে বলতে শুরু করলো,

–“তোমার বাবাকে তো আমি চিনি। উনি কোনোদিনও শাহেদকে মেনে নেবেন না। তারচেয়ে বরং এক কাজ করি। সকাল হতেই আমি নীলুকে নিয়ে পালিয়ে যাব। তারপর শাহেদের সাথে যোগাযোগ করে ওদের বিয়ে দিয়ে দেব। আর একবার বিয়ে হয়ে গেলে তোমার বাবার না মেনে উপায় নেই। কি বলো?” আমি বিরক্তস্বরে বললাম,

–“তোমার মাথায় পালানো ছাড়া আর কিছু ঘুরে না?”
–“না ঘুরে না। এবার বলো, কাজটা কেমন হবে?”
–“তুমি তো অর্ধেক গল্প বললে। আমি এবার বাকিটা বলি শোনো।”
–“হ্যাঁ শুনছি।”
–“বাবা এমনিতেই তোমাকে পছন্দ করেন না।

আর যখন বুঝতে পারবেন তুমি নীলুকে পালাতে সাহায্য করেছ, তখন দেখা যাবে রাগের মাথায় নীলুর হবু বরের সাথে আমার বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। আমিও আমার বাবাকে চিনি। রাগ করে এমন কিছু করলে মোটেও অবাক হব না। এবার তুমি বলো, বউ বড় না শালী বড়?”

শ্রাবণ আমার দিকে উদ্ভট দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রইলো। আমার ঘরের পাশেই নীলুর ঘর। সেখান জনপ্রিয় একটা গানের তিনটি লাইন বারবার রিপিট হচ্ছে। “আমি জ্ঞান হারাবো।” “মরেই যাবো।” “বাচাতে পারবে না কেউ।” সকাল দশটা। চিন্তিত মুখে নাশতার টেবিলে বসে আছে শ্রাবণ। আম্মা ওর প্লেটে খাবার ঠেসে দেওয়ায় ব্যস্ত। কিন্তু শ্রাবণের খাওয়ায় মনোযোগ নেই। আমি আম্মার দিকে তাকিয়ে বললাম,

–“নীলু ওঠেনি?”

–“ওঠেছে বোধহয়। দরজা বন্ধ করে বসে আছে। ডাকলাম, কোনো সাড়া শব্দ নেই।” আমি আর কিছু না বলে চুপচাপ খেতে বসে পড়লাম। আম্মা অবাক হয়ে বললেন,

–“ছোট বোনটা রাত থেকে না খেয়ে আছে। আর বড় বোন হয়ে তোর গলা দিয়ে খাবার নামছে কী করে?” আমি টোস্টে কামড় দিয়ে বললাম,

–“গলধঃকরন প্রক্রিয়ায় নামছে।”

আম্মা বিরক্ত হয়ে রান্নাঘরের দিকে চলে গেলেন। একটু পর ফোলা ফোলা চোখ-মুখ নিয়ে নীলুর আগমন ঘটলো। সারারাত কাঁদতে কাঁদতে চোখের পানির স্টক শেষ হয়ে গিয়েছে মনে হচ্ছে। এসেই পরপর তিনগ্লাস পানি পান করল। আমি আরেক গ্লাস পানি ওর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললাম,

–“আজ কয়বার জ্ঞান হারানোর পরিকল্পনা হয়েছে?” নীলু যেন আমার কথা শুনতেই পায়নি এমন ভঙ্গিতে উঠে পড়ল। আমি ওকে থামিয়ে বললাম,
–“এখানে বস।” নীলু বসল।
–“শোন। এতকিছু না ভেবে আগে তোর এই বিয়েটা ভাঙার ব্যবস্থা করতে হবে, বুঝলি?” নীলু উদাস কন্ঠে অন্যমনস্ক হয়ে বলল,

–“কীভাবে ভাঙ্গবো? আমার মাথা কাজ করছে না।”
–“তোর মাথা লকডাউনে চলে গেলেও আমার মাথা আনলকই আছে।” নীলু যেন এবার আশার আলো ফিরে পেল। শ্রাবণও আমার দিকে পিটপিট করে তাকিয়ে আছে। আমি বললাম,
–“এই বিয়ে ভাঙতে পারেন একমাত্র সেলিম আংকেল, যিনি তোকে রিকশায় ঘুরতে দেখেছিলেন।”
–“কীভাবে?”একই সাথে শ্রাবণ আর নীলুর প্রশ্ন। আমি চেয়ারে হেলান দিয়ে বললাম,

–“বাবার এখন যা মানসিক অবস্থা, তাতে ঐ “হারামজাদা” ছাড়া পৃথিবীর যেকোনো ছেলের সাথে তোর বিয়ে দিতে রাজি আছেন। যাইহোক, সেলিম আংকেল অবশ্যই আজ তোর বিয়েতে আসবেন। এখন ধর, তিনি যদি তোর হবু বরকে দেখে আৎকে উঠে বলেন, এইতো সেই ছেলে! যাকে আমি নীলুর সাথে দেখেছি। ব্যস! বিয়ে ভাঙা ঊনষাট সেকেন্ডের কাজ মাত্র। যেহেতু সেলিম আংকেলকে বাবা অন্ধের মত বিশ্বাস করেন সেহেতু উনার কথাই সত্যি ধরে নেবেন। শুধু খারাপ লাগছে এটা ভেবে যে, শুধু শুধু একটা নিষ্পাপ ছেলের গাল লাল হবে!” বেশ কিছুক্ষন চুপচাপ থাকার পর শ্রাবণ বলল,

–“কিন্তু বেড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধবে কে? সেলিম আংকেলকে এ ব্যাপারে রাজি করাবে কে?” নীলুরও একই প্রশ্ন। আমি বললাম,

–“সেটা তো আমি জানি না। আমার কাজ ছিল ঘন্টা জোগাড় করা। করেছি। এবার তোমরা এটা বাঁধার ব্যবস্থা করবে। সেলিম আংকেল অবশ্য শ্রাবণকে খুব পছন্দ করেন।” চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে আমি রান্নাঘরের দিকে এগোলাম। বিয়ে বাড়ি উপলক্ষে আজ অনেক আইটেম রান্না হচ্ছে। আমার পছন্দের কালাভুনার অর্ডার দেওয়ার এখুনি সময়। যেতে যেতেই পেছন থেকে নীলুর কন্ঠ শুনতে পেলাম। দরদভরা কন্ঠে টিপিক্যাল স্টাইলে শ্রাবণকে ইমোশনাল ব্লাকমেইল করছে,

–“আজ আমার ভাইয়া বেঁচে থাকলে” বিকেল তিনটা। শ্রাবণ গিয়েছে সেলিম আংকেলের সাথে কথা বলতে। পরিকল্পনা অনুযায়ী সেলিম আংকেলকে মিথ্যা জবানবন্দি দেওয়ার জন্য যেভাবেই হোক সে রাজি করাবে। এবং আটটার আগেই উনাকে নিয়ে বাড়িতে ঢুকবে। নীলু শ্রাবণের ওপর বিশেষ ভরসা করতে পারছে না। অস্থিরভাবে পায়চারী করতে করতে সে জিজ্ঞেস করলো,

–“যদি সেলিম আংকেল রাজি না হন? তাহলে আমার কী হবে আপা?” বিয়ে উপলক্ষে আমি হাতে মেহেদী লাগাচ্ছিলাম। সেটা লাগাতে লাগাতেই বললাম,

–“কী আর হবে। “বিসমিল্লাহ” বলে বাবার পছন্দের পাত্রে গলায় ঝুলে পড়বি। প্রথম প্রথম কষ্ট হবে। বাট একসময় ঠিকই খাপ খাইয়ে নিবি।” নীলুর মুখ দেখে মনে হচ্ছে আবার বেহুশ হয়ে যাবে। আমি সাথে সাথেই বললাম,

–“শাহেদের খবর কী? মেসেজের কোনো রিপ্লাই দিয়েছে?” নীলু ডানে বায়ে মাথা নেড়ে হতাশ কন্ঠে বলল,

–“না। গতকাল ওর গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার কথা। সেখানে নেটওয়ার্কের প্রব্লেম আছে। তাই হয়তো মেসেজটা পায়নি।” আমি মেহেদী দেওয়া হাতের তালুতে ফু দিয়ে বললাম,
–“অসাধারণ!”

সন্ধ্যা ছয়টা। কিছুক্ষণের মধ্যেই পাত্রপক্ষ আর কাজী সাহেবরা চলে আসবেন। বাবা ভীষণ ব্যস্ত। অল্প সময়ের মধ্যে বেশ কয়েকজন আত্মীয়স্বজনকে দাওয়াত করে ফেলেছেন। এদিকে বাবার ওপর সাংঘাতিক ক্ষেপে আছেন আম্মা। ছোট মেয়ের বিয়ে হচ্ছে, কিন্তু বাবা একবার জিজ্ঞেস করারও প্রয়োজনবোধ করেন নি। একবার জানতেও চান নি উনার পাত্র পছন্দ হয়েছে কী-না। সেদিক থেকে আম্মার রাগ করাটা যুক্তিসঙ্গত। তারপরও বাবার ওপরের রাগ করে তিনি বসে নেই। উনার যা যা দায়িত্ব-কর্তব্য আছে সেসবই পালন করে যাচ্ছেন। কোথাও কোনো ত্রুটি রাখছেন না। রান্নাঘরে উঁকি দিয়ে আমি এবার বাবার কাছে এলাম। আমাকে দেখেই তিনি আত্মীয়স্বজনের লিস্ট হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন,

–“দেখতো মিলি, কেউ বাদ পড়লো কি-না।” আমি লিস্ট ভালোমতো দেখলাম। বাবাকে খুশি করার জন্য, বিয়ে নিয়ে খুব আগ্রহ প্রকাশ করে বললাম,

–“কাছেই তো ইমতিয়াজ চাচা থাকেন। উনাকেও ডেকে নিলে কেমন হয়?”
–“হুঁ ভালো বলেছিস। আচ্ছা, তোর মায়ের আদরের জামাইকে দেখছি না যে। কোন রাজকার্যে বেড়িয়েছেন শুনি।”
আমি হাসিমুখে বললাম,
–“নীলুর বিয়ের গিফট কিনতে গিয়েছে বাবা।”
–“এতসময় লাগে?”
–“গিফট পছন্দ হচ্ছে না মনে হয়। ওর আবার সহজে কিছু পছন্দ হয় না।”
–“ও আচ্ছা।”

সন্ধ্যা সাতটা। শ্রাবণ আর সেলিম আংকেল ছাড়া সবাই এসে পৌঁছেছেন। ঘরভর্তি মুরুব্বি আর বাচ্চাকাচ্চা। নীলুকে পার্লারের মেয়েরা সাজাচ্ছে। এই ফাকে লোকজনের ভীড় ঠেলে আমি ড্রয়িংরুমে এসে উঁকি দিলাম। বাবা, পাত্রের বাবা, পাত্র, মামা আর কাজী সাহেব সেখানে বসে আছেন। কিছুক্ষণের মধ্যে বিয়ে পড়ানো হয়ে যাবে। সেলিম আংকেল এসে যদি নাটকটা না করেন তাহলে নীলুর বিয়ে অবধারিত। আমি মনে মনে দোয়া-দরুদ পড়ে যাচ্ছি। হঠাৎ করেই আমার দোয়া কবুল করে সেলিম আংকেলের আগমন ঘটলো। মনে মনে আমি নাটক দেখার জন্য প্রস্তুত হয়ে গেলাম। সেলিম আংকেল পাত্রকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন। তারপর একসময় ভ্রুঁ কুঁচকে বলে উঠলেন,

–“এটা তো সে’ই ছেলে! যাকে আমি নীলুর সাথে দেখেছি।” সেলিম আংকেলে কথা শুনে বাবা চিন্তিত কন্ঠে বললেন,
–“তাই নাকি?”
–“হ্যাঁরে।” কাজী সাহেব বাবাকে জিজ্ঞেস করলেন,
–“জনাব, বিয়ে পড়ানো শুরু করে দেবো?”

বাবা আমাকে অবাক করে দিয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি দিয়ে দিলেন। আমার বুকের ভেতর ছ্যাৎ করে উঠলো। আশেপাশে আমি শ্রাবণকে খুজতে লাগলাম। কিন্তু পেলাম না। রাত আটটা। শেষপর্যন্ত নীলুর বিয়েটা হয়েই গেলো। আমি, শ্রাবণ আর সেলিম আংকেল এখন বাবার রুমে বসে আছি। কিছুক্ষণ আগে শ্রাবণ এসেছে। ও আসতেই আমাদের এই রুমে নিয়ে আসা হয়েছে। অনেকটা আসামীর মতো। অনেকক্ষণ এপ্রান্ত ওপ্রান্ত পায়চারি করতে করতে অবশেষে বাবা মুখ খুললেন। আমাদের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললেন,

–“তোমরা যে’ই গাছের ডালে ডালে ঘুরো, আমি সে’ই গাছের পাতায় পাতায় ঘুরি। আমি জানতাম তোমরা কিছু না কিছু একটা গন্ডগোল করবেই। তাই সবসময় তোমাদের দিকে নজর রেখেছিলাম। আজ সকালে খাবার টেবিলে যখন বেড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধার পরিকল্পনা করছিলে, তখনই সমস্তটা আমি শুনে ফেলেছিলাম।” বাবার কথা শুনে আমি ফোস করে নিঃশ্বাস ছাড়লাম। ইচ্ছে করছে নিজের কপাল নিজেই কামড়ে খাই। ফিসফিস করে শ্রাবণকে জিজ্ঞেস করলাম,

–“তোমার এত দেরি হলো কেন? কোথায় ছিলে।” শ্রাবণও ফিসফিস করে বলল,

–“আর বলোনা! সেলিম আংকেলের সাথে যোগাযোগ করার জন্য আমি অনেক চেষ্টা করেছি। প্রথমে গিয়ে উনাকে বাড়িতে পাইনি। উনার স্ত্রী বললেন শপিংয়ে গিয়েছেন। চলে আসবেন। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে শেষে উনাদের বাসার নিচে চলে গেলাম। তারপর পুরো বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত উনার বাড়ির সামনেই ঘুরঘুর করেছি। তারপরও উনার কোনো দেখা পেলাম না। যদি জানতাম উনি বাসায় না গিয়ে সরাসরি এখানে চলে আসবেন, তাহলে এই বাড়ির সামনেই উনাকে আটকে ফেলতাম।” আমি হতভম্ব হয়ে বললাম,

–“তারমানে তুমি আংকেলের সাথে কথা বলোনি?”
–“না, উনার দেখা পেলে তো কথা বলব?”

আমি তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে সেলিম আংকেলের দিকে তাকালাম। বাবার ওপর উনি যথেষ্ট বিরক্ত। ঘটনা কিছুই বুঝতে পারছেন না। নীলুকে ডেকে নিয়ে পাত্রের পাশে বসানো হলো। নীলু এখনও ছেলেটার দিকে তাকায়নি। মাথা নিচু করে বসে আছে। বাবা আবেগী কন্ঠে নীলুকে বললেন,

–“আমি যা করেছি ভালোর জন্যেই করেছি। তুই আমার ওপর আস্থা রাখতে পারিস। ঐ হারামজাদার কথা ভুলে যা। শাহেদ তোকে খুব সুখে রাখবে দেখিস।” বাবার শেষের কথায় এবার নীলুর টনক নড়ল। ঘোমটা সরিয়ে পাত্রের দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইলো। পাত্রের মুখটা হাসি হাসি। নীলুর কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে সে বলল,

–“সারপ্রাইজ! হুট করেই গতকাল এক ঘটক এসে মাকে তোমার ছবি দেখালো। বলল জরুরী ভিত্তিতে বিয়ে দিতে চায়। আমার বাড়িতে মায়ের কথাই শেষ কথা। তো উনার পছন্দ হলেও, “জরুরি ভিত্তি” শুনে একটু ঘাবড়ে গিয়েছিলেন। তবে আমি সেটা ম্যানেজ করে নিয়েছি। আর তোমার জন্য সারপ্রাইজ হিসেবে রেখে দিয়েছিলাম। কেমন লাগলো সারপ্রাইজ?”

নীলু সম্ভবত এত বড় সারপ্রাইজ হজম করতে পারল না। আনন্দের ধাক্কা সামলাতে না পেরে সে শেষবারের মতো জ্ঞান হারিয়ে শাহেদের কাঁধে পড়ে রইলো। আমি পেছন থেকে শ্রাবণের কাঁধে থুতনি রেখে অবাক বিস্ময়ে বললাম,
“বাবা যদি আমাদের প্লানটা না শুনতেন, তাহলে তো সেলিম আংকেলের কথাই বিশ্বাস করে ফেলতেন, তাই না শ্রাবণ?” শ্রাবণ হাসতে হাসতে বলল,

–হ্যাঁ। ভাগ্যিস তোমার বাবা বৃক্ষের পাতায় পাতায় ঘুরেন!

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত