শেষ কান্না

শেষ কান্না

“এই যে, শুনছেন? সকাল গড়িয়ে দুপুর হলেও সূর্যের আলো এখনও দেখা যায়নি।কুয়াশা ঘেরা এ মধ্য দুপুরে আমি বের হয়েছি আজ বাজারের ব্যাগ হাতে।অবশ্য এ সময় বাজারে আসার কোন ইচ্ছেই আমার ছিল না।তবুও আসতে হলো।এর অবশ্য বিশেষ একটা কারন ও আছে। অফিসে আজ কাজ নেই।অলস সময় পার করতেও আমার খুব একটা খারাপ লাগে না।আবার বসে থাকতেও ভাল্লাগে না।আমার এই ভাল লাগা খারাপ লাগার মাঝেই ফোনটা বেজে উঠলো।”কুহুর ফোন” আমি ফোনটা ধরে আস্তে করে বললাম,

-আজ অফিসে আসতে না আসতেই ফোন,ব্যাপার টা কি? আমার কথায় কুহু কপট রাগ দেখিয়ে বললো,
-কেন,এসময় ফোন দেওয়া মানা? কুহুর উল্টো প্রশ্নে আমি মুচকি হাসলাম।মেয়েটার এই অল্পতেই অভিমান আমার বেশ লাগে।এসময় মেয়েটার মুখে দুনিয়ার সব মায়া এসে ভর করে।তবে এখন এই মায়ামাখা মুখটা না দেখতে পেরে আমার বেশ আফসোস ই হচ্ছে।আমি চুপ থেকে বললাম,

-উহু,তুমি যে কোন সময় যেকোন ভাবেই ফোন দিতে পারো। আমার কথায় কুহু রাগ দেখিয়ে বলে,

-তোমার অনুমতি আমার প্রয়োজন নেই।তুমি না চাইলেও আমি তোমাকে ফোন দেবো।যেটা আমার,সেটা আমারই।
কুহুর কথায় আমি আবারও মুচকি হাসি।মেয়েটার এরকম জোর খাটানো আমার বেশ লাগে।সত্তি ই তো।যেটা আমার সেটা আমারই।আমার চুপ থাকা দেখে কুহু আস্তে করে বলে,

-বাসায় আজ তোমার শ্বশুর শ্বাশুড়ি আসবে।সাথে আরও দু একজন আসতেও পারে। কুহুর কথায় আমি হাসিমাখা মুখে বলি,
-বাহ ভাল তো।আসুক।সমস্যা কি? আমার কথায় কুহু মুচকি হেসে বলে,
-তো বাজারটা কে করবে সাহেব? কুহুর সব কিছু ভাল লাগলেও আমার এই কথাটা মোটেও ভাল লাগে না।এই বাজার করাটা আমার কাছে বেশ ঝামেলার।আমি একটু চুপ থেকে বলি,

-আজ বাজারটা একটু করে নিতে পারো না? কুহু আমার কথায় চুপ থেকে বলে,
-অবশ্যই পারি।তবে আজ আমি বাজার করলে যে বিরিয়ানি রান্না করতে চেয়েছিলাম সেটা হবে না। কুহুর কথায় আমি আর দেড়ি করি না।চেয়ার থেকে উঠতে উঠতে বলি,
-তুমি রেস্ট করো।আমি আসছি।দ্রুত।বাজার নিয়ে।

আমার কথায় কুহু হাসে।বেশ জোরেই হাসে।যাকে বলে খিলখিলিয়ে হাসি।এ মেয়েটা বেশ ভাল করেই জানে কোথায় নক করলে আমাকে কাবু করা যাবে।আর ঘুরেফিরে সে সেখানেই আঘাত করে।কুহু হাসতে হাসতে বলে, আসো।দ্রুতই আসো।

আজ দেখছি মাংসের বাজার বেশ চড়া।একদামে সব বিক্রি করছে।এরকম বাজার আমি মাঝে মাঝেই দেখি।বলতে গেলে যেদিন বিরিয়ানি রান্না হয় সেদিনই তাদের দাম বেড়ে যায়।লোকজন আজও বুঝে গেছে আজ বাসায় বিরিয়ানি হবে।তাই দাম যতই হোক মাংস উনি কিনবেন ই। আমি বাজার শেষে কুহুকে আবারও ফোন দেই।কিন্তু মেয়েটা ধরে না।কুহু।”তিতিশ্মা মুসাররাত কুহু” মেয়েটার সাথে যেদিন আমার বিয়ে হয় সেদিন সকালেও কুহু আমাকে বেশ কয়েকবার ফোন দিয়েছিল।আমি ধরিনি।সেদিন মেয়েটা ছোট্ট করে একটা মেসেজ ও দিয়েছিল।

“আমাকে কি আপনি পছন্দ করেই বিয়ে করছেন?নাকি অন্যকিছু? মেয়েটার মেসেজের রিপ্লে আমি সেদিন দেইনি।ইচ্ছে করেই দেইনি।তবে আজ কেমন যেন সেই মেসেজের রিপ্লে দিতে ইচ্ছে করছে।আমি আর দেড়ি করলাম না।মেসেজ লিখতেই কেও একজন পেছন থেকে ডেকে উঠলো, ” এই যে,শুনছেন?” এই বাজারের মধ্যে আমাকে সদ্য ডাকা মেয়েটাকে দেখে আমি কিছুটা অবাক হলাম।বোরখাতে পুরো শরীর মোড়ানো।চোখদুটো স্পষ্টই দেখা যায়।হয়তো মেয়েটা আমাকে চেনে নয়তো ভুলে ডেকেছে।মেয়েটা আমার দিকে বেশ কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে বললো,

-আপনি আহাদ না?

মেয়েটার কথায় আমার বলা উচিত ছিল, হ্যা আমিই আহাদ।কিন্তু বলতে পারলাম না।এ কন্ঠটা আমার বেশ পরিচিত।আমি আস্তে করে বললাম,

-মিহিন।

মেয়েটা আমার কথায় মাথা নাড়ালো।আমি বাজারের ব্যাগ হাতে আরও কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলাম মেয়েটার দিকে।মিহিনের দিকে। “হক গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রির মালিক আফজাল হকের একমাত্র মেয়েকে আজ দুদিন হলো পাওয়া যাচ্ছে না।হুট করে মেয়েটার এমন হাওয়া হয়ে যাওয়া আফজাল সাহেব খুব একটা সহজ ভাবে নিচ্ছেন না।আফজাল সাহেবের রাগ দেখে থানার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারাও বেশ ভয়ে আছেন।তারা বারবার বুঝিয়ে যাচ্ছেন,আমরা খুব দ্রুতই আপনার মেয়েকে খুজে বের করবো।আপনি এতটা অস্থির হবেন না। এ কথায় আফজাল সাহেবের চোখমুখ আরও লাল হয়ে যায়।রাগে শরীর কাপতে থাকে।বিভিন্ন জায়গায় এতক্ষনে লোক লাগিয়ে দিয়েছেন তিনি।তবুও আজ দু দিন হতে চললো মেয়ের কোন খবর নেই। আমার ঘুম ভাঙে আরও একটু দেড়িতে।ততক্ষনে মিহিন আমার মাথার পাশে এসে বসেছে।আমার চোখ খোলায় মেয়েটা আমার দিকে মিষ্টি হেসে বলে,

-গুড মর্নিং। মিহিনের কথায় আমি কিছু বলি না। চুপ করে থাকি।আমার এরকম চুপ থাকা দেখে মিহিন হাসে।হাসতে হাসতে বলে,

-ভয় নেই।আমি আছি তো। মিহিনের এমন কথায় আমি ভরষা পাই না।এতক্ষনে ওর বাবা আমাদের খোজার জন্যে লোক লাগিয়েছেন।শহরের এত নামী দামী লোকের মেয়ে যে পালিয়ে গেছে এটা আর কারও বোঝার বাকি নেই।নইলে দুইদিনে অন্তত আফজাল সাহেবের কাছে ফোন যেতো মুক্তিপন দেওয়ার জন্যে। মিহিনকে আমি প্রথম দেখি আফজাল সাহেবের সেই পাচতলা বাড়িতে।প্রতিদিন যখন মিহিনের ছোট ভাইকে পড়িয়ে বের হতাম মেয়েটা থাকতো পর্দার আড়ালে,নয়তো ড্রয়িং রুমে।মাঝে মাঝে আমার দিকে আড় চোখে তাকাতো।আমি বুঝতাম,কিছু বলতাম না।সবে মাত্র পড়াশোনাটা শেষ হলো।এখন জব না পাওয়া পর্যন্ত এই টিউশনিটা আমার কোন মতেই হারানো চলবে না।

বড়লোকের মেয়ে।এদের নামেই নাকি এদের সুন্দর লাগে।তবে মিহিনকে তেমন লাগতো না।মেয়েটা যার ই হতো যেখানেই থাকতো সেভাবেই সুন্দর লাগতো।তবে এ সুন্দরের মায়ায় আমার পড়া যাবে না, কোন ভাবেই না।
দিন বাড়তে থাকলো,মেয়েটার কাছে আসার সুযোগ আরও বেড়ে গেলো।ফেসবুকে মাঝে মাঝে কিছু পোষ্ট দেখা যায়।সুন্দরী মেয়েরা নাকি নেশাখোর বখাটেদের প্রেমে পড়ে।কিন্তু এ মেয়ে আমার প্রেমে কিভাবে পড়লো আমি বুঝলাম না। আমি ভাবি, বেশ গভীর ভাবেই।আমাকে কি কোনভাবে নেশাখোরদের মত দেখতে?এর উত্তর আমি পাই না।এরকম স্বাস্থবান ছেলেকে দেখে কেও বলবেও না এ ছেলে নেশা করে।আমি তবুও ভাবি।এ ভাবনা থেকে আর বের হতে পারি না।দুনিয়ার সব খারাপ শক্তি আমার উপরে ভর করে।যে ভর আমি সহ্য করতে পারিনা।ভুলের পথে পা বাড়াই। আমার চুপ থাকা দেখে মিহিন আবারও বলে,

-বাবা ফোন করেছিল।উনি আমাদের সম্পর্কটা মেনে নিয়েছেন।বাসায় যেতে বলেছেন। মিহিনের কথায় আমার কেমন যেন জ্বর চলে আসে।এ লোক এত সহজেই মেনে নেওয়ার পাত্র নন।তাছাড়া এরকম বেকার ছেলের সাথে তো নয় ই।আমি একটু চুপ থেকে বলি,

-তোমার ফোনটা না বন্ধ ছিল?
-সকালে চালু করেছি।

মিহিনের কথায় আমি আর কিছু বলি না।ঘুমে আমার চোখ আবারও বন্ধ হয়ে যায়।ঘুম দরকার।ঘুম। আফজাল হকের এরকম সহজভাবে সবকিছু মেনে নেওয়াটা কেমন যেন আমার খুব একটা ভাল লাগছে না।লোকটা এখনও বেশ সহজ ভাবেই সবকিছু বলে যাচ্ছে।মিহিন এতক্ষন আমার পাশে দাড়িয়ে থাকলেও এখন ঠিক ওর বাবার পাশে গিয়ে বসেছে।আমার কেমন যেন বসতে ইচ্ছে করছে না। আফজাল সাহেব বেশ সহজ ভাবেই বললেন,

-তোমরা কি সত্তি ই বিয়ে করেছো? আফজাল সাহেবের কথায় মিহিন মাথা নাড়িয়ে আবারও জানান দিল হ্যা,সত্তি ই বিয়ে করেছি। মেয়ের কথায় আফজাল সাহেব আর কিছু বললেন না। আমার দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বললেন,

-যেটা করেছো খুব একটা ভাল করোনি।এখন আমার মেয়েকে নিয়ে খাওয়াবে কি?ভেবেছো কিছু? আফজাল সাহেবের কথায় আমি কিছুটা চুপ থেকে বলি,
-ভাবিনি।তবে আপনার মেয়েকে ভাল রাখার দায়িত্বটা আমি ঠিকভাবেই নিতে পারবো।

আমার এমন কথায় আফজাল সাহেব আমাকে বেশ কিছুক্ষন বোঝালেন।তার মতে আমার জব না হওয়া পর্যন্ত মিহিন এখানেই থাকুক।আমি আসবো মাঝে মাঝে।জব পেলে মিহিনকে এখান থেকে নিয়ে যাব। আফজাল সাহেবের এরকম প্রস্থাব আমার খুব একটা খারাপ লাগলো না।তবে মিহিনকে রেখে যাওয়াটা আমার খুব একটা ভালও লাগলো না।আমি কিছুটা নরম হলেও মিহিন আমাকে যেতে দিতে নারাজ।সে আমার সাথেই যাবে।এখনি যাবে। আমি মিহিনদের বাসা থেকে বের হয়ে আবারও উপরের দিকে তাকালাম। বেলকুনিতে মেয়েটা চুপচাপ দাড়িয়ে আছে।হয়তো কাদছে।আমি এত দূর থেকে কিছু দেখি না,তবে বুঝতে পারি।কেমন যেন মনে হচ্ছে মিহিনকে একা রেখে যাওয়াটা আমার উচিত হচ্ছে না।ভুল করছি আমি, হ্যা ভুলের মধ্যেই হাটছি।

আমার জবটা হয়েছিল এরও দেড় বছর পর।ততক্ষনে আমি বেশ দূরে চলে এসেছি।সেদিনের পর আর মিহিনকে দেখতে পাইনি।বলতে গেলে আমাকে আর দেখা করতে দেওয়া হয়নি।মেয়েটাকেও হয়তো আটকে রেখেছিল নয়তো দেখিয়েছিল কোন ভয়।হুট করে একদিন ডিভোর্স পেপারটা আমার সামনে আসলেও সেদিন আমার কান্না পায়নি।আমি হেসেছিলাম।ভুলে ভরা হাসি।সেদিন তো মিহিন চেয়েছিল আমার সাথে আসতে,আমি আনিনি।আজ ও হয়তো মেয়েটা ডিভোর্স পেপারটা পাঠাতে চায়নি কিন্তু এসেছে।সেদিনের সহজ সরল আফজাল সাহেব তার নিজের চিরচেনা চরিত্রে বেশ ভালভাবেই আত্বপ্রকাশ করেছে।হয়তো লোকটা আজ হাসছে,অটঠাসি।ফেটে পড়ছে পুরো শহর।এ হাসির নিচে চাপা পড়ে যায় দুটো মানুষের কান্না,ভালবাসা,ভালথাকা। আমি মিহিনের দিকে আবারও তাকালাম।চোখদুটো একদম ভিজে উঠেছে।আমি কাপা গলায় বললাম,

-কেমন আছো?

মেয়েটা আমার কথায় কিছু বলে না।হয়তো বলতে পারলো না।শুনেছিলাম বেশ বড় ঘরে বিয়ে হয়েছে ওর।হয়তো ভাল আছে।মিহিন আরও কিছুক্ষন চুপ করে দাড়িয়ে রইলো।এক দৃষ্টিতেই তাকিয়ে।আমার দিকে।অবশ্য এসময় মিহিনের এইখানে থাকার কারনটা আমার জানা নেই।আমি জানতেও চাইনা।আমার এই না জানতে চাওয়ার মাঝেই মেয়েটা কান্না ভেজা চোখ লুকাতে বেশ ভালভাবেই ব্যর্থ হলো।মিহিন আর দাড়ালো না।উল্টো পথে হাটা দিল।হয়তো পাশেই গাড়িটা দাড় করানো। আমি আর কিছু ভাবতে পারলাম না।বাসায় যাওয়া দরকার। আমি একটু আগাতেই ফোনটা বেজে উঠলো।কুহুর ফোন।মেয়েটা আমাকে প্রচন্ড রকম ভাবে ভালবাসে।যেটা আমি আমাদের বিয়ের পর থেকে বেশ ভালভাবেই বুঝতে পারছি।আমি কুহুর ফোনটা ধরেই বললাম,

-বিয়ের দিন জানতে চেয়েছিলে না যে,তোমাকে আমি পছন্দ করেই বিয়ে করছি কি না? আমার কথায় কুহু আস্তে করে বললো,
-হু। আমি এবার আর চুপ থাকলাম না,দেড়িও করলাম না।আস্তে করে বললাম,
-কুহু,আমি তোমাকে পছন্দ করেই বিয়ে করেছি।আর এখন শুধু পছন্দই না,ভালও বেশে ফেলেছি।খুব গভীর ভাবে।হ্যা গভীর ভাবে।

আমার কথায় কুহু কিছু বলে না।চুপ করে থাকে। ওদিক থেকে কেমন যেন ভেসে আসে কান্নার আওয়াজ।কুহুর কান্না।মেয়েটা কাদছে।আমি কুহুর কান্না থামানোর কোন চেষ্টা করলাম না।কাদুক মেয়েটা।কাদুক।তার শেষ কান্না। এরপর আর কাদতে দেওয়া যাবে না।কোন ভাবেই না।কোন মতেই না।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত