খুব পছন্দ করি মেয়েটাকে কিন্তু পাত্তাই দেয় না। মেয়েটার নাম অবন্তী প্রথম দেখাতেই প্রেমে পড়ে যাই। ছয়টা মাস ধরে অবন্তীর পিছে পিছে ঘুরি। কিন্তু কিছুতেই অবন্তী ওর মনে আমাকে জায়গা দেয় না। যতবারই ওর কাছে গিয়ে দাঁড়াই আমাকে অপমান করে তাড়িয়ে দেয়। কিন্তু হাল ছেড়ে দেইনি। কারণ কবি বলেছেন; পারিব না এ কথাটি বলিও না আর এক বার না পারিলে দেখ শত বার। আজও অবন্তী কলেজ থেকে বের হতেই ওর পিছু নিয়েছি। একটা সময় ও দেখতে পায় যে আমি ওকে ফলো করছি।আর তখনই আমার কাছে এসে বলল;
— এই যে মিস্টার আপনি আবার আমার -পিছু নিয়েছেন, আমি তখন মুচকি একটা হাসি দিয়ে বললাম;
— হুম নিয়েছি।
— আচ্ছা আপনাকে না কতো করে বলেছি যে আমার পিছু নিবেন না। এমনকি অপমানও করেছি আচ্ছা আপনার ভেতরে লজ্জাসরম বলতে কিছু নেই। আমার তো মনে হয় নেই।
— হুম তোমার প্রেমে পড়ে আমি ব্যাহায়া হয়ে গিয়েছি। আর আমার কি দোষ বলো তোমার মায়ায় বন্দি হয়ে গিয়েছি। এখন তুমি যতক্ষণ না তোমার মনে জায়গা দিবে আমি তোমার পিছু ছাড়ছি না। অবন্তী তখন কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো।
— দেখুন আমি এইসব প্রেম ভালোবাসা পছন্দ করি না। বড়জোর বন্ধুত্ব করতে পারবো। যদি রাজি থাকেন তো বন্ধু হতে পারি আর না হলে এখান থেকে ফোটেন।
একটু ভেবে দেখলাম যে নাই মামার চাইতে তো কানা মামাই ভালো, তাই রাজি হয়ে গেলাম। একটা বছর ওর পিছু ঘোরার পর অবশেষে ওর বন্ধু হতে পারলাম। আর এটাই আমার জন্য অনেক। কারণ ভালোবাসার শুরু তো হয় বন্ধুত্ব থেকেই তাই না। শুরু হয় আমাদের বন্ধুত্ব, খুনসুটি ঝগড়া, রাগ অভিমান সব মিলিয়ে খুব সুন্দর একটা ফ্রেন্ডশীপ আমাদের মাঝে হয়ে যায়। অবন্তী যেখানেই যেত আমি ওর পিছু ছাড়তাম না। আঠার মতো লেগে থাকতাম ওর সাথে। অনেকেই আমাদের কে দেখে প্রেমিক প্রেমিকা ভাবতো। আস্তে আস্তে নীরা আমার প্রতি দুর্বল হতে শুরু করে। আর একটা সময় আমাদের বন্ধুত্ব ভালবাসায় পরিণত হয়।
উচ্চ মাধ্যমিক সম্পূর্ণ করলাম, খুব ভালবাসতাম অবন্তীকে। খুব বেশি ভালবাসতো ও আমাকে। উচ্চ মাধ্যমিক সম্পূর্ণ করার পরে একটা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে এডমিশন নেই দুজনে। এডমিশনের কিছু দিন পর জানতে পারি যে, অবন্তী পুরো পরিবারসহ চলে যাচ্ছে ঢাকার বাইরে চিটাগাং।অবন্তী আমাকে কিছু জানাতে পারেনি। দুই দিন পর ফোন দিয়ে আমাকে বলল; আগামী সাপ্তাহে নাকি ওদের ফ্যালাইট, পুরো পরিবার চলে যাচ্ছে দেশের বাইরে। আবাক হয়ে রইলাম ওর কথাটা শুনে। আমি তখন বললাম;
— পুরো পরিবার চলে যাচ্ছো, এইটাতো একদিনের কিছু না। সময় লাগে প্রসেস করতে কিন্তু তুমি তো আগে থেকে জানতে রাইট। চুপ থেকে বলল যে হ্যাঁ।
— বলনি কেন।
— পরিবারের বারণ ছিল।
— আমি তো তোমার শত্রু না, বা আমি তো এমন কিছু করতাম না। যাতে তোমাদের যাওয়া না হয় বা কোন বিপদের সম্মুখীন হও।
— আমি জানি না, বাবা মা নিষেধ করেছিল। কি করব ঝগড়া করলে তো ও আর চলে আসবে না। কিন্তু কষ্টে বুকটা ফেটে যায়। প্রশ্ন করলাম;
— আচ্ছা কবে আসবা। ও তখন বলল;
— এই ম্যাক্স তিন বছর চলে আসব, আমরা তো ব্যাক করছি। মন খারাপ করো না প্লিজ।
হাসি দিয়ে চিন্তা করলাম; আরে এই পাগলীকে পটাতে তো আমার এমনিতেই এক বছর চলে গিয়েছে। সারাজীবন পাওয়ার জন্য তিনটা বছর অপেক্ষা করতে পারব না। নাহ আমি পারবো।
প্রথম দুই মাস বার বার অবন্তী আমাকে ফোন দিত। একা ফিল করছে ও ওখানে পরিচিত কেউ নেই। এমন করে ছয় মাস কেটে গেল। ও ওইখানকার একটা স্থানীয় ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হলো। কিছু দিন পরে না কি কোন একটা রেস্টুরেন্টে পার্ট টাইম কাজও পেয়েছে। ইউনিভার্সিটি শেষ করে কাজ করে আমাকে সময় দিতে পারত না। অদ্ভুত সময় ছিল, অপেক্ষা করতম। একবার না দুইবার না বার বার টেক্সট করতাম। ফ্রি, এখন ফ্রি আছো একটু কথা বলা যাবে। কিন্তু কোন রিপলাই পেতাম না। এক বছর কেটে যায়, দের বছরে দুই দিন তিন দিন পরে হয়তো দু চার মিনিটের জন্য কথা বলতে পারতাম। ওর সাথে কথা বলার সময় আমি রেকর্ড করে রাখতাম। ফোনটা রাখার পড়ে বার বার শুনতাম। পুরোনো সেই ছবিগুলো বার বার দেখতাম। ছবিগুলোর সাথে কথা বলতাম। অপেক্ষার দিন গুনতাম।
দুই বছরের মাথায় গিয়ে ওর মাঝে এক ধরনের অদ্ভুত পরিবর্তন আমি পাই। ঠিক ভাবে আমার সাথে কথা বলে না। আগে যেমন দুই তিন দিন পরে হলেও দু এক বার কথা বলত। এখন তাও বলে না, ওর জামাকাপড়ের মাঝে কিছু পরিবর্তন চলে আসে। নিজেকে মানাতাম, একটা ওয়েস্টার্ন কান্ট্রিতে থাকে। পরিবর্তন হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছুই না। এগুলো নিয়ে যখনি কথা বলতে যেতাম। বার বার আমাকে শুনতে হতো আমি না কি আনকালচার, আমি না কি খ্যাত, আমি না কি সমাজ বুঝি না। খুব কষ্ট পেতাম ওর ওইসব কথাগুলো শুনে। বলতে পারতাম না। বার বার বলতে ইচ্ছে করত কতো অচেনা আজ তুমি। চিত্কার করে বলতে ইচ্ছে করত আমার সেই তুমি কে একটু ফিরিয়ে দিবে প্লিজ। আবার নিজের মনকে বোঝাতাম, আর কিছু দিন পর তো ফিরেই আসবে। তখন বাঙালি মেয়ে না হয় বাঙালিই থাকবে। তিন বছর কেটে যায়, সারে তিন বছর কেটে যায়, চার বছর কেটে গেল। কবে আসবা এই প্রশ্নটা যদি করতাম। বিরক্তি ভাব নিয়ে বার বার বলতো;
— একি ঘ্যানর ঘ্যানর বার বার ভালো লাগে না। থাকলে থাকো না থাকলে চলে যাও, আমি জানি না কবে আসব।
ওইখানে না কি ওর কিছু ভালো ছেলে বন্ধু আছে। খুব কষ্ট হতো ছেলেগুলোর সাথে যখন ওর খুব ক্লোজ পিক দেখতাম। তার পরেও মুখ বুজে সহ্য করতাম। একদিন ও যেই দেশে থাকত, ওই দেশ থেকে একটা ফোন আসে। ওই দেশের একটা কোড। খুব বেশি এক্সসাইটেড হয়ে যাই আমি, মনে হয় অবন্তী ফোন দিয়েছে। ফোনটা রিসিভ করি, ওপাশ থেকে একটা মেয়ের কন্ঠ।
— হ্যালো আপনি কি অয়ন ভাইয়া বলছেন।
— জি আমি অয়ন, কিন্তু আপনি কে?
— ভাইয়া আমি অবন্তীর খুব কাছের একজন বান্ধবী। আপনাকে কিছু কথা বলার জন্য ফোন দিয়েছি। ভাইয়া প্লিজ ওকে কিছু বলবেন না। আমি তখন বললাম;
— হ্যাঁ আপু বলো কি বলতে চাও।
— ভাইয়া আপনি যার আশায় আছেন, ও আসলে এইখানে কারো একজনের সাথে আছে।
— আরে পাগলী কি বল এই গুলা।
— জি ভাইয়া, আপনি এক মিথ্যা আশায় অপেক্ষা করছেন।
প্রতিটা মূহুর্তে আমার খারাপ লাগত যে আপনার মত একজন মানুষ ওইখানে মিথ্যা এক আশা নিয়ে আছে। অনেক বার আমি ওকে বুঝিয়ে ছিলাম, তখন ও আমাকে বলে; ও নাকি ওই দেশে গিয়ে ওই কালচারে না কি আর থাকতে পারবে না। ওর সাথে কিছু হবে না। আপনার কথা অনেক বুঝিয়েছি ভাইয়া।
চোখ দিয়ে পানি টলমল করছিল মেয়েটার কথাগুলো শুনে। একটা বারও আমি অবাক হইনি, কারণ সত্যি কারের ভালবেসেছি তো মনের সাথে মনের একটা কানেকশন ছিল। বুঝতাম ও আর আমার নেই। বার বার আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতাম এই খবরটা যেন আমায় কোন দিন পেতে না হয়। কিন্তু বিধাতার নিষ্ঠুর নিয়মে পেয়ে গেলাম আজ।
ভালবাসার মানুষ, অন্যের মুখ দিয়ে তো শোনা যায় না। ফোন করলাম ওর নাম্বারে, কেটে দিল। টেক্সট করলাম, পাঁচ মিনিট সময় দাও। আর কোন দিন ফোন দিব না, পাচ সেকেন্ডের জন্য ফোন দাও। কিছুক্ষণ পরে ও ফোন ব্যাক করল। কথাগুলো শেয়ার করা সাথে সাথেই কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল;
— জেনেই যখন গিয়েছ, আসলে আমি বলতে পারিনি। শুরু করতে চেয়েছিলে ওইখানে ওর নতুন ভালবাসার গল্প। থামিয়ে দিয়ে একটা কথাই বললাম;
— রাতে তুমি না ঘুমালে, খুব সহজেই তোমার ওই চোখের নিচে কালো দাগ পড়ে যায়। রাতে একটু ঘুমিয়ে নিও মেয়ে, ভালবেসে আবার রাত জেগ না। সারা জীবনের জন্য ভালো থেকো। তোমার সাথে এইটা আমার শেষ কথা। তার পর রেখে দিলাম ফোন।
আজ দীর্ঘ তিন বছর অবন্তীর সাথে আমার কোন যোগাযোগ নেই। কোন পরিচয় নেই। আজও ভালবাসি আমার সেই আগের ওকে। কিছু দিন আগে জানতে পারি ও নাকি বাংলাদেশে। আমাকে না কি খুঁজছে। একটা সিম ছিল, যেই সিমের নাম্বারটা ও জানতো। মানিব্যাগে রাখতাম, যখন জানতে পারলাম ও আমাকে খুঁজছে। একটা হাসি দিয়ে, মানিব্যাগ থেকে সিমটা বের করলাম। ওর নামটা মুখে নিয়ে সিমটা ভেঙে ফেললাম। রাস্তার ধারে ভাঙা সিমটা ফেলে দিয়ে বললাম; তিন বছর আগে আমাকে মেরে ফেলেছ তুমি। গলাটিপে হত্যা করেছ আমার ভালোবাসা,,,,