সকালে ঘুম থেকে উঠেই ফেসবুকের পাতায় স্ক্রল করা একটা অভ্যাস হয়ে গিয়েছে। আজ ফেসবুক খুলতেই চক্ষু চড়ক গাছ। আমার সবচেয়ে ফেসবুক একটিভ বন্ধু তাসনুভার স্ট্যাটাস।
‘আল্লাহ গো করোনা নামে কি আজাব আপনি দিলেন? সবাই নিজে নিজে যার যার ঘরে ঢুকে যাইতেসে। খুবই ভালো কথা। কিন্তু ঘরের ভেতরের আজাব যে ক্রমবর্ধমান হারে আকাশ ছুঁইতেসে তাতে করোনাতে মৃত্যু না হলেও এই বাসায় থাকার সাইড এফেক্টেই না মৃত্যু তরান্বিত হইয়া যায়, তাহা লইয়া ব্যাপক চিন্তায় আছি।’
আমার হোস্টেলের রুমমেট কাম বান্ধবীর নাম তাসনুভা। আমরা আদর করে ওকে তাসনু ডাকি। সেই স্কুল থেকে বন্ধু আমরা। একটু আহ্লাদী ধরনের চরিত্র বলে অনেকেই তাকে এড়িয়ে চলে। তবে লোক খারাপ না। যদিও আহ্লাদ মাঝে মাঝে মাত্রাতিরিক্ত হয়ে গেলে একটু বিরক্তই লাগে। আমার অবশ্য ওকে একটু বোকা ধরনেরও মনে হয়। আর তাই লোকে ওর আহ্লাদেপনা নিয়ে হাসাহাসি করে বলার পরেও ওর তেমন একটা বদল হয়না।
দুবছর প্রেম শেষে বিয়ে করলো আমাদেরই ডিপার্টমেন্টের সিনিয়র ভাই রিয়াদকে। ওদের প্রেমের সময়টা রীতিমত হিংসে করার মতোই ছিল। রিয়াদ ভাই ওর এতোই কেয়ার করতো যে কোন বিশেষ দিন, কোন ইভেন্ট তাসনু খালি হাতে হোস্টেলে আসতোনা। বিয়ের পরও এ ধারা অব্যাহত থাকে। বলা চলে, জানিস রিয়াদ আমায় আজ অমুক ডে দেখে এই শাড়ি দিয়েছে, তমুক ডে দেখে এই গলার হার দিয়েছে; এসব আমাদের মুখের কথা হয়ে গিয়েছিল। কখনো দেখা যেতো ও বলার আগেই আমরা বলে দিয়েছি, নিশ্চিত এটা ঐ দিবসের উপহার? তখনো ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়া নিয়ে ছবি দেয়া নিয়ে তাসনুভার এতো হুজুগ হয়নি বলে রক্ষা।
বয়সের সাথে সাথে হয়তো ঘন ঘন উপহার দেয়ার ধরনও পাল্টেছে। তবু বিশেষ দিনে তাসনুভার একটা উপহার পোস্ট আর সপ্তাহের অন্যান্য দিন আজ কোথায় খেলো, কাল কোথায় গেলো এসব তো থাকেই। সাথে থাকে ওর আর রিয়াদ ভাইয়ের সেরকম ভালবাসাবাসির ছবি। করোনার কারণে ঘরে আটকে থাকলে নিশ্চিত ওদের পোস্টে পোস্টে সয়লাব হয়ে যাবে ফেসবুক। অন্যসময় রিয়াদ ভাই বাসায় থাকেনা বা সময় কম দেয় বলে তাসনুভা প্রায়শই স্ট্যাটাসে লিখে। এখন নিশ্চয়ই দুঃশ্চিন্তার পাশাপাশি সেরকম সুখের দিন কাটবে। অথচ তা না হয়ে এরকম স্ট্যাটাস! একটু ফ্রেশ হয়ে তাসনুভাকে মেসেজ পাঠাই।
– কি রে এমন কঠিন স্ট্যাটাস? তোর তো ভালবাসাবাসির ছবি দেখবো ভাবসিলাম। তোর কি মাথা খারাপ হইসে অরু? ঘরের মধ্যে এতো বছরের পুরান জামাই নিয়া থাকা আর পাগলা গারদে থাকার মধ্যে কোন তফাত নাই।
– কেন বলতো?
আরে ধুর আগে দিনে ঘন্টা কয়েকের দেখা হতো। সারাদিনের এটা ওটা কথা হয়ে দিন ফুরাতো। সপ্তাহান্তে হ্যাং আউটে একে ওকে দেখে মন রিফ্রেশ হয়ে যেতো। আর এখন সকালে ওঠা থেকে রাতে চোখে ঘুম নামা না পর্যন্ত একে দেখা। সাথে এই আজ এটা রাঁধো, ওটা রাঁধো সেসব তো আছেই। সারাদিন টিভি অন। করোনার আপডেট বোধহয় আমারই সব মুখস্ত গ্রাফসহ। কারো সাথে কথা বলতে নিলে, এতো কার সাথে কথা বলো? ফেসবুকে কিছু লিখতে গেলে, সারাদিন কেন ফেসবুকে পড়ে থাকতে হবে, একটু শুয়ে থাকলে, সারাদিন শুয়ে বসে থাকলে তো মোটা হয়ে যাবে ইত্যাদি ইত্যাদি। সারাদিন শাসন ডাক দোহাই শুনতে শুনতে মাথা নষ্ট যাকে বলে। তার ওপর বুয়া নেই। সব কাজ সামলে এসব শুনলে মেজাজ ঠিক থাকে কারো? কাল না পেরে আর দিসি একটা চিৎকার। অবাক হয়ে বলে তুমি আমার সাথে এভাবে কথা বলতে পারলা?
– ভাইয়া এই স্ট্যাটাস দেখলে কিছু বলবেনা? ব্লক দিয়ে রাখসি। বাদ দে তোর ঘরের কি অবস্থা?
– ঐ যে বললি, ঘরে একসাথে আটকে থাকার সাইড এফেক্টেই যদি মরে যাই অবাক হওয়ার কিছু নেই। হা হা হা।
হা হা হা। মেসেঞ্জারে কথা চালাচালি করায় ব্যস্ত থাকা দুই বান্ধবীর জানা হয়না তাদের স্বামীরাও তখন বন্ধুদের সাথে মেসেঞ্জারে কথা বলায় ব্যস্ত। কথার সারমর্ম অনেকটাই এরকম, ‘দোস্ত, বউয়ের লগে সারাদিন এক লগে থাকা যে এতো পেইন এইটা জানলে পকেটের টাকা গচ্চা দিয়া আলাদা হোম কোয়ারেন্টাইনে ভাড়া থাকতাম। শুইলে দোষ, বইলে দোষ, ডাইনে দোষ, বায়ে দোষ। ইয়া আল্লাহ ঘরে থাকার সাইড ইফেক্টেই না জীবনটা শেষ হইয়া যায়।’